পার্বতীর পারে ৪ (শেষ)




 ঘুম ভেঙে বৃষ্টির শব্দ পেলাম। মরণপণ করে নামেনি আবার দায়ও সারছে না। অর্থাৎ টানবে।

মেঘ ডাকছিল ঘন ঘন। হালকা চিন্তা হচ্ছিল। যে রকম চিন্তায় ঘাম হয় না কিন্তু স্নায়ুগুলো মাপমতো টানটান হয়ে থাকে। চিন্তাটা হচ্ছে আজ দুপুরে পার্বতী কুটির ছেড়ে লিটল ইটালি ইন-এ মুভ করতে হবে। কাল বাজারে লিটল ইটালি ইন দেখেছি। পার্বতী কুটির যেমন বনচ্ছায়ায় লিটল ইটালি ইন তেমন ঘিঞ্জি বাজারের মধ্যিখানে। অটোতে বসে বাইরের ছবি দেখে আমার পছন্দ হয়নি। ঘরের ছবিগুলো ভালো ছিল বলে বুক করেছিলাম। আর কোথাও রুম পাওয়াও যাচ্ছিল না। কাল বাজারে ঘুরতে ঘুরতে বাইরেটা দেখেও অবশ্য ভালোই লাগল। অর্চিষ্মান তো হাটের মধ্যে থাকতেই ভালোবাসে। মাঝরাত পর্যন্ত হর্নের চোটে ভুত পালাবে, বারান্দায় ঝুঁকলেই কোটি কোটি লোক দেখা যাবে আর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলেই তেলেভাজার দোকান - এই হচ্ছে ওর আইডিয়াল হ্যাবিটাট।

আমার পছন্দ এ রকম। এই যে জঙ্গলের মধ্যে শুয়ে শুয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনছি, বৃষ্টি থামলে নদীর শব্দ শুনব, গাছের ছায়ায় ছোট্ট দোলনায় দুলব, দুলতে দুলতে ডানদিকে ঘাড় ঘোরালে অভ্রংলিহ পর্বতচূড়া, বাঁদিকে ঘাড় ঘোরালে একতলা ছোট্ট বাড়ি, সামনে নদী, পেছনে জঙ্গল, পুব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ ঊর্ধ্ব অধঃ কোথাও মানুষ নেই। সভ্যতার সাড়া বলতে আধুনিক প্লাম্বিং আর হাই স্পিড ওয়াইফাই।

জীবনভাইয়া চা দিয়ে গেলেন। বৃষ্টি ধরেনি তবে আকাশ পরিষ্কারের দিকে যাচ্ছে। ছাউনি দেওয়া বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বৃষ্টিতে চারদিকের সবুজ হাই রেজলিউশন হয়ে গেছে। আমাদের তাঁবু আর পার্বতী কুটিরের বেড়ার মাঝখানের জমিতে জকি ব্র্যান্ডের জাঙিয়া পড়ে পড়ে ভিজছে। সুযোগ ফোন করলেন। গলা এখনও পরিশীলিত তবে এখন তার সঙ্গে একটা চোরা ছুরির ধার। আপনাদের এগারোটার সময় চেক আউট করতে হবে।

আচ্ছা বলে ফোন কেটে দিলাম। লেপের তলা থেকে অর্চিষ্মান বলল কাল একটায় চেক ইন করলাম আজ এগারোটায় চেক আউট কেন করব? আমি বললাম সেই তো। কী বলব বল দেখি। অর্চিষ্মান বলল কী আবার বলবে। বল যে আমরা একটায় বেরোব।

ফোন করলাম। সুযোগ বললেন একটায় চেক ইন এগারোটায় চেক আউট এটাই নাকি কম্পানি পলিসি। উনি সহৃদয় হয়ে বারোটা পর্যন্ত অ্যালাউ করতে পারেন তারপর আর না।

ফোন রেখে লেপের ঢিপি ঝাঁকানি দিয়ে বললাম শুনলে তো কী বলল। অর্চিষ্মান বলল লিটল ইটালি পর্যন্ত যাওয়ার গাড়ি বলে দিতে বল। আর বল বেরোনোর সময় ছাতা দিতে। বললাম। সাড়ে এগারোটায় রেডি হয়ে বারান্দায় বসে রইলাম। সুযোগ ফাইন্যাল বিল নিয়ে এলেন। গলার ছুরির ধার অদৃশ্য। বিলের সমাধা করতে করতে মিষ্টি গলায় অর্চিষ্মানকে জিজ্ঞাসা করলেন আপ কেয়া করতে হো সার? অর্চিষ্মান বলল। সুযোগ ইমপ্রেসড মুখ করে চুপ করে রইলেন। অর্চিষ্মান চুপ করে রইল। আমিও চুপ করে রইলাম।

শিক ভাঙা ছাতার তলায় এক এক করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে অপেক্ষারত গাড়িতে এসে বসলাম। ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে শহরের দিকে চললেন। রিভারসাইড ক্যাফে পেরিয়ে এলাম। আজ এখানে আসার প্ল্যান ছিল। হবে বলে মনে হয় না।

লিটল ইটালির ঘর বাথরুম ভালো। ব্যাগ রেখে রেস্টোর‍্যান্টের জানালার ধারে এসে বসলাম। এখানে ঠাণ্ডা বেশি কিন্তু ভিউ দিয়ে অফসেট হয়ে যাবে। ল্যাপটপটা খুললাম যাতে সান্ত্বনা পাই যে আমি একজন প্রোডাকটিভ মেম্বার অফ মানবসমাজ। খুলে ডানদিকে তাকিয়ে থাকলাম যেখানে রাস্তার ওপারের পার্পল হোটেলের তিনকোণা ছাদের আকাশি কার্নিশ বেয়ে জলের ফোঁটারা লাইন করে চলেছে।

