আজকাল আমরা বাইরে কম খাই কেন
ট্যাক্স সিজন যাওয়ার পর আমাদের বাড়িতে এখন সেভিং সিজন চলছে। এমনি টাকা খরচ হলে অত গায়ে লাগে না, যত বুক হু হু ট্যাক্সের বেলায়। ট্যাক্স না দেওয়ার প্রশ্ন কিংবা সাহস কোনওটাই নেই, অগত্যা পড়ে থাকে একটিমাত্র বিকল্প। ট্যাক্স জমা দিয়ে শপথ নেওয়া, এবার থেকে খরচা কমাব।
প্রতি বছরই শপথ নেওয়া হয়, প্রতি বছরই প্রথম ক’টা দিন খুব তেড়েফুঁড়ে সংযম প্র্যাকটিস হয়, তার পর আবার ঢিলেমো সেট ইন করে। এ বছর সেটা হতে দেওয়া চলবে না। আমরা কষে কোমর বেঁধেছি। মেথডিক্যালি এগোচ্ছি যতখানি সম্ভব।
খরচ কমানোর প্রথম ধাপটা হচ্ছে খরচ কোথায় কোথায় কমানো সম্ভব তা চিহ্নিত করা। বা ঘুরিয়ে বললে, কোথায় বাজে খরচ হচ্ছে, নির্দয় হয়ে নিজেকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো।
বলাই বাহুল্য, বাজে খরচের সংজ্ঞা প্রতিটি মানুষের কাছে আলাদা। জাত, ধর্ম, প্রিয় খাবার, প্রিয় লেখক, কত কিছু দিয়ে মানুষ বিচারের বন্দোবস্ত আছে পৃথিবীতে, আমার মতে এদের সবার থেকে এফেক্টিভ বিচার হচ্ছে খরচের অভ্যেস। কে কোথায় খরচ কমায় বা কিপটেমো করে সেটা একটা ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার স্টাডি হতে পারে। আমি একজনকে চিনি যে প্রচণ্ড গরম কিংবা প্রচণ্ড শীতেও বাস ছেড়ে অটো চড়ে না। কারণ বাসের ভাড়া পাঁচ আর অটোর পঞ্চাশ। আর যদি বিনামূল্যে হেঁটে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকে তাহলে তো অটোও বাদ। অ্যাফর্ড করতে না পারার প্রশ্ন নেই, কারণ তার বাবা উইপ্রো কোম্পানির পাঁচজন বৃহত্তম শেয়ারহোল্ডারের মধ্যে একজন। এর খরচের প্রায়োরিটি আলাদা। অটো চড়ে না, কিন্তু অম্লানবদনে হার্ভার্ডের এম পি এ ডিগ্রি নিজেকে গিফট করেছে।
অফ কোর্স, এই আলোচনায় খরচ কমানোর চয়েসের কথা বলা হচ্ছে, বাধ্যতামূলক খরচের কথা বলা হচ্ছে না। না কমালেও চলে, তবু যেখানে কমানো। মানে আপনি খাওয়ার খরচ না কমালে ওষুধ কেনার টাকা বেরোবে না, কাজেই খাওয়ার খরচ কমাতে হবে, সে রকম খরচ কমানোর কথা হচ্ছে না। কারণ সেটা চয়েস-এর মধ্যে পড়ে না। এবং যদিও একজন আমাকে আশ্বস্ত করেছেন আচ্ছে দিন আসার পর ভারতবর্ষে এই রকমের চয়েস করার মতো গরিব আর কেউ নেই, অন্তত দিল্লি শহরে তিনি চোখে দেখেননি, আমি তাঁর কথা বিশ্বাস না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
টাকা খরচে সংক্রান্ত আরেকটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে, সকলের কাছেই তার তার নিজের টাকা খরচের কারণ ভয়ানক যুক্তিযুক্ত্, বাকিদেরটা জাস্ট অপচয়। আমি একজনের মাসে কসমেটিকস কেনার খরচ শুনে হাঁ করে থাকলে, সে-ও আমার বাইরে খাওয়ায় টাকা ওড়ানোর পরিমাণ দেখে চোখ কপালে তুলতে পারে। কিংবা গাছেদের জন্য অনলাইন সারযুক্ত মাটি কেনার সিদ্ধান্তে। আমি একজনকে চিনি, যিনি বেড়াতে গিয়ে টাকা খরচকে ধর্তব্যের মধ্যেই ধরেন না, অথচ বই কেনাকে ভীষণ তাচ্ছিল্যের চোখে দেখেন। বই কিনিয়েরাও জাজমেন্টে কিছু কম যান না, বলাই বাহুল্য। যিনি নন ফিকশন পড়েন তিনি ফিকশন পড়ে (এবং কিনে) কার কী মোক্ষলাভ হবে ভেবেই পান না, সাই ফাই বলেন গোয়েন্দা বই কেনার পুরো পয়সাটাই জলে, গোয়েন্দা বলেন কবিতার বই কিনে পয়সা নষ্ট করার কী দরকার, ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলে ফেললেই ফ্রি-তে দেদার পড়া যায়, কবিতাপড়ুয়া (আমি অলমোস্ট শিওর, তিনি নিজে লেখেনও) বলেন, মাগো কফি টেবিল বই কিনে ঘর সাজায় কারা, তারা কি পাঠক না পাষণ্ড?
