অফসিজন রেজলিউশন



নিজেকে পছন্দ করার আমার যে দেড়খানা কারণ, তার মধ্যে গোটা কারণটা হল যে আমি এমন একজন লোক যার সময়ের টানাটানি হয় না। কখনও হয়নি। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকের আগে সাড়ে ন'টায় ঘুমোতে গেছি, পরীক্ষা শুরুর আগের দিন মায়ের সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়েছি, তেমন ঠাণ্ডা পড়লে নাওয়া ভুললেও খাওয়ার সময় ঠিক বার করে নিয়েছি।

আমার গর্বের সেই জায়গা টলতে বসেছে। আমারও সময়ের অভাব ঘটেছে। দিনটা চব্বিশ ঘণ্টার না হয়ে আটচল্লিশ ঘণ্টার কেন হচ্ছে না সেই নালিশটা করছি না জাস্ট এই জন্য কারণ আমি অলমোস্ট নিশ্চিত বাড়তি চব্বিশ ঘণ্টাও কাজের পেছনে বা কাজ-করছি-না নখকামড়ানির পেছনেই খরচ হয়ে যাবে। আরাম কিছুই হবে না। ওই নরকভোগের জন্য চব্বিশ ঘণ্টা এনাফ।

সময় নেই মানে কী? রাতে কি ঝাড়া সাত ঘণ্টা ঘুমোচ্ছি না? দিনে তিনবার ভরপেট, সাতবার কিছুমিছু খাচ্ছি না? ইউটিউবে হাতে বানানো উনুনে, কাঠের জ্বালে অথেনটিক বিরিয়ানি রাঁধা দেখছি না?

আমার দৈনিক টু ডু লিস্ট কি লিওনার্দো দা ভিঞ্চির টু ডু লিস্টের মতো দেখতে হয়ে গেছে?

অফ কোর্স, না।

কিছুই বাদ পড়েনি, সবই চলছে, চলার ধরণ খালি পালটে গেছে। আগে যেমন বুক বাজিয়ে আড়াইঘণ্টা একটানা ক্যান্ডি ক্রাশ খেলা যেত, এখন একচোখ স্ক্রিনের ঈশানকোণের ঘড়িতে রেখে চট করে একদান খেলে নিতে হয়। মিডসামার মার্ডারসের পঁচিশবার দেখা এক ঘণ্টা তেত্রিশ মিনিটের এপিসোড ছাব্বিশতম বার চালানোর আগে স্পিড বাড়িয়ে সাড়ে ছেচল্লিশ মিনিটের করে নিতে হয়।.বিবেকের চোখে চোখ ফেলা এড়িয়ে বলতে হয়, ওর মধ্যে ডিনারটাও সেরে নেব, আলাদা সময় নষ্ট করব না, এই ল্যাপটপ ছুঁয়ে বলছি।

বাদ যে পড়েছে, সে অবান্তর। মনে পড়ে না গত দশ বছরে, পনেরোদিনের বেশি না পোস্ট না ছেপে থেকেছি কি না। আগামীকাল শেষ পোস্ট ছাপার পনেরোদিন হবে, তাই আজ জরুরি কাজ লেখা ফেলেও পোস্ট লিখছি। এ রেকর্ড ব্রেক না করলেও চলবে।

করলেই বা কী? লোকে সিগারেট ছেড়ে দেয়, প্রেম ছেড়ে দেয়, কত কত বছরের প্রিয় মানুষকে চিরকালের মতো ছেড়ে দেয়। ছাড়লেই ছাড়া। ধরে থেকেই বা কী হাতিঘোড়া হচ্ছে। সেদিন একজন আমার মুখের ওপরই প্রশংসা করে বললেন, ধন্যি আপনার অধ্যবসায়, বছরের পর বছর ধরে ব্লগটা যে ভাবে মেন্টেন করেছেন উইদাউট এনি ভিজিবল সাকসেস, খুব কম লোকেই পারত।

