অমৃতসর ২: হরমন্দির সাহিব, মহারাজা রঞ্জিৎ সিং মিউজিয়াম
অমৃতসর টুরিস্টদের জায়গা। দেখার, খাওয়ার, ঘোরার জিনিসের লিস্টের অভাব নেই। আমরা কী কী দেখব ঠিকই করে রেখেছিলাম। তার মধ্যে প্রথম ছিল রামবাগে রাজা রঞ্জিত সিং-এর গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ।
ঘোর গোলমেলে শহরের একেবারে মধ্যিখানের পাড়া রামবাগ। রাজারাজড়াদের জায়গা বলে কথা। পরিষ্কার রাস্তা, দুপাশে বৃক্ষরাজি, পুরোন ইমারত মিলিয়ে বেশ ইতিহাস ইতিহাস ভাব।
যে শহরের তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালে পঞ্চাশ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়ায় সেখানে কেন কেউ সাধ করে গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ বানাতে যাবে ভেবে আমরা মাথা চুলকোচ্ছিলাম। সিমলা কিংবা শিলং থাকতে? কিন্তু অমৃতসরে সত্যি সত্যিই মহারাজা রঞ্জিত সিং-এর সামার প্যালেস ছিল। পুরোনো প্রাসাদ সারানো হচ্ছে। নরম্যাল সময়ে ভেতরে ঢোকা যায় কি না জানি না। প্রাসাদ কম্পাউন্ডের প্রান্তে একটি আধুনিক দোতলা বাড়িতে মহারাজা রঞ্জিত সিং মিউজিয়াম।
মিউজিয়ামে শুনেছি দেখার মতো অনেক কিছু আছে, রঞ্জিত সিং-এর আমলের মুদ্রা, বইপত্র, অস্ত্রশস্ত্র, কিন্তু সারাইটারাই হচ্ছে বলেই হয়তো কয়েকখানা চমৎকার পোর্ট্রেট আর পেন্টিং আর কিছু রাজসিক পোশাকআশাক ছাড়া আর কিছু প্রদর্শন করা ছিল না। দেওয়ালজোড়া পেন্টিং-এর ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা হচ্ছে একই দৃশ্যে বিবিধ সামাজিক স্তরের, বিবিধ অনুভূতির সহাবস্থান। চাঁদোয়ার নিচে রাজারানীর সামনে মেঝেতে মহার্ঘ কার্পেটের শুয়ে বেবি রঞ্জিত হাত পা নেড়ে খেলা করছেন, পাঁচ হাত দূরেই একজন দুঃখী হাত পা ঊর্ধ্বমুখে কাতরাচ্ছেন, কুকুর লেজ তুলে দৌড়চ্ছে।
মিউজিয়ামের মূল আকর্ষণ হচ্ছে একটা অডিটোরিয়ামের মতো ঘরে তিনশো ষাট ডিগ্রি জুড়ে ত্রিমাত্রিক মূর্তি গড়ে রঞ্জিত সিং-এর নানাবিধ যুদ্ধের দৃশ্যের লাইট অ্যান্ড সাউন্ড সহযোগে বর্ণনা। সে বেশ দেখার মতো জিনিস।
রঞ্জিত সিং যুদ্ধ করেছিলেন প্রচুর। দশ বছর বয়স থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত রঞ্জিত সিং যুদ্ধ করেছেন। তাঁর আগে পাঞ্জাব ছোট ছোট ‘মিসল্’ বা গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল। রঞ্জিত সিং যুদ্ধবিগ্রহ করে এবং বিবাহসম্পর্ক স্থাপন করে তাদের সংঘবদ্ধ করেছিলেন। রঞ্জিত সিং ছোটখাটো দেখতে ছিলেন, পড়াশোনাও