বইমেলা ২০১৯




অনেক বয়স হয়েছে কবে কখন কোথায় কী বলেছি মনে থাকে না, হয়তো আমিও এ বিষয়ে গলার শিরা ফুলিয়েছি কখনও। বইমেলায় কফি কেন থাকবে, মাছভাজা কেন থাকবে, মুখের ছবি আঁকার স্টল কেন থাকবে, জ্যোতিষী কেন থাকবে, গিটার কেন থাকবে, বিরিয়ানি কেন থাকবে, অম্বল কেন থাকবে, হজমি গুলি কেন থাকবে।

বইমেলায় যদি কিছু থাকতেই হয় তাহলে থাকবে বই। শত শত কাগুজে খসখসে বই, যা মনের জানালা খোলে, জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন ঘটায় হয়, বই না-পড়া মানুষের থেকে বই পড়া মানুষকে বেটার প্রতিপন্ন করে।

আপনি সে রকম বইমেলা দেখেছেন কি? আমি দেখেছি। এই দিল্লিতেই হয়। প্রগতি ময়দানে। বিশ্ব বইমেলা। রাজধানী বলে কথা, গুরুগম্ভীর প্রকাশনা সংস্থারা আসেন। যেদিকে তাকাও বই আর বই আর বই। আর গুরুগম্ভীর জনতা। ভুরু কুঁচকে বইয়ের পাতা উল্টোচ্ছেন। এগরোল খাননি জীবনেও। মেলা চলছে না শোকসভা চট করে বুঝে ওঠা মুশকিল।

কলকাতা বইমেলাটাকে আর যাই হোক, মেলার মতোই দেখতে লাগে। পাঁচ বছর বাদে সেই মেলায় গেলাম। প্রথম দিকে নানা রকম  হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটতে শুরু করল। অর্চিষ্মানের ওই সময় কাজ থাকবে, কাজেই কলকাতা যাওয়া হবে না। মাবাবার সঙ্গে মেলায় ঘুরতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু অভ্যেস খারাপ হয়ে গেছে, সন্দেহ হয় অর্চিষ্মান সঙ্গে না থাকলে যতটা মজা হতে পারত ততটা হবে না হয়তো। 

তারপর জানা গেল অর্চিষ্মানের কাজটা কলকাতাতেই। আমাদের একটা আফসোস আছে যে আমাদের আলাপ দুজনেরই কলকাতা ছাড়ার পরে হয়েছে কাজেই কলকাতায় যুগলে ঘোরাঘুরির সুযোগ আমরা বিশেষ পাইনি। সেই অন্যায়ের বদলা নিতে নানারকম উত্তেজিত প্ল্যান করে ফেললাম। কলেজ স্ট্রিটে দেখা করব, প্যারামাউন্টে শরবত খাব, মেলায় ঘুরব ইত্যাদি প্রভৃতি। মাবাবাদেরও একেবারে বাদ দেওয়া হয়নি। একদিন শ্বশুরবাড়ি, একদিন বাপের বাড়ির সঙ্গে যাব ভেবেছিলাম, শেষমেশ মোটে একদিনই মেলায় যাওয়া হল, সবার সঙ্গে আনন্দও জমাট বেঁধে চতুর্গুণ হল।

বইমেলার জায়গা বদলেছে, টিকিট কাটা না কাটার নিয়ম বদলেছে। আমার মতে চরিত্রও বদলেছে। চরিত্র বদলানোটা অবশ্য জায়গার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। মাঠে মেলা হওয়ার সময় যত্রতত্র বসে পড়ে গিটার নিয়ে গান হত। হয়তো এখনও দিনের শেষে বেচাকেনা ফুরোলে স্টলের বাইরে গানটান হয়, কিন্তু এমনি এদিকসেদিক বসে পড়ে ধুলোয় বসে পড়ে গিটার বাজিয়ে বিরহের জীবনমুখী গান, ছোটবেলায় দেখেছি বলেই বোধহয় আবার দেখতে ইচ্ছে করে।

