উত্তরাধিকার




বইমেলায় সৃষ্টিসুখের স্টলে নাকতলার মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে সৌরাংশু বলল, আপনি একেবারে আপনার ছেলের মুখ পেয়েছেন। মা অবশ্য মনে করেন অর্চিষ্মান বাবার চেহারা পেয়েছে, কিন্তু পাওয়াপাওয়ির ব্যাপারে নাকচোখমুখের থেকে রকমসকম, হাবভাব ম্যাটার করে বেশি। আমি আমার মায়ের তেমন কিছুই পাইনি কিন্তু কথা বলার ধরণখানা পেয়েছি বলে সবাই বলে আমি মায়ের মেয়ে। এদিকে আমি যে বাবার মেজাজখানা নিক্তি মেপে পেয়েছি কিন্তু সে কি না বাইরে প্রকাশ পায় না, বুকের ভেতর ধিকি ধিকি জ্বলে, তাই লোকে ভাবে আমি বাবার কিছুই পাইনি। অথচ আমার মতে জেনেটিক উত্তরাধিকারের মধ্যে নাক চোখ ভুরু চোয়ালের মিলের থেকে ঢের ইনটারেস্টিং হচ্ছে পায়ের ওপর পা তুলে বসার মিল। তাকানোর মিল। আমি আর আমার জেঠু দুজনেই মন দিয়ে শুনলে ঘাড় কাত করে চোখ সরু করে শুনি। আমার বাবা বাড়িতে এঘর ওঘর চলতেফিরতে মাঝে মাঝে ”ব্যোম ভোলে” বলে ওঠেন, ইদানীং আমারও হঠাৎ হঠাৎ মুখ থেকে “ব্যোম ভোলে” বেরিয়ে পড়ছে। ইচ্ছে করে নয়, প্রক্রিয়াটা প্রায় হেঁচকির মতো অনৈচ্ছিক। প্রথম যেদিন ঘটেছিল অর্চিষ্মানের নাকে চা ঢুকে গিয়ে একশা কাণ্ড হয়েছিল, এখন খালি মাথা নাড়ায়। তবে নাকচোখ দিয়ে মিল বিচার আনইন্টারেস্টিং হলেও, নিরাপদ। স্বভাব মেলাতে বসলে ভালোর উত্তরাধিকার ভালো,  খারাপের উত্তরাধিকার খারাপ এই করতে করতে বিবিধ গোলমালের উৎপত্তি হতে পারে, কাজেই নাক চোখ মুখ রং কে কার পেয়েছে সেই দিয়ে উত্তরাধিকার চেনানোই সেফ।

*****

ছাব্বিশে জানুয়ারি যে এ বছর ছুটি পাওয়া গেল না সেই নিয়ে আমার রাগ ছিল। আমার মা কোনও রকম জাতীয় ছুটির দিবসে দিল্লির রাস্তায় না বেরোনোর স্ট্যান্ডিং নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন কারণ কোথায় বোমা ফাটে তার ঠিক নেই, তবু ছাব্বিশে জানুয়ারি বেরিয়েছিলাম। বেরোতেই হল। শীতের রোদ জানালা দিয়ে মেটে হলুদ বেডকভারে এমন তেরছা হয়ে পড়ল যে আর ঘরে থাকা গেল না। 

ছাব্বিশে জানুয়ারি বেরোনোর একটাই অসুবিধে, সব দেখার দোকান, খাওয়ার দোকান বন্ধ। তাতে সুবিধেই হল। অনেকদিনের সাধ ছিল রাস্তায় কাত করা পেতলের হাঁড়িতে রাখা ছোলে আর কুলচা খাব, খাওয়া হল। হাঁড়ি থেকে হাতায় করে ছোলে নিয়ে, পেঁয়াজ, লংকা ধনেপাতা কুচি আর লেবুর রস মিশিয়ে শালপাতার বাটিতে তাকে পরিবেশন করা হল। তারপর প্রিমেড সাদা ফ্যাটফেটে কুলচা প্লাস্টিক ছিঁড়ে বার করে, খুন্তির কোণায় করে অল্প তেল গরম তাওয়ায় ছিটিয়ে, ধনেপাতাকুচি ছড়িয়ে তার ওপর কুলচাগুলো খুন্তি দিয়ে চেপে চেপে গরম করা হল। ফুড চ্যানেলে শেফরা একেই বলেন ফ্রেশ হার্বস দিয়ে ফুডকে রিফ্রেশ করা। 

