ডুমস্ক্রোলিং, কোডিং, চিটিং


কয়েকমাস আগে ইমেল করে একজন ঘোষণা করলেন যে তিনি আমার একটা উপকার করতে চান।

সবিনয়ে জানালাম, অসংখ্য ধন্যবাদ, কিন্তু আমার উপকারটার দরকার নেই। তিনি উদারতার ইমোজি পাঠিয়ে বললেন, আহা, লজ্জার কিচ্ছু নেই, উপকারটা করতে তাঁর কোনও অসুবিধেই হবে না। বললাম, সে জানি কিন্তু আমার সত্যি উপকারটা লাগবে না। তখনকার মতো মুখ বুজলেও তিনদিন পর তিনি ফের হোয়াটসঅ্যাপে টুকি দিলেন। আমি যেন না ভাবি যে উনি উপকারের প্রস্তাব বিস্মৃত হয়েছেন। যখনই লাগবে যেন খবর দিই।

অর্চিষ্মান বলবে, এই ক্রুশিয়াল মুহূর্তটাতেই তুমি ভুল করলে। মুখে বড়া দিয়ে বসে থেকে ভাবলে তোমার নীরবতাকে তিতিবিরক্তি (যথার্থ) বুঝে নিয়ে উল্টো পক্ষ ক্ষান্ত দেবে। সে উচ্চাশায় না ভুগে তুমি যদি, 'আরে না না সত্যি বলছি উপকারটা আমার লাগবে না। সব ভালো তো? অন গড ফাদার মাদার, সত্যিই লাগবে না। তারপর, সব ভালো তো?' বলে সুস্থ মানুষের মতো স্বাভাবিক কথোপকথনে লিপ্ত হতে তাহলেই যা ঘটেছে তা ঘটত না।

যেটা ঘটল সেটা হচ্ছে সাতদিন পর আরেকটা মেল এল। আপনি যে কাজের কথাটা বলেছিলেন (লক্ষ করুন, উপকারটা কাজ হয়ে গেছে আর প্রস্তাবটার গতিমুখও গেছে ঘুরে) সেটা অনেক কষ্টে সেরে উঠতে পেরেছি। এবার আপনার কবে সুযোগ হবে বলুন, গিয়ে দায়মোচন করে আসব।

এ জিনিস আগেও দেখেছি, শব্দ ব্যাপারটা নিতান্ত নৈর্ব্যক্তিক হলেও যে যার মাথার ভেতর সুবিধে মতো নিজস্ব মানেওয়ালা ডিকশনারি বানিয়ে রেখেছে। এমন নয় যে কাছাকাছি শব্দ; পানের মানে ধান ধরে নিচ্ছে বা কানের মানে গান। চেহারায় চরিত্রে যে সব শব্দ সুমেরু-কুমেরু সেগুলোকেও রেহাই দিচ্ছে না। রেগুলারলি না বললে হ্যাঁ বুঝছে, হ্যাঁ বললে হতেও পারে। লিবারেল শুনলেই লেফট দেখিয়ে দিচ্ছে, ম্যারেজ শুনলেই সন্দেহ করছে নির্ঘাত ওপেন।

দায়মোচনের জায়গাটা (ঠিক দায়মোচন লেখেননি, আভাস দিয়েছেন) পড়ে পাঁচমিনিট ডিপ ব্রিদিং করতে হল। তারপর রিপ্লাই লিখতে বসলাম। এবার আর কম কথায় বোঝানোর ভরসায় না থেকে শুরুতে যথাবিধি সম্বোধন, অন্তে যথোপযুক্ত সম্মানজ্ঞাপনের মাঝখানে যথাসাধ্য খোলসা করে লিখলাম যে অসংখ্য ধন্যবাদ, কিন্তু আমি উপকারটা গ্রহণ করতে অপারগ। কারণ গোড়াতেই বলেছি যে আমি চাই না।

তিনি আকাশ থেকে পড়ে বললেন, কিন্তু সে তো ভদ্রতা করে!

তিনিও যেহেতু আমার কালচারাল - মর‍্যাল - রিজিওন্যাল প্রেক্ষাপটেরই মানুষ, তিনি কি জানেন না আমাদের জন্মে ইস্তক মনের ঠিক উল্টো কথাটা মুখে বলার ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে? তার ওপর আবার আমি প্রান্তিক লিঙ্গের প্রতিনিধি, আমার পেটে খিদে মুখে লাজ হবে না তো কি ও পাড়ার নটবরের হবে?

তাছাড়া মাত্র একবার ‘না’ বলে থেমে গেলে কী করে হবে? (পাশ থেকে মুচকি হাসি। "বলেছিলাম।") একশোবার কানের কাছে ঘ্যানরঘ্যানর না করলে নিশ্চিত হওয়া যায় নাকি?

