পল অস্টার ও অর্চিষ্মানের মুচকি হাসি


দুটো মানুষের সম্পর্ক সেই একই কারণে সফল হয় (যদি টিঁকে যাওয়াকে সাফল্য বলে ধরে নিই বাকি সবার মতো) যে কারণে একটা ফুটবল (বা ক্রিকেট বা হকি বা লুডো) ম্যাচ বোরিং হয়। রেজাল্ট ড্র হলে। নো হার। নো জিত। আর সে রকম হতে হলে দু'পক্ষের শক্তি সমান সমান হওয়ার দরকার। একজন এ কে ফর্টিসেভেন অন্যজন গুলতি - এ রকম হলে কেস।

শক্তি বহুমাত্রিক। সামাজিক, আর্থিক, নৈতিক। সব মাত্রাতে শক্তির সাম্য আশা করা পাগলামো। বিশেষ করে যেগুলোতে নিজের হাত নেই। দীপিকা পাডুকোন দীপিকা পাডুকোন হয়ে জন্মেছেন; আমি আমি হয়ে। এবার কারও যদি দীপিকা পাডুকোনকে পছন্দ হয় সেখানে আমার সত্যিই কিছু করার নেই।

স্পষ্টবাদীরা বলবে তাহলে তোমাকে সারাজীবন ঠুঁটো হয়েই বসে থাকতে হবে কারণ দীপিকা পাডুকোনকে পছন্দ নয় এমন লোক ভূভারতে জন্মায়নি। মানছি। তবে কমবেশি আছে। দীপিকা না হলেও মনের দুঃখ মনে চেপে কাজ চালিয়ে নেবে এমন কাউকে খুঁজে বার করতে হবে। তারপর বার করতে হবে আর কী কী বিষয় আছে যেগুলোকে সে গুরুত্ব দেয়। তারপর বার করতে হবে তাদের মধ্যে কোন কোন বিষয়কে আমিও গুরুত্ব দিই। তারপর ঠিক করতে হবে সেই কমন বিষয়গুলোতে দুজনের ক্ষমতার তারতম্য কতখানি। তারপর সে তারতম্য কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

কেউ বলেনি হইচই দেখতে দেখতে সম্পর্ক তৈরি করা যায়। কেউ বলেনি ক্যান্ডি ক্রাশ খেলতে খেলতে সে সম্পর্ক চমৎকার রক্ষা করা যায়। সকলেই বলেছে অত পরিশ্রম করবে কি না সে সিদ্ধান্ত তোমার কারণ সম্পর্ক পরীক্ষার নম্বর নয় যে পড়লেই পাওয়া গ্যারান্টি।

তখন আমরা নিজেদের অস্ত্রশস্ত্রের রফা করছিলাম। কয়েকটা ক্যাটেগরি গোড়াতেই স্কিপ করে যাওয়া হল। অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস। শেয়ার মার্কেট। বাঞ্জি জাম্পিং। ভিনটেজ কার রেসিং। ফ্যাশন। স্বাস্থ্যের দিকটাও এড়ানো হল। আজকাল জিম আর ইয়োগা ক্লাস প্রেম নামার হটস্পট। উইকে তিনবার, সোম বুধ শুক্র, সকাল ছ'টা থেকে সাতটা, পাশাপাশি ম্যাটে ডাউনওয়ার্ড ডগ হতে হতে প্রেম হয়ে যাচ্ছে। জিম সেলফি দেওয়ানেওয়া করতে করতে ভালোবাসা। একজন বামপন্থী নায়িকা, আপাতত সিংগল এবং লুকিং, আধঘণ্টা আগে ইন্টারভিউতে বললেন ওঁর স্বপ্নের পুরুষকে স্বাস্থ্যসন্ধানী হতে হবে। কাপলস হু লিফট টুগেদার, স্টে টুগেদার। বললেন, নিয়মিত জিমে যায়, ভাজাভুজি খায় না, এ রকম পুরুষ ওঁর ভালো লাগে। মেডিক্যাল মাইন্ডেড প্রেমিকপ্রেমিকা আরও আছে। রাজর্ষির ব্লগ পড়ে জানলাম একজন ডেটিং অ্যাপে আলাপ জমাতে নিজের ভাঙা পায়ের বিফোর অ্যান্ড আফটার এক্সরে রিপোর্ট নিয়ে এসেছেন।