বৃষ্টি ধরল। বেরিয়ে পড়লাম। চালাল বলে একটা ট্রেল আছে সেটা ধরে হাঁটব। তার আগে শম্ভু মোমো, যেটা নাকি না খেলে কসোল যাওয়া বৃথা, খাব। শম্ভু মোমো শম্ভু মোমো বলে তীরচিহ্নে গোটা শহর ছাওয়া। গেলাম। হাফ প্লেট ভেজ হাফ প্লেট চিকেন অর্ডার দিলাম। ভালো। কিন্তু অত তীরচিহ্নের অধিকারী না। আমাদের করুণাদির মোমো এর কাছাকাছিই।

কসোলের মেন মোড় থেকে পর্বতচূড়ার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে বাঁদিকে লিকপিকে চালাল ট্রেলের এন্ট্রি পয়েন্ট। এদিক থেকে লোক যাচ্ছে ওদিক থেকে লোক আসছে। গাড়িও আসছে। চারচাকার ছোট মডেল, ট্রেলের শুরুর দিকটায় যাতায়াত করে। বৃষ্টিতে ট্রেল জলেকাদায় ভরে গেছে তার মধ্যে ঘন ঘন সাইড দিতে হচ্ছে। এটা দিল্লি হলে আমার রিঅ্যাকশন কী হত আমি জানি। অথচ কসোলের ট্রেলে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে, ঝোপঝাড় ধরে ঝুলে, দুটো পাথরের মাঝখানে ল্যামডা আকৃতি ধারণ করে গাড়িদের সাইড দিচ্ছিলাম। কারণ আমার মুড ভালো ছিল। ভরপেট মোমো খেয়ে হাঁটছি, ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে লাগছে, চারপাশে তাকালে এইসব দৃশ্য দেখছি, মুড ভালো না থাকার কোনও কারণ নেই।


এঁকেবেঁকে চললাম। চালাল ট্রেল বেসিক্যালি মেন রোডের প্যারালাল। পার্বতীর ওপারে মেন  রোড এ পারে আমরা। যেতে যেতে ওপারে রিভারসাইড ক্যাফে দেখলাম, নদীর ধারে চোখা মাথার তাঁবুর কেবিনের সারি দেখলাম, দূরে পার্বতী কুটিরও দেখতে পেলাম বলে মনে হল।

দু'কিলোমিটারের ছোট্ট ট্রেল। কসোল টু ফ্রিডম ক্যাফে। ফ্রিডম ক্যাফের নাম সু-ও লিখেছিল। গোটা রাস্তা জুড়ে পাথরের গায়ে সাদা রঙে লেখা ফ্রিডম ক্যাফে, নিচে তীরচিহ্ন। ট্রেনের শেষমুখে গ্রাম দেখা গেল। মুখব্যাদান করলাম। গাছপালা নদীনালার পাহাড়পর্বতের মধ্য দিয়ে হাঁটতে বল হেঁটে দেব কিন্তু কার বাড়ির বারান্দা দিয়ে, কার রান্নাঘরের পেছন দিয়ে, কার বাথরুমের সামনে দিয়ে হাঁটাহুঁটি আমার পোষায় না। চলো তো বলে অর্চিষ্মান আমাকে টানতে টানতে গ্রামের ভেতর ঢুকে গেল।

ফ্রিডম ক্যাফের লাগোয়ে একটা মনাস্টেরি মতো। থাকার জায়গাও আছে। বিস্তীর্ণ চাতাল। দুটো সিঁড়ি উঠে একটা দোতলা চাতাল। চেয়ারটেবিল আর স্ট্যান্ড থেকে অশ্রুবিন্দু আকৃতির ঝুড়িদোলনা পাতা। কাজ থাকলে অ্যামাজনে ঢুকে এ রকমের দোলনা ব্রাউজ করি। রেলিং-এর ধারের দোলনাগুলোর গদি বৃষ্টিতে চুপচুপে। অপেক্ষাকৃত শুকনো দেখে একটায় বসলাম। কয়েকটা দল ইতিউতি টেবিলে বসে ছিল। আমরা থাকতে থাকতেই আরও দলেরা এল। যা বুঝলাম হেঁটে এসে এখানে সবাই লাঞ্চ করে। আমরা করব না। আমরা ফিরে গিয়ে এভারগ্রিন ক্যাফেতে ইজরায়েলি খাবার খাব। কসোল এবং কসোলের আশপাশে বড়সড় ইজরায়েলি বসতি আছে। ফলতঃ এখানকার সব হোটেল রেস্টোর‍্যান্ট ক্যাফের মেনুতেই ইজরায়েলি খাবারের সেকশন থাকে। ফ্রি-তে দোলনা চড়ে চলে আসা ভালো দেখায় না বলে ফ্রেশ লাইম সোডা অর্ডার দিলাম।

