অসম্ভব
বছর ঘুরে ইনটার্ন-ঋতু ফিরেছে, অফিস অলরেডি কানায় কানায় ছিল, ফাটো ফাটো হয়েছে। কনফারেন্স রুমের দরজা খুললে ইনটার্ন উপচে পড়ছে, প্যাসেজ দিয়ে হাঁটার সময় তাদের ল্যাপটপের প্রসারিত তারে ঠোক্কর খাচ্ছি সকালবিকেল।
খারাপ লাগে না। এমনিতে তো সাড়ে আটটা-পাঁচটা জ্যান্ত মড়া হয়ে ঘোরা, ঘণ্টায় একবার করে প্যান্ট্রি ভিজিট। গরম জলে লেমন টি ব্যাগ ডোবাতে ডোবাতে প্রোজেক্ট আর সাবমিশন আর সেমিনারের চর্বিতচর্বণ। সে জায়গায় যৌবনের দূতেরা রংচঙে মাছের মতো ঝাঁক বেঁধে অফিসের মধ্যে দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে, লাফিয়েঝাঁপিয়ে কাজ করছে, শেষ করে এনে জিজ্ঞাসা করছে, "এবার কী করব?"
ইচ্ছে হয় শিখিয়ে দিই, "কাজ শেষ হয়ে গেছে বলতে নেই, ঘাপটি মেরে থাকো যতক্ষণ না বস ডেকে পাঠায়।" শেখাই না। আমার ওস্তাদি করার দরকার নেই, এ সব বেসিক শিক্ষা সময় শিখিয়ে দেবে।
ইচ্ছে হয় শিখিয়ে দিই, "কাজ শেষ হয়ে গেছে বলতে নেই, ঘাপটি মেরে থাকো যতক্ষণ না বস ডেকে পাঠায়।" শেখাই না। আমার ওস্তাদি করার দরকার নেই, এ সব বেসিক শিক্ষা সময় শিখিয়ে দেবে।
এরা জোরে কথা বলে, আস্তে হাসতে পারে না। এদের হেডফোনের ওপারের ঢিকচিক ঢিকচিক গোটা অফিস শুনতে পায়। সেদিন আমার এক সহকর্মী "বচা লো ভাইয়া" বলে অ্যাডমিনের কাছে গিয়ে হত্যে দিয়ে পড়েছে। তার পাশের ঘরে চারজন ইনটার্ন বসেছে এবং ক্রমাগত উচ্চঃস্বরে কথা বলছে, হেসে গড়াচ্ছে। সহকর্মী দেওয়ালে টকটক টোকা দিয়ে আপত্তি প্রকাশ করাতে প্রত্যুত্তরে টোকা এসেছে। খিলখিল হাসি সহযোগে।
আমি অফিসে কানে ইয়ারফোন গুঁজে রাখি। কিছু না চললেও। প্রাইভেট আলাপচারিতার জন্য আমি অ্যাভেলেবল নই বোঝানোও হয়, লোকজনের প্রাইভেট আলাপচারিতায় আড়িও পাতা যায়। আসাযাওয়ার পথে ইনটার্নদের কথা শুনি। এটা শেষ করে ওটা, এখান পুরোনো হলে ওখান। প্ল্যানিং-এ প্ল্যানিং-এ জীবন ছয়লাপ। ভাবি, এত কষে আঁটোসাঁটো প্ল্যান কোরো না বাছা, হাওয়াবাতাস চলার খানিকটা জায়গা রাখো। আহূত অনাহূত সারপ্রাইজদের আসাযাওয়ার ব্যাকডোর খোলা রাখো।
অফ কোর্স, মুখে বলি না। গম্ভীর মুখে চায়ের কাপে টি ব্যাগ ডিপ ডিপ ডোবাই। নিজের বাকি জীবনটার জন্য যে প্ল্যানটা ছকেছি সেটাতে আরেকটু ঢিলে দিতে হবে, ডিসিশন নিই।
সেদিন প্যান্ট্রিতে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে দিনের পাঁচ নম্বর চা-টা বানাচ্ছি, এমন সময় আর্তনাদ।
নাইনটি ওয়ান?! ইউ আর নাইনটি ওয়ান বর্ন?