আগেও বলেছি আবারও বলছি। ভবিষ্যতেও বলব। আমার অগুন্তি দুর্ভাগ্য এই একটিমাত্র সৌভাগ্য দিয়ে কাটাকুটি হয়ে গেছে। ডেটিং অ্যাপের বাজারে প্রেম করতে হয়নি।

যাই হোক, তখন আমার আর অর্চিষ্মানের অস্ত্রশস্ত্রের সেটলমেন্ট চলছে। আমার তরফ থেকে কয়েকটা মিসফায়ার অলরেডি করে ফেলেছি। তখন ফুডব্লগ পড়তাম খুব তাই নিজেকে ফুডি ভ্রম হয়েছিল। ফার্স্ট ডেটের অন্তে ছিল থাই রেস্টোর‍্যান্ট। চুল পাকতে শুরু করেছে বটে তা বলে তোমাদের মতো তরুণ তুর্কিদের থেকে অ্যাডভেঞ্চারাসনেসে কিছু কম যাই না সিগন্যাল দেওয়ার তাগিদে বুক ফুলিয়ে বলেছিলাম "ব্যাংভাজা আনুন প্লিজ"। চশমার ওপারে অলরেডি বড় বড় চোখ আরও বড় বড় করেছিল অর্চিষ্মান। তুমি ব্যাংভাজা খাবে? সত্যি সত্যি? স্মার্ট হেসেছিলাম, আরে তুমিও খাও। তখনও তো জানি না এ কুমড়োফুল ভাজা পর্যন্ত খায় না, নাকি কেমন কেমন লাগে। অর্চিষ্মান ঘাড় নেড়েছিল। না বাবা। ডাঙায় তবু একরকম, জলে আমি চিংড়ি পর্যন্ত নামতে পারি, তার বেশি না। তুমি ব্যাংভাজা খাও আমি চিকেন খাই বরং।

ধ্বসে যেতে পারতাম। আগের সপ্তাহেই বড়মাসি ফোন করে মাকে বলেছেন, অ্যাঁ এবারেরটাও ভেগেছে? তোমার মেয়ের দ্বারা হবে না মনে হচ্ছে মণি। ইরাদিকে মনে আছে? আমার কোলিগ? বারুইপুরে বাড়ি? হ্যাঁ সেই ইরাদি তো শাদি ডট কম বলে কী একটা বেরিয়েছে, সেখান থেকে চমৎকার ছেলের বউ নিয়ে এসেছে। তবে তুমি চিন্তা কোর না। গুরুদেব স্বপ্ন দিয়েছেন আজ হোক কাল হোক পরশু তোমার মেয়ের বিয়ে একটা হবেই। এও বলেছেন পাত্রের নাম অ দিয়ে শুরু।

আমি ততদিনে ঊনত্রিশের লাস্ট ল্যাপ। গত এক দশক ধরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে রুপোলি রেখা বার করাতে পি এইচ ডি করে ফেলেছি। দমলাম না। ব্যাং মেলেনি তো কী হয়েছে। একে অপরের পছন্দে কোপ না বসানোর স্বভাবে মিলেছে। কে জানে, হয়তো ব্যাং মেলার থেকে বেশি জরুরি এ জিনিস মেলা।