তাছাড়া সামনাসামনি মনের ভাব বুঝে উঠলেও যদি বা ওঠা যেতে পারত, ইমেল-এ গলার স্বরের ওঠানামা, ভুরুর সোজাবাঁকা যেহেতু নেই, ঠিক বুঝলেই অদ্ভুত।<

স্পষ্ট ভাষায় যেটা লেখা আছে সেটার ওপর ভরসা রাখা? এমন অদ্ভুত কথা কারও চোদ্দপুরুষে কখনও শুনেছে? ইমোজি ব্যবহার করলে তবু না হয় হত।

সে সব কিছুই না করে, নিজের বোঝাতে না পারার ঘাড়ে দোষ না নিয়ে যদি পরের বুঝে উঠতে না পারার ওপর চাপাতে চাই তাহলে সত্যিই কিছু বলার নেই।

*

এই ধরণের গোলমাল আমার আর অর্চিষ্মানের মধ্যে ঘটার আশংকা কম। ইমোজি লাগে না, মুখের ভাব দেখলেই আন্দাজ করা যায় জল কোনদিকে গড়াচ্ছে। তবে গেসওয়ার্কের জায়গা গত এগারো বছরে অনেক কমে এসেছে। অধিকাংশ বোঝা না-বোঝার পরিস্থিতি বিবিধ পারমুটেশন কম্বিনেশনে এক না একবার মুখ দেখিয়ে ফেলেছে। সে বাবদে যাবতীয় আলাপআলোচনা, আপোষটাপোষও সারা।

আপোষ অনিবার্য, মা সাবধান করেই রেখেছিলেন। আপোষেও নেই আপত্তি নেই আমারও। শুধু কার সঙ্গে আপোষ করছি সেটা জরুরি। কাউকে গড়ের মাঠ লিখে দিতেও গায়ে লাগে না, কাউকে সূচ্যগ্র মেদিনী ছেড়ে দিতেও বুক ফাটে।

অর্চিষ্মান, বলা বাহুল্য, গড়ের মাঠের গোত্রে পড়ে। একটা কারণ পার্শিয়ালিটি, কিন্তু অন্য একটা কারণও আছে। রফা করার সময় অন্যপক্ষের আপোষটা নজরে পড়লে নিজের আপোষটা অনেক সহজ হয়ে যায়। শুধু আমিই জমি ছাড়ছি না, সেও ছাড়ছে। একসঙ্গে থাকলে সেই দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে, আপোষের গায়ে না লাগার সম্ভাবনাও।

আমার জন্য অর্চিষ্মানের করা অনেক আপোষের একটা আমাকে বিশেষ করে খোঁচায়। আগেও বলেছি, আমি বিশ্বাস করি যে কোনও সফল পার্টনারশিপের একটা প্রধান আরামের (এবং সফলতার) জায়গা হল নিন্দেমন্দ করার টপিক/মানুষ কমন পড়া। ভাবুন বিয়েবাড়ি খেয়ে বেরিয়ে খালি এই মর্মে আলোচনা চলছে যে বিরিয়ানিটা কি ঝরঝরে ছিল দেখেছিলে? আলুভাজাগুলো কি ঝুরঝুরে, রসগোল্লাটা কি নরম, আইসক্রিমটা কি মোলায়েমdiv>

শেষ ব্যাচের লোকের কপালে মাংসের বদলে স্রেফ ঝোল আর আলু জুটল যে সেই নিয়ে মাথা নাড়া যাচ্ছে না।

অমন বিয়েবাড়ি যাওয়ার থেকে না যাওয়া ভালো। অমন বিরিয়ানি সাঁটানোর থেকে কে বি সি দেখতে দেখতে বাঁধাকপি রুটি চিবোনো বেটার।

অর্চিষ্মানের এই আরামের জায়গাটাতেই আমি আঘাত হেনেছি। বেচারা সারাদিন টুইটার এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোরে, আড়ালে দাঁড়িয়ে পপকর্ন খেতে খেতে নানারকম তামাশা দেখে; স্বাভাবিক যে বাড়ি ফিরে সেগুলো ব্যাখ্যান করে বলতে ইচ্ছে করবে। আর বাড়িতে আমি ছাড়া লোক নেই। কিন্তু আমি সেই আনন্দটুকু থেকে বেচারাকে বঞ্চিত করে রেখেছি। আমাকেও দোষ দেওয়া যায় না। বাইরে থেকে আমাকে দেখতে সুস্থসবল মনে হলেও ভেতরে বিস্তর গ্যাঁড়াকল। বইয়ের পাতায় যতখুশি পোঁচ দিয়ে দিয়ে ধড় মুণ্ডু হাত পা আলাদা করে হাইড্রোক্লোরিকের ড্রামে চুবিয়ে দেওয়ার বর্ণনা দিয়ে রাখুন, লেপের তলায় ঢুকে আয়েশ করে গিলব, এদিকে ব্রেকিং নিউজে টিভির স্ক্রিনে গাছ থেকে ঝোলা দুটো ধর্ষিত রোগা শরীরের দিকে চোখ পড়ে গেলেই ব্যস। কিংবা রেললাইনে রুটি, কিংবা কোমরজলে দাঁড়িয়ে বন্যার্তদের খাবারের লাইন। ব্রেকডাউন হয় হয়। সিপ্রালেক্সের ডোজ ফেল পড়ে পড়ে।

