The Luminaries





অক্টোবরের মাঝামাঝি এক ঝলমলে রোদওঠা দুপুরবেলা বেড়াতে বেরিয়েছিলাম। আমার সেদিনের ভ্রমণের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল Pantheon দেখা আর এরিক কাইসারের বুটিক বেকারির Pain au Chocolat খাওয়া রুশো-ভলতেয়ারের সমাধিওয়ালা গর্ভগৃহ আর ফুকোর পেন্ডুলাম যেখান থেকে ঝোলানো হয়েছিল সেই সিলিং দেখে, ছবি তুলে, কাইসারের দোকান থেকে পাউরুটির থলি হাতে বেরিয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটতেই দেখি নদীর ধার, নদীর ধারে René Viviani-র চত্বরআর অমনি আমার মনে পড়ে গেল চত্বরের ওপাশেই একটা বইয়ের দোকান দেখেছিলাম না?

দোকানে ঢুকে নতুন বইয়ের টেবিলটার দিকে তাকিয়ে দেখি বাকি সব বইয়ের মাথার ওপর থান ইটের মতো গ্যাঁট হয়ে চেপে বসে আছে এলেনর কাটনের দ্য লুমিনারিস্‌। দু’হাজার তেরোর ম্যান বুকার বিজয়ী বই। যেমন তেমন বিজয়ী নয়, ম্যান বুকারের ইতিহাসে সব থেকে কমবয়সী লেখকের লেখা বিজয়ী বই। কাজেই কিনতেই হল। অক্টোবরের বইয়ের বাজেট যদিও ফুরিয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই, তবুও।

বই হাতে নিয়ে কাউন্টারে এসে দেখি সেখানে একটা ছোটখাটো আড্ডা চলছে। কাউন্টারের ওদিকে একজন, আর এদিকে দুজন তিনজনেরই চোখে চশমা, গালে দাড়ি, মাথাভর্তি উশকোখুশকো চুল। আমি  বই নিয়ে ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকায় তাদের আড্ডায় বাধা পড়ল। আমার দিকে একবার শীতল দৃষ্টি হেনে কাউন্টারের এপাশের একজন বলল, ‘যাই জ্যাকেটটা ওপরে রেখে আসি গিয়ে।’

বুঝলাম ইনি দোকানের ওপরেই বাস করেন। দুজন ওপরে চলে গেল, আমি তাদের ছেড়ে যাওয়া জায়গাটা দখল করে কাউন্টারের ওপর বইটা নামিয়ে রাখলাম।

কাউন্টারের ছেলেটার ভুরুদুটো সামান্য উঠল। পাশে রাখা স্ক্যানারটা হাতে তুলে নিয়ে বারকোডে টিপ করতে করতে ছেলেটা বলল, ও-ও নাকি বইটা পড়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তারপর ঠোঁটের কোণটা সামান্য বেঁকিয়ে হাসির একটা ভঙ্গি করে জুড়ে দিল, ‘জাস্ট টু সি হাউ মাচ ওভার-হাইপড্‌ দ্য হোল থিং ইস্‌।’

রাস্তাঘাটে এ’রকম মনের মিলওয়ালা লোকজনের দেখা পেলে কী ভালো লাগে না? আমি কাউন্টার চাপড়ে বলে উঠলাম, ‘আরে আমিও কিনছি তো সেই জন্যই। আঠাশ বছরে বুকার, ইয়ার্কি হচ্ছে? এক্সপেরিয়েন্সের দরকার নেই? মানসিক পরিণতির দরকার নেই? সাত ঘাটের জল খেয়ে জীবনের মানে বোঝার দরকার নেই?’ ছেলেটা খুব দুঃখী মুখ করে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘নেই যে সে তো দেখাই যাচ্ছে।’ তারপর বইয়ের প্রথম পাতায় শেকস্‌পিয়ারের মুখ আঁকা স্ট্যাম্পটা মেরে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘কী আর করা, নিয়ে যাও, পড়ে দেখো, কেমন লাগে।’

কেমন লাগল সেই কথা বলতেই আজকের পোস্ট।

যে কোনও বই সম্পর্কে বিশেষজ্ঞের মতামত জাহির করতে গেলেই অর্চিষ্মান আমাকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘আহা, আগে বল গল্পটা কী।’ তাই আপনাদেরও গল্পটা বলেই শুরু করছি