এই প্রসঙ্গে বলি, আমাদের অফিসে একজন ছিলেন তিনি গল্পের বই পড়াকেই ভয়ানক জাজ করতেন। আমার ডেস্কে রাখা একটা গোয়েন্দা গল্পের বই দেখে উনি ঈদের চাঁদের মতো বাঁকা হেসে বলেছিলেন, কাম কে বাদ টাইম মিলতা হ্যায়? এই রকম বিপজ্জনক প্রশ্নের উত্তর স্বভাবতই আমি দিতে পারিনি, আমতা আমতা করছিলাম, ততক্ষণে উনি হাসতে হাসতে চলে গেলেন।
যাই হোক, খরচ কমানো যখন স্থির হল তখন নিজেদের বাজে খরচের জায়গাগুলোও খুঁজে খুঁজে বার করতে হল। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম কঠিন হবে, কারণ সবার মতো আমরাও বিশ্বাস করি যে বাজে খরচ আমরা মোটে করিই না। সত্যিই, জামাকাপড়ের খরচ আমাদের খুবই কম, একজোড়া বাটার জুতো সব জামার সঙ্গে চলে যায়, বেড়াতে যাই, কিন্তু সেটাও যথাসম্ভব কম খরচেই করার চেষ্টা করি, সরকারি হোটেলে থাকি, চান্স পেলেই বাসে এবং ট্রেনে চড়ি। বেড়াতে গিয়ে খুচুরখাচুর এই স্কার্ফ, ওই ধূপদানি কিনি না। এ পাড়ায় যতখানি কম ভাড়ায় সম্ভব ততখানি কম ভাড়াতেই থাকি।
আমাদের সন্তুষ্টি বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। খুঁজতে শুরু করতে না করতেই দেখলাম চারদিক থেকে অপচয়েরা ড্যাব ড্যাব করে তারা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
এক, খবরের কাগজ। আজকাল খবরের কাগজ পড়া হয় না। আমি ছেড়েছি বহু দিন, সময়ের অভাবে নয়, সুস্থ থাকার তাড়নায়, আর অর্চিষ্মান সারাদিন এত বিবিধ সূত্র থেকে খবর সংগ্রহ করে, এবং রূপে রসে গন্ধে প্রকাশভঙ্গিমায় সে সব সূত্রেরা a এতই বৈচিত্র্যময় যে শুকনো খসখসে খবরের কাগজের পক্ষে তাদের পক্ষে পাল্লা দেওয়া মুশকিল। একটাই রিটার্ন, ছ’মাস বাদে বাদে কাবাড়িভাইসাবের কাছ থেকে গোটা চল্লিশ টাকা আদায়।
দুই, বই কেনায় আমাদের একটা খরচ আছে, কিন্তু সেই খরচটা আমরা জরুরি হিসেবেই ধরি। কিছু কিছু বই ঝোঁকের মাথায় কেনা হয়, কিছু ওভারহাইপড প্রাইজ পাওয়া বই, সোশ্যাল মিডিয়ায় হাততালি পাওয়া বই ইত্যাদি। তবে আমি যেহেতু বিশ্বাস করি নিয়ম করে বাজে বই পড়া উচিত তাই সে খরচগুলোতেও বিশেষ আফসোস হয় না। আফসোস হয় অতৃপ্তি গ্যারান্টিড জেনেও বই কিনলে। যেমন পূজাবার্ষিকী। আগের সপ্তাহেই কিনেছি দু'খানা। ওই খরচগুলো স্রেফ সেন্টিমেন্টাল এবং বাজে।
তিন, বই কেনার খরচ বাজে না হলেও, আমার খাতা কেনার খরচ সম্পূর্ণ বাজে। কারণ মন খারাপ হলেই (যেটা আমার মারাত্মক রকম ঘন ঘন হয়) আমি গিয়ে একটা ডায়রি বা নোটবুক কিনে আনি। যেন তাতে লিখতে শুরু করলে পুরোনো মনখারাপগুলো চলে যাবে। যায়ও, কিন্তু নতুনও আসে নিয়ম করে, তখন আবার আরেকটা নতুন খাতার খোঁজে বেরোতে হয়। দু’হাজার সতেরোতে আমি আর নতুন নোটখাতা কিনব না।
