দিল্লির দিল্লাগি



মানুষ বদলায় নাকি একই থেকে যায় এ নিয়ে অনেক সেমিনার হয়ে গেছে। যে কোনও সেমিনারের মতোই এ বিষয়েও কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায়নি। যাওয়ার কথাও না। আপনি যদি সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চান যে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে তাহলে আপনাকে সেই সব লোকদের নিয়েই সেমিনার বসাতে হবে যারা অলরেডি বিশ্বাস করে যে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। কে সি পালকে প্যানেলে এসে বসালে হবে না। সবথেকে ভালো হয় দর্শকশ্রোতারাও সেই মতের অনুসারী হলে। অন্য মতের লোকেরা হলের ভেতর ঢুকে পড়লে সেমিনার চৌপট। তাদের হলের বাইরে প্রতিবাদমূলক প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড় করিয়ে রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

একই যুক্তি খাটে মানুষের বদলানো না বদলানোসংক্রান্ত সেমিনারের ক্ষেত্রেও। আমি অবশ্য সে সব সেমিনার অ্যাটেন্ড করিনি। আমার যা কথাবার্তা হয়েছে সবই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আদানপ্রদান। কত লোকে কত কেস দেখেছেন বলে দাবি করেছেন, যেখানে মানুষ জীবন সম্পূর্ণ একশোআশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে ফেলেছে। ভালো লোক বাজে হয়ে গেছে, বাজে লোক ভালো, বদমাশ লোক সিধে, সিধে লোক ট্যাঁরা ইত্যাদি।

আমি সে সব উদাহরণ শুনে "তাই বুঝি!” বলে জায়গামতো বিস্ময়মূলক অভিব্যক্তি যেখানে যা দেওয়ার দিয়েছি বটে, কিন্তু মনে মনে মচকাইনি। কারণ আমিও আমার জীবনে কম লোক দেখিনি, এবং দেখেশুনে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে অন্য রকম যারা দেখেছে সব তাদের চোখের ভুল।

মানুষ বদলায় না।

একটা হাল-ছাড়িয়ে-দেওয়া খবর পেয়ে বসে বসে এই সব ভাবছিলাম। ভাবছিলাম মা খবরটা পেলে কী বলতেন। কীভাবে আমাকে সান্ত্বনা দিতেন। নির্ঘাত বলতেন, যা হয়েছে ভালো হয়েছে সোনা। পরেরবার ভালো হবে দেখিস।

মায়ের আশাবাদ ছিল দেখার মতো। আর সে জন্যই মা অনবরত নিজেকে বদলাতে চাইতেন। আরও ভালো কী করে হওয়া যায়। আমি যত বলতাম, তুমি অলরেডি যথেষ্ট ভালো, আর ভালো হতে হবে না, মায়ের মন মানত না। কোনও কোনও দিন মায়ের “হ্যালো” শুনে আমি টের পেতাম মা দক্ষিণেশ্বর ঘুরে এসেছেন। রামকৃষ্ণের ঘরের বাইরে ঝোলানো বোর্ডে রঙ্গরস চাপল্য নরকের রাস্তা বলে লেখা আছে, কাজেই মা গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করছেন। শেষপর্যন্ত এই রফা হয়েছিল যে স্বর্গে যাওয়া নিশ্চিত করতে মা বাকিদের সঙ্গে গাম্ভীর্য প্র্যাকটিস করবেন, খালি আমার সঙ্গে রঙ্গরস চালিয়ে যাবেন।

এইসব ভাবছি, এমন সময় দরজা ঠেলে টিমের জুনিয়র উত্তেজিত হয়ে ফোন হাতে এসে বলল, হ্যাভ ইউ সিন দিস?

গত এগারো মাস ধরে দেখছি, এ মেয়েও অবিকল এক আছে। চমৎকার কর্মী। পরিশ্রমী। নিষ্ঠাবান। ওড়িশায় ফণীকবলিত অঞ্চল সার্ভে করে এসে মুখ থমথমে করে বলেছিল, ইউ ওন্ট বিলিভ, কুন্তলা, ইউ কান্ট ইম্যাজিন। আমি বলেছিলাম, ইম্যাজিন আমি করতে পারছি না ঠিকই, কিন্তু বিলিভ করছি হান্ড্রেড পার সেন্ট। তেড়েফুঁড়ে ডিস্যাস্টার বন্ড নিয়ে পড়তে শুরু করেছিল।

