চব্বিশটি বছর পরে



অবান্তরের পাঁচজন পাঠকের একজনও যদি আমার মতো হন, তাহলে তিনি আজকের পোস্টের হেডিং পড়েই হাওয়া হয়েছেন। আমিও আজকাল হই। চব্বিশ, বিদায়, এক্সপ্রেস ভারতরত্ন---বাতাসে এই সব শব্দের গন্ধ পেলেই আর একমুহূর্ত সেখানে দাঁড়াই না, প্রাণ হাতে পলায়ন করি।

অবশ্য পালালেই তো আর সমস্যা মেটে না। বরং দেশজোড়া 'রিটায়ারমেন্ট ধামাকা'র অংশ হতে না পারার অপারগতা মনকে কুরে কুরে খায়। মিসফিট বাচ্চার মতো পার্কের কোণে ভুরু কুঁচকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে হয়, কখন এই বিচ্ছিরি খেলাটা শেষ হবে আর অন্য কোনও খেলা শুরু হবে যেটা আমি খেলতে পারি। আর সেই মুহূর্তে যদি পার্কের অন্য একটা কোণায় চোখ ফেলে দেখি সেখানে আর একটা খেলা চলছে, যে খেলাটা অবিকল এই খেলাটার মতোই, তফাৎ শুধু যে এই খেলাটা আমি দারুণ ভালো খেলতে পারি, আর খেলতে চাইও---তাহলে কী মজা হয় ভাবুন একবার?

আমার আজকের পোস্টটা সেই অন্য খেলাটাকে কেন্দ্র করে। সে খেলাটাও একটা ঘটনার শেষ হওয়া নিয়ে, আর কী আশ্চর্য সমাপতন, এই ঘটনাটাও শেষ হচ্ছে গত চব্বিশ বছর ধরে চলার পর। উনিশশো ঊননব্বই সালের নভেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পায়ে প্যাড বেঁধে প্রথম খেলতে নেমেছিলেন সচিন তেন্ডুলকর, আর তার মাত্র মাসআষ্টেক আগে জানুয়ারি মাসের এক কনকনে শীতের রাত্তিরে নাকের নিচে পালিশ করা গোঁফ সেঁটে, পায়ে পালিশ করা পেটেন্ট লেদারের জুতো পরে, আর সর্বাঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত এক লিটল্‌ বেলজিয়ান ডিটেকটিভের নির্ভুল চিহ্ন নিয়ে টিভির পর্দায় প্রথম আবির্ভূত হয়েছিলেন ডেভিড সুশে।

উৎস গুগল ইমেজেস
হারকিউল পোয়্যারোকে এতদিন পৃথিবীর লোক বইয়ের পাতায় পড়েই এসেছিল, এবার সবাই জানল তাঁকে আসলে কেমন দেখতে।

বিশ্বসাহিত্যে অমর চরিত্র অনেক সৃষ্টি হয়েছে, সে সব চরিত্র চলচ্চিত্রের পর্দায় রূপান্তরিতও হয়েছে। সে চরিত্রচিত্রণ আসলের কত কাছাকাছি গেছে (Vito Andolini Corleone-র চরিত্রে মার্লন ব্র্যান্ডো) নাকি যেতে পারেনি (ফেলুদার ভূমিকায় শশী কাপুর। অবশ্য ট্রেলরের বাংলা উচ্চারণ শুনে মনে হচ্ছে শশী কাপুরকে এ ব্যাপারে ফেল ফেলবেন শঙ্করের রোলে দেভ।) আলোচনা ঘুরেছে সেই সব প্রশ্নকে কেন্দ্র করেই। ডেভিড সুশের হারকিউল পোয়্যারোকে দেখার পর একমাত্র যে প্রশ্নটা মনে জাগতে পারে সেটা হচ্ছে আগাথা ক্রিস্টি ত্রিকালজ্ঞ ছিলেন কি না। তিনি কি মন্ত্রবলে জানতে পেরেছিলেন কে তাঁর মৃত্যুর প্রায় তেরো বছর পর হারকিউল পোয়্যারোর ভূমিকায় অভিনয় করতে নামবেন? পঞ্চান্ন বছর ধরে কি তিনি তেত্রিশটি উপন্যাস আর পঞ্চাশেরও বেশি ছোটগল্প লিখে গেছেন সেই স্বপ্নে পাওয়া চেহারাটিকে বুকের ভেতর রেখে?

