নভেম্বর
চন্দ্রবিন্দুর কোনও একটা গানের লাইনে অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘কে না ভালোবাসে শৈশব’। উনি যে ভালোবাসেন সে তো বোঝাই যাচ্ছে, ওঁর বানানো প্রথম সিনেমাটা দেখলেও সেটা স্পষ্ট। (দ্বিতীয়টা তৃতীয়টা এখনও দেখা হয়নি, কবে টিভিতে ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হবে হত্যে দিয়ে বসে আছি। আপনারা দেখেছেন নাকি কেউ ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’?) অনিন্দ্য একা নন, জিজ্ঞাসা করলে অধিকাংশ লোকেই শৈশব ভালোবাসেন বলে দাবি করবেন। খারাপ লাগার তো কিছু নেই, খাওয়াদাওয়ার চিন্তা নেই, বসের গালি খাওয়া নেই, গুরুজনেদের ঘাড়ে বডি-ফেলা জীবনযাপন। তলিয়ে দেখলে কী বেরোবে অবশ্য বলা যায় না। আমার এমনিতে তলিয়ে-টলিয়ে দেখার বদভ্যেস নেই কিন্তু সেদিন আচমকা একটা সত্য, শৈশব-সংক্রান্ত, উদ্ঘাটিত হল। নিতান্ত অনাড়ম্বর সেটিং-এ। কোনও এক শনিরবি, সাড়ে দশটা নাগাদ বিছানায় শুয়ে শুয়ে ক্যান্ডি ক্রাশ খেলতে খেলতে কিংবা মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার এপিসোড অটো প্লে-তে দেখত দেখতে (দুটো একইসঙ্গে করতে করতেও হতে পারে) আকস্মিক আমি ওই মুহূর্তের অসামান্য সুখ উপলব্ধি করতে পারলাম। এবং গ্রেটফুল হলাম।
গ্রেটফুল হলাম বড় হওয়ার জন্যও। শৈশবের শনিরবিগুলো মনে পড়ে গেল। শনিবার হলে সকাল সাড়ে দশটার সময় প্রার্থনার লাইনে দাঁড়িয়ে আছি আর রবিবার সাড়ে দশটা হলে তবলার মাস্টারমশাই এসেছেন, হাঁ করে জৌনপুরী কিংবা কালিংড়া ধরেছি, গান সেরে স্নানে যেতে হবে, তারপর গাজরসেদ্ধ দিয়ে ভাত খেয়ে উঠে বাধ্যতামূলক ঘুম থেকে উঠে ট্রেনে চড়ে গানের স্কুল। গান ভালো করে করতে না পারলে বা মাঝপথে তান কাটলে মাস্টারমশাই মাথা নাড়বেন। মা এমন মুখ করবেন যেন আমি নয়, তিনিই অংক পরীক্ষায় গোল্লা পেয়েছেন।
এ সব শনিরবির সঙ্গে সে সব শনিরবি? কীসে আর কীসে।
ঠাট্টা মনে করতে পারেন কেউ কেউ, যদিও আমি আপাদমস্তক সিরিয়াস হয়েই বলছি। আমার বিশ্বাস করি বড়দের শৈশব ভালোলাগে কারণ বড়রা এ ব্যাপারে ভয়ানক ছেলেমানুষ, শৈশবের যত ভালো জিনিসগুলোই খুঁটে খুঁটে মনে রাখে আর যত খারাপ জিনিস ঝটপট ভুলে যায়। হ্যাঁ, শৈশবে আপনি জীবনের প্রথম আইসক্রিম খাচ্ছেন, প্রথমবার জায়ান্ট হুইল চড়ছেন, প্রথমবার মাহেশের রথের মেলায় গিয়ে পাঁপড়ভাজা খেয়ে আর মাটির ট্রাফিক পুলিসের মালিক হয়ে বাবার সাইকেলের সামনের রডে লাগান সিটে দু’পা ঝুলিয়ে বসে বাড়ি ফিরছেন। কিন্তু শৈশবে আরও অনেক জিনিস প্রথমবার হচ্ছে। শৈশবে আপনি প্রথমবার টের পাচ্ছেন যে যে ছোট্ট মেয়েটিকে বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে আপনার মন চায়, সে আপনার ফ্রেন্ডও হতে চায় না। শৈশবে আপনি প্রথম জানছেন সান্ত্বনা পুরস্কার বলে একটা ব্যাপার হয় এবং সেটা প্রতি বছর আপনার জন্য বাঁধা থাকে। শৈশবে ভিড় ট্রেনে প্রথম একটা গোঁফওয়ালা লোক আপনার দু’পায়ের মাঝখানে হাত দেয়।
এবং সেই লোকটার মুখ, সব ভুক্তভোগী ছোটরাই জানে, প্রথম আইসক্রিমের স্বাদের থেকে স্মৃতিতে অনেক বেশি টেঁকসই।