তারপর আরও অনেক প্রোজেক্টে দেখেছি। আমি যেমন সব প্রোজেক্টেই ফাঁকি মারি, এ সব প্রোজেক্টই নিষ্ঠাভরে করে। কোনওটাতেই নিষ্ঠার বদল ঘটে না।

আরও একটা কাজ এগারো মাস ধরে এ নিষ্ঠাভরে করে, তা হচ্ছে সকালবেলা এসে হোয়াটসঅ্যাপ খুলে আমাকে আজকের যত তাজা খবর দেওয়া। সেদিন ফোন খুলে মেয়ে আমাকে বলল, এই যে করোনাকাণ্ড ঘটবে, এ ভবিষ্যদ্বাণী সিলভিয়া ব্রাউন নামের এক সুদসেয়ার নিজের বইয়ে লিখে গিয়েছিলেন, ক্যান ইউ ইম্যাজিন?

আমি নিশ্চিত, আমি যেমন আমার সহকর্মীকে পছন্দ করি, সহকর্মীও আমাকে পছন্দই করে। এবং পছন্দ করার একটা অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাকে সকাল সকাল এসে চমকে দিতে পারাটা। করোনা ভাইরাস, বসন্তোৎসব, দাঙ্গা - ইত্যাদি সমস্ত কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সে আমাকে সবার প্রথম আলোকিত করতে পেরে ও খুশি হয়।

আর কেউ করুক না করুক, করোনা ভাইরাসের একটা ভালো অবদান আমি রোজ সকালবিকেল স্বীকার করছি; একা হাতে দাঙ্গার আপডেট থামিয়ে দিয়েছে। যা আমাক এর আগে রোজ সকালে জানতে হচ্ছিল। মায় দেখতেও। কে কাকে ক'কোপে কেটেছে, উবু হওয়া মাথা চেপে বসে থাকা রক্তলটপট একা মানুষের দিকে রোদ্দুর রায়ের থেকেও ভয়ংকর হাঁ করে তেড়ে আরেকদল মানুষ তেড়ে আসছে অস্ত্র হাতে - আপনি আমাকে অচেতন, বালিতে মুখ গোঁজা উট, যা খুশি বলে গাল পাড়তে পারেন - স্বেচ্ছায় দেখছি না, দেখব না।

বলা বাহুল্য, না দেখার অপশন থাকলে তবেই। বাড়িতে অর্চিষ্মান টিভি চালালে চোখ বন্ধ করে কান চেপে ট্রালালালা গাইতে গাইতে অন্য ঘরে পালানো যায়, অফিসে সেটা করা যায় না। যথোপযুক্ত মুখ করে ঘাড় নাড়তে হয়। বিভীষিকা। সেই বিভীষিকার মধ্যে একটাই রুপোলি রেখা ছিল, গোটা বিষয়টায় আমার সঙ্গে আমার সংবাদদাতার মত মেলে।

আপাতত রোজ সকালে করোনা ভাইরাসের আপডেট পাচ্ছি। বলা বাহুল্য, এ বিষয়েও সহকর্মীর নিষ্ঠায় টান পড়ছে না। দাঙ্গার সঙ্গে ভাইরাসের আপডেটের একটা পার্থক্য হচ্ছে যে গোটা ব্যাপারটার মধ্যে একটা পরোপকারের ইচ্ছাও আছে। যেমন ধরুন, ডাক্তারের কাছে না গিয়ে কী করে জানবেন আপনার কোভিড নাইনটিন হয়েছে কি হয়নি। আপনি যদি দম বন্ধ করে ধীরে ধীরে, চিটিং করে তাড়াতাড়ি গুনলে হবে না, দশ পর্যন্ত গোনেন আর তার মধ্যে যদি আপনার কাশি না পায়, তাহলে হয়নি। আমি সেদিন অটোয় বসে দম বন্ধ করে কুড়ি পর্যন্ত গুনে দেখেছি, কাশি হয়নি। বাঁচা গেছে। তারপর ধরুন হোয়াটসঅ্যাপে লিখেছে, গরম জল খেলে নাকি যদি শরীরের ভেতরে কোনও ভাইরাস ঢুকেও থাকে, টপাটপ মরে যাবে। গরম জল ভয়ানক বাজে খেতে, গরম চা খাচ্ছি বেশি বেশি করে, কাজ একই দেবে আশা করি।