ডেভিড সুশের কাজটা একদিক থেকে ভীষণ শক্ত ছিল, আবার ছিলও না। শক্ত কারণ উনিশশো ঊননব্বই সালে তিনি পোয়্যারোরূপে অবতীর্ণ হওয়ার আগেই পৃথিবীর প্রায় একশোটি ভাষা বলা লোক পোয়্যারোকে অলরেডি চিনত। পোয়্যারোর ও.সি.ডি., গোঁফ এবং লিটল গ্রে সেলস নিয়ে অপরিসীম গর্ব, অর্ডার এবং মেথডের প্রতি জীবনভরের আনুগত্যের কথা ততদিনে আর কারও জানতে বাকি ছিল না। যে কেউ এসে টিভির পর্দায় দাঁড়িয়ে ফ্রেঞ্চ অ্যাকসেন্টে “বোঁ” আর “মনামি হেসতিংস্‌” বলেই নিজেদের পোয়্যারো হিসেবে চালাতে পারত না। সত্যি বলতে কি সে চেষ্টা যে আগে হয়নি তেমন নয়। অ্যালবার্ট ফিনি, পিটার উস্তিনভের মতো বাঘাবাঘা অভিনেতারা পোয়্যারোর ভূমিকায় আগে নেমেছেন এবং নেমে (এখানে বান্টির একটা সামান্য অপরিশীলিত কিন্ত মোক্ষম বর্ণনা ধার না করে পারছি না, মাপ করবেন) “এন্তার ছড়িয়েছেন”। বছরের পর বছর ধরে হারকিউল পোয়্যারোর নামে অকথ্য ক্যারিকেচারের পর, ডেভিড সুশে এসে যদি যা করেছেন তার সিকিভাগ অভিনয়ও করতেন, জনগণ তাঁকে মাথায় তুলে নাচত। সেদিক থেকে দেখতে গেলে ডেভিড সুশের কাজটা বলতে গেলে একরকম সোজাই ছিল।

যদিও ডেভিড ফাঁকি মারেননি। তিনি হারকিউল পোয়্যারোকে নিয়ে রিসার্চ করেছেন, ভেবেছেন, বছরের পর বছরের ধরে সেই লিট্‌ল্‌ বেলজিয়ানটির মাথার ভেতর ঢোকার সাধনা চালিয়ে গেছেন। প্রকৃতির সান্নিধ্য যাঁর ভালো লাগে না কারণ প্রকৃতি সরলরেখা ধরে চলে না। তার থেকে লন্ডন শহরের জ্যামিতিক ছক ঢের ভালো।

আমার বিচারে ডেভিড সুশে তাঁর সাধনায় দেড়শো শতাংশ সফল। সবাই বলছে বলে নয়, আমার নিজের কষ্টিপাথরে যাচাই করে তবেই বলছি। আগাথা ক্রিস্টির দুই বিশ্ববিখ্যাত নায়কনায়িকার মধ্যে আমার ফেভারিট আজীবন ছিলেন মিস মার্পল। এখনও আছেন। জেন্ডারজনিত একচোখোমি তো আছেই, তাছাড়া গোয়েন্দার স্টিরিওটাইপে মিস মার্পল এতই খাপছাড়া যে তাঁকে না ভালোবেসে আমার উপায় নেই। সে তুলনায় হারকিউল পোয়্যারো বড় বেশি মেনস্ট্রিম (প্রাক্তন পুলিশ ইত্যাদি প্রভৃতি)। আগাথা ক্রিস্টির ফ্যানেদের মধ্যে জনপ্রিয়তায় হারকিউল পোয়্যারো মিস মার্পলকে হারিয়ে দিয়েছেন, সেটাও পোয়্যারোর প্রতি রাগের আমার আরেকটা কারণ।