ফেরার পথে আকাশ ঝলমলিয়ে উঠল। পাহাড়ি ওয়েদার আমার মেজাজের মতো। সকালে মনে হবে আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না কোনওদিন, দুপুরে মনখারাপ বানান জিজ্ঞাসা করলে বিপদে পড়ে যাবে। এভারগ্রিন ক্যাফেতে আজও ভিড়। কী ভাগ্যিস কমিউনাল টেবিলের একদিক ফাঁকা ছিল। এভারগ্রিনেও দেখলাম, সানশাইনেও দেখেছি, দল বেঁধেই আসে লোকে বেশি আবার আমাদের মতো শুধু কাপলও আসে। হোল ফ্যামিলিও আসে। আবার একেবারে একলা লোকও আসে। সে রকম একজন আমাদের উল্টোদিকে বসেছিলেন। রেস্টিং দুঃখী ফেস। আমরা আবার ব্রাউনির খোঁজ করলাম, আবারও জানানো হল নট অ্যাভেলেবল। অথচ ইন্টারনেটে সর্বত্র এভারগ্রিন ব্রাউনির কথা ফলাও করে লিখে রেখেছে। সু-ও লিখেছে। আমার ধারণা ওঁদের বিজনেস মডেল সানশাইন ক্যাফের থেকে আলাদা। সানশাইনে যেমন যে কেউ ঢুকে যা খুশি চাইলেই দিয়ে দেওয়া হবে এখানে আগে বিশ্বাস অর্জনের প্রয়োজন। এই ট্রিপে তিনবার (আগামীকাল শেষবারের মতো আরেকবার যাব) এভারগ্রিনে ঢুকেছি, বসেছি দু’বার, প্রতিবারেই উষ্ণতার মাত্রা স্টেডিলি বৃদ্ধি পেয়েছে। আর বারতিনেক গেলেই ব্রাউনি কোড ক্র্যাক করে ফেলা যেত। গতকাল যিনি ব্রেক চলছে পরে আসুন বলে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন তিনিই এলেন দেখভাল করতে। দেখামাত্র মুখে পরিচিতির আশ্বাস ফুটল। আমি খুশি হলাম। তবু তো কেউ মনে রাখার মতো স্পেশাল ভেবেছে। খুশি প্রকাশ করলাম না কারণ করলেই অর্চিষ্মান চোখ ঘোরাবে। ওদের দোকানে দিনে ক’গণ্ডা করে লোক আসে বলত? ওরা সবাইকে দেখেই ও রকম চেনার ভঙ্গি করে।

এ হচ্ছে জীবনের পয়েন্ট অফ ভিউ। এ ভিউ ভাগ করা যায় না। এ ভিউ ভাগ করার দরকারও নেই। অর্চিষ্মান কী খেল ভুলে গেছি। আমি ইজরায়েলি ডিপ অর্ডার করলাম। মুখে দেওয়ার আগে চোখে দেখেই মন ভালো হয়ে গেল। প্রাচীন মিশরীয় দেবতাদের টানা টানা চোখের মতো প্লেট, অর্চিষ্মানের এক হাতের সমান লম্বা প্লেটে তিনটে ডিপের বাটি। একটায় হামাস, একটায় বাবাগনুশ, একটায় লাবনেহ্‌। বাটির ফাঁকে ফাঁকে নৌকো জুড়ে ডিপের আধার হিসেবে পিটা, লাভাশ, সুমাক ছড়ানো আলুভাজা। ডিপগুলোর মধ্যে চামচ দিয়ে চেপে খাঁড়ির মতো বানানো তাতে টলটলে পান্নার মতো অলিভ অয়েল জমে আছে। টেবিলের চারপাশের লোকজনেরও খাবার এসে গেল। অধিকাংশের খাবারই ওইরকম সুন্দর আকৃতির প্লেটে। উল্টোদিকে তিনজনের দল বসেছিল, বাঙালি, একটা সিজলার না কী নিলেন। টেবিল খাবারের সুগন্ধে আর ধোঁয়ায় ভরে উঠল।

হামাস এমনিই ফাটাফাটি লাগে। বাবাগনুশকে আরও একটু ভালোবাসতে পারতাম যদি বেগুনপোড়াকে না চিনতাম। লাবনেহ্‌ খাওয়ারই চান্স জীবনে সবথেকে কম পেয়েছি এবং এভারগ্রিনে খেয়ে আবারও মুগ্ধ হলাম। এই গরমে এই রকম খাবারদাবার খেতে দিলে ভাতরুটি ছেড়ে দেব। সকালে একবাটি হামাস খাব, দুপুরে একবাটি লাবনেহ্‌ আর রাতে একবাটি, উঁহু বাবাগনুশ না, বেংগন কা ভর্তা ভি না, বিশুদ্ধ বেগুনপোড়া সর্ষের তেল, কাঁচালংকা দিয়ে মাখা। পাশে এক্সট্রা কাঁচালংকা রাখা থাকবে, ইন কেস। একচামচ বেগুনপোড়া মুখে পুরব আর এক কামড়ে অর্ধেক কাঁচালংকা সাবাড় করব।

সন্ধের মুখে এভারগ্রিন থেকে বেরিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। নতুন রাস্তায়। পাহাড়চুড়ো সঙ্গে সঙ্গে চললেন। এদিকেই কোথাও জিম মরিসন বলে একটা বিখ্যাত ক্যাফে আছে। গুগল ম্যাপে সেটা যেখানে দেখাচ্ছে সেখানে খাঁখাঁ রাস্তার এদিকে খাদ, ওদিকে খাড়া পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে তীর চিহ্ন। কিন্তু অন্য কী একটা ক্যাফের নাম লেখা। ব্রাউনিশিকারে মরিসনের পেছনে ধাওয়া করা যায়। করলাম না। আবার মেঘ ঘনিয়ে আসছে। আমাদের চেনা পাপীই ভালো। সানশাইন ক্যাফের পথ ধরলাম।

