আজি হতে (অর্ধ)শতবর্ষ পরে



পঞ্চাশ বছর পরে কী হবে আন্দাজ করতে বললে আমার মতো আত্মসর্বস্ব লোকের প্রথম যেটা মাথায় আসে সেটা হচ্ছে আমি থাকব না। থাকলেও সেটা না থাকার মতোই হবে। তবে পঞ্চাশ বছর পর শুনছি পাটুলি ঢাকুরিয়াও থাকবে না, কাজেই আমার না থাকা নিয়ে দুঃখ করা শোভা পায় না। 

পঞ্চাশ বছর আগে কী হত ভাবতে বসলেও শিহরণ। বাংলাদেশের কারও বাড়িতে টিভি ছিল না, অ্যামেরিকায় মেয়েরা সন্তানসম্ভবা হলে তাদের চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া আইনসিদ্ধ ছিল, আমাদের দেশে ডাইনেবাঁয়ে পশুবলি হত। আমার এক দাদু মোষবলি দিতেন, পঞ্চাশ বছরের একটু বেশি আগে অবশ্য, তবে খুব বেশি আগেও নয়, মেরেকেটে পঁয়ষট্টি। শুদ্ধমনে স্নান করে, গরদের ধুতি পরে তিনি মোষের ওপর আরোহণ করতেন, চারদিক থেকে মোষটিকে দড়ি বেঁধে টেনে রাখা হত, তিনি মোষের ওপর বসে জয় মা বলে মোষের ঘাড়ে কোপ মারতেন, মোষটি পালাতে না পেরে চিৎকার করে ছটফট করতে করতে ঘাই মেরে মেরে উঠত যতক্ষণ না প্রাণটা পুরো বেরিয়ে যাচ্ছে, দাদু গর্বিত মুখে, ঠোঁটে স্মৃতিমেদুর হাসি নিয়ে বলে যান। 

এখনও হয়তো আমরা এমন অনেক কিছু করি যা আমাদের নিজের চোখে অদ্ভুত ঠেকে না কিন্তু পঞ্চাশ বছর পর কেউ এসে দেখলে আমাকে নিয়নডারথালের সঙ্গে এক করে ফেলবে। সবই মোষবলির মতো রোমহর্ষক হওয়ার দরকার নেই, এই যে আমরা রচনা লিখতে গিয়ে বিরিয়ানির হাঁড়ির ঢাকনা খোলার সঙ্গে নববধূর ঘোমটা তোলার উপমা দিচ্ছি, সেই পড়েও পঞ্চাশ বছর পরের লোকে হেঁচকি উঠতে পারে। 

এই আর্টিকলটার দেখাদিখি আমারও ইচ্ছে হয়েছে একটা লিস্ট বানানোর। আজকালকার আমাদের এমন কয়েকটা কাণ্ডকারখানার, যার নমুনা শুনলে পঞ্চাশ বছর পরের লোক আঁতকে উঠবে। যে কোনও ভবিষ্যদ্বাণীর বিজনেসেরই যা রিস্ক, ভুল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। উনবিংশ বা অষ্টাদশ শতাব্দীর, মোদ্দা কথা মান্ধাতার আমলের, একটা ছবি দেখেছিলাম, সেখানে দুহাজার সালে বিজ্ঞান, পোশাকআশাক ইত্যাদি বিষয়ে মানবসভ্যতার অগ্রগতির একটা আঁচ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। মাথা নাড়া ছাড়া সে ছবির প্রতি আর কোনও প্রতিক্রিয়া দেখানো অসম্ভব। একটা জনপ্রিয় ভবিষ্যদ্বাণী ছিল মানুষকে আর পায়ে হাঁটতে হবে না, সবাই উড়ে উড়ে একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাবে। এরোপ্লেনের কথা বলা হচ্ছে না, শহরের রাস্তায় সবাই যান্ত্রিক ডানা মেলে উড়ছে, এমনটাই কল্পনা করেছিলেন তখনকার নস্ত্রাদামুসেরা। মানুষের পা যে মাটিতে গেঁথে রইবে একশো দুশো তিনশো বছর পরেও, এদিকে পৃথিবীর উল্টোদিকের একজন মানুষের মুখ যে সে দেখে ফেলতে পারবে হাতের তেলোয়, সে সম্ভাবনা তাঁদের মাথায় খেলেনি। 