আমাদের শিল্প সাহিত্য গান কবিতায় ওই দ্বিতীয় শৈশবটা অনুপস্থিত। কাশের বনে ফড়িং-এর পেছনে দৌড়নো নিয়ে কত গান কত কবিতা বাঁধা হল, কিন্তু সে ফড়িংকে একবার ধরে ফেলার পর পটাং পটাং ডানা ছিঁড়ে তার গায়ে সুতো বেঁধে বন বন করে ঘোরানো কিংবা শিশিতে বন্ধ করে রাখার অংশটুকু নিয়ে সবাই স্পিকটি নট।
ব্যতিক্রমও আছে। ইংরেজ লেখক গ্রাহাম গ্রীন মূলতঃ থ্রিলার এবং ধর্মকেন্দ্রিক উপন্যাস লেখার জন্য বিখ্যাত ছিলেন কিন্তু তিনি ছোটগল্পও লিখেছেন অনেক। উনিশশো চুয়ান্ন সালে প্রকাশিত তাঁর ‘টোয়েন্টি ওয়ান স্টোরিজ’ ছোটগল্প সংকলনের বেশ কয়েকটি গল্পের থিম সেই সন্ত্রস্ত, ঈর্ষান্বিত, হিংস্র, আশাহত, বঞ্চিত, অবদমিত শৈশব যা বড়রা ভুলে যায় বা ভুলে থাকে। টোয়েন্টি ওয়ান স্টোরিজ-এর বেশিরভাগ গল্পই পড়ার পর ভোল বদলানোর লোভ জেগেছিল কিন্তু শেষমেশ ‘দ্য ইনোসেন্ট’ গল্পটি বাকিদের হারিয়ে দিল।
‘দ্য ইনোসেন্ট’ গ্রীন লিখেছিলেন উনিশশো সাঁইত্রিশ সালে। উনিশশো সাতচল্লিশ সালে গল্পতি আরও আঠেরোটি গল্পের সঙ্গে ‘নাইনটিন স্টোরিজ’ নামের ছোটগল্পের সংকলনে আত্মপ্রকাশ করে। সাত বছর পর উনিশশো চুয়ান্ন সালে আরও তিনটে ছোটগল্প জুড়ে এবং একটি গল্প বাদ দিয়ে ‘টোয়েন্টি ওয়ান স্টোরিজ’ নামের ছোটগল্প সংকলনে ঠাঁই পায়। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে ‘দ্য ইনোসেন্ট’-এর ছায়া অবলম্বনের লেখা আমার ছোটগল্প ‘নভেম্বর’-এর লিংক এই রইল।
আমি আমার বড়বেলাকে ভালোবাসি...একথা বোধহয় বলেছিলাম একবার । বড় বয়সের স্বাধীনতা যতই দাম দিতে হোক বড়ই প্রিয় ।
ReplyDeleteতোমার অনুবাদ এর ভক্ত আমি বরাবর । এই গল্পটাও দারুন লাগলো, অনুবাদও যেমন গল্পটাও ...থ্যাংক ইউ :)
নতুন বছর ভালো কাটুক।
থ্যাংক ইউ, প্রদীপ্ত। তোমাকেও নতুন বছরের অনেক শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা জানাই।
Deleteহ্যা৺ ঘটনা গুলো অনেক টা এরকমই, তবে এ নিয়ে লেখা গল্প এবং তার অনুবাদ বেশ অন্যরকম। ভালো লাগলো।
ReplyDeleteধন্যবাদ, নালক। আমার নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানবেন।
DeleteHappy New Year Kuntala, Archisman ebong Abantor. Sobai khub bhalo thakben ei notun bochhore. :)
ReplyDeleteGolpota besh laglo....erokom golpo ami age porini khub ekta, tai besh chomokito holam. :)
শুভ নববর্ষের প্রীতি শুভেচ্ছা আপনাকেও, অরিজিত। দুহাজার উনিশ খুব ভালো কাটুক।
DeleteGolpo ta besh onnorokom.. golper theke abantor er lekhata besi bhalo laglo.. amar boro bela besh bhalo lage..choto mukhe boro kotha bolchi hoyto..ei prothom ei golpotay kuntala dir chena style laglo na ..tumi pls didi gune kichu mone korona.. pan mukhe diye kothatay satyajit ray er kotha mone korano ta bhalo..:)
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, ঊর্মি।
DeleteHappy New Year Kuntala Di . chotobelay baba, ma , vai bon j sob eksathe sathe seta khub miss kori. Echara borobela valoi, sobthrke valo orthonoitik Swadhinata paoa.