আজ এখনও ক্যাফে ভরেনি। গদি ফাঁকা। দৌড়ে বডি ফেললাম। মৃদু ইংরিজি গান, মাথার ওপর ঝুড়ি ল্যাম্পশেড থেকে নিভন্ত হলদে আলো। এভারগ্রিনের মতো সানশাইনেও রিপিট ভিজিটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। হাস্যমুখ ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। হোয়্যার আর ইউ গাইজ ফ্রম? উত্তর দিয়ে কাজের কথায় গেলাম। টু মোমোজ প্লিজ। আজ অর্চিষ্মানকে বিচক্ষণতা খরচ করতে হবে না। আজ আমরা গোটা গোটা গাঁজার মোমো খেয়ে দেড়শো মিটার আলোকিত ঘিঞ্জি রাস্তা হেঁটে হোটেলে ঢুকে লেপের তলায় ঢুকে পড়ব।

মোমো এসে গেল। সেই কনডেন্সড মিল্কের বিছানায় কড়া ভাজা ডালের বড়া। দুজনে দুজনকে চিয়ার্স দিয়ে মুখে পুরে দিলাম। আজ অর্চিষ্মান চোয়াল শক্ত করে নেমেছে, নিয়তির হাতে কিছু ছাড়বে না। উঠে গিয়ে দোকানের কোণের স্বচ্ছ ফ্রিজের কাছে দাঁড়িয়ে এদিকওদিক তাকাতে লাগল। হাসিহাসি বন্ধু রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। অর্চিষ্মান জিজ্ঞাসা করল ক্যান আই টেক ওয়ান? বন্ধু দুই হাত আকাশে তুললেন। ফিল লাইক ইউ ওন দা প্লেস ব্রো। বোতল নিয়ে টেবিলে ফিরে এল অর্চিষ্মান। গ্লাসের তরলে মাথার ওপরের ঝুড়ি থেকে দুলন্ত আলো চিকচিক করতে লাগল। চুমুক দিলাম।

এক ফ্যামিলি দোকানে ঢুকে আমরা কাল যে টেবিলে বসেছিলাম সেটাতে বসলেন। আরেকটু হলেই বাঙালি হয়ে যেতেন কাজেই অসমিয়া। এঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক চিহ্নিতকরণের ফাটকায় গোটা বছরের মাইনে বাজি রাখা যায়। বাবা মা মেয়ে। সবাই চুপ করে মেনু দেখছে। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না। অনাত্মীয় হলে গল্প করে ফাটিয়ে দিত। অবশ্য পরিস্থিতি ম্যাটার করে। ক্যাফের বারান্দায় দুটো ছেলে নিজেদের থেকে বড় রুকস্যাক নিয়ে বিষণ্ণ মুখে ফোন ঘাঁটছে। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না। পরিবেশকদের কথাবার্তায় বুঝছি যানবাহনগত আতান্তর। হাসিহাসি ভাইসাব দরজা ঠেলে মুণ্ডু বার করে বলছেন কাম অ্যান্ড সিট ইনসাইড। আরেকটা ফ্যামিলি ঢুকছে। তিন জেনারেশন। বেজি, পুত্তর, পুত্তর ইন ল, পোতা। মেয়ে জামাই নাতিও হতে পারে। বাঙালি অসমিয়াতে ওডিয়াতে যেমন গোলানোর সম্ভাবনা থাকে, অনভ্যস্ত চোখে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যও মিলেমিশে যেতে পারে, এই একটার জাতের সে রকম কিছু হওয়া অসম্ভব। আসমুদ্রহিমাচল এই রকমসকম আর কারও নেই।

দেখছি। গান শুনছি। চুমুক দিচ্ছি। গানের ফাঁক দিয়ে অন্য একটা শব্দ কানে ঢুকে পড়ছে। ইগনোর করছি। একবার। দু'বার। তিনবার। চারবার। পাঁচবার। অর্চিষ্মানের দিকে ঝুঁকছি। তোমাকে কেউ নাম ধরে ডাকছে? অর্চিষ্মানের মধ্যে বিশ্বমানের থেরাপিস্ট হওয়ার পোটেনশিয়াল ছিল। আজ পর্যন্ত কোনও প্রশ্নের উত্তর প্রশ্ন ছাড়া দেয়নি। কেন তোমাকে ডাকছে? ঘাড় নাড়লাম। শুধু ডাকছে না। ফিসফিস করে ডাকছে। কু ন্ত লা আ আ আ, কু ন্ত লা আ আ আ… অর্চিষ্মানকে ডেকে শোনাচ্ছি। অর্চিষ্মান গম্ভীরমুখে ঘাড় ওপরনিচ করছে। বুঝেছি। হাত নেড়ে ভাইসাবকে ডাকছে। বিল নিয়ে আসুন প্লিজ। উই নিড টু লিভ রাইট অ্যাওয়ে।

হোটেলে পৌঁছলাম। প্রতিটি বিন্দু উইলপাওয়ার খরচ হয়ে যাচ্ছে। অর্চিষ্মান অ্যাটেম্পটও নেয়নি। খাটের ওপাশটায় ধপাস করে পড়েই স্থির হয়ে গেছে। শ্বাসের শব্দে বুঝতে পারছি ঘুমিয়ে পড়েছে। আমিও শুয়ে পড়ছি। আমার মুণ্ডু গ্যাসবেলুন হয়ে গেছে। শরীর সুতো। এক্ষুনি একটা কিছু আঁকড়ে না ধরলে উড়ে যাব। অর্চিষ্মান চোখ খুলে দেখবে আমি ওর ওপর ভাসছি। আমার মুণ্ডুটা ঘাড় থেকে দুমড়ে সিলিং-এ সেঁটে আছে। সেঁটে সেঁটে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে। শরীরটা আলতো এদিক থেকে ওদিক দুলছে।

