লিটল সাইগন, হজ খাস মার্কেট



উবার-এর সহযাত্রীদের টাইপসংক্রান্ত পোস্ট লেখার সময় একখানা টাইপ আমার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। এঁরা হচ্ছেন সেই টাইপ যাঁরা কথা না বলে থাকতে পারেন না। ড্রাইভারের সঙ্গে দরকারি কথোপকথন শেষ হওয়া মাত্র ব্যাগ থেকে ফোন বার করে লোক শিকারে বেরোন। অনেক সময় উল্টোদিকের লোকটি আগ্রহীও থাকেন না, তা এদিকের “অওর বাতাও”, “অওর বাতাও”-এর ঘনঘটা দেখেই বোঝা যায়। কিন্তু কখনও কখনও মণিকাঞ্চনযোগ ঘটে, যেমন সেদিন ঘটেছিল, আর সেই যোগে আমার মতো উলুখাগড়ার লাভ হয়। 

সেদিন তিনটে ফোন “অওর বাতাও”-এ শেষ হওয়ার পর চতুর্থ ফোনে আমার সহযাত্রীর শিকে ছিঁড়ল। উল্টোদিকের লোকটিও সঙ্গের জন্য হন্যে হয়ে ছিলেন, তিনি একেবারে ডিনারের প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। ইনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, “শিওর শিওর, কাহাঁ পে? হ্যাভ ইউ বিন টু লিটল সাইগন? নো? লেট’স গো টু লিটল সাইগন দেন।”

সে রাতের মতো একা ডিনার খাওয়ার সম্ভাবনা এড়াতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে সহযাত্রী সিটে হেলান দিয়ে বসলেন। আমার গন্তব্য এসে গেল। আমি নেমে বাড়ি চলে এলাম, লিটল সাইগন নামটা মগজের ভেতর জেগে রইল। 

নামটা একেবারে অচেনা নয়। অনেকদিন আগে শুনেছিলাম, ভুলেও গিয়েছিলাম। কেন কে জানে। ভিয়েতনামিজ খাবারের জন্য ওঁত পেতে থাকি, বান মি-র গন্ধে গন্ধে গুড়গাঁও পর্যন্ত ধাওয়া করেছি, অথচ হজ খাস মেন মার্কেটের লিটল সাইগন-এর নাম শোনা সত্ত্বেও ভুলে গেছি। জোম্যাটো খুলে চোখ কপালে উঠল। রেটিং পাঁচে চার। রিভিউর পর রিভিউ জুড়ে শুধু প্রশস্তি, “অথেনটিক”, “ইয়াম্মি”, “রিমাইন্ডেড মি অফ দ্য ইয়ার অমুক হোয়েন আই ওয়াজ অন সাইট ইন ভিয়েতনাম।”

আর নিজেকে ভুলতে অ্যালাউ করলাম না। নিজেকে ভুলতে না দেওয়ার একমাত্র রাস্তা হচ্ছে হাতের কাছে যাকে পাওয়া তাকে অহোরাত্র মনে করানো। অষ্টপ্রহর লিটল সাইগন লিটল সাইগন করে অর্চিষ্মানের কানের পোকা ঝালাপালা করে দিলাম, অবশেষে শনিবার দুপুরে উবার ডেকে চলে গেলাম হজ খাস মেন মার্কেট। 

যেটা হজ খাস ভিলেজের থেকে আলাদা। ইদানীং কিছু কিছু লোক, কোনও কোনও জায়গার কাছাকাছি এলে নিজের বাড়ন্ত বার্ধক্য টের পাই, হজ খাস ভিলেজ তার মধ্যে একটা। শেষ যেবার হজ খাস ভিলেজে গিয়েছিলাম সেদিন ছিল দিল্লি ইউনিভার্সিটির ভোট। ভিলেজের চেহারা দেখে “মাগো” ছাড়া আর কোনও কথা বেরোয়নি আমার মুখ থেকে। আমার স্বীকার করে নিতে লজ্জা নেই, হজ খাস ভিলেজ আমার পক্ষে এখন টু কুল, টু হিপ, টু ইয়ং।

আমার পক্ষে বরং ঢের সুটেবল হজ খাস মেন মার্কেট। দিল্লির আর পাঁচটা মার্কেটের মতই, লাভলি ড্রাই ক্লিনারের পাশে মেহরা জেনারেল স্টোর্সের পাশে স্টেট ব্যাংক অফ পাতিয়ালা। আর এই স্টেট ব্যাংক অফ পাতিয়ালার পাশেই লিটল সাইগন। 