না মেলার লিস্ট কিন্তু বাড়ল। খাওয়াদাওয়া, সংগীত, শাহরুখ খান কিস্যু কমন পড়ল না। রাজনীতি খাপে খাপ মিলল কিন্তু রাজনীতিচর্চার ভঙ্গি না। সে সারাদিন কাউন্টিং কানে গুঁজে বসে আছে, আমি কাউন্টিং যাতে না কানে ঢোকে সে জন্য সারাদিন জীবনের সারসত্য কানে গুঁজে বসে আছি। বাকি রইল সিনেমা আর বই। চোখকান একসঙ্গে অতক্ষণ ধরে এনগেজড রাখতে অস্বস্তি আমার, কাজেই বইতে রফা হল। আমি এদিক থেকে বেল জার-এর বাণ মারলাম, ওদিক থেকে বাবুঘাটের কুমারী মাছ উড়ে এল। জন্মদিনে ক্যালভিনোর জবাবে পয়লা বৈশাখে ক্যালভিন অ্যান্ড হবস পাঠালাম। গোয়েন্দাগল্প পছন্দ করি শুনে অর্চিষ্মান বলল উমবার্তো একো পড়েছ নিশ্চয়, আমি বললাম আশাপূর্ণা দেবীও বাদ দিইনি। তখন অর্চিষ্মান বলল তাহলে পল অস্টার নিশ্চয় পড়া আছে?

পল অস্টার? গোয়েন্দাগল্প লেখক?

না, লেখক অনেকরকমই কিন্তু এঁর তিনটে মিস্ট্রি নভেলের সিরিজ আছে 'নিউ ইয়র্ক ট্রিলজি' বলে। বেসিক্যালি, পোস্টমডার্নিস্ট কমেন্টারি অন ডিটেকটিভ ফিকশন। তাছাড়া ভেরিয়াস ফিলোজফিক্যাল থিমের এক্সপ্লোরেশনও আছে। পড়ে দেখতে পার।

পরের বাণটা হাতেই রয়ে গেল। মগজের ভেতর ধৃতরাষ্ট্র শূন্যতা হাতড়াতে লাগলেন, ইয়ে সব কেয়া হো রহা হ্যায়? মুখে কোনও মতে বললাম, ওহ তাই বুঝি? ঠিক আছে পড়ব। আমি নামই শুনিনি আগে। থ্যাংক ইউ।

মুখে বললাম মানে চ্যাটে টাইপ করলাম। ওই সময় আমাদের লং ডিসট্যান্স। দুজনের মাঝখানে গুণে গুণে আটশো চুরানব্বই দশমিক নয় তিন পাঁচ কিলোমিটার। কাজেই সেই মুহূর্তে অর্চিষ্মানের মুখ আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। ইমোজিও দেয়নি আমি শিওর। তবু আমি জানি। শরীরের সমস্ত রক্তবিন্দু দিয়ে জানি। সমস্ত শ্বাসপ্রশ্বাস দিয়ে জানি। আগামী চোদ্দ বছরে যে চোদ্দশত সহস্র নিযুত কোটি অর্বুদ মহার্বুদ খর্ব মহাখর্ব পদ্ম মহাপদ্ম মুচকি হাসি অর্চিষ্মান আমার দিকে তাকিয়ে হাসবে তাদের সব্বার প্রথম হাসিটা, অর্চিষ্মান ওই মুহূর্তে নিজের একলা ঘরে, ল্যাপটপের নীল আভায় বসে হেসেছিল।

তিরিশে এপ্রিল পল অস্টারের মৃত্যুর খবর পড়লাম ইন্টারনেটে। মনে পড়ল এক বনবাস আগে অর্চিষ্মানের কাছে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের ব্যাকুলতায় নিউ ইয়র্ক ট্রিলজি পড়া এবং পড়ার পর বইটা আমার প্রিয় বইয়ের তাকে পার্মানেন্ট জায়গা করে নেওয়ার পরেও পরের চোদ্দ বছরে ভদ্রলোকের লেখা আর একটি অক্ষরও পড়ে দেখার উদ্যোগ নিইনি। সে দুর্বোধ্য সিদ্ধান্ত সংশোধনের জন্য এখন দুটো বই নিয়ে বসেছি। একটা মেমোয়ার। দা ইনভেনশন অফ সলিচিউড। আরেকটা গল্পের বই। দা বুক অফ ইলিউশনস। ইচ্ছে হলে পরে তাদের বিষয়ে বলব।

Comments

  1. Ei re. New York Trilogyr prothom boita amar bishesh poshayni. Tai dwitiyo ta obdhi egoini ar. Arekbar cheshta kore dekhbo bolcho?