বাথরুম যাওয়া দরকার। দেওয়াল ধরে ধরে গেলাম। ফ্যাটফেটে সাদা আলোয় আলোকিত আয়নার ভেতর আমি আর আমার আবক্ষ মূর্তি। তিনভাগ মাথা একভাগ বক্ষ। আমি কি নিজের মুখটা ভালো করে দেখেছি কোনওদিন? যদি নিজেকে যেমন দেখতে ভেবেছি আসলে তেমন দেখতে না হই? বেসিনে পেরিয়ে মুখটা আয়নার খুব কাছে নিয়ে গেলাম। নাহ্‌ খুব বেশি আলাদা না। একদমই আলাদা না। অ্যাকচুয়ালি আশ্চর্যরকম মিল আমার মুখের সঙ্গে। সেই ভোঁতা নাক, সেই ছাগচক্ষু, সেই গোবিন্দর মা গালে অজস্র ফুটো। এ কী সম্ভব? আয়নার বাইরের আমি আর আয়নার ভেতরের আমির মধ্যে কোনও অমিল নেই? খুঁটিয়ে দেখছি। ফাইন্ড দা ডিফারেন্সেস খেলছি। দূরে কেউ লা লা করে গান গাইছে। গান কম চিৎকার বেশি। নাকি ডাকছে? এমন কাউকে যার নামের শেষে লা? আমার নাম কী? আয়নার লোকটার নাম জানি আমি। কুন্তলা। দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। অর্চিষ্মানের গলা। আঙুলের টোকা। কুন্তলা। দরজা বন্ধ কোরো না। বুকের ভেতর আশ্চর্য সাহস পাচ্ছি নিজের ইচ্ছে স্পষ্ট করে প্রকাশ করার। গর্ব হচ্ছে। না আমি দরজা বন্ধ করব। না হলে অস্বস্তি হবে। কিন্তু তুমি চিন্তা কোরো না আমি ঠিক আছি।

দরজা খুলছি। অর্চিষ্মান দাঁড়িয়ে ছিল, বাথরুমে ঢুকে আসছে। আয়নায় এখন আমাদের দুজনের মুখ। তাকিয়ে আছি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। অর্চিষ্মানকে কত বছর ধরে চিনি? তেরো? চোদ্দ? এই চোদ্দ বছর ধরে আমি এতখানি অন্ধ হয়ে থাকলাম কী করে? অর্চিষ্মানও কি দেখেনি? হ্যাঁ গো, এর আগে খেয়াল করেছ কোনওদিন? কী খেয়াল করব? এই যে আমার মুখটা চৌকো আর তোমার মুখটা লম্বা? অর্চিষ্মান উত্তর না দিয়ে হাসছে। আমার মুখ চৌকো আর ওর মুখ লম্বার মতো গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটা না জেনে চোদ্দটা বছর কাটিয়ে দেওয়ার অ্যাবসার্ডিটিতে আমিও হাসছি। ফোন বার করে ছবি তুলছে অর্চিষ্মান। আমি বাঁদিকে হেলে পড়ে চোখ বুজে হাসছি অর্চিষ্মান ডানদিকে ফিরে ফোনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। কসোল বাজারের লিটল ইটালি ইনের দু'শো সাত নম্বরে ঘরের বাথরুমের আয়নায় দুজনের হাসির প্রতিচ্ছবি রয়ে যাচ্ছে ক্লাউডে।

অর্চিষ্মানের কনুই ধরে বেরিয়ে আসছি। কান্না পাচ্ছে। ভয়ানক অপরাধবোধ হচ্ছে। আমার নেশা সামলাতে গিয়ে তোমার নেশা চটকে গেল। জীবনে আর কোনওদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। অর্চিষ্মান আশ্বাস দিচ্ছে। কিচ্ছু চটকায়নি কুন্তলা। শুয়ে পড়। আর উঠো না। বালিশের পাশে ব্রাউন কভার পরানো ফোন। চার্জে বসাচ্ছি। বেডসাইড ল্যাম্পের পেছনেই ধপধপে বোর্ডে তিনটে প্লাগ পয়েন্ট। ভাবা যায়? কাল রাতেই তাঁবুতে ছিলাম নো প্লাগ পয়েন্ট, আজ থ্রি প্লাগপয়েন্টস। তাও আধহাতের মধ্যে। গ্র্যাটিচিউড হৃদয়ের কিনারায় কিনারায় ছলকাচ্ছে। অর্চিষ্মানের দিকেও কি প্লাগ পয়েন্ট আছে? অর্চিষ্মান? অর্চিষ্মান? তোমার দিকে প্লাগ পয়েন্ট আছে? সাড়া নেই। শ্বাসের শব্দ। ঘুমিয়ে পড়েছে। একটা দুশ্চিন্তা শরীর নিচ্ছে। কী হবে ওর দিকে যদি প্লাগ পয়েন্ট না থাকে? তাহলে আমার প্লাগ পয়েন্টটা আমি ওকে দিয়ে দেব। অর্চিষ্মানের জন্য আমি প্রাণ দিতে পারি আর একটা প্লাগ পয়েন্ট দিতে পারব না? কনুইয়ে ভর দিয়ে ডেডওয়েট শরীর টানতে টানতে বিছানা পেরোচ্ছি। অর্চিষ্মানের ঘুমন্ত মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ছি। অর্চিষ্মান? অর্চিষ্মান? তোমার দিকে প্লাগ পয়েন্ট আছে? গলাটা দারোগার মতো শোনাচ্ছে কিন্তু আমি দারোগা হতে চাই না। অ র চি ষ মা আ আ আ ন্‌ ন্‌? লেপ ধরে ঝাঁকাচ্ছি। বিষম খেয়ে অর্চিষ্মান উঠে বসছে। কী হল কুন্তলা? কিছু না। বলছি যে তোমার দিকে প্লাগ পয়েন্ট আছে? না হলে তুমি আমার দিকে এসে শোও আমি তোমার দিকে এসে শুচ্ছি। আছে কুন্তলা। সব আছে। তুমি এবার ঘুমোও। আবার বুকে হেঁটে বিছানার এপার। বিছানাটা স্কুলের মাঠের মতো বড় হয়ে গেছে। একটা অদ্ভুত ফিলিং হচ্ছে। আমিই শুধু অর্চিষ্মানের থেকে সরে আসছি না আমার সঙ্গে সঙ্গে এই মুহূর্তটাও অর্চিষ্মানের সঙ্গে ওই মুহূর্তটা থেকে সরে আসছে। আমার মুহূর্তটা একটা বুদবুদ হয়ে যাচ্ছে। যার মধ্যে আমি একা। বুদবুদটা ক্রমশঃ বড় হচ্ছে। সময় স্ট্রেচ হচ্ছে। গড়াচ্ছে। সেই দানবীয় বুদবুদ গড়াতে গড়াতে আমাকে অন্য মুহূর্ত, অন্য মানুষদের থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাবা, বুচিদিদি, ছোটকাকু, অর্চিষ্মান, মা। সবাইকে ঠেলে দূরে আরও আরও দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। এত দূরে যে সবাই ঝাপসা। আমার সমস্ত স্মৃতি ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। অর্চিষ্মানের পাশে বসে থাকা সানশাইনের সন্ধে অলরেডি ঝাপসা। আমি আর মা রাতের ছাদে মাদুর পেতে শুয়ে আছি কত জন্ম পেরিয়ে গেছে।