এ জিনিস হামেশাই ঘটে আমার সঙ্গে; দেখতেশুনতে প্রশংসার মতোই লাগে, কিন্তু মন খুলে খুশি হতে পারি না। একবার পোয়্যারো হেস্টিংসকে খুব তোল্লাই দিয়ে বলেছিল, "আমাদের এক্ষুনি একজনকে দরকার যাকে দেখলেই বোকা মনে হয়, তুমি সে রোলে অপরিহার্য, মনামি হেস্টিংস।" আমার দশা ওই হেস্টিংসের মতো। "আমাগো সোনার রং কালো অইলে অইব কি, মন এক্কেরে দুধের মতো সাদা" থেকে শুরু করে অবান্তরে "অনেকদিন পর/অবশেষে/ফাইন্যালি একটা ভালো লেখা পেলাম" পার হয়ে শেষমেশ "উইদাউট ভিজিবল সাকসেস।"

থতমত অবস্থা কাটিয়ে স্থির করলাম ওঁর বক্তব্যের একটা অংশের সঙ্গে আমি একমত। "যেমনই হোক, কিছু একটা হচ্ছে" আশ্বাস না থাকলে কোনও কাজ চালিয়ে যাওয়া শক্ত। কিন্তু উইদাউট ভিজিবল সাকসেস অবান্তর চালিয়ে নিয়ে যাওয়া-সংক্রান্ত প্রশংসা করার অংশটার সঙ্গে প্রাণ পণ করেও একমত হতে পারলাম না। ভাবার চেষ্টা করলাম, আমি সত্যিই মারাত্মক অন্যরকম, বিনা রিটার্নে অবান্তরের মাটি কামড়ে পড়ে আছি, পারলাম না।<

সত্যিটা হচ্ছে আমার কখনওই অবান্তরকে আনসাকসেসফুল মনে হয়নি। আমার বাকি জীবনের ছিরি নিয়ে সবার সন্দেহ আর করুণা দুই-ই বাড়বে জেনেও স্বীকার করছি - অবান্তর আমার জীবনের অন্যতম সাকসেস স্টোরি।

উইদাউট ভিজিবল সাকসেস অবান্তর কামড়ে পড়ে আছি কেন-র থেকে ঢের বেশি রহস্যজনক প্রশ্ন বরং এতদিন পড়ে থাকার পরেও পরেও "লেখা" সোজা হয় না কেন। কে যেন গল্প বলেছিল, "সুনীলদা, প্লিজ..." শোনার কুড়ি মিনিটের মধ্যে দেশ পত্রিকার সম্পাদকীয় লিখে, এডিট করে, হাতে ধরিয়ে, টা টা করে অফিস থেকে বেরিয়ে যেতে পারতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সুনীলদা নই কাজেই কুড়ি মিনিটের উচ্চাশা যদি ছেড়েও দিই, পনেরোশো শব্দে মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য কুড়ি ঘণ্টা অন্ততঃ যথেষ্ট হওয়া উচিত?

হয় না। একেকটা পোস্ট লিখে শেষ করতে অনন্ত সময় লাগে। আমি অতীব পারফেকশনিস্ট বলে নয়। প্যারাগ্রাফের সৌকর্ষ বাড়ানোর পেছনে পরিশ্রম করার থেকে প্যারাগ্রাফটাই উড়িয়ে দেওয়া আমার কাছে বেশিরভাগ সময়েই প্রেফারেবল। এই ঢিলেমোর জন্য দায়ী আমার নিজেকে খারাপ লাগার হাজার কারণের একটা। হিসেব কষে দেখেছি একটা দু'ঘণ্টার কাজের জন্য আমার তিরিশ মিনিট ওয়ার্মিং আপ, মাঝে পঁয়তাল্লিশ মিনিট টিফিন, শেষে ঘণ্টা তিনেকের উদযাপন লাগে। এই মুহূর্তে ওই পরিমাণ সময় খরচ করা আমার পক্ষে অসম্ভব। যেটুকু ফাঁক পাই পরিশ্রম করতে ইচ্ছে করে না। ডবল স্পিডে এক এপিসোড মিডসমার মার্ডারস দেখে নিতে মন চায়।

পরিস্থিতির আশু পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ একসময় যে রেটে অবান্তরের পাতা ভরত, অদূর ভবিষ্যতে সে রেটে আর ভরবে না।

খালি সারাদিনের আবোলতাবোল হাবিজাবি ব্যস্ততার মধ্যে মন যেমন অবান্তরে পড়ে থাকত, তেমনই পড়ে থাকবে। খারাপ লিখলেও লিখব, ভালো লিখলেও লিখব। সময় থাকলেও লিখব, সময় না থাকলেও লিখব। কম লিখব, রেগুলার লিখব। এক তাৎপর্যপূর্ণ বছরের তাৎপর্যহীন এক বৃহস্পতিবারের সন্ধেবেলায় এই আমি আমাকে কথা দিলাম।