অমৃতসরি কুলচার স্বাদ তখনও মগজে জ্বলজ্বল করছে কিন্তু খিদেপেটে খারাপ লাগল না। কুলচা খেয়ে আমরা আরও একটা ‘প্রথম’ খেলাম। দিল্লির রাস্তায় শকরকন্দ বা মিষ্টি আলু সেঁকা বিক্রি হয় তেকোনা স্ট্যান্ডের ওপর রেখে। সেটার দিকে অনেকদিন আমি সন্দেহজনক দৃষ্টিপাত করেছি, খাইনি কখনওই কারণ ধারণা ছিল ভালো লাগবে না। কিন্তু ওইরকম সুন্দর শীতের দুপুরের রোদে সবকিছুই ভালো লাগবে আশা জাগে। অন্ততঃ ট্রাই করে দেখার সাহস জোগানো যায়। ট্যাবা ট্যাবা মাকুর মতো লাল আলু। সুসিদ্ধ আলুর মধ্য দিয়ে ছুরি চলে গেল যেমন যায় এঁচোড়ে পাকা কিশোরীর হৃদয় গলে দাস ক্যাপিটাল মুখস্থ বলা দাদার চশমাপরা চাউনি। তারপর দুই হাতে শালপাতার বাটি ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে “তেজ” পরিমাণ মশলা মাখিয়ে খাও টুথপিক গুঁজে।

আমার সন্দেহটা ঠিকই ছিল। বড় বেশি মিষ্টি। আর খাব না, কিন্তু একবার খেয়ে দেখার ইচ্ছেটা মিটল।

শেষপাতে ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার মোড়ের চায়ের দোকান থেকে কফি। কফির কাপ হাতে রেলিংঘেঁষা পাথরের স্ল্যাবে বসে কে এন এস ডি-র ছাত্র আর কে এন এস ডি-র ছাত্র নয়, কে বাঙালি নয় আর কে হান্ড্রেড পার সেন্ট বাঙালি গেস করার খেলা খেললাম। 

মোট কথা ছাব্বিশে জানুয়ারি আমাদের আমাদের খুবই ভালো কাটল। বাড়িতে এসে মাকে ফোন করে বললাম। ওঁদেরও যে প্রজাতন্ত্র দিবস ভালোই কাটছে আশ্বাস ছিল। কারণ ছাব্বিশে জানুয়ারি আমাদের পাড়ায় স্পোর্টসের তারিখ।

শুনলাম বাবা সকাল থেকেই মাঠে, মা ভাবছেন যাবেন না। আমি বললাম যাও যাও, খেলায় নাম দাও। মা এমন হাসলেন যে ভয় লাগছিল চোখ দিয়ে জল না বেরিয়ে যায়। একটা কথা মনে পড়ে মজা লাগল। আমাদের পাড়ায় স্পোর্টসে নাম দিতে চাওয়া মহিলাদের জন্য তিরিশোর্ধ্ব থেকে আমৃত্যু একটাই ক্যাটেগরি। অর্থাৎ মা আর আমি এখন স্পোর্টসে নাম দিলে মেমোরি রেসে দুজনকে একই বাটির ওপর ঝুঁকে পড়ে রাঁধুনি, জিরে চিনতে হবে। 

বাবাদের জন্য বুড়োবার সীমাটা আরেকটু দেরিতে, চল্লিশ টু আমৃত্যু। এই প্রসঙ্গে অনেকদিন, মানে অনেএএএকদিন আগের একটা স্মৃতি মনে পড়ে গেল। বাবার মাথার সামনেটা তখন আমার এখনকার সামনেটার মতোই, অনেকখানি সাদা। সকালে আমার খেলা হয়ে গেছে, যথারীতি আমি সে সব রেসেই সুবিধে করতে পেরেছি যেখানে আমার শারীরিক শক্তি, ক্ষিপ্রতা, নমনীয়তা ইত্যাদির প্রমাণ চাওয়া হয়নি। অর্থাৎ গুলিচামচ আর অংক রেস। তবে যেগুলো ভালো পারি খালি সে সব খেলাতেই নাম দেব এমন যুক্তিতে আমার ছোটবেলা চলত না। রানেও নামতে বাধ্য করা হত এবং আমি প্রতি বছর লাস্টে কিংবা লাস্টের আগে পৌঁছে লোক হাসাতাম। যাই হোক, সে সব হেনস্থার পালা শেষ, এবার বাবার নাম দেওয়ার পালা।  নাম লেখার সময় একজন কাকু বাবাকে বললেন, মেজদা, তোমার এখনও চল্লিশ হয়নি? ইয়ার্কি? বাবা বললেন, আরে সত্যি হয়নি রে। কাকু বাবার মাথার দিকে তাকান আর মাথা নাড়েন। আমার বাবা তখন আমি এখন যা, তাই, অর্থাৎ আটত্রিশ, আমি দশ। আমিও খুব ঘাড় নেড়ে নেড়ে বাবাকে সমর্থন জানিয়েছিলাম মনে আছে। কাকু, সত্যি বাবার চল্লিশ হয়নি। 