আবার বৃষ্টির সকাল। আজ ফেরা। একটা ভালো, বাস ধরতে ভুনতার বা কুলু যেতে হবে না। লক্ষ্মী ট্র্যাভেলসের কসোল শাখা অফিসের সামনে থেকে রাত আটটায় বাস ছাড়বে। বৃষ্টি কমতে সোজা এভারগ্রিন। আজ আবার ভিড়। কাউন্টারের কাছাকাছি যেতেই দৃষ্টিতে পুরোনো পরিচয়। পাশের সোফাতে বসার ইঙ্গিত। তিন মিনিট পর দোকানের অন্য প্রান্ত থেকে যিনি পরশুদিন হাঁকিয়েছিলেন, কাল অর্ডার নিয়েছিলেন, হাত নেড়ে ডাকলেন। বুদ্ধমূর্তির পায়ের কাছে লেদার সোফার টু সিটারে বসলাম। অর্চিষ্মান বলল আমি না থাকলে তুমি এখানে কয়েকদিনের জন্য এসে থাকতে পার কিন্তু। কাছাকাছি হোটেলে থাকবে। সকালে এখানে চলে এসে সারাদিন কাজ করবে। ভালোই লাগবে মনে হয়। তা কেন লাগবে না? খারাপ লাগার কোনও কারণ নেই। কল্পনায় নিজেকে একা একা কসোলের পথে পথে ঘুরতে দেখতে, ক্যাফেতে বসে একমনে খটাখট টাইপ করতে দেখতে লোভনীয় লাগছিল কিন্তু জানি এ কপোলকল্পনা। একা একা এতদূর উজিয়ে আসার এনার্জি হবে না।

বৃষ্টি ধরল, বাড়ল। লোকের জুতোয় জুতোয় মেঝে জলকাদা হল, একটা ছেলে এসে ঝাঁট দিল। আরেকটা ছেলে মপ দিয়ে মুছল। দুজনেই কী খুঁটিয়ে কাজ করল অবাক হয়ে দেখলাম। কোণের চেয়ারের নিচের ন্যাপকিনের ছেঁড়া টুকরোও ছাড়ল না। লিটল ইটালি থেকে চেক আউট দুপুর বারোটায়। রাস্তায় রাস্তায় ঘোরার বয়স নেই বলে এক্সট্রা ভাড়া দিয়ে সন্ধে ছ’টা অবধি ঘরটা রেখেছি। পাঁচটা নাগাদ হোটেলে ফিরলাম। অর্চিষ্মান কাকে দেখে হাসছে। সোনম ঠাকুর। কাল বন্ধ রেখেছিলেন আজ আবার ফুচকার দোকান খুলেছেন। অলরেডি দু’চারজন কাস্টমার টেবিল ঘিরে গুনগুনাচ্ছে। সোনম আমাদের দেখে হাত নাড়লেন। আমরাও হাত নাড়লাম। এঁর সঙ্গে আর দেখা হবে না। আমার একটা গোপন সুপারপাওয়ার আছে। কিছু কিছু লোকের ক্ষেত্রে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি তাদের সঙ্গে আমার এটাই শেষ দেখা। দিস ইজ ইট। ফিনিশিং পয়েন্ট।