জানতেন না বিশেষ, শৈশবে বসন্তরোগে তাঁর একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা তিনি নিয়ে জন্মেছিলেন এবং আজীবন তা অটুট ছিল। কিন্তু তাই বলে তাঁর গোটা জীবনটাকে যুদ্ধ দিয়ে মাপা কেমন যেন। বিশেষ করে রঞ্জিত সিং-এর আরও নানারকম বলার মতো জিনিস ছিল। সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, যত মত তত পথে বিশ্বাস রাখতেন, প্রচুর দানধ্যান করেছেন। সেগুলো আরেকটু হাইলাইট করা যেত। হরমন্দির সাহিবের মাথা সোনা দিয়ে মুড়ে রঞ্জিত সিং-ই তাকে গোল্ডেন টেম্পল করে তোলেন।
তিনি মারা যাওয়ার সময় তাঁর পত্নী উপপত্নী মিলিয়ে জনা এগারো মহিলা সতী হয়েছিলেন।
আমরা যখন মিউজিয়াম দেখছিলাম কোনও এক বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও মিউজিয়াম দর্শনে এসেছিল। শৈশবকৈশোরের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ব্যাপারটা অত্যন্ত হাই ডেসিবেলের। আমার অফিস কম্পাউন্ডের দেওয়াল শেয়ার করে একটি স্কুল। ক্লাস শুরু হওয়ার আগে যতক্ষণ ছেলেমেয়েরা মাঠে থাকে, সে চিৎকার কল্পনা করা যায় না। কোনও প্রাপ্তবয়স্ক, ঘরে আগুন না লাগলে ওই লেভেলে গলা ছাড়ে না। যখন পোস্ট-লাঞ্চ চা খেতে আন্টিজীর দোকানে যাই, তখন ছোট ক্লাসের ছুটি হয়। সে গোলযোগের বর্ণনাও দুঃসাধ্য। একে বয়সজনিত দোষ, তায় ছুটির আনন্দ। সবথেকে মজার হচ্ছে গোটা চেঁচামেচির অকারণতাটা। বাসের দিকে দৌড়তে দৌড়তে গলা সপ্তমে ছেড়ে রাখা। জাস্ট এমনিই।
মোদ্দা কথা, প্যানোরামার বদ্ধ ঘরে বালিকাদের কলকাকলির আবহ মারাত্মক হয়ে উঠছিল। রঞ্জিত সিং-এর যুদ্ধের হাড়হিম সাউন্ড এফেক্টও ফেল। তারপর দুয়েকজন নার্ভাস দেখতে মেয়ে দৌড়ে এসে ঘোষণা করল, মিস অমুক নিচে ডাকছেন, গুটি গুটি ভিড় খালি হয়ে গেল। আমাদেরও দেখা শেষ হয়ে গিয়েছিল, আমরা নেমে এসে উবার বুক করে টাউন হলের দিকে চললাম।
অমৃতসরের সবথেকে সুন্দর অংশটা হচ্ছে টাউন হল এবং হলসংলগ্ন অঞ্চল। সর্বাধিক টুরিস্টলাঞ্ছিতও বটে। ওই অঞ্চলের তিনদিকে হরমন্দির সাহেব অর্থাৎ গোল্ডেন টেম্পল, নবনির্মিত পার্টিশন মিউজিয়াম, জালিয়ানওয়ালাবাগ। জায়গাটা চমৎকার সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এই জায়গাটা নাকি সম্প্রতি এই রকম হয়েছে। বছরখানেক আগেই এই গোটা রাস্তায় গাড়ি ঢুকত এবং যানজট চলত মন্দিরের প্রায় মুখ পর্যন্ত। এখন একেবারে সৌন্দর্যায়নের হদ্দমুদ্দ। রাস্তার দুপাশে গাছ, মূর্তি, সারি সারি দোকান, জুত্তি