মা বাবা বইটই কিনলেন, আমরা সঙ্গ দিলাম। ভেজ প্যাটিস, আইসক্রিম খাওয়া হল। আর অগুনতি লেমন টি।  চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে যতবারই যাচ্ছিলাম এক কাপ করে লেমন টি খাচ্ছিলাম। শেষটা আর বলতেও হচ্ছিল না, দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই ছেলেটা চায়ের কাপ হাতে ধরিয়ে দিচ্ছিল। ওই চা টুকু না থাকলে আমার বইমেলার আনন্দ অর্ধেক হয়ে যেত। আইসক্রিম আর ভেজ প্যাটিস না থাকলে আরও অর্ধেক। অর্থাৎ বইমেলার আনন্দ সিকিভাগ হয়ে যেত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে বইমেলার বিশুদ্ধতা নষ্ট করার জন্য বেনফিশের নামে নালিশ করতে গিয়েছিলেন কেউ, তাতে উনি বলেছিলেন, আহা মেলা যখন থাকলই না হয়। মেলাটাকে আরও মেলার মতো করার জন্য যদি নাগরদোলাটোলা বসানোর ব্যবস্থা হয় তাতেও দোষ দেখি না। আমি সুনীলের সঙ্গে একমত। পরের বার থেকে নাগরদোলাও হোক, আইসক্রিম খেতে খেতে চড়া যাবে।

লেমন টি-র দোকানে একটা মজার ঘটনা ঘটল। আমার পাশে দাঁড়িয়ে চা বা কফির অপেক্ষা করছিলেন এক ভদ্রলোক। আমাকে বললেন, আসুন না ম্যাডাম আমাদের স্টলে, কিছু ইনভেস্ট করতে হবে না, জাস্ট ঘুরে যান। ওঁর শব্দচয়নে কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম আপনাদের স্টলটা কীসের? আঙুল দিয়ে দেখালেন, এই তো, এস বি আই। বললাম, আর কিছু বলার দরকার নেই। আমার খুদকুঁড়ো যা আছে, সব আপনাদের ফিক্সড ডিপোজিটেই যায়, যাবেও। অন্য ব্যাংকের নাম শুনলেই আমার বুক ধড়ফড় করে। মনে হয় এই বুঝি সব টাকা মেরে পালাল। ভদ্রলোকের মুখটা দেখার মতো হয়েছিল। এত খুশি উনি গত তিন মাসে হননি, গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি। তার নিশ্চিত প্রমাণ, ম্যাডাম থেকে দিদি হয়ে যাওয়া। ছ’খানা ভর্তি কাপ টি একটা ট্রে-তে ব্যালেন্স করে নিয়ে যেতে যেতে বলে গেলেন, দিদি, আলাপ করে খুব ভালো লাগল। বললাম, আমারও আমারও।

ঘোরাঘুরি করতে করতে অনেকের সঙ্গে দেখা হল, সুস্মিতা, অদিতি, অনিন্দ্য, প্রদীপ্ত, সৌগত। সন্ধে নামল। রিষড়ার বাবামা বাড়ি রওনা দিলেন। নাকতলার মা, আর হাঁটছি না বাবা, বলে বাউল গানের সামনে বসে বইয়ের প্যাকেট খুললেন। আমরা বললাম, একটু ঘুরে আসছি। 

আবোলতাবোল ঘোরারও যেমন উদ্দেশ্য ছিল আমাদের তেমনই নম্বর খুঁজে খুঁজে কয়েকটা বিশেষ দোকানে যাওয়ারও ইচ্ছে ছিল। নম্বর খুঁজতে অসুবিধে হচ্ছিল যদিও। একজন প্রচণ্ড রেগে বলছিলেন, এরা কি এক দুই গুনতে শেখেনি? সত্যিই নাম্বারিংটা খটমট হয়েছে। আসলে ঝাঁক ঝাঁক করে দোকান বসানো হয়েছে, যেখানে চারশো সাত শেষ হচ্ছে, চারশো আট তার পর থেকে শুরু হচ্ছে না। কোনও একটা গেটের মুখে একটা ম্যাপ দেখেছিলাম, কিন্তু আরও কয়েকটা ম্যাপ ইতিউতি রাখলে মন্দ হত না। এই সব করতে করতে মারাত্মক হাঁটা হয়ে গেল। শেষদিকটা মনে হচ্ছিল পায়ের পাতা না খুলে হাতে চলে আসে। 