হোটেলে ঢুকে ঘরের দিকে হাঁটছি, রিসেপশনিস্ট স্মল টকের অংশ হিসেবে জানতে চাইলেন বাস ক’টায়? কোথা থেকে ছাড়বে? আমরা বললাম এই তো আটটায়। লক্ষ্মীর অফিসের সামনে থেকে। ভদ্রলোক বললেন সে কী জানেন না? ল্যান্ডস্লাইড হয়েছে আবার। কোনও বাস যাবে না। শুধু ছোট গাড়ি। আসার পথে এ খবরে কান না দেওয়ার পরিণতি মনে ছিল। অ্যাবাউট টার্ন করে দৌড়লাম। সারাদিনের বৃষ্টিতে রাস্তা পেছল। লক্ষ্মী ট্র্যাভেলসের অফিসে একজন বসে আছেন। আটটায় বাস ছিল শুনে বললেন সাতটায় চলে আসুন গাড়ি করে ভুনতার চৌমাথায় পৌঁছে দেওয়া হবে। সেখানে মেন অফিসের সামনে বাস অপেক্ষা করবে। চেক আউট করে ছ’টাতেই চলে গেলাম। প্রশস্ত চাতালে ভিড় বেড়ে উঠল। সবাই বাসের যাত্রী নয়। এটা কসোলের মেন পিক অ্যান্ড ড্রপ পয়েন্ট। ট্রেকারে করে এসে লোকজন নামছে। পোশাকআশাক দেখে মনে হচ্ছে ক্ষীরগঙ্গা ট্রেক থেকে ফিরছে। জমকালো এস ইউ ভি-রা মিছিল করে কসোল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। কাল পরশু শহরটা হাঁপাবে। রাস্তা পেরিয়ে উল্টোদিকের দোকান থেকে দু’কাপ চা, কুরকুরে আর কর্ন পাফের ফ্যামিলি প্যাক নিয়ে পা টিপে টিপে ফিরছি, একটা টেন সিটার গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে অর্চিষ্মান জোরে জোরে হাত নাড়ল।

গাড়ি ছেড়ে দিল। একঘণ্টা লাগবেই। আঁকাবাঁকা রাস্তায় হেডলাইটের আলোয় আলোকিত রাস্তাটুকু দেখতে দেখতে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যাত্রা। গাড়ির লোকজন আশ্চর্যরকম চুপ। আমি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছিলাম। অর্চিষ্মান পেছনের রোতে। আরও দুটো ছেলেদের গ্রুপ উঠেছিল। কেউ নিজেদের মধ্যে একটা শব্দও বলছিল না। উল্টোদিক থেকে একটা মিছিল আসাতে গাড়ি স্লো করতে হল। সোনালি ডাণ্ডার মাথায় ঝকমকে পতাকা আর ট্রফির মতো কী সব উঁচিয়ে গান গাইতে গাইতে মিছিল চলেছে। সবাই পুরুষ। মিছিলের পেছনের পুরুষদের কাঁধে সোনালি সিংহাসনে দেবতা। নৈঃশব্দ্য ভেঙে জিজ্ঞাসা করলাম ইনি কে? ড্রাইভার ছেলেটা বলল শেষনাগ পতা হ্যায় ম্যাম? বিলকুল হ্যায়। ইনিই তিনি। বলে ছেলেটা কপালে বুকে আঙুল ছোঁয়াল। জনপদ এল। একটা বাড়ির সামনের ছড়ানো চত্বরে প্রায় নিভে যাওয়া যজ্ঞের আগুন ঘিরে মেয়েরা গান গাইতে গাইতে ঘুরে ঘুরে নাচছেন। অলমোস্ট শিওর এখানেই ওই শেষনাগ পূজিত হয়েছেন। পুরুষ ভক্তরা মিছিল করে গাইতে গাইতে কে জানে কোথায় চলেছেন, মহিলা ভক্তরা এখানে আগুন ঘিরে গাইতে গাইতে নাচছেন। খুব চেষ্টা করলাম সেই অশ্বক্ষুরাকৃতি মোড়টা চিহ্নিত করার, যেখানে পরশু দুপুরে বসে ছিলাম আর শিব সুইটসে খেলাম। পারলাম না। রাস্তা তো একটাই। নিশ্চয় অন্ধকারে মিস করে গেছি। এত শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা সত্ত্বেও। হেডলাইটের আলোয় রাস্তার পাশে থেমে থাকা গাড়ি আলোকিত হল। দুই মহিলা, অব্যর্থ মা মেয়ে, দরজা খুলে নামছিলেন। মুখে তৃপ্তি ডিমরির আদল।

ভুনতারে লক্ষ্মী ট্র্যাভেলসের অফিসের সামনে নামিয়ে গাড়ি চলে গেল। অফিসের লাগোয়া ওয়েটিং রুমে আমি ব্যাগ পাহারা দিতে লাগলাম, অর্চিষ্মান বাইরে বাস পাহারা দিতে লাগল। আমাকে ঘিরে অ্যাথলেজার অ্যাটায়ার পরিহিত লোকজন শূন্য দৃষ্টিতে বসে কলার পর কলা খেয়ে চললেন। অর্চিষ্মান তৎপর মুখে দরজা ঠেলে ঢুকল। চল কুন্তলা। বাস এসে গেছে।