স্টোর, কৃপাণ ভাণ্ডার, ম্যাকডোনাল্ডস - তাদের নামধাম সব একই ছাঁদ, রং এবং হরফের নাম দিয়ে লেখা। গোটা চত্বরের মাঝখানে মহারাজা রঞ্জিত সিং-এর চমৎকার অশ্বারোহিত মূর্তি। সম্প্রতি গাড়িটাড়ি ঢোকা বারণ হয়েছে কাজেই চালকরা তাঁদের অটো, ব্যাটারি অটো, ট্যাক্সি বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে চত্বরে ঢুকে ক্রমাগত ঘোরাঘুরি করতে থাকেন এবং চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে খদ্দের জোগাড় করতে থাকেন। চেঁচানোর ভলিউম এবং ফ্রিকোয়েন্সি দেখে অমৃতসরের টু ডু লিস্টের জনপ্রিয়তার ক্রম আন্দাজ করা যায়।
লিস্টের টপে ওয়াগা বর্ডার দর্শন। দ্বিতীয় পপুলার হচ্ছে জুত্তি, ফুলকারি শপিং। এ ছাড়া হোটেলের দালালও কিছু ঘোরাঘুরি করছেন।
আমাদের তিনটের একটাও দরকার ছিল না, কাজেই চিত্ত অবিচলিত রেখে হেঁটে চললাম স্বর্ণমন্দিরের দিকে। হাঁটার সময় এদিকওদিক থেকে কমলা রঙের ভাঁজ করা কাপড়ের টুকরো ধরা হাত এগিয়ে আসতে লাগল। আমরা দর করিনি, কিন্তু শুনেছি চল্লিশপঞ্চাশ টাকা চেয়ে বসা কোনও ব্যাপারই না। অর্চিষ্মানের এক সহকর্মী সাবধান করে রেখেছিলেন, মন্দিরের থেকে বেশি দূরে মাথা ঢাকার কাপড় না কিনতে। মন্দির থেকে পাঁচশো মিটার দূরে যে কাপড়ের দাম চল্লিশ, মন্দিরের গেটের বাইরে তাই দশ।
আমি বলব দশ টাকাও খরচ করার দরকার নেই। গেটের ভেতর ঢুকে যান। জুতো রেখে মূল প্রবেশদ্বারের দিকে এগোন। একটা ঝুড়ি দেখবেন। ফিরে যাওয়ার সময় ওই ঝুড়িতে দর্শনার্থীরা মাথার কাপড় খুলে রেখে যাচ্ছেন, একটা তুলে মাথায় বেঁধে নিন। চল্লিশটাকা না, দশটাকা না, এক্কেবারে ফ্রি। আমরা মাথায় কাপড় বাঁধছি এমন সময় একজন এসে বললেন জুতোটা কিন্তু জুতো রাখার জায়গাতেই রেখে আসবেন, না হলে চুরি হয়ে যেতে পারে। আমাদের দেখে নতুন মনে হয়েছে সম্ভবতঃ বা অন্য কোনও কারণে, তাই সাবধান করলেন। আমাদের ভ্যাবাচ্যাকা ভাব দেখে, 'আমার আসলে এখানে ডিউটি তো' বলে জ্যাকেট সরিয়ে ওঁর ব্যাজটা দেখিয়ে হাসিমুখে চলে গেলেন।
অমৃতসরের সর্বত্র তো বটেই, বিশেষ করে হরমন্দির সাহিবের ভেতরে লোকজনের ভদ্র ব্যবহার চোখে না পড়ে থাকে না। এবং এই ব্যবহার শঠে শাঠ্যং নীতিতে বিতরণ করা হয় না। তাহলে এই মোবাইল মহামারী জমানায় অর্ধেক লোকের প্রবেশাধিকার থাকত না। সেদিন একটা আর্টিকল দেখলাম কোনও একটা সাইটে, লিখেছে এখন আমরা সিগারেটকে যে চোখে দেখি, এক সময় আসবে যখন সেলফোনকে সেই একই দৃষ্টিতে দেখা হবে। গুরুদ্বারার