    ReplyDelete
    Replies
    1. দেখতে পার, বিম্ববতী। কী আর হবে, কয়েকহাজার তেমন-ভালো-নয় শব্দ পড়া হবে। সেকেন্ডটাও ভালো না লাগলে থার্ডটার ব্যাপারে তখন সিদ্ধান্ত নিয়ো।

      Delete
  2. পল অস্টার তো আমারও জানা নেই। সাধারণ গোয়েন্দা গল্পের মতো নয় যখন, দোকানে দেখতে পেলে একটুখানি পড়ে দেখবো আগে। গোয়েন্দা গল্পের মধ্যে রিসেন্টলি কেইগো হিগাশিনো পড়লাম কয়েকটা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভালো লাগল?

      Delete
    2. "The Devotion of Suspect X"টা দারুন লাগলো, নতুন ধরণের প্লট ছিল আমার জন্যে এটা। অন্য যেগুলো পড়লাম সেগুলোও ভালো লাগলো (অন্তত আরো কেনার প্রবণতা তো জাগিয়েছে), তবে সেগুলোর ডিটেল বা এক্সপিরিয়েন্সটা বেশিদিন মনে থাকবে না।

      Delete
  3. বৈজয়ন্তীJune 21, 2024 at 11:29 PM

    প্রথম অনুচ্ছেদটা কোট করে বিবাহিত বন্ধুদের শেয়ার করেছিলাম। সবাই সায় দিলো। কিন্তু একজন মহা ঝগড়া বাঁধিয়ে দিলো। বললো, শক্তির থেকে বেশি মানসিকতা দরকার টিকিয়ে রাখার জন্য। অনেক কিছু বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু তার পয়েন্টটা বুঝতে পারছিনা, এটাই শুনলাম বারবার। শেষমেষ হাত তুলে দিলাম।
    আপনার "জীবনের সারসত্য" টাই আসল কথা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. বৈজয়ন্তী, হ্যাঁ ওটাই সত্য। ধ্রুব এবং অন্তিম সত্য।

      আপনার বন্ধুকে চিনি না, কাজেই ওঁর সম্পর্কে কিছু বলছি না। তবে এই "বুঝতে না পারা" প্রসঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরে ইন্টারেস্ট বোধ করছি। অনেকেরই আজকাল এই ভঙ্গিটা দেখছি। ওঁদের সঙ্গে একমত না হওয়া মানেই উল্টোপক্ষ ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। অর্থাৎ উল্টোপক্ষের বুদ্ধি কম। বুদ্ধি আরেকটু বেশি হলে উল্টোপক্ষে তাঁর যুক্তি বুঝতে পারত এবং সে যুক্তির সঙ্গে একমত হওয়া ছাড়া আর কোনও রাস্তাই খোলা পেত না। বুঝতে পেরেও যে ভিন্নমত পোষণ করা যায় এটা বোঝার বুদ্ধি ওঁদের সর্বদাই কম পড়ে।

      Delete
  4. গুগল বলছে ভদ্রলোক অনেক বই লিখেছেন। ভাবছি পড়ে দেখব।

    ReplyDelete
    Replies
    1. নিশ্চয়, আরাফ। আমার তো ইনভেনশন অফ সলিচিউড বেশ ভালো লাগল। ভদ্রলোকের জীবন খুবই ইন্টারেস্টিং।

      Delete

Post a Comment