Comments

  1. Without visible success! Bollei holo! Choshma porte bolo. Ba jeno je uni ekkebarei bolg ta poren na. :-)
    Tumi chaliye jao Kuntala. Tomar lekha pore amader mon bhalo hoye. Hote thakbe o.
    Onek bhalobasha roilo.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা,থ্যাংক ইউ,শর্মিলা। ভালোবাসা রইল আমার তরফ থেকেও।

      Delete
  2. Abantor...ekhono mon kharap lagle.goto shat bochor dhore.tomar post pori...purono theke notun.tomar post er jonno opekkha kori..eta ki success noi....,,

    ReplyDelete
    Replies
    1. সাকসেস তো বটেই, রণিতা, ভীষণ ভীষণ ভালোলাগা-দেওয়া সাকসেস। আমারও একই রকম ভালোলাগে। পাবলিশ ক্লিক করে মনে হয়, যাক একটা কাজের কাজ হল আজ, গোটা দিনটা পুরোটা মাটি হল না। সেটাও আমার মতে সাকসেস। কাজেই আমি দমছি না মোটেই।

      Delete
  3. 2014 theke tana porchi .. jani ajkal post er frequency komeche tao khule dekhi lekha elo kina.. majhe majhe old post pori.. specially beranor post.. Visible success bojhate ar ki korte hobe sudhu bolo ..

    ReplyDelete
    Replies
    1. তোর কমেন্ট পড়ে একা ঘরে শব্দ করে হাসছি, ঊর্মি। এই না হলে জুনিয়র বোন? কিচ্ছু করতে হবে না, এইরকম মজার থাকিস সারাজীবন।

      Delete
  4. ভিজিবল সাকসেস মানে কি কে জানে! কিন্তু তোমার ব্লগ তোমার পাঠকদের কাছে অতি প্রিয়,আর লিখে তোমার আনন্দটা ওই ভিজিবল সাকসেসের এর প্রপিতামহ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, আমারও তাই মত, প্রদীপ্ত।

      Delete
  5. Yeh, amio bodhhoy min. 6-7 bochhor porchhi.
    "Jeno kichhu mone koro na, keu jodi kichhu bole !"
    Tobe hya, ei samayeo samayer obhab hole chinta r boi ki .. Pathak der pokshe

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, শিবেন্দু। আর বলবেন না, সবই উল্টোপুরাণ আমার। যখন সবাই কাজ করছিল আমি ক্যান্ডি ক্রাশ খেলছিলাম, যখন সবাই লকডাউনে সৃষ্টিশীল, আমি দম ফেলার ফুরসৎ পাচ্ছি না। ও, গানটার চয়েস একেবারে অব্যর্থ।

      Delete
  6. উইদাউট ভিজিবল সাকসেস? চূড়ান্ত অসভ্য লোক তো! তুমি তাকে ছেড়ে দিলে কিছু না বলে? জিজ্ঞেস করলেনা কাকে সাকসেস বলে আর কিকরে তা ভিজিবল হয়! যত্ত সব| অবান্তর অতুলনীয় আর তার কোয়ালিটি এই ভাবেই মেইনটেইন করো যত দিন লাগুকনা কোনো লেখা শেষ হতে|

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, আমি নিজেকে বুঝিয়েছি ছেড়ে দেওয়াতেই শান্তি, অমিতা।

      Delete
  7. উইদাউট ভিজিবল সাকসেস! 😂😂 জানিয়ে যাই কুন্তলাদি, আমার নিজের একটা ব্লগ আছে। বছর ছয়েকের বেশি হয়েছে ওটা একমাত্র আমিই দেখি। নিজের ব্লগ না দেখলেও আপনার ব্লগে এসে দু এক দিন পর পর উঁকি মেরে যাই। এই ব্লগটা দেখেই হয়ত নিজের ব্লগটাও প্রাণে ধরে ডিলিট করতে পারিনি। অবান্তর নিয়ে এই অবান্তর জুমলা মানছি না মানব না 🤗

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, থ্যাংক ইউ, সুদীপ। ভালো লাগল।

      Delete

Post a Comment