গল্পটা অবশ্য বলার মতোই। আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগের কথা। ক্যালেন্ডার দেখে বলতে গেলে বলতে হবে সালটা হচ্ছে আঠেরোশো ছেষট্টি। নিউজিল্যান্ডের পাথুরে মাটিতে তখনও তাল তাল কাঁচা সোনা লুকিয়ে আছে, সে সোনা খুঁড়ে তুলবে বলে সারা পৃথিবী থেকে ভাগ্যসন্ধানীরা জাহাজ বোঝাই করে নিউজিল্যান্ডের বন্দরে এসে ভিড়ছে প্রতিদিন।

ওয়ালটার মুডিও এসেছে। নিজের অতীত থেকে পালাতে পালাতে এসে ঠেকেছে হোকিটিকা বন্দরে। হোকিটিকা তখন সোনা-খুঁজিয়েদের স্বর্গরাজ্য। ওটাগার খনির সোনা খুঁড়তে খুঁড়তে তলানিতে ঠেকেছে প্রায়। কাজেই সবাই এসে ভিড় জমিয়েছে হোকিটিকায়।

গডস্পিড নামের জাহাজে চেপে ওয়ালটার এসে নামে হোকিটিকায়। শারীরিক, মানসিকভাবে পর্যুদস্ত হয়ে। জাহাজে কী যেন একটা ঘটনা ঘটতে দেখে ভয়ে, আতঙ্কে ওয়ালটার অভিভূত হয়ে আছে। তুমুল ঝড়বৃষ্টির সন্ধ্যেয়, কোনওমতে নিজের কাগজপত্রগুলো বুকে চেপে, কাঁপতে কাঁপতে সে এসে আশ্রয় নেয় ক্রাউন হোটেলে।

ভবিতব্য আর কাকে বলে (ভবিতব্য কাটনের বইয়ের একটা ভীষণ জরুরি চরিত্র, সে কথায় পরে আসছি), সেই সন্ধ্যেতেই ক্রাউন হোটেলে একটা গোপন মিটিং বসেছিল। টুয়েলভ অ্যাংরি মেন। ওই কমন অ্যাংগারটা ছাড়া যাদের চেহারা, শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের মিল সামান্যই। ওয়ালটার কি সেই মিটিং-এ বাদ সাধল? নাকি নিজেও ভিড়ে গেল দলে? গডস্পিড জাহাজের যে অভিজ্ঞতা ওয়ালটারকে আমূল ঝাঁকিয়ে দিয়েছে, যার কথা কোনওদিন কারও কাছে উচ্চারণ করবে না বলে শপথ করেছে সে নিজের কাছে, তার সঙ্গে কি কোনও সম্পর্ক আছে এই গোপন মিটিং-এর?

আঠেরোশো ছেষট্টির হোকিটিকায়, সোনা আর আফিং-এর নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা গোল্ড-ডিগারের দল, হৃত ঐতিহ্যের গর্বে গর্বিত মাওরি যুবক---জীবনধারণের উপায় যার কাছে কমতে কমতে এসে ঠেকেছে খনির মজুরগিরিতে, ওষুধের দোকানের আড়ালে আফিং-এর ব্যবসা চালানো কেমিস্ট, ফরাসি কলমচি, পিতৃহত্যার প্রতিশোধের শপথ বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো চায়নাম্যান, চিত্তদৌর্বল্যের ফাঁদে পড়া রাজনীতিক, নির্মম আইনরক্ষক, মৃতব্যক্তির আত্মাদের আবাহন করা বুজরুক বিধবা, ভ্যানিশ হয়ে যাওয়া তরুণ ধনী উদ্যোগপতি, চোরাই সোনাভর্তি কুটিরের ভেতর হাতে বিষের বোতল নিয়ে চিরঘুমে তলিয়ে যাওয়া একলা একটা ছিন্নমূল মানুষ---আর এদের সবার জীবনের যোগসূত্র হয়ে বিরাজমান “লেডি অফ দ্য নাইট” আনা। এদের সবাইকে নিয়ে প্রায় সাড়ে আটশো পাতার এক মহাগল্প ফেঁদে বসেছেন কাটন।

পরিশ্রমের ছাপ দেখলে কি আপনি ইমপ্রেস্‌ড্‌ হন? গভীরে গিয়ে রিসার্চ, খুঁটিনাটির ওপর পুঙ্খানুপুঙ্খ নজর এসব দেখলে কি আপনার মন ভালো হয়ে যায়? তাহলে দ্য লুমিনারিস আপনার ভালো লাগবে।