অত হাঁটতে পারতাম না যদি না ইতিউতি থেকে সেলিব্রিটিরা দেখা দিয়ে যেতেন। আন্দাজ করেছিলাম শনিবার সন্ধেবেলায় চাঁদের হাট বসবে, বসলও। লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, রন্ধনশিল্পী, গায়ক, বাদক কেউ বাদ নেই। আমার আবার একটা বদভ্যেস আছে। অফ কোর্স, যারা ধূমকেতু, পেছনে অনুগামীর ল্যাজ নিয়ে ঘোরেন তাঁদের সযত্নে এড়িয়ে চলি কিন্তু পছন্দের লোককে একা বা দোকা পেলে জানাই আপনার লেখা বা অমুক বিষয়টা আমার খুব ভালো লাগে। সানডে সাসপেন্সের ইন্দ্রাণীকে মেলায় দেখলাম (এখন যদিও উনি আর সানডে সাসপেন্সের সঙ্গে যুক্ত নন, কিন্তু লিজেন্ডটা ওঁর হাত ধরেই গড়ে উঠেছে), দৌড়ে গিয়ে বললাম, কত ভালোবাসি সানডে সাসপেন্স। তন্দুরি চিকেন না কী একটা খাবার দোকানের সামনে আরেকজনকে দেখলাম, দেখেই চিনেছি, উনি রুফটপে ড্রাম এবং অন্যান্য তালবাদ্য বাজান। বললাম দেখেছি ইউটিউবে, খুব ভালো লাগে আপনাদের কনসার্ট। হেসে বললেন, থ্যাংক ইউ, খুশিই হলেন মনে হল।

তবে সবাই খুশি হন না। একজনকে যেমন বলতে গিয়েছি আপনার লেখা খুব ভালো লাগে। তিনি বেঁকা হেসে বললেন, আসল লেখাগুলো পড়ে বলছেন নাকি স্রেফ ফেসবুক স্টেটাস পড়েই? থতমত খেয়ে বললাম, না মানে অন্য লেখার কথাই বলছি। অর্চিষ্মান বলল, আরও যাও দৌড়ে। সেলিব্রিটিদের থেকে যত পার দূরে দূরে থাকবে। প্রথমটা একটু বোমকে গিয়েছিলাম কিন্তু তার পর মনে পড়ল, আঙুলের মতো সেলিব্রিটিরাও সবাই সমান হন না। কাজেই আমি দমছি না। ভালো লাগলে ভালোলাগা প্রকাশ করার নীতিতে অটল থাকছি। 

ঘুরতে ঘুরতে বুঝতে পারছিলাম বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মেলার নেশা মাথায় চড়ে গিয়েছিল, থামতে পারছিলাম না। ভাগ্যিস মা ফোন করে বললেন, কী রে বাড়ি যাবি না নাকি? তখন এই তো হয়ে গেছে বলে দৌড়ে বাউল গান পয়েন্টে ফিরে এলাম।  আবার কবে যাওয়া হয় না হয় ভেবে বেশ মন খারাপ করছিল আসার সময়। ভারি ভালো কেটেছিল সে দিনটা।

কিছু বইও জোগাড় হয়েছে। আমি যথারীতি যেগুলো কিনব প্ল্যান করেছিলাম সেগুলোই কিনেছি, অর্চিষ্মান দেখেশুনে বেছেবুছে অজানা অচেনা বই কিনেছে। দুই স্যাম্পল থেকে দুটো বইয়ের খবর শিগগিরই আপনাদের দিতে পারব আশা করি। 



Comments

  1. Khub valo. Boier listi deben dujoner e, r review. Opekhay roilam

    ReplyDelete
    Replies
    1. লিস্ট দেওয়া একটু ঝামেলার, সুহানি, তবে কয়েকটা বইয়ের রিভিউ নিশ্চয় দেওয়ার চেষ্টা করব।

      Delete
  2. ভালো লাগলে ভালোলাগা প্রকাশ করার নীতিতে অটল থাকছি। - Kothata shahosh jogalo, othocho kothao porechhilam j diney ekta compliment nishchoi dewa uchit, of course honest compliment, tatey money khub bhalo lage ... goto bochhor r tar ager bocchor jete perechhilam besh kichhu bochhor gap er por ... tai ei bochhor na jetey paray extra koshto hochhilo ... kintu asha rakhi, abar ekta shomoy ashbe jokhon proti bocchor jetey parbo, tao ekadhik diney .... Apnara bhalo thakben ...