কিন্তু একা কত ফাইট দেওয়া যায়? ভেতর গরম রেখে কী হবে যদি বাইরে কনকনে হাওয়া বইতে থাকে? করোনা ভাইরাসের ব্যাপারে আরও একটা খবর যা পেলাম (হোয়াটস অ্যাপ থেকে সহকর্মীদ্বারা সংগৃহীত), এ ভাইরাস ঠাণ্ডা জায়গাতেই দাপায় বেশি যে জন্য ট্রপিকাল দেশগুলোয় বেশি কেরামতি দেখাতে পারছে না।

সে দিক থেকে দেখলে মার্চ মাসের দিল্লিতে এর এক মিনিটও টেকার কথা না।

কিন্তু যে শহরের এই সময় ভাজাভাজা করার কথা, সে এই ভাইরাসের বাজারে রীতিমত ঠাণ্ডা হাওয়া বইয়ে খেলা দেখছে। পথকুকুরদের সোয়েটার খুলে আবার পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যারা জয়পুরী কম্বল কাচিয়ে তুলে রেখেছিলেন, মাথা চাপড়াচ্ছেন। এসি সার্ভিসিং ইন্ডাস্ট্রি কেঁদে কেঁদে ফিরছে, কেউ ফোন করে “ভাইয়া আ যাও” বলছে না। হোলি, যা কিনা নরকের কটাহে ভাজা ভাজা শুরু হওয়ার অফিশিয়াল সীমারেখা, সেই হোলির রাতে এবং তার পরের দিন সকালেও দিল্লিতে বৃষ্টি হয়েছে।

আগেই আন্দাজ করা উচিত ছিল। যে শহরের ইতিহাস ল্যাং মারামারি আর পিঠে ছুরি মারামারিতে জীর্ণ, তার থেকে এই বাজারে আর কীই বা আশা করা যায়। রাজাবাদশারা ক্ষান্ত দিয়ে বিদেয় হয়েছেন, দিল্লি এখন  আমজনতাকে ল্যাজে খেলিয়ে মজা লুটছে।


Comments

  1. Besh bhaloi laagche. Onekei office a jacket theke t-shirt a shift kore abar fire jete hoyechhe. Tobe ei gorom porlo bole..

    ReplyDelete
    Replies
    1. জ্যাকেট পরাটা একটু বাড়াবাড়ি অবশ্য। ভালো লাগছে তো বটেই। এতদিন যে বসন্ত থাকবে কে ভেবেছিল।

      Delete
  2. হ্যাঁ মোবাইল এসে যেমন ঘড়ি, ক্যামেরা ক্যালেন্ডারের বাজার মেরেছিল, করোনা এসে বাকি সব কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সকে গলা ধাক্কা দিয়ে দূর করেছে।
    তবে সাবধানে থেকো, যদিও ভয় বয়স্কদের নিয়েই বেশী। তারা আবার বয়স বেড়ে গিয়ে কথা শুনতে চায়না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. বয়স্কদের থেকে অবাধ্য আর গোঁয়ার কমই আছে, প্রদীপ্ত। আমি নিজে একসময় এরকম হব (যদি না অলরেডি হয়ে গিয়ে থাকি) ভাবলেই দুঃখ হচ্ছে।

      Delete
  3. Ekshomoy anek bhebe chinte thik korechhilaam je manush ashole bodlay na. Jeta paltate dekhi seta hochhe biswabrohmando sommondhe tar anubhuti ba upolobdhi, ebong pholoto biswabrohmando-r proti tar protikriya.
    Tar por neuroplasticity abishkaar kore abar bhabnay pore gelam.
    Finally: Bodlak, na bodlak, amaar boye gechhe.
    Tobe torko-torko hole shunte heabby lage.

    Aar aajkal corona-r forward ele monta 'korona, korona' daak-i chhare.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, রাজর্ষি, তর্ক ব্যাপারটা সাইডলাইন থেকে বসে দেখতে চমৎকার, যদি না আমাকে খেলায় নামতে বাধ্য করা হয়। বা আমি যদি হাঁদার মতো নিজেই নেমে না যাই।

      করোনা কবে যে যাবে। ওয়ার্ক ফ্রম হোম আর পোষাচ্ছে না। জঘন্য।

      Delete
  4. ভালো লাগলো - দিল্লিতে শিগগির গরম পড়ুক! হোয়াটস্যাপ ফরওয়ার্ড এর নরক যন্ত্রনা থেকে তোমরা পরিত্রান পাও :)
    করোনার এপিসেন্টার এ বসে আমাদের যদিও নিস্তার নেই...

    ReplyDelete
    Replies
    1. এখানেও তো প্যানিক তুঙ্গে, কাকলি। কী যে হবে।

      Delete

Post a Comment