চার, আমি বেশ কিছু ইনডোর গাছ কিনেছি এবং তাদের কয়েকটাকে মেরেছি। সেটাকে বাজে খরচ বলতে আমার বাধছে, কারণ আমি তাদের বাঁচাতেই চেয়েছিলাম। তাছাড়া এই করতে গিয়ে খানিকটা শেখাও হয়েছে, কোন ইনডোর গাছগুলো সত্যি সত্যি ইনডোর আর কোনগুলো নামেই, আসলে তাদের ছ’ঘণ্টা রোদ লাগাতে হয় ইত্যাদি সম্পর্কে একটা আবছা ধারণা হয়েছে।
পাঁচ, কয়েকটা বাজে খরচ আমি অনেকসময় করে ফেলি উচ্চাশার বশবর্তী হয়ে। যেমন আমাদের মাইক্রোওয়েভ। গ্রিল, কনভেকশন আরও যতরকম হিজিবিজি থাকা সম্ভব সব ওতে আছে। আমার দোষ, আমি কেনার সময় ভেবেছিলাম যে শনিবার শনিবার কেক বানাব, রবিবার রবিবার সন্ধ্যেবেলায় আমাদের মাইক্রোওয়েভে ছাল ছাড়ানো কিউট চিকেন শূলবিদ্ধ হয়ে ঘুরবে বনবন। এখন খালি ঘোরে ডালের বাটি, সয়াবিনের ঝোল। অর্চিষ্মান সাবধান করেছিল, বলেছিল, এটা অবিকল ওই সিনড্রোম, যেটা কেব্ল লাইন নেওয়ার আগে হিস্ট্রি আর ডিসকভারি চ্যানেল ছাড়া কিছু না দেখার কনফিডেন্স দেয়, আর মাইক্রোওয়েভ কেনার আগে কেক পেস্ট্রি চিকেনমটনের বন্যা বওয়ার আশ্বাস। অর্চিষ্মান পাঁচশো পার সেন্ট ঠিক প্রমাণ হয়েছে, আমাদের টিভিতে খালি চলে সংগীত বাংলা আর মাইক্রোওয়েভে খালি গরম হয় ভাত ডাল আলুপোস্ত। সস্তা মডেল কিনলেও কিছু ক্ষতি হত না।
একটা সন্দেহ ছিলই, অর্চিষ্মানের ফোনের অ্যাপ সেটা নিশ্চিত করল, এগুলো সব খুচরো পাপ, আমাদের আসল খরচটা হয় বাইরে খাওয়া আর অফিস যাতায়াতে। ওলা উবার এসে অভ্যেস খারাপের চূড়ান্ত করেছে, মেট্রো চড়া মাথায় উঠেছে। অথচ মেট্রোয় খরচ কম, আরাম বেশি। তবু আমরা এখনও এই খরচটা বজায় রাখার সিদ্ধান্ত রাখছি। অফিস জায়গাটা এত খারাপ লাগে, আসাযাওয়ার পথটা অন্তত একটু আরামের হোক।
অতএব কমানোর জন্য পড়ে আছে কেবল বাইরে খাওয়া। সে খরচে একেবারে কোপ মেরেছি বলব না, কিন্তু সেটা আমাদের স্ট্র্যাটেজিরই অংশ। একেবারে বন্ধ করলে রিবাউন্ডের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই আমরা এখনও ক্বচিৎ কদাচিৎ খাই, আগে থেকে একটা ভেবে রাখা খরচসীমা (আমাদের আগের খরচের, যেটাকে বাজেট বলতে বাধছে, কারণ সে খরচে বাজেটের বিন্দুমাত্র ছাপ ছিল না, অর্ধেক) কোনওমতেই টপকাই না। আর খেতে হলে সস্তা দোকানে খাই। কারণ আমরা ভেবে দেখেছি, আমাদের বাইরে খাওয়া যত না ‘খাওয়া’র প্রতি আসক্তিতে, তার থেকে বেশি বাড়ির বাইরে নিজেদের গল্প করার সুযোগ করে দেওয়ায়। সে গল্প নিভু নিভু মোমবাতিওয়ালা টেবিলের দুদিকে বসে বিরিয়ানি খেতে খেতে করলাম না মা তারায় রুটি তরকারি খেতে খেতে, তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ টেবিলের এপারে আমি সেই আমি, ওপারে অর্চিষ্মানও সেই অর্চিষ্মান, আর সত্যি বলতে কি আমাদের গল্পগুলোও সব চেনা।
Bhalo laglo pore. Baje khoroch byaparta satti khub-i byaktigoto.