কাজেই আমি ও সব এড়িয়ে চলি। যিনি বিজেপিতে যাওয়ার তিনি তো ড্যাংড্যাঙিয়ে চলেই যাবেন, আমি সারারাত না ঘুমিয়ে ঘামলে কার কোন উপকারটা হবে? ও যন্ত্রণার থেকে বালিতে মুখ গোঁজা উট হয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দেব, চোখকানবোজা সমাজবিমুখ বদনাম কিনব সেও ভালো।

যখন আমার সঙ্গে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স নিয়ে সমস্ত রকম আলোচনায় অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিতাদেশ জারি করেছিলাম অর্চিষ্মান মুখ কালো করেছিল। আমার মাথা খারাপ হলেও মনটা ভালো, বললাম আচ্ছা চল একটা গিভ অ্যান্ড টেক করি। তুমি যদি আমাকে টুইটার রিডিং পড়ে না শোনানোর সংযম দেখাও তাহলে আমি প্রতি সপ্তাহে যে তিনদিন সকালবেলা তোমাকে টিউব থেকে 'ঠিক' করে টুথপেস্ট (সুনিয়ন্ত্রিত উপায়ে নিচ থেকে ক্রমশঃ ওপরে ওঠা, ঘুমচোখে যেখান সেখানে টিপে টিউব অষ্টাবক্র মুনি করে ফেলার বদলে) বার করতে না পারা নিয়ে গঞ্জনা দিই, সেটা বন্ধ করব।

অর্চিষ্মান ছাদের সমান লাফ দিয়ে অফার অ্যাকসেপ্ট করল।

তবু ফাঁকফোঁকর বেরিয়েই পড়ে। টুথপেস্ট 'ঠিক' করে বার করা নিয়ে কেউ যে এত প্যাশনেট হতে পারে নিজেকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না, এখনও ক্বচিৎকদাচিৎ মুখ খুলেই ফেলি, তেমন তেমন গায়ে কাঁটা দেওয়া ব্রেকিং নিউজ হলে অর্চিষ্মানও না দিয়ে পারে না।

সেদিন যেমন ফোন দেখতে দেখতে বলল, শোনো না, একটা মারাত্মক বখেরা বেধেছে। এই সিজনে বখেরাটা নির্ঘাত রাজনীতিসংক্রান্ত ধরে নিয়ে আমি দুই কান চেপে ধরে ট্রালালালালা গাইতে শুরু করলাম। অর্চিষ্মান হাতমুখ নেড়ে আশ্বস্ত করল আর যে এ বখেরায় বিজেপি নেই। আধা-সন্দিগ্ধ মনে কান অল্প ফাঁক করতে অর্চিষ্মান বলল যে, আছে ব- দিয়ে নাম শুরু হওয়া একটা কোম্পানি যারা শিশুদের কোডিং শেখানোর নামে চিটিং করে বেড়াচ্ছে। কোন শিশু ওদের ক্লাসে কোডিং শিখে অ্যাপ লিখে মিলিয়ন বিলিয়ন ডলার রোজগার করেছে ঢাক পেটানোর পর বাবামায়েরা নোলা সকসকিয়ে টাকার থলি আর বাচ্চা বগলে ছোটার পর বেরিয়েছে সব ভাঁওতা। অ্যাপ লিখে বড়োলোক হওয়া বাচ্চার নাম থেকে শুরু করে সবটুকু কোম্পানির কারও উর্বর (এবং বাবামায়ের চরিত্র গুলে খাওয়া) মস্তিষ্কের অবদান।

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স হওয়া সত্ত্বেও আমি শুধু শুনলাম না খবরটা, রীতিমত রেলিশ করলাম। ঠোঁটে আর মনে বেশ মুচকি হাসি খেলে গেল। আরও যাও কোডিং শিখতে। কেন রবীন্দ্রসংগীতের ক্লাস কী দোষ করেছিল? পাড়ার আঁকার স্কুলে চিটিং করে টাকা মেরেছে ইতিহাসে কেউ কখনও শুনেছে?