ভেতরে ছবি তোলার নিয়ম নেই। কিন্তু প্রচুর লোকে মোবাইলে ছবি তুলছেন। সেলফি, গ্রুপফি, পোর্ট্রেট, আরও যা যা ভঙ্গিতে তোলা সম্ভব। তাছাড়া কথা বলা তো আছেই। মন্দিরের একেবারে নাকের ডগায় গিয়ে একজন ফোনে কানে ধরে কথা বলে চলছিলেন। একজন কর্তৃপক্ষের লোক, যিনি সিল্কে মোড়া ডাণ্ডা তুলে ও নামিয়ে মন্দিরের ভিড়ের স্রোত নিয়ন্ত্রণ করছেন, বারণ করলেন। ভদ্রলোক ফোনটা নিষেধকারী যেদিকে ছিলেন সেদিকের কান থেকে সরিয়ে অন্য কানে ধরলেন এবং কথা চালিয়ে গেলেন। তখন একজন ভক্ত এগিয়ে এসে, অত্যন্ত বিনয়ী হয়ে ঝুঁকে পড়ে বললেন, অনুগ্রহ করে ফোনটা রাখুন দাদা।
পরের দিন, অর্থাৎ রবিবার সকালবেলার আরেকটা ঘটনায় আমি আরও ইমপ্রেসড। একটা বড় গ্রুপের সবাই এক এক করে দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে, হাহাহিহি করে, সোনার মন্দিরকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে ছবি তুলছে। পাশ দিয়ে যাচ্ছিল একটি কিশোর, সাদা পোশাক, কমলা পাগড়ি, কোমরে কৃপাণ। মন্দিরের লোক। দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, সবাই পাশাপাশি দাঁড়ান, গ্রুপ ফোটো আমি তুলে দিচ্ছি। বলে সবাইকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে ছবি তুলে দিল। তারপর ফোন ফেরত দিয়ে বলল, এই তো সবারই ফোটো তোলা হয়ে গেল, আর তুলবেন না দয়া করে।
আমি যদি ওই কিশোরের জায়গায় থাকতাম, আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া হত হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে পুকুরে ফেলে দেওয়া। সেটা করার সাহস না পেলে নিদেনপক্ষে মন্দিরে ঢোকার মুখে লাগানো বোর্ড দেখিয়ে বলা, চোখে ন্যাবা নাকি? আমি জানি ভদ্র ব্যবহারের জন্য বয়সটা ইস্যু নয় কিন্তু ওইটুকু ছেলের আত্মনিয়ন্ত্রণ দেখে লজ্জাই পেলাম। নিজেকে আরেকটু মোলায়েম করার ইচ্ছে হল। দেখা যাক, পারি কি না।
হরমন্দিরে সব ফ্রি। জুতো রাখা, ব্যাগ রাখা, প্রবেশ, লঙ্গরখানায় খাওয়া, সুজিপ্রসাদ সব। মন্দিরের চেহারা দেখে বোঝাই যায়, অর্থের অভাব নেই। মন্দিরের চারদিকে লাগানো স্পিকারে গান ভেসে আসছে, সবক’টা স্পিকার বোসের। আমার আবার মধ্যবিত্ত মানসিকতা, টাকা সম্পর্কে ট্যাবু এখনও কাটাতে পারিনি। নিজের থেকে বড়লোক দেখলেই মনে হয় নির্ঘাত বাজে লোক। মন্দিরের ভালো ব্যবহার, ভক্ত-ফ্রেন্ডলিনেস ইত্যাদি দেখেটেখে মন নরম হয়েই ছিল। অর্চিষ্মান যেই না বোসের স্পিকার পয়েন্ট আউট করল আমি লাফিয়ে গুরুদ্বারাকে ডিফেন্ড করতে নেমে পড়লাম। বড়লোক হলে কী হবে, লোক ভালো। আমার মতো যদি কেউ থাকেন তাঁদের আশ্বস্ত করার জন্য বলি, গোল্ডেন টেম্পলের টাকা আছে কিন্তু টাকার গরমটা একেবারেই নেই। টাকা থাকা আর না থাকা মানুষের মধ্যে ফারাক করার অসভ্যতাটাও না।