বা বলা ভালো কারণ ছিল। এখন যে নেই তার জন্য দায়ী একমাত্র ডেভিড সুশে। ডেভিড সুশে আমার পোয়্যারো-অ্যালার্জি সম্পূর্ণ নিরাময় করেছেন। আমার মাথার ভেতর হারকিউল পোয়্যারো হিসেবে নিজেকে একটু একটু করে বপন করেছেন। আমি যতদিন বাঁচব, ততদিন হারকিউল পোয়্যারোর কথা মনে পড়লে আমার ডেভিড সুশের মুখ মনে পড়বে। ঠিক যেমন লালমোহন গাঙ্গুলী বললেই সন্তোষ দত্তের মুখ মনে পড়ে, বাড়ি বললেই রিষড়ার কথা মনে পড়ে।

The Adventure of the Clapham Cook দিয়ে চব্বিশ বছর আগে যাত্রা শুরু করেছিলেন, শেষ করলেন Curtain দিয়ে। তেরোই নভেম্বর, দু’হাজার তেরোয় Curtain: Poirot’s Last Case সম্প্রচারিত হয়েছে আই টিভিতে। চাইলে আমি এক্ষুনি সেটা দেখে ফেলতে পারি। কিন্তু বাকি গল্পগুলোর মতো Curtain-এর গল্পটাও আমার জানা। আমি জানি ও গল্পের শেষে কী ঘটবে। আর জানি বলেই হয়তো Curtain আমি কোনওদিন দেখব না। পোয়্যারোকে ভালোবাসি বলে নয়, পোয়্যারোরূপী ডেভিড সুশেকে ভালোবাসি বলে।




Comments

  1. Kuntala di, bachale!

    Ami goto koyek din dhore bhabchi je prokashhey jodi bolei feli, ke retire korlo na korlo tate amar kissu jay ashe na, tahole ki amar kopale gonodholai jutbe? sahosh korini, ajke tumi o ek i sure kotha bolle dekhe aram laglo :)

    David Suchet ke ami chintam na. ekdin hoddo bore hoye Miss Marple er protita series pore "and" dekhe felar por bhablam, Poirot ta o dyakha jak, khoti ki? Byas. Onorgol dekhe gelam. Agatha Christie-r ki khomota chilo, bolo? ek dike Miss Marple er moton ghoroya, kotha theke ki hoye gyalo crime, aar ekdike Poirot-r calculated deductions, as logical as it can get crime, mohisoyi mohila!

    ReplyDelete
    Replies
    1. আসলে লেবু কচলাতে লোকের এত ভালো লাগে যে কখন ব্যাপারটা অসহ্য তিতকুটে হয়ে যাচ্ছে সেটা আর মাথায় থাকে না। আমি শিওর আমি তুমি একা নই সুমনা, অনেকেরই বিষয়টায় নাভিশ্বাস উঠেছে।

      আগাথা ক্রিস্টিকে নিয়ে কোনও কথা হবে না। ডেভিড সুশে হারকিউল পোয়্যারোর চরিত্রে অভিনয় না করলে আমরা অনেকেই ওঁকে চিনতাম না, যেটা খুবই স্যাড হত।

      Delete
  2. আমিও সচিনের রিটায়ারমেন্ট নিয়ে কিছু লিখব নাই ঠিক করেছিলাম, কারণ সবাই লিখে আর কিছু লেখার বাকি রাখেনি। অবশ্য আমি সচিনের ভক্ত নয় তা বললে ভুল হবে, আগে ব্লগ লিখেওছি সচিনকে নিয়ে, কিন্তু এবারে আর ইচ্ছে করলনা।

    ডেভিড সুশে আর পোয়ারোর ব্যাপারে এক্কেবারে একমত - পোয়ারো বললে সুশে ছাড়া কারুর কথা ভাবতেই পারিনা। পোয়ারোর শেষ সিজনটা সবে দেখা শুরু করেছি। বাকিগুলো বেশিরভাগই একাধিকবার দেখা। আর নতুন এপিসোড হবেনা ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আর সিরিজটাও কি অনবদ্য! যেমন অভিনয়, তেমনি সেট, তেমনি পরিচালনা, তেমনি কস্টিউম ডিজাইন। ২৪ বছরে কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রীকে আলাদা চরিত্রের রোলে রি-ইউস হতে দেখলামনা। এদিকে সন্দীপ রায় পর পর দুবছর দুটো ফেলুদা বানালে সে দুটোয় পরান বন্দ্যোপাধ্যায় কে দিয়ে দুটো আলাদা রোল করান। দেখেও তো মানুষ শিখতে পারে?