ভাগ্যিস ফোন করে গিয়েছিলাম। ঠেসেঠুসে চোদ্দ জন বসা যায়, তার মধ্যে আটজনের জায়গা অলরেডি বুকড। আমাদের ভাগ্যে জুটল একটা প্লাস্টিকের চেয়ার, একটা প্লাস্টিকের টুল। আমরা থাকতে থাকতেই কিছু খদ্দের এসে ফিরে গেলেন কারণ তাঁদের বুকিং ছিল না। 

এর থেকে কম সাজাগোজা রেস্টোর‍্যান্ট আর হতে পারে না। প্লাস্টিকের চেয়ারটেবিলের কথা তো আগেই বললাম, দু’খানা টেবিল দেখলাম আসলে রিসাইকেলড সেলাই মেশিনে স্ট্যান্ড। তকতকে পরিচ্ছন্ন দোকানে সাজ বলতে দেওয়ালে ঝোলানো কয়েকটি ভিয়েতনামিজ (আমি অ্যাকচুয়ালি জানি না ওগুলো কোন দেশী, ভিয়েতনামিজ দোকান বলে ধরে নিচ্ছি ভিয়েতনামিজই হবে) টোকা।

যাই হোক, সাজ দেখতে তো যাইনি, গেছি খেতে। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে দশ হাত দূরের ঘষা প্লাস্টিকের সুইং ডোরের ওপারে রান্নাঘরে একটা কী যেন ফোড়ন দিল আর তার গন্ধে আমাদের খিদে একেবারে তুঙ্গে। পত্রপাঠ অর্ডার করলাম। 


ফ গা। ভিয়েতনামিজ চিকেন সুপ। স্বচ্ছ সুপের মধ্যে মোটা মোটা রাইস নুডলস, চিকেনের টুকরো, লাল লংকাকুচি। আপাদমস্তক মিনিম্যালিস্টিক। সোজা, কিন্তু সরল নয়। ওই যে পরিষ্কার টলটলে ঝোল, ওর মধ্যে টক ঝাল মিষ্টি উমামির কত পরত যে লুকিয়ে আছে, নিয়মিত খেলে মনের না হোক, শরীরের ক্লেদ, গ্লানি ধুয়ে যেতে বাধ্য। ওঁরা কতক্ষণ রেঁধেছিলেন ভদ্রতার খাতিরে আমি জিজ্ঞাসা করিনি, কিন্তু আমি শুনেছি এই ঝোল রাঁধতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগে। 


এই খাবারটার মেনুতে নাম লেখা আছে 'লিটল সাইগন প্লেটিং'। বেসিক্যালি জিনিসটা হচ্ছে একটা ডিকনস্ট্রাকটেড র‍্যাপ। আপনাকে সেটা আবার রিকনস্ট্রাকট করে খেতে হবে। র‍্যাপে থাকে অবশ্যই তাজা লেটুস, ঠাণ্ডা ঝুরঝুরে নুডলস, লাল টুকটুকে টমেটো, পর্ক বার্গার, বাদামের গুঁড়ো, আর লেটুসের পাতার পাশে যে সবুজ পাতার গোছা, তাতে আছে বাসিল, পুদিনা ইত্যাদি, আপনার ইচ্ছেমতো সেগুলো ব্যবহার করতে পারেন। আর অফ কোর্স, ফিশ সসে চুবোনো লাল লংকা। 


লিটল সাইগনের লেটুসও তাজা, টমেটোও সজীব, নুডলসও ঝরঝরে, পুদিনা বাসিলও সুগন্ধী, আর পর্ক বার্গারও অতীব সুস্বাদু। কাজেই গোটা ব্যাপারটাও ভালো। তবে এধরণের র‍্যাপ বানিয়ে আমরা শিম টুর-এ আগে খেয়েছি। এবং গ্রাউন্ড পর্কের বদলে গোটা পর্কের টুকরো ব্যবহারের জন্যই হোক বা রসুনের উপস্থিতির জন্যই হোক, বা আর কিছু না হলেও, রান্নাটা যে আমাদের চোখের সামনে ঘটছে সেই চমকের জন্যই হোক, আমাদের বেশি ভালো লেগেছিল। 