হরমন্দির সাহিবের প্রথম আইডিয়া এসেছিল শিখ সম্প্রদায়ের তৃতীয় গুরু অমর দাসের মাথায়। তিনি যখন মন্দিরের জায়গা পছন্দ করেন তখন ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিক। তাঁর উত্তরাধিকারী চতুর্থ গুরু রাম দাস মন্দিরের জন্য সে জায়গার স্বত্ব কেনেন। মন্দিরের কাজ শুরু করেন পঞ্চম গুরু অর্জন। আট বছর ধরে দিঘি খোঁড়া হয়, দিঘির মাঝে বানানো হয় ইটের মন্দির। গুরু অর্জনই মন্দিরে গ্রন্থসাহিব প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর দিঘি জলে ভরে দেওয়া হয়।
শিখ ধর্মের দিক থেক হরমন্দির সাহিব সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই, রাজনৈতিক দিক থেকেও এ মন্দির চিরদিন মধ্যমণি থেকেছে। সেই গুরু রাম দাস জমির স্বত্ব জোগাড়ের সময় থেকে শুরু করে মাঝপথে বারংবার আক্রান্ত হওয়া থেকে অপারেশন ব্লু স্টার পর্যন্ত, যুগে যুগে রাজারাজড়ার লোভ, আক্রোশ, হিংসের ভিকটিম হয়েছে। অনেক ঘা, অনেক চোট পেয়েছে, অনেকবার সে ক্ষত ভরা হয়েছে।
গুরু অর্জন নাকি বাকি শহরের থেকে সামান্য নিচু করে মন্দির বানানোর কথা বলেছিলেন, বিনম্র থাকার গুরুত্ব মনে রাখার জন্য। মন্দিরের চারদিকে দরজা রাখা হয়েছিল যাতে সবাই মন্দিরে ঢুকতে পারে। দিঘি খোঁড়া, মন্দির বানানোর কাজে হাত লাগিয়েছিল অগুনতি স্বেচ্ছাসেবী।
স্বেচ্ছাসেবার সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। এখনও মন্দির পরিচালনার একটা বিরাট অংশ স্বেচ্ছাসেবীরা দেখেন। জুতো, ব্যাগ রাখার কাউন্টারে স্বেচ্ছাসেবী ভক্তরা পালা করে কাজ করেন। লঙ্গরখানার রান্না করেন, বাসন ধোয়ামোছা করেন। মন্দিরের বিশাল চত্বর, দিঘির জলের সাফসাফাই, সবেতেই স্বেচ্ছাসেবী।
ভক্ত পরিষেবা ব্যাপারটা শুনতে অদ্ভুত কিন্তু হরমন্দির সাহিবে সেটাই চোখে পড়ে সবথেকে বেশি করে। গুরুদ্বারায় পা ধুয়ে ঢোকার জন্য যে পরিখা কাটা থাকে তাতে যে জলটা বইছে সেও অল্প উষ্ণ করা, যাতে ভক্তদের পায়ে কষ্ট না হয়। হাত ধোয়ার জন্য কল থেকে জল পড়ছে, তাও উষ্ণ।