সেই বাবার এই জানুয়ারিতে সাতষট্টিতে পড়লেন। বাবার এখন ইভেন্ট হচ্ছে মিউজিক্যাল হ্যাট, যেখানে বাজনা চলার সঙ্গে সঙ্গে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পাশের লোকের মাথায় টুপি পরাতে হয় আর বাজনা থামলে যার মাথায় টুপি থাকে সে আউট হয়ে যায়। তার থেকে ঢের ইন্টারেস্টিং খেলা হচ্ছে চোখ বেঁধে হাঁড়ি ভাঙা। 

আমি জীবনে একবারই হাঁড়ি ভাঙা খেলায় নাম দিয়েছিলাম। মামাবাড়ির ছাদে। ছাদ বলে হেলাছেদ্দা করার কিছু নেই, রীতিমত প্যান্ডেল বেঁধে স্পোর্টস হচ্ছিল। ফার্স্ট থেকে শুরু করে সান্ত্বনা পুরস্কারের ব্যবস্থা ছিল। সিরিয়াস ব্যাপার। মামাবাড়ির আশেপাশের ছাদের রেলিং-এ ঝুঁকে দাঁড়িয়ে লোকজন চিয়ার করছিল। সেখানে আমি কেন প্রাইজ পাইনি জানেন? কারণ চোখ বেঁধে ভাইবোনেরা এদিকওদিক হুড়ুমদুড়ুম ঘুরিয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার পর তিন সেকেন্ড নিয়েছিলাম ধাতস্থ হতে, তারপর হনহনিয়ে হেঁটে গিয়ে হাঁড়িতে ঠোক্কর খেয়েছিলাম। 

পত্রপাঠ ডিসকোয়ালিফায়েড। কেন? না হাঁড়িতে লাঠি মারতে বলা হয়েছে, লাথি নয়।

কারা প্রাইজ পেল? উল্টোদিকে গিয়ে পাখির বিষ্ঠালাঞ্ছিত সিনটেকসের ট্যাংকে বাড়ি মেরেছিল যে তারা। কাদের হারিয়ে? যারা সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করেও বোঝেনি গোলমাল হয়েছে, তাদের।

সেই রাগ আমি এখনও পুষে রেখেছি (বাবা হলেও রাখতেন।) 

রাতে বাবার ফোন এল। "সোনা!" শুনেই বুঝেছি ভালো খবর। বাবা হাঁড়ি ভাঙায় সান্ত্বনা না, থার্ড না, সেকেন্ড না, এক্কেবারে ফার্স্ট হয়েছেন।

ব্যাকগ্রাউন্ডে মায়ের উত্তেজিত গলা পাচ্ছিলাম। প্রাইজও নাকি ভালো পাওয়া গেছে। যে রকম প্রাইজ খালি ঘরের শোভা বাড়ায় না, কাজের কাজে লাগে। স্টিলের ছড়ানো একখানা টিফিনবাক্স। এর পরের বার পুরী যাওয়ার সময় পরোটা আলুভাজা প্যাক করতে কোনও অসুবিধে হবে না। তিন সেকেন্ড থেমে মা বললেন, তোকেও তিলের নাড়ু দিয়ে দেওয়া যাবে সোনা। 