    দেভ-এর উচ্চারণের ব্যাপারে একমত, কিন্তু আপাতত তার বেশি কিছু বলবনা কারণ ট্রেলারের বাকিটা আমার ভয়ানক পছন্দ হয়েছে। সিনেমাটা দেখা অবধি মতামত মুলতুবি রাখলাম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনার কমেন্টের শেষ থেকে শুরু করি সুগত। আপনি ঠিকই বলেছেন, মতামত মুলতুবি রাখাই উচিত, কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখতে হবে যে ট্রেলরের বাকিটুকুতে যে অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য, বাঘসিংহ দেখা যাচ্ছে, সিনেমাটার সিংহভাগে কিন্তু তারা থাকবে না। সিনেমাটার সিংহভাগ জুড়ে থাকবে ওই বাংলাটা, যার নমুনা ট্রেলরের শেষ পাঁচ সেকেন্ডে পাওয়া গেছে।

      পোয়্যারো ইজ ইকুয়্যাল টু সুশে। অ্যান্ড ভাইসি ভার্সা। এ ব্যাপারে আমার আপনার সঙ্গে হায়েস্ট ফাইভ।

      Delete
  3. Ahhh, bnachale Kuntala di! Ei sedin Facebookey ei article tar songe sohomot prokash koray, gushtishuddhu lok eshe amay ki tulodhona tai na korlo!

    http://www.epaper.eisamay.com/Details.aspx?id=7467&boxid=4272746

    Birokto hoye kichhudin log in-i korini ar. Jottosob. (Ar tumi thik bolechho, post er title dekhei ami pray pogarpaar hochchhilam ar ki.)

    David Suchet niye kono kotha hobe na. Ekdom boss typer. (Ar Deb er golata dub korte parlo na kano? Ki ashchorjo.)

    ReplyDelete
    Replies
    1. তোমার তো ভীষণ সাহস বিম্ববতী, তুমি প্রকাশ্যে এই বাজারে ও লেখার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করতে গেছ? আরে উনি তো খবরের কাগজের বর্মের আড়ালে বসে লিখেছেন, তুমি তো জ্যান্ত রক্তমাংসের মানুষ, লোকের হাতের নাগালে ঘোরাফেরা করছ। এত রিস্ক নিতে আছে, বালাই ষাট?

      কী জানি কেন ডাব করেনি। আমার কাছেও সেটা একটা রহস্য ঠেকছে।

      Delete
  4. Kalke dekhlam curtain:Poirot's last case. Mon ta eto kharap ki bolbo. Maasher por maash opekhya kortam notun episode er jonno, opekhya kortam dekhte Eibar poirot r gomph ta ki rokom hobe, Hastings ke Eibar koto ta ridicule korbe... Shesh hoye gelo shob poirot r adventure. Shei 1930 s er Art Deco set, dress Shirts, pocket watch, patent leather er juto, pince-nez... Bujhtei parchho moner ki obostha amar. Sigh!

    ReplyDelete
    Replies
    1. ইস রাকা, তোমার কমেন্ট পরেই আমি আরও ডবল শিওর হয়ে যাচ্ছি যে আমি কার্টেন দেখব না। প্রোডাকশন সত্যি অসম্ভব ভালো। আমি সুশের কথাই খেলিয়ে লিখলাম বটে, কিন্তু বাকিটাও অনবদ্য, তুমি ঠিকই বলেছ।

      Delete
  5. টমি আর টাপেন্সকে ভালো লাগে না?

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই রে অদিতি, এবার সত্যি কথাটা বলতে হবে, লাগে না।

      Delete
    2. আহা তাতে কী, আমি কি খেলব না বলেছি নাকি৷

      Delete

Post a Comment