মন্দিরের ভেতর ঢুকে প্রথম যেটা টের পাওয়া যায়, বিশেষ করে বছরের এই সময়টায়, বাইরের সঙ্গে ভেতরের তাপমাত্রার তফাৎ। বাইরের কড়া ঠাণ্ডার পর ভেতরের ওম চমৎকার আরাম দেয়। তারপর ঝলসে দেয় ঝকমকে ইনটেরিয়র। সোনালি দেওয়াল সিলিং ছেয়ে অতি সূক্ষ্ম ফুলের ডিজাইন। লতাপাতা।
তারপর কানে আসে গান।
মন্দিরের মূল কক্ষের মাঝখানে সোনার লতাপাতায় আঁকা মহার্ঘ লাল চাদর দিয়ে ঢাকা বাক্স, ওর মধ্যেই আছে গ্রন্থসাহেব। একজন বসে তার সামনে বসে বিড়বিড় করে কিছু একটা পাঠ করছেন। আর একপাশে মাইকের সামনে বসেছেন গাইয়ের দল। সোনালি হারমোনিয়ামের বেলো টেনে টেনে গান ধরেছেন দু’জন, পাশ থেকে সোনালি বাঁয়াতবলায় ঠেকা দিচ্ছেন আরেক পাগড়িধারী। আশেপাশে ইতিউতি বসে গলা মিলিয়েছেন ভক্তরা।
গ্রন্থসাহেবের বেদী আর বেদীসংলগ্ন খানিকটা জায়গা সোনালি রেলিং দিয়ে ঘেরা। তারপর ঘরে আর বেশি জায়গা থাকে না। আমরা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় গেলাম। দোতলায় চারদিকের বারান্দায় জানালা কাটা, সেই জানালার ধারে বসে আপনি গান শুনতে পারেন। করিডরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে চুপ করে বসে গান শুনছেন মানুষ, কেউ বসেছেন জানালায় হেলান দিয়ে।
আমরা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। গান শুনতে শুনতে আরেকটা সন্ধের কথা মনে পড়ল। সারাহানের ভীমকালী মন্দির, এ গুরুদ্বারার তুলনায় অনেক ছোট, কিন্তু সেখানেও মন্দিরের মূল কক্ষ ঘিরে সরু কাঠের বারান্দা, সেই বারান্দায় বসে গান শুনছিলেন জনাকয়েক শ্রোতা। তাঁরা সম্ভবতঃ রোজই আসেন। সে গান কেউ লাইভও গাইছিল না, ভজনের রেকর্ড বাজছিল, তবু ওই পাহাড়ঘেরা মন্দিরের সরু বারান্দার ভেতর নিবুনিবু বাল্বের আলোয় চেনা ভজন অন্য মাত্রা পাচ্ছিল। ছোটবেলায় দক্ষিণেশ্বরে ভিড়ের ঠেলা পেরিয়ে মাকালীর মুখ দেখতে পাইনি, একটা সময়ের পর ইচ্ছেও হয়নি। কিন্তু নাটমন্দিরের গানের প্রতি মুগ্ধতা কখনও কমেনি। কিংবা অনেক বছর আগে গান শিখে ফেরার পথে সন্ধেবেলা রেললাইনের পাশে মস্ত অশ্বত্থগাছটার নিচে ছোট হনুমানমন্দিরের সামনের লাল চাতালে বসে ঢাকঢোল বাজিয়ে হনুমানচালিশা শুনতে পেতাম। টিউনিং না করা হারমোনিয়ামের প্যাঁ প্যাঁ, ঢোলের ধুমধাড়াক্কা, আমার সদ্য শিখে আসা লয়কারী তানকারী ঠমকগমক মাথা থেকে বার করে দিত। আফসোস হত আরেকটু সাহসী কেন হলাম না, তাহলে ‘আমিও গাইব’ বলে চাতালে উঠে গলা ছাড়া যেত। বড় বয়সে নিজামুদ্দিন দরগাতেও সেই একই অনুভূতি হয়েছে। হারমোনিয়াম বাজিয়ে, ঢাকঢোল পিটিয়ে যখন সুফি কাওয়ালি ধরা হয় তখন আমার মতো হাতে পায়ে খিল ধরা লোকেরও সতর্ক থাকতে হয়, কখন না উত্তেজনার বশে দুই হাত মাথার ওপর তুলে নাচতে শুরু করি।