চিংড়িমাছ পোরা সামার রোলও আমাদের খাওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু পেটে আর জায়গা ছিল না। তাছাড়া মেনুর কোকোনাট আইসক্রিমটা খেতেই হত। এ জিনিসটা আসে গ্লাস জেলির সঙ্গে, কিন্তু গ্লাস জেলি ফুরিয়ে গিয়েছিল, তাই আমরা শুধু শুধু আইসক্রিমই খেলাম। এর সঙ্গে ন্যাচারাল-এর টেন্ডার কোকোনাট আইসক্রিমের কোনও মিলই নেই। ওটা মসৃণ, এটায় দানা দানা নারকেল মুখে পড়ে। লক্ষ্মীপুজোর চিনির নাড়ু যদি আইসক্রিম হিসেবে আপনাকে খেতে দেওয়া হয় তাহলে যেমন হবে, লিটল সাইগনের কোকোনাট আইসক্রিম অবিকল সেরকম খেতে। তবে নাড়ুর থেকে মিষ্টিটা একটু হালকা। 


লাস্টে কনডেন্সড মিল্ক ঢালা ভিয়েতনামিজ কফি। খেয়ে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবার থেকে নিজেরাও সপ্তাহে একদিন অন্তত দুধের বদলে মিল্কমেড দেওয়া কফি খাব।

লিটল সাইগন আমাদের দুজনেরই দারুণ ভালো লেগেছে। এই শীতের ক’মাসে যদি আরও বারচারেক ওখানে গিয়ে অন্তত সুপটা না খাই তাহলে খুবই বোকামো হবে।

এই পর্যন্ত লিখে লিটল সাইগনের গল্প থামানো যেতে পারত কিন্তু গল্পের হিরোর কথাই তাহলে বলা হত না। লিটল সাইগনের হিরো হচ্ছেন হ্যানা হো। দিল্লির তাজ প্যালেসে ব্লু জিঞ্জার রেস্টোর‍্যান্টের (যেটা এখন বন্ধ হয়ে গেছে) ভিয়েতনামিজ রান্নার দায়িত্বে ছিলেন হ্যানা। ব্লু জিঞ্জার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তিনি লিটল সাইগন খোলেন। তিনিই লিটল সাইগনের মালিক, রাঁধুনি (তাঁর এক আত্মীয় তাঁকে রান্নায় সাহায্য করেন), ম্যানেজার, অতিথিআবাহক, অর্ডারগ্রাহক এবং টেবিলপরিষ্কারক। (মহিলা নাকি আবার আমারই বয়সী, যাকগে সে কথা মনে করে আর কষ্ট পাওয়ার দরকার নেই।) তাছাড়াও আমি নিশ্চিত আমি যেটুকু দেখতে পাচ্ছি সেটা একটা গোটা রেস্টোর‍্যান্ট চালানোর যাকে বলে ওনলি টিপ অফ দ্য আইসবার্গ, বাকি সব কাজও হ্যানাকেই সামলাতে হয়।

আমি বলছি না, হ্যানা-র এই অসামান্য পরিশ্রমের মর্যাদা দিতে আপনি হজ খাস মার্কেটের লিটল সাইগন-এ একদিন খেয়ে আসুন। লিটল সাইগন-এ আপনার এমনিই খেতে যাওয়া উচিত, স্রেফ খাবারগুলো ভালো বলেই। কিন্তু যদি যান তাহলে হ্যানা-র পরিশ্রমও পুরস্কৃত হয়, এই আরকি।


Comments

  1. এঁরা হচ্ছেন সেই টাইপ যাঁরা কথা না বলে থাকতে পারেন না। ড্রাইভারের সঙ্গে দরকারি কথোপকথন শেষ হওয়া মাত্র ব্যাগ থেকে ফোন বার করে লোক শিকারে বেরোন।

    eta puro ami....

    khabar gulo darun..roj e khawa jay..sasthokor puro..khub bhalo..enzoy

    prosenjit

    ReplyDelete
    Replies
    1. এটা ঠিক বলেছ, প্রসেনজিৎ। রোজই খাওয়া যায়।

      Delete
  2. Thanks for the recommendation, will try to visit soon. BTW er moddhe aamra ekdin HKV Deer park ar samner restaurant gulo ghurechhilam. Looks like you don't want to go to HKV, but if you do, you may try 'Lama Kitchen' - for Tibetan, Nepalese or Sikkim cuisine :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে না না, সেদিনের অভিজ্ঞতাটা একটু ওভারডোজ হয়ে গিয়েছিল বলে ওরকম বলেছি, লামা কিচেন নিশ্চয় ট্রাই করে দেখব। লিটল সাইগন এখন বোধহয় একমাস বন্ধ থাকবে, কারণ মহিলা ভিয়েতনাম গেছেন। যাওয়ার আগে অবশ্যই ফোন করে যাওয়া ভালো। আর আমরাও বার্মা বার্মা-য় গিয়ে উঠতে পারছি না, এবার যাবই।

      Delete

Post a Comment