ReplyDeleteযা বলেছেন, সুস্মিতা। যার সঙ্গে সবেতে মিল, তার সঙ্গেও খরচের প্যাটার্ন মেলে না।
Deleteএকি, একটা বাজে নেশা থাকতে হয় তো! আপনাদের তো যতটুকু জানি, মদগাঁজাসিগারেটের প্রতি আসক্তি নেই, বাইরে খাওয়াটুকু বন্ধ করছেন কেন? এসব ভুল ডিসিশন নিয়েই পরে লোকে এক্সট্রাম্যারিটালের ফাঁদে পড়ে যায়।
ReplyDeleteআমার আছে তো বাজে নেশা, ক্যান্ডি ক্রাশ। একেবারে লাইফ হেল করে রেখে দিয়েছে।
DeleteDarun su-swadu lekha. 5 number point er paragraph ta pore prochondo haslam :D
ReplyDeleteBaire khawa ekebare bondho korenni jene bhalo laglo.
ki ki pujabarshiki kinlen? ami apatoto chepechupe control kore jachhi :D
আপাতত আনন্দমেলা আর পত্রিকা কিনেছি, অরিজিত। দেশটাও কিনব হয়তো, বেরোয়নি এখনও।
Deletehaha darun analysis. sottii baje khoroch beparta person to person vary korte thake. ami jemon motei baire khai na, kintu online shopping kore bhoot bhagiye diyi. boi o joto na pori tar cheye beshi kini. akhon paperwhite kenbar dhanda korchi. ami jeeboneo borolok hobo na.
ReplyDeleteঅনলাইন কেনাটা এত সুবিধের যে সামলানো শক্ত, কুহেলি। এ জন্মে বড়োলোক না হতে পাড়াতে হাই ফাইভ।
DeleteApnar gachher shombhaar ekdin dekhar ichhe achhe ...
ReplyDeleteআরে না না, সম্ভারটম্ভার কিছু না, খুবই সাধারণ কয়েকটা ইন্ডোর প্ল্যান্ট, অনুরাধা। তবু চোখের সামনে থাকলে ভালো লাগে।
Delete"ছাড়ানো কিউট চিকেন শূলবিদ্ধ হয়ে ঘুরবে বনবন" - hahahaha :)
ReplyDeleteসিরিয়াসলি কাকলি, কত স্বপ্ন ছিল, সব গোল্লায় গেছে।
Deleteekta jinis dekhe khub bhalo laglo je apnader sab kharoch guloi basically nijeder pichone kora kharoch....mon kharap korben na, apnara asole hisebi i beshi, behisebi kom :)
ReplyDeleteধন্যবাদ।
DeleteAmi ek bar Nana khat er khoroch toroch er data jomiyechhilam ek du maas. Tarpor muskil holo je Jai chart kori bojhar jonye, bar, line, pie, map, jabotiyo jinis ei ektai category dekhay ...khaoadaoa, onyo category gulo Khali naam dekha jay, kintu kono chart a tader kono value ase na..
ReplyDeleteহ্যাঁ, শিবেন্দু। আমার নিজের ব্যক্তিগত মতে হিসেব রাখার বেস্ট উপায় হচ্ছে গুড ওল্ড খাতা পেনসিল। হাতে করে লিখলে মনে বেশি থাকে, অন্তত আমার।
Deleteআর সত্যি বলতে কি আমাদের গল্পগুলোও সব চেনা।
ReplyDeletejioh...straight sixer boss..tumi relationship counselling khule felo agaency..
besh bhalo mojar lekha..
ami tomar dole,biryani,roll,chop,golper boi,kam chalau kaporjama,motamuti hotel,sarjukto mati,faukabaji adda,total mosti
prosenjit
থ্যাংক ইউ, প্রসেনজিৎ।
Deleteপূজাবার্ষিকী কেনা আমিও বন্ধ করে দিয়েছি| কোনো না কোনো সাইট থেকে ডাউনলোড করতে পারি পরে, দেখেছি|
ReplyDeleteতবে বাইরে খাওয়াটা বন্ধ করবেন না, প্লিজ ! না হলে পোস্ট পড়ব ক্যামনে ?
সেটা একটা সমস্যা বটে, অন্বেষা।
Deletebolchi tumi lukiye fb koro mone hochhe...noile eto tothyo pachho ki kore hain?
ReplyDeletear apis jaygata eto kharap , jatayat ta upobhogyo kora sotti proyojon :D - Pradipta
হাই ফাইভ, প্রদীপ্ত।
Delete