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই প্রতিদিন কমপ্লিমেন্ট দেওয়ার ব্যাপারটা আমিও পড়েছি, অনুরাধা। প্রতিদিন শুনলে একটু মেকানিক্যাল মনে হয় বটে, কিন্তু আসল হচ্ছে প্রশংসা করার সাহসটা জোগাড় করতে পারা। অভ্যেসটা গড়া। অফ কোর্স, যদি জরুরি মনে হয় তবেই।

      Delete
  3. আমিও food for thought আর thought for food দুয়েতেই বিশ্বাসী। রিভিউ এর অপেক্ষায় রইলাম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভেরি গুড, নালক। বিশ্বাসের রেঞ্জটা বড় হলে ক্ষতির থেকে লাভই বেশি বলে আমার ধারণা।

      Delete
  4. আমার এই শেষতম বার বইমেলা যাওয়া, ওই গুনতে না শেখার ব্যাপারটা আমাকেই বলতে শুনে থাকতে পারো। অসম্ভব বিরক্ত হয়েছি, কেমন গায়ে গায়ে স্টল, ঘুপচি মত, হাঁটার জায়গা নেই, অথচ অন্য কোনো মেলায় সেন্ট্রাল পার্কে গেলে এমন তো লাগেনা। এবং এবং এবং, জীবনে পেত্থমবার আমার ব্যাগ থেকে কোনো এক মহানুভব টাকার ব্যাগটি হাতসাফাই করেছেন এই বইমেলায়। তাই তিতিবিরক্ত হয়ে আর না যাবার সিদ্ধান্ত।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ইস, পকেটমারি হলে ভীষণ খারাপ লাগে। তাছাড়া অনেক কার্ড ইত্যাদিও তো ছিল সম্ভবতঃ, সেগুলোর হিল্লে করতে নিশ্চয় ঝামেলা পোয়াতে হয়েছে? আমার সমবেদনা রইল, শাল্মলী।

      Delete
    2. হ্যাঁ, ওই ব্লক করা ইত্যাদি। ভাগ্যিস মহানুভব আমার ফোনটার ওপরে দয়া করেননি। তাহলেই গিয়েছিলাম আর কি।

      Delete
  5. Melay omuk tomuk college university er puro fanka stall gulo, kimba selfie competition, bibhinno tv channel er stall, free wifi debar naam e telecomm er stall jekhane melay wifi kaj korena.. egulo baad dile jara kom budget bole jayga payna.. tader jayga hoto.. seta na holeo guitar bajiye gaan kora ba bosar jayga hoto.. guitar bajiye gaan korata amar khub bhalo lagto.. numbering ami ager bareo bujhini.. ebar to jaini.. benfish to khub bhalo chilo.. last year ekta lok bhir er modhye monginis er pizza khete khete mukhe cheese mekhe amake ki ekta stall er naam jiges korechilo.. issh.. :P

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, শেষের ব্যাপারটায় মঞ্জিনিসের থেকে লোকটার দোষ বেশি বলে মনে হচ্ছে, ঊর্মি।

      Delete
    2. Thik.. issue ta holo boro duto boi er stall er gaye sandwich er moto monginis k bosano hoyechilo.. kichu lok to sekhane khabei.. ei sodbuddhi gulo boimela kortipokkher dekhano uchit.. seta keu ajkal dekhano dorkar mone korena..

      Delete
    3. ওহ, আমি দোষ বলতে লোকটার মুখে খাবার নিয়ে কথা বলাটা আর প্রাপ্তবয়স্ক হয়েও পিৎজা খেতে গিয়ে সারা মুখে চিজ মাখামাখি করাটা বোঝাতে চেয়েছি, মনজিনিসের দোকান বসানোর সিদ্ধান্তটাকে নয়।

      Delete
    4. Ekdom ... Lokta puro khilli chilo.. pizza kheye dekhi geeta kinte geche ... Mane oi bedanta type er stall e ghurchilo .. �� oboshyo erokom loker ovab nei.. sob jaygay pawa jay..

      Delete
    5. Acha ekta onno kotha bolchi.. tumi ki purono photo tule niyecho.. ami berlin ta porchilam onek photo dekha jacchena

      Delete
    6. হ্যাঁ, ওই ফোটোগুলো কেন যেন সব হাওয়া হয়ে গেছে। আমি কোনও কারণ খুঁজে পাইনি রে ঊর্মি।

      Delete
  6. তোমার সাথে দেখা হয়ে আমার এই জীবনের একটি ইচ্ছেপূরণ হয়েছে। তোমরা খুব ভালো থেকো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমারও খুব ভালো লেগেছে, সুস্মিতা। দারুণ মজা হয়েছে।

      Delete
  7. বইমেলা আমি এ এবার প্রায় রোজই গেছি...একা দোকা, দল সবেতেই। তোমার সাথে দেখা হয়ে ভারী ভালো লেগেছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমারও তোমার আর সৌগতর সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভালো লেগেছে, প্রদীপ্ত। এখনও মনে পড়লে মন খুশি হয়ে যায়।

      Delete

Post a Comment