মাসছয়েক আগে জয়েন করা আমাদের টিমের নবীনতম ছেলেটির দিকে তাকিয়ে ইনটার্ন রুদ্ধশ্বাস। মুখ হাঁ, চোখ বিস্ফারিত। ওর এক হাতের মধ্যে দাঁড়িয়ে উনিশশো একানব্বই সালে জন্মানো একটা রক্তমাংসের মানুষ চা খাচ্ছে। যেন একটা টি-রেক্স ছোটো ছোটো হাত তুলে দুদিকের গাড়ি থামিয়ে নেহরু প্লেসের সিগন্যাল পেরোচ্ছে। এও কি সম্ভব?
একবার ভাবলাম, আমার জন্মসালটা বোমার মতো ফাটাই। কী রিঅ্যাকশন হয় দেখি। নিজেকে মনে করালাম, বাচ্চাদের ভয় দেখিয়ে আনন্দ পায় সাইকোপ্যাথরা। সবুজ বিনে টি ব্যাগ টিপ করে ফেলে সিটে ফিরে এলাম।
*****
গরমের ছুটি শেষ। ক্লাস শুরু হবে। ধীরে ধীরে ইনটার্নরা বিদায় নিচ্ছে। এবং কেউ কেউ দাবি জানিয়েছে আমি যেহেতু সবার আগে অফিসে আসি, ওদের বস/ সুপারভাইজার/ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষেরটেবিলে গিয়ে আমি যদি বিদায়কালীন গিফটগুলো রেখে আসতে পারি তবে খুব ভালো হয়। এমন সময়েই যেন রাখি যখন টেবিলে ম্যাম/স্যার থাকবেন না, ওকে? আর যদি থাকেন তবে যেন আমি কোনও একটা এক্সকিউজ দেখি চলে আসি, ওকে? প্লিজ? প্রমিস?
আপাতত সকালবেলা অফিসে এসে সহকর্মীদের ডেস্কে সলমাচুমকিখচিত র্যাপার মোড়া গিফট রাখছি, আবেগমথিত বিদায়বাণী লেখা পোস্ট-ইট সাঁটছি আর ভাবছি, সামনের বছর যারা আসবে তারা যারা এ বছর যারা চলে গেল তাদের থেকেও বেশি ছেলেমানুষ হবে।
এও কি সম্ভব?
ইয়ে অফিস হ্যায় ইয়া কল সেন্টার হ্যায়?
ReplyDeleteবক্তাঃ আমার বসের বসের বস
সময়ঃ ২০০৫ সাল
কন্টেক্সটঃ ৪০০ জনের ক্যাপাসিটি ওয়ালা অফিসে সত্তর জন ফ্রেশার জয়েন করেছে
ওরে বাবা।
Deleteami ei buro boyese ekhon nijei intern. office er lokera mone hoy amar somporke erokom e bhabchhey pechhone. :(
ReplyDeleteআরে না, ভালোই বলছে, আমিও খারাপ কথা বলতে চাইনি ঠিক। হয়তো খারাপের মতো শুনিয়েছে, কিন্তু সেটা আমার উদ্দেশ্য ছিল না।
Deleteaha kharaap keno bolbe.. kochikacha bhabchho to eder. tai bollam ar ki :)
Deleteহাহা, বুঝেছি, চুপকথা।
Deleteআমি গতবছর যখন এই অফিসে যোগ দিলাম, তখন দেখলাম যে তাতে শেষ নিযুক্তি হয়েছিল ১৯৯২ সালে! ফলে আমার মতো একটি মধ্যবয়স্ক পুরুষ এই অফিসেই প্রায় 'সবুজ ও অবুঝ' গোত্রভুক্ত ছিল। এবছর এস.এস.সি দিয়ে ন'জন সত্যিকারের নওজোয়ান তরুণ-তরুণী অফিসে ঢুকেছে। আমি "মন চলো নিজ নিকেতনে" গেয়ে নিজের বয়সে ফিরে গেছি।
ReplyDeleteআমার জীবনের জাতীয় সংগীত এই গানটা, ঋজু। বয়স, সাফল্য, পাবলিকেশন, যে কোনও বিষয়ের কথা উঠলেই আমার ওই গানটা গাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
Deleteউচ্চতম পঞ্চ। বয়স, সাফল্য, পাবলিকেশন + চাকরি, সেভিংস, নিজ নিকেতন, যোগব্যায়াম, ম্যারাথন, পাকা চুল ... সবেতেই "বল মা তারা, দাঁড়াই কোথা"
Deleteহাহা, উচ্চতম পঞ্চ, অস্মিতা।
Delete"ইচ্ছে হয় শিখিয়ে দিই, "কাজ শেষ হয়ে গেছে বলতে নেই, ঘাপটি মেরে থাকো যতক্ষণ না বস ডেকে পাঠায়।"
ReplyDeleteএত কষে আঁটোসাঁটো প্ল্যান কোরো না বাছা, হাওয়াবাতাস চলার খানিকটা জায়গা রাখো। আহূত অনাহূত সারপ্রাইজদের আসাযাওয়ার ব্যাকডোর খোলা রাখো।
একবার ভাবলাম, আমার জন্মসালটা বোমার মতো ফাটাই। কী রিঅ্যাকশন হয় দেখি।
দারুণ <3
ধন্যবাদ।
Delete"ইচ্ছে হয় শিখিয়ে দিই, "কাজ শেষ হয়ে গেছে বলতে নেই, ঘাপটি মেরে থাকো যতক্ষণ না বস ডেকে পাঠায়।"
ReplyDeleteEi Line ta pore shuttle e bose khub haschi.