ReplyDeleteহ্যাপি নিউ ইয়ার, সুহানি। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ব্যাপারটায় হাই ফাইভ।
Deleteইয়ে, মানে মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি বোধহয় অনিন্দ্যবাবুর তৃতীয় সিনেমা। ওপেন টি এর পর প্রজাপতি বিস্কুট আছে।
ReplyDeleteওহ, তাও বটে। থ্যাংক ইউ।
Deleteশুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা কুন্তলা। গল্পটা পড়ব এবার। মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি দেখার জন্য আমিও হাঁ করে বসে আছি। আর ছোটবেলায় ফড়িং ধরলে আমরা কচুপাতার রস খাইয়ে ছেড়ে দিতাম।
ReplyDeleteআর ইয়ে, লেখার লোভ সামলাতে পারলাম না, যে আমি এই মুহূর্তে একটা ট্রেনে বসে, আর ট্রেনটা রিষড়া স্টেশনে ঢুকছে।
অ্যাঁঅ্যাঁঅ্যাঁঅ্যাঁ!!!!!!!!!! কী সাংঘাতিক ক্লাইম্যাক্সে কমেন্ট শেষ করলেন, সুগত। নতুন বছরের অনেক অনেক শুভেচ্ছা ভালোবাসা আপনাকে পৌলোমীকে আর শাল্মলীকে। খুব ভালো কাটুক দু'হাজার উনিশ।
Deleteনা না সেরকম কিছু না, ব্যান্ডেল লোকালে হাওড়া যাচ্ছি। গল্পটা অনবদ্য। ট্রেনের বাইরের আর মফঃস্বলের নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন। খুব ভাল লাগল।
Deleteথ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ। আশা করি হালুয়ায় ট্রেন বেশিক্ষণ না দাঁড়াক।
Deleteদারুণ, কুন্তলাদি, দারুণ। চার নম্বর আর আপনার জুটি অনবদ্য।এটা আপনার অন্যতম সেরা গল্পের একটা। আপনাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে আমিও শার্লি জ্যাকসনের একটা গল্পের ভাবানুবাদ করে ফেলেছি। লটারি নাম।
ReplyDeleteচার নম্বর ম্যাগাজিনটা সত্যিই দারুণ করছে সোমেন্দা-ব্রতীনদা-দেবব্রতদারা।অনবদ্য সব লেখা ছাপছে
অসংখ্য ধন্যবাদ, ঋতম।
Deleteএটা কেমন লাগছিলো যে পুরোনো পোস্টে কমেন্ট লিখে যাচ্ছি আর নতুনটায় চুপচাপ | প্লাটফর্ম এর গল্প খুব ভালো আর শেষটা শকিং, কিন্তু দ্যাট ইজ দি পয়েন্ট নিশ্চয় | আর ছোটবেলা বড়বেলার না বলা কথাগুলো যে বলা হলো রীতি ভেঙে সেটা দারুন হয়েছে | এই ব্যাপারে আমার টু সেন্টস - যতদিন না ছানাপোনা হচ্ছে ততদিন বড়বেলা পারফেক্ট | তারপর রাত জাগা নাপি পাল্টানো এই সব ছাড়াও সারাজীবনের জন্য তাদের জন্য চিন্তা যখন অ্যাড হবে তখন বড়বেলা আর এত ভালো নাও লাগতে পারে | সেই সাথে সব সময় মনে হবে আমাদের সময়ে আমরা কি বাধ্য বাছা ছিলাম, আজকালকার বাচ্ছারা একদম কথা শোনেনা :)
ReplyDeleteহাহা এটা ভালো বলেছেন, অমিতা। এই সিন্যারিওটা যুক্তিযুক্ত।
Delete