দিল্লি টু কুলু বাসের এসির হাওয়াটাও এখনও চাইলে কপালের ত্বকে ফিরিয়ে আনতে পারছি অথচ ফেরার বাসের বাইরের রংটাও মনে করতে পারছি না। একজন যাত্রী যথেষ্টরকম বিরক্তি জাগরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে স্মৃতিতে রয়ে গেছেন। গোটা রাস্তা ঘুমোলাম। মাঝরাতে ডিনারের জন্য বাস থেমেছিল। অর্চিষ্মানের ঠেলেও ছিল। খাব না বলে মাথা নেড়ে আবার ঘুমে ফেরত গেছি। মাঝে ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম ভাঙছিল কিন্তু জানালার বাইরে কী দেখেছি বা আদৌ দেখেছি কি না সেটাও মনে নেই। হতে পারে এমন সুন্দর একটা ছুটির পরে ফিরতে এত জঘন্য লাগছিল যে তার কোনও স্মৃতি রাখতে চাইনি। সকালে দিল্লির ঘিঞ্জি উপকণ্ঠ পেরিয়ে, নির্মল হৃদয়-এর হলুদ বাড়ি পেরিয়ে বড় বড় ফ্লাইওভারের ফাঁদে ঢুকে পড়লাম। আই এস বি টি আসার প্রায় আধঘণ্টা আগে রুক্ষ চিৎকার করে ভাইসাব সবাইকে জাগিয়ে দিলেন। যাতে বাস থামার দেড় মিনিটের মধ্যে সবাই বাস খালি করে নেমে যেতে পারে। যারা ব্যাগ বাসের পেটে জমা দিয়েছে তাদের আদেশ দেওয়া হল পরচি হাতে নিয়ে বসতে। আদেশ দেওয়ারই যা ভঙ্গি গন্তব্যে পৌঁছে যদি দেখা যায় যে কেউ আদেশ পালনে অক্ষম হয়েছেন আচরণটা কেমন হবে ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিল। নিঃসন্দেহে দিল্লি ফিরছি। আমাদের পরচিটরচির ব্যাপার নেই কাজেই গালি খাব না। বাসে বসেই উবার অটো বুক করে রেখেছিলাম। নামার দু’মিনিটের মধ্যে ভাইসাব সামনে এসে ব্রেক কষলেন। তখনও দিল্লির ভোরের হাওয়ায় আরাম ছিল যা এই পোস্ট লেখার মুহূর্তে সম্পূর্ণ অন্তর্হিত। গলা বাড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছি তিন্নি ফোন করল। কীরে কেমন ঘুরলি। বললাম এখনও টেকনিক্যালি ঘোরা শেষ হয়নি। তিন্নি সরি সরি বলে ফোন রেখে দিল।

বাড়ির দরজার তালা খুলে সোজা রান্নাঘরে ঢুকল অর্চিষ্মান। চা খাবে তো? জল বসাচ্ছি। টিপ খুলে পাতায় সাঁটতে সাঁটতে বললাম, ফিল লাইক ইউ ওন দা প্লেস ব্রো।

                                                                                                                                                        (শেষ)




Comments

  1. সবসময়ের মতোই এটাও ভালো লাগলো পড়ে।

    নেশার সময়ের বর্ণনাটা দারুন লাগলো। এই প্রসঙ্গে, আমি একবার এলকোহলের ঘোরে (হালকা নয়, বেশ ভালোমতো ঘোর) লেখার চেষ্টা করেছিলাম, পরে পড়ে দেখি যাইচ্ছেতাই হয়েছিল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কাজের কাজ কিছু হয় না। আমি অবশ্য চেষ্টাও করিনি। ওই সময় ঘুমিয়ে পড়াটাই অপটিমাল ও আরামের।

      Delete
    2. বাই দা ওয়ে, লেখা সম্পর্কে হেমিংওয়ের একটা টোটকা হচ্ছে, "Write drunk; edit sober." কাজেই আপনার নিরীক্ষাটা একেবারে ফেলে দেওয়ার নয়।

      Delete
  2. কদিন ধরেই মনটা খুব ডাল-ভাত-চোখার আবেদন জানাচ্ছিল, ইউটিউব শর্টস ভরে ভরে ওই আসছে। আপনার পোস্ট পড়ে তার সাথে আরেকটা আর্তি জুড়ে গেলো, ফাইনালি খাওয়া হলো, সাথে সরষের তেল, কাঁচালঙ্কা, পেঁয়াজ ওয়ালা বেগুনের চোখাও।
    নেশার বর্ণনাটা তো বটেই, ফেরার বর্ণনাটা খুব যেন অনুভব করতে পারলাম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, বৈজয়ন্তী। আপনার সাড়া সর্বদা ভালোলাগা জাগায়। ডাল ভাত চোখা পোস্টপোন করবেন না, খুঁজেপেতে জোগাড় করে ফেলুন। গরমের আদর্শ খাবার তাছাড়া এই সব ছোট ছোট ইচ্ছে পূর্ণ করাই আসলে জীবনকে লুটেপুটে নেওয়া।

      Delete
    2. আমি ভুল কমেন্ট করেছি। আপনি তো অলরেডি ডালভাতচোখা খেয়েছেন। সরি। প্রথমবার কেন পড়ে বুঝতে পারিনি কে জানে। আবারও সরি।

      Delete
    3. বৈজয়ন্তীMay 2, 2024 at 11:30 PM

      আরে এটা কোনো ব্যাপারই না.. আমি তো এসব ভুলভাল বোঝার পুরোনো খদ্দের।
      স্কুলে যে কত বকা খেয়েছি।

      Delete
  3. khub valo laglo series ta, ekebare unputdownable. kokhono Dilli te neme byag bochka kothao rekhe ekbar odikta ghure asbo vaabi. Kintu ekbar namlei soja bari bole rowna hoye pori. Ei ar ki. Valo thakben.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভাববেন না, করে ফেলুন। টিকিট কেটে রাখবেন তাহলে মোটিভেশন আসবে। দিল্লির কাছে এত ভালো ভালো জায়গা। আপনি তো উত্তরপূর্বের? সেখানে তো আরও সুন্দর সুন্দর জায়গা।

      Delete
  4. বড় চমৎকার হল গোটাটা মিলে। নেশার অবস্থাটা বর্ণনাটা বড় চমৎকার হয়েছে সবে মিলে ভারী আরাম পুরো সিরিজটা।
    অবশ্য তোমার বেশীরভাগ লেখাই পড়ে আরাম পাওয়া যায়।
    -প্রদীপ্ত

    ReplyDelete

Post a Comment