একটা রহস্য গল্পের কঙ্কালের ওপর রক্তমাংস চাপিয়ে গোটা একটা জগৎ তৈরি করেছেন কাটন। আমারআপনার হেঁটেচলে বেড়ানো জগতের সঙ্গে সে জগতের কোনও মিল নেই। সময়, সমাজ, সমাজের নিয়মকানুন, সব আলাদা। কাটনের লেখার গুণে সে সব বাস্তবের থেকেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বইটা শেষ করার পর মনে হচ্ছে হোকিটিকার রাস্তাঘাট আমি প্রায় রিষড়ার রাস্তাঘাটের মতোই চিনি।

মানুষগুলোকে তো চিনিই। তাদের লোভ, ঈর্ষা, কাম, স্নেহ, প্রতিহিংসা, প্রেম, রেসিজম্‌---সব চিনি। এই ভীষণ ভেতরের জিনিসগুলো পালটে যাওয়ার পক্ষে দেড়শো বছর যথেষ্ট লম্বা সময় নয় বলেই চিনি। আফিং-এর দোকান আর সোনার খনির বর্ণনা যদি উড়িয়েও দিই, কিন্তু প্রায় পনেরোখানা মুখ্য চরিত্রের এমন নিখুঁত চিত্রণকে ওড়াব কী বলে? নিড়বিড়ে ব্যাঙ্ককর্মী থেকে শুরু করে দোর্দণ্ডপ্রতাপ পলিটিশিয়ান---প্রতিটি চরিত্রকে সিনেমার মতো সামনে এনে হাজির করেছেন কাটন। আর সেটা করতে গিয়ে, এতগুলো লোককে তাদের সমস্ত ভালোমন্দ, সুখদুঃখ, ঘোরপ্যাঁচশুদ্ধু সমকালীন সমাজের প্রেক্ষাপটে ফেলে, একই গল্পের বঁড়শিতে গেঁথে তুলতে গিয়ে একটা ভয়ানক জটিল গোলকধাঁধা ফেঁদে বসতে হয়েছে কাটনকে।

আমার মতে, এই গোলকধাঁধাটাই হল দ্য লুমিনারিস্‌-এর মূল সুর। আটশো বত্রিশ পাতা আর বারো চ্যাপ্টারের বইয়ের প্রথম চ্যাপ্টারটাই হচ্ছে তিনশো ষাট পাতার কাছাকাছি। এ চ্যাপ্টারে আমরা ঘটনাটা কী ঘটেছে সেটা প্রথম জানতে পারি। বা বলা ভালো, জানার চেষ্টা করতে পারি। ঘটনার বর্ণনা মূলত সংলাপভিত্তিক। এ ওকে বলছে, সে তাকে বলছে, সে আবার একে বলছে। সবাই নিজের নিজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলছে বলাই বাহুল্য। চ্যাপ্টারটা শেষ করার পর আপনি যদি আমাকে পড়া ধরতেন যে ঘটনাটা সত্যি কী ঘটেছে, আমি ভাসাভাসা একটা আউটলাইন আপনাকে দিতে পারতাম, কিন্তু ওইটুকুই।

পুরো বইটা পড়ার পরেও কি পারব? প্রথম চ্যাপ্টারের থেকে ভালো পারব অফ কোর্স, কিন্তু সেটা যে একেবারে নির্ভুল হবে সে আত্মবিশ্বাস আমার নেই। যদিও কাটনের আছে। ইন ফ্যাক্ট গল্পের অলিগলি বেয়ে, পারম্পর্যের আগুপিছুতে ক্রমাগত ঠোক্কর খেতে খেতে, একটা থেকে আরেকটা পয়েন্ট অফ ভিউতে অবিরত ঝাঁপ দিতে দিতেও যে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে না, তার অন্যতম কারণ লেখকের আত্মবিশ্বাস। হাতের তার তো লাগেই, ভালো গল্প বলতে গেলে আরেকটা জিনিসও লাগে, সেটা হচ্ছে পাঠকের মনে ভরসা জাগাতে পারা। ঘটনার চরম ঘনঘটার মধ্যে দিয়ে এগোতে এগোতে যখন একূলওকূল দেখা যাচ্ছে না, তখন ‘ভয় নেই ভয় নেই’ বলে শক্ত হাতে দাঁড় বেয়ে যাওয়ার দুঃসাহস যাঁর থাকে, আমার মতে তিনিই আদর্শ লেখক।