ভবিষ্যদ্বাণী যে শুধু কল্পনাশক্তির অভাবেই ব্যর্থ হয় তেমন নয়, সভ্যতার গতি উল্টোপথেও ঘুরে যেতে পারে। বলা যায় না, হ্যান্ডমেড’স টেল বইয়ের পাতা থেকে জীবনে নেমে এল। পরমাণু বোমায় সব উড়ে গিয়ে চাকা আবিষ্কার থেকে কেঁচে গণ্ডূষ করতে হল। 

আরও একটা ব্যাপার হচ্ছে এই ধরণের লিস্টে লিস্ট-বানানেওয়ালার ব্যক্তিগত বিবমিষা, ভালোমন্দ উচিতঅনুচিতের সংজ্ঞাটা মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। সকলেরই হৃদয়ের তলতলে জায়গায় কিছু বিষয়ের বাসা থাকে যাদের নিয়ে আশাপ্রত্যাশা করতেও ভয় হয়, এই বুঝি উল্টোটা সত্যি হল। সে সব বিষয় নিয়ে খেলাধুলো করাও আমার মতো ভীতুর পোষায় না। 

এতসব যদি কিন্তু অতএব বরং মাথায় রেখে আমি একটা লিস্ট বানালাম। সাতটা কাজ/ আচরণের লিস্ট, যা আমরা এখন অবলীলায় করি, না ভেবে করি, অথচ আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর যাদের আনথিংকেবল ঠেকবে। প্রায় ভগবানকে তুষ্ট রাখতে গিয়ে একখানা জলজ্যান্ত মোষের ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা করে দেওয়ার মতো আনথিংকেবল।

১। পাড়ায় পাড়ায়, মোড়ে মোড়ে জ্যান্ত, আর্তনাদ করা মুরগি কেটে বিক্রি করা। 

২। সেই সদ্যকাটা রক্তাক্ত মুরগি নিয়ে তৃপ্ত মানুষের বসন্তদিনে বাড়ি ফেরা। প্লাস্টিকের প্যাকেটে ঝুলিয়ে।

৩। সিগারেট খাওয়া।

৪। গান শোনা, বই পড়া, সিনেমা দেখা, খবর শোনা ইত্যাদি পরিষেবা/বিনোদন আলাদা আলাদা পয়সা দিয়ে কেনা, শুধু দ্রুত ইন্টারনেট সংযোগ না কিনে।

৫। সরকারি স্কুল আর সরকারি হাসপাতাল বলে দু’রকম প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি। অন্য স্কুলে বেশি মাইনে দিয়ে পড়ানোর ক্ষমতা থাকলেও কিছু লোকের সেধে সেই সব স্কুলে নিজেদের সন্তানদের ভর্তি করা। সরকারি হাসপাতালে যাওয়া, বেঁচে ফেরার আশা নিয়ে।

৬। পিতৃপক্ষ + দেবীপক্ষ মিলিয়ে, এক মাস জুড়ে না উদযাপিত হয়ে দুর্গাপূজা মোটে পাঁচদিন হয়েই বন্ধ হয়ে যাওয়া।

৭। পৃথিবীর বুকে অ্যামেরিকা নামের এক এল ডোরাডোর অবস্থান। চাঁদে যেতে পারলেও তত গর্বিত না হওয়া, যত অ্যামেরিকা যেতে পারলে। 

আপনাদের বিচারে পঞ্চাশ বছর পর আজকালকার কোন আচরণটা আনথিংকেবল প্রতিভাত হবে কমেন্টে জানালে বাধিত হব।



Comments

  1. 1 and 2 ta Sweden e akhon i ache. Nischoi USA te apni o dekhechen. Tobe ami khub nischit noi je seta khub bhalo jinish. Karon, ei deshe mangshor songe prochur plastic packing thake. Seta nischoi beshi din cholte parbe na. 3 (cigaratte) er byapare ami apnar songe sumpurno ekmot. 4 already eshe gache.