হাঁড়িভাঙা আমাদের স্পোর্টসের অন্যতম জনপ্রিয় ইভেন্ট। সেই সময় সাধারণতঃ মাঠভর্তি দর্শক থাকে। মাংসভাত পরবর্তী দিবানিদ্রা সেরে সকলে ভিড় করে আসেন। যে প্রতিযোগী যত খারাপ করে দর্শকের উত্তেজনা তত বেশি। সেই তুমুল উত্তেজনা ধারণ করার শক্তিও অবাক করার মতো। আমি নিজে চোখে দেখেছি, একজন সম্পূর্ণ উল্টোদিকে হেঁটে পুকুরে নেমে যাচ্ছেন দেখেও ছয় থেকে ছিয়াশি মাঠভর্তি দর্শক মুখে আঁচল কিংবা হাত চাপা দিয়ে নিঃশব্দে হেসেছে, পুকুরে পা দেওয়ার আগের মুহূর্তে কেউ গিয়ে দৌড়ে কাছা টেনে ধরেছে, আরে জেঠু কর কী। স্বচক্ষে দেখেছি, দুই হাতে লাঠি মাথার ওপর হাঁকিয়ে তোলা মোজেসের সামনে হাসির দমকে কাঁপতে কাঁপতে ভাগ হয়ে যাচ্ছে জনসমুদ্র। ফোল্ডিং কাঠের চেয়ার টপাটপ ভাঁজ হয়ে যাচ্ছে, একটুও শব্দ হচ্ছে না। দেখিই না কোথায় যায়। যেই না সে লাঠি মণ্ডপের লাল সিঁড়িতে আছড়ে পড়ছে, চোখের বাঁধন খুলে বোকা বোকা হাসি হাসা লোকটির হেনস্থার প্রতি উল্লাস পুকুর পেরিয়ে পাশের পাড়ায় পৌঁছচ্ছে। 

আমার বাবা সে রকম হেনস্থা হননি। তিনি গটগটিয়ে হেঁটে এসে হাঁড়ির মোটে চার ফুট দূরে, যা কি না স্পোর্টসে হাঁড়ি ভাঙার ইতিহাসে রেকর্ড হলেও হতে পারে, লাঠি মাঠের ওপর দড়াম করে মেরেছেন এবং বাকিদের হেলায় হারিয়ে ফার্স্ট হয়েছেন। 

ফার্স্ট।

চোখ বেঁধে সোজা হাঁটার ক্ষমতাটা যে আমার বাবা ঠিক আমার মতোই পেয়েছেন, এটা জেনে আমার ভারি গর্ব হল।

*****

বোনাস কুইজঃ "ঠাকুরদার একটা গুণ পেয়েছে আরকি।" সংলাপটা ফেলুদার কোন গল্পের?

উত্তরঃ জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা




Comments

  1. Bah, khub sundor laglo lekhata. Onekdin pore elam, r monta furfurey hoye gyalo. :)
    Bonus quiz e fail :(
    Feluda arekbar jhalate hobe.....

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, অরিজিত। আমারও এ বছর একটা সুপ্ত ইচ্ছে আছে ফেলুদা রিভাইস করার।

      Delete
  2. Replies
    1. Ei re. Chhinnomostar Obhishap chhara ar kichu mone ashchhe na. Tomar uttorer opekkhay roilam. Feluda ta ebar ekbar revise na korlei noy.

      Delete
    2. উত্তরটা হল জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা। শঙ্করপ্রসাদ চৌধুরী তাঁর খুড়তুতো ভাই জয়ন্তর ক্লাবে গিয়ে পোকার খেলার কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন।

      Delete
  3. Tumi bom bhole bolle kemon lagbe seta bhabchi.. haha... Quiz ta ebar tough ache.. robartsoner ruby ar nahole samaddar er chabi?

    ReplyDelete
    Replies
    1. হয়নি হয়নি। দাঁড়া, আর একটু দেখি, তারপর উত্তরটা বলছি।

      Delete
  4. অবান্তরের ফেলুদা কুইজে আমি প্রথমবার নাম দিচ্ছি বোধহয়। আমার মনে হচ্ছে গোরস্থানে সাবধান । কুন্তলাদি, নটা লেখা সমেত গোটা 'নয়' বইটাই খুব পছন্দ হয়েছে।

    ময়ূরী

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে থ্যাংক ইউ, ময়ূরী। খুব ভালো লাগল জেনে। গোরস্থানে সাবধান নয়, উত্তরটা আজ কিংবা কাল বলে দেব।

      Delete
    2. অবান্তরের email id টা একবার দেবেন কুন্তলাদি? খুঁজে পাচ্ছি না।

      Delete
    3. এই নাও, ময়ূরী।

      abantorprolaap@gmail.com

      Delete
  5. Bosepukure khunkharapi? Tahole kintu thakurda na ... Great grandfather

    ReplyDelete
    Replies
    1. বোসপুকুরে খুনখারাপি নয় তো। জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা।

      Delete
  6. Oho.. ei golpo tar kotha bhulei gechilam... Eta boi na dekhe partap na..:p

    ReplyDelete

Post a Comment