বসে বসে সারা সন্ধে গান শোনাই যেত, কিন্তু আমাদের দেড়দিনের টুরিস্ট, টু ডু লিস্টের অর্ধেকও টিক মারা যাবে কি না সন্দেহ হচ্ছে তাই আর অপেক্ষা করলাম না। গুরুদ্বারার ভেতরেই আরেকটা টু ডু ছিল। কড়া প্রসাদ। অর্থাৎ কি না গব্যঘৃতে রান্না হওয়া সুজির হালুয়া। অনেকদিন আগে মণিকরণের গুরুদ্বারায়, পরে মায়ের সঙ্গে ধুবরির গুরুদ্বারায়, যেখানে নাকি স্বয়ং নানকের পদধূলি পড়েছিল, সেখানেও এই সুজিপ্রসাদ খেয়েছি। সুজি তো জীবনে কম খাইনি, কিন্তু অভিজ্ঞতায় জানি, গুরুদ্বারার প্রসাদের সঙ্গে স্বাদে পাল্লা দেওয়া সুজি চট করে পাওয়া শক্ত। মিস করার প্রশ্নই ওঠে না।
হাতে লেগে থাকা সুজির গুঁড়ো জিভের ডগা দিয়ে চেটে নিয়ে, কলের জলে হাত ধুয়ে, মাথার বাসন্তী বসন ছেড়ে ফেলে, জুতো পরে গুরুদ্বারার বাইরে বেরিয়ে এলাম।
(চলবে)
Khubi bhalolaglo lekhata :) Ar chhobigulo-o chomotkar....
ReplyDeleteধন্যবাদ, ধন্যবাদ, সায়ন।
Deleteঅমৃতসর ভ্রমনে বেরিয়ে সুজি পর্যন্তখাওয়া শেষ হল। সুজির গন্ধটা দারুণ, কিন্তু তার থেকেও দারুণ কি বলতো? লেখার প্রতি ছত্রে প্রবাহিত আড্ডাবাজির স্রোতটা। সত্যি বলছি কুন্তলা, তোমার লেখা পড়ার পর এত ইচ্ছে অরে তোমার মুখোমুখি এক জম্পেশ আড্ডায় বসতে। তুমি কি এবার রামগড়ে আসছ? তুমি যদি না আসতে চাও, তবে আমিই তোমার বাড়ি পৌঁছে যেতে পারি। আঃ, এই সময় বাবি থাকলে কি যে ভাল হত। তোমায় জোর করে ধরে আনতে পারতাম।
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, মালবিকা। মুশকিল হচ্ছে আমি এ বার পুরো আটচল্লিশ ঘণ্টাও থাকছি না পশ্চিমবঙ্গে, তার মধ্যে আবার অর্ধেক গাঙ্গুলিবাগান অর্ধেক রিষড়া ভাগাভাগি। এবার সত্যিই সময়ের বড্ড টানাটানি। পরে কখনও হাতে সময় বেশি নিয়ে গেলে নিশ্চয় কিছু একটা প্ল্যান করা যাবে।
DeleteNotun bochhorer shurute shiter chhutir amej makhano lekha----besh bhalo laaglo. Aami saare tin bochhor boyose Amritsar gechhilam. Gurudwara r bhetor ta ektu aabchha mone pore, mathai rumal poriye dilo maa aar ashchorjo rokom bhabe prasad er sujir kotha mone aachhe....
ReplyDeleteধন্যবাদ, সুস্মিতা। ওইরকম ভালো সুজির কথা মনে পড়াই স্বাভাবিক।
Deleteগোল্ডেন টেম্পল বাদে অমৃতসরে এত কিছু দেখার আছে জানতাম না
ReplyDeleteঅমৃতসর চমৎকার শহর, নালক।
Delete