    Amar mone hoi ekta boro poriborton hobe, plastic er byabohar onek onek kome jabe.

    ReplyDelete
    Replies
    1. প্লাস্টিকের ব্যাপারে আমারও সেটাই ধারণা, ঘনাদা, কারণ ওটা না কমালে বেঘোরে মরব সবাই।

      Delete
  2. মাঝে সাঝে এখানে উঁকি দিয়ে যেতাম, কিন্তু লেখা হত না। আজকের টপিকটা দারুণ ইন্টারেস্টিং, তাই ভাবলাম কিছু লিখেই ফেলি। আমার মতে কিছু জিনিস যা এখন কমন, কিন্তু ভবিষ্যতে থাকবে না...

    ১ পঞ্চাশ বছর পরে কেউ গাড়ি চালাতে জানবে না। কারণ গাড়ি নিজেই চলবে। আমার ধারণা পঞ্চাশ বছর পর খুব কম লোকেরই নিজস্ব গাড়ি থাকবে

    ২ পঞ্চাশ বছর পর মধ্যপ্রাচ্য গরিব হয়ে যাবে কারণ পেট্রোলের প্রয়োজন হবে না। গাড়ি, অন্তত ছোট গাড়ি, সবই বিদ্যুতে চলবে

    ৩ পঞ্চাশ বছর পর সকালে উঠে অফিস যাওয়া ব্যাপারটা অনেক কমে যাবে। অধিকাংশ মানুষই ওয়ার্ক ফ্রম হোম করবেন

    ৪ পঞ্চাশ বছর পর খবরের কাগজ বন্ধ হয়ে যাবে। কাগজের গল্পের বই বন্ধ হয়ে যাবে। স্কুল কলেজে কাগজের বই থাকতে পারে

    ৫ পঞ্চাশ বছর পর সপ্তাহে কাজের দিন পাঁচ বা ছয় থেকে কমে চারে গিয়ে দাঁড়াবে

    ৬ পঞ্চাশ বছর পর গুড়গাঁও, বেঙ্গালুরু সমেত ভারতের বেশ কিছু শহর (এবং ভারতের বাইরেও গুটিকয়েক ঝাঁ চকচকে শহর) পানীয় জলের অভাবে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে

    ৭ পঞ্চাশ বছর পর ক্যান্সারের প্রতিষেধক এবং এডসের প্রতিকার আবিষ্কার হবে। টুইস্ট নাচনের কুনো কারণ নাই, কারণ তদ্দিনে আরেকটা বেয়াড়া অসুখও আবিষ্কার হবে

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই নতুন অসুখের আমদানির ব্যাপারে সহমত। ওয়ার্ক ফ্রম হোমটা জানি না, কিন্তু চারদিনের কাজের ব্যাপারটা নিজের কর্মজীবনে না পাওয়ার আক্ষেপ আমার যাবে না।

      Delete
  3. ভবিষ্যতের কল্পনা আমার খুবই প্রিয় বিষয়। আপনি ও অন্যান্য পাঠকেরা যা যা কল্পনা করেছেন সব সত্য হোক।futuretimeline.net দেখতে পারেন, মজা পাবেন।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, নালক।

      Delete
  4. রোবট দিদি কাপড় ভাঁজ করে দেবে, ডিশ ওয়াশার খালি করে দেবে। অকল্পনীয় হবে যে এইগুলো করে মানুষ সময় নষ্ট করতো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, এটা হওয়ার হাই চান্স রয়েছে।

      Delete
  5. বিজ্ঞাপন দিয়ে পাত্র/পাত্রী খোঁজার ব্যাপারটাও হয়তো 50 বছর পর বিলুপ্ত এবং হাস্যকর হয়ে যাবে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, এটা একটা ভালো পয়েন্ট।

      Delete

Post a Comment