এলেনর কাটনের সে সাহস পর্যাপ্ত আছে। সত্যি বলতে কি আমার ধারণা, দরকারের থেকে খানিক বেশিই আছে। এক রিভিউয়ার দেখলাম দ্য লুমিনারিস্‌-কে বর্ণনা করার সময় ‘সেলফ্‌-ইনডালজেন্স’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন। খুব যে ভুল কিছু করেছেন তা নয়। পড়তে পড়তে (খাবি খেতে খেতে বলা উচিত, যদিও খুবই মনোহর খাবি সেটা আমি হাজারবার বলব।) আমি কাটনকে কল্পনা করতে পারছিলাম। লিখছেন, প্লট সাজাচ্ছেন, চরিত্রদের ভাঙছেনচুরছেন---আর যেই মুহূর্তে চোখের সামনে গল্পের গতিপথ স্পষ্ট ফুটে উঠছে, অমনি আঙুল দিয়ে সে রাস্তা ঘেঁটেঘুঁটে দিচ্ছেন। নিজের কাজটা কী করে আরও জটিল করে তোলা যায়, সেটাই যেন তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য।

তবে জটিল আর ভালো তো সমার্থক শব্দ নয়। দ্য লুমিনারিস্‌-এর কিছু কিছু জটিলতা আমার, খারাপ লেগেছে বলব না, তবে অপ্রয়োজনীয় লেগেছে। সত্যি বলতে কি এই লুমিনারিস্‌-এর অ্যাংগেলটার কথাই যদি ধরি। গ্রহনক্ষত্রের চলাফেরা, একে অপরের কক্ষপথে অবিরাম ঢুকে পড়া, ছেড়ে যাওয়া এই থিমটাকে গল্পের মধ্যে বুনে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এলেনর আপ্রাণ। যদি না করতেন, গল্পের কোথাও কম পড়ত কি না সে নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। বারোটি রাশি, বারোটি মানুষ, বারোটি অধ্যায়। সে অধ্যায়ের অগ্রগতির সঙ্গেও মহাজাগতিক চালচলনের মিল আছে। তিনশো ষাট পাতার প্রথম অধ্যায়টিই গল্পের দীর্ঘতম, তারপরের এগারোটি চ্যাপ্টার একে অপরের থেকে ক্রমশ ছোট হয়েছে। শেষ চ্যাপ্টারটির পৃষ্ঠাসংখ্যা মোটে দুই। গ্রাসের দীর্ঘ ছায়া পেরিয়ে অবশেষে চারদিক আলোয় আলো।

তবে যিনি এমন লিখতে পারেন, তিনি যদি সেলফ্‌-ইনডালজেন্ট হনও, আমি তাতে কিচ্ছু দোষের দেখি না। এলেনর কাটনের খুঁত ধরব বলে তাঁকে দোকান থেকে তুলে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম, আমার সে উদ্দেশ্য মাটি হয়েছে। এলেনর কাটনের বয়স মোটে আঠাশ জেনে একসময় ক্ষোভ হয়েছিল, এখন সে তথ্যটা মনে পড়লে খালি আরামই লাগছে। আরও অনেকদিন লিখবেন কাটন, আর আমি আরও অনেকদিন ধরে তাঁর লেখা পড়ার সুযোগ পাব।

Comments

  1. তাহলে কিনব বলছিস্‌?

    ReplyDelete
  2. tomar lekha pore boita ekhuni kinte ichha korchhe. tobe onek gulo boii list e dhuke porechhe, kinbo kinbo kore konotai kena hochhena, boi er dokane dhuke onyo kichhu kine berie aschhi, na ebar eta kintei hochhe.

    ReplyDelete
    Replies
    1. কিনে ফেলুন ইচ্ছাডানা, আমার মনে হয় ভালো লাগবে।

      Delete
  3. Eki. Amaro Octoberer boi er budget shesh hoye gachhe. Ki kori ebar? :(

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, আরে বিম্ববতী, নভেম্বরে কেনো। তবে আমার বিশ্বাস তোমার বইটা ভালো লাগবে।

      Delete
    2. তোর ক্যালেন্ডার নেই বিম্বো? সেলফোনেও না?

      Delete
  4. "...if page 534 finds us only in the second chapter, the length of the first one must have been really intolerable." ~Sherlock Holmes (The Valley of Fear)
    পড়বার ইচ্ছে রইল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, বইটা একটু বাড়াবাড়ি রকমের বড়, তবে কোনওদিন সময় বা ইচ্ছে হলে পড়ে দেখতে পারেন।

      Delete
  5. kine fellam..jonmodine nijei nijeke dilam eta..ebar yatra shuru.thanks karon prothom abantorei khoj peyechilam boi tar

    ReplyDelete

Post a Comment