আরে এসব বেসিক ব্যাপার জানে না দেখে আমি অবাক, সুহানি। ছোট হওয়ার সবটাই সুবিধে নয়, অসুবিধেও প্রচুর।
Deleteঘাপটি মেরে থাকো যতক্ষণ না বস ডেকে পাঠায়।"
ReplyDeletechupchap fool e chaap...
bhule gele aro mosti
prosenjit
দুঃখের বিষয়, বসরা ভোলেন না, প্রসেনজিৎ। ভোলেন না বলেই সম্ভবতঃ তাঁরা বস হন।
Deleteআবার অনেক দিন বাদে কমেন্ট করছি আপনার লেখায়। খুব মন ছুঁয়ে গেল, লেখাটা; বোধ হয় আমার নিজের বয়স হচ্ছে বলে, অথবা এখনো একটা সত্যিকারের চাকরি করি না বলে অথবা এখনো ভবিষ্যতের কথা ভাবি বলে।
ReplyDeleteএই ইন্টার্নদের কথা শুনলেই কিরকম একটা ফিল-গুড অথবা হীনমন্যতা বোধ জন্ম হয় ভেতরে ভেতরে। মনে মনে আশা করি, যেন সকলেরই সব ইচ্ছা পূরণ হয়, অমলকান্তি সমেত। কোন অমলকান্তির যেন রোদ্দুর হতে কোন অসুবিধা না হয়।
আমারও সে রকমই কামনা, অস্মিতা।
Deleteআমাদের এখনো cute ইন্টার্ন season চলছে।
ReplyDeleteতোমার প্রত্যেকটা observation কাঁটায় কাঁটায় মিলে গেলো :)
লাঞ্চ খায় সোফার উপর উঠে বসে , আর সে কি হাহা হিহি !
ইনটারনের কোনও দেশজাতিধর্মবর্ণ হয় না। তারই প্রমাণ হল কাকলি।
DeleteDdurdanto lekha....kono kaatha hobena.
ReplyDeleteKintu intern-ra manager-der gift dey eta besh baje laglo pore. Ek bochhor erokom hobar porei HR er announce kore dewaa uchit chhilo to the next batch of interns.
-Manidipa
এ বছরের গোড়ার দিকে নতুন প্রজেক্টে এসে আমারও প্রায় এরকমই লাগছিলো , কার ২০১২ তে মাধ্যমিক , কে চুরানব্বইতে জন্মেছে সেসব আলোচনা হচ্ছিলো কিনা।
ReplyDeleteভারী ভালো লাগলো লেখাটা :)
ধন্যবাদ, প্রদীপ্ত।
DeleteLekhata pore mone hochche satti aamra koto purono hoye gechhi....satti oder achoron, kohon sab i aamader theke alada...
ReplyDeleteamader niyeo bodhhoi keu/kara esab bhabten...
সে তো বটেই, সুস্মিতা। রিষড়ায় একজন ডেলিপ্যাসেঞ্জার মহিলা ছিলেন, যিনি আমার মা যখন প্রেগন্যান্ট অবস্থায় দৌড়ে ট্রেন ধরতেন মাকে বকতেন। সেই মহিলা আমাকে দেখলেই আঁতকে উঠে বলতেন, ওরে বাবা ওকে দেখলেই আমার অস্বস্তি হয়।
Deleteতখন আমার একটু বোকাবোকাই লাগত, এখন বুঝি অস্বস্তিটা খুবই রিয়েল।