হাসির পেছনে আমাদের-সময়ে-কেউ-কোডিং-খায়-না-মাথায়-দেয়-জানত-না জনিত সন্দেহ তো আছেই, আরও একটা ব্যাপার আছে। একটা না, দুটো। এক, যারা ঠকেছে আসলে দোষটা যে তাদেরই, খুব গভীরে সেই বিশ্বাস। দুই, আমি হলে যে ঠকতাম না সে প্রত্যয়। এই প্রসঙ্গে অবশ্য আমার বাচ্চা নেই বলে, কই আমি তো চাইল্ড লেবার খাটিয়ে অ্যাপ লিখিয়ে বড়োলোক হওয়ার লোভে বাচ্চা নিয়ে চিটিংবাজের ক্লাসে ভর্তি করাতে বলে বুক বাজানো যাবে না, তবে এই জাতীয় অন্যান্য ক্ষেত্রে আমার মনের ভাবটা এই গোছেরই হয়।

টাকা ডবল করতে গিয়ে চিটফান্ডে গেছে? কই আমি তো রাখিনি টাকা চিটফান্ডে। আমাকেও তো জামতাড়া গ্যাং-এর লোক ফোন করেছিল, কই নাম, ধাম, অ্যাকাউন্ট নম্বর, পিন, ও টি পি তো হাঁদার মতো গড়গড়িয়ে বলে দিইনি?

এই রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়ে মোড় ঘুরলে, 'মাঝরাতে সাহস দেখিয়ে একা একা রাস্তায় বেরিয়েছেই বা কেন, কই আমি তো বেরোইনি'র সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে সেটা যখন অনুধাবন করি থতমত লেগে যায়। নিজেকে মনে করাতে হয়, একদিকের আচরণটা যদি বোকামি বলে ধরেও নিই, বোকামি সম্পূর্ণ আইনানুগ একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। উল্টোদিকেরটা আগাপাশতলা ক্রাইম এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

কোডিং শেখানোর নামে চিটিং-এর খবরটা শোনার পর ভিক্টিম ব্লেমিং-এর জোয়ারে ভেসে যেতে গিয়েও সংযত হলাম। আর সেই সংযমের রাস্তা ধরে ঘটনাটার কথা মনে পড়ে গেল।

*

মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকের পরের তিনমাস যাতে 'নষ্ট' না হয় সে জন্য সচেতন অভিভাবকদের একটা তাগিদ থাকেই, আমার মায়েরও ছিল। আর ছিল আরেকটা কোম্পানিরও, যারা খবরের কাগজে, টিভিতে, হাওড়া ব্রিজে ওঠার মুখে, নামার বাঁকে - বেসিক্যালি মা যেদিকে মুখ ফেরাচ্ছিলেন, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বিজ্ঞাপন টাঙিয়ে রেখেছিল যে সন্তানের দুধভাতের ব্যবস্থা যদি করতে চান পত্রপাঠ কম্পিউটার শেখাতে ভর্তি করুন। বলা বাহুল্য, তাদের সংস্থায়। সংস্থার নাম চার অক্ষরের অ্যাব্রিভিয়েশন, পুরো শব্দটা কী ছিল ভগবান জানেন, শুরু হত এন আর শেষ হত টি দিয়ে।

ঠাণ্ডা মাথার লোকেরাও সন্তানের ব্যাপারে অবিবেচনার প্রমাণ দিয়ে ফেলে শুনেছি, আমার মায়ের মাথা ঠাণ্ডা ছিল এমন সার্টিফিকেট মায়ের অতি বড় অনুরাগীও দেবে না। ক্রমাগত ওই বিজ্ঞাপনের মুখে পড়তে পড়তে একসময় মায়ের প্রতিরোধ ভাঙল, তিনি এক শনিবার বিকেলে, 'সোনা, রেডি হও' আদেশ করে আমাকে বগলদাবা করে শ্রীরামপুরে সংস্থাটির শাখায় তিনমাসের কোর্সে ভর্তি করে দিয়ে এলেন। কোর্সের দাম কত ছিল এই এত যুগ পরে ভুলে গেছি, তবে সস্তা যে ছিল না মনে আছে।

এখন যেমন কোডিং না জানলে না খেতে পেয়ে মরার ভবিষ্যদ্বাণী চলছে, আমাদের প্রস্তরযুগে কম্পিউটার না জানলে উপোস করার ন্যারেটিভটা চালু ছিল। "কম্পিউটার জানা" মানে আসলে কী সেটা খুব কম লোকেরই ধারণা ছিল কাজেই তিনমাস ধরে কম্পিউটার খোলা, বন্ধ আর রিফ্রেশ করা শিখিয়ে 'মডিউলের' ঘট নেড়ে দিলে কেউ কিস্যু বলতে আসত না।

কী শিখেছিলাম মনে নেই কাজেই অন, অফ, রিফ্রেশ ছাড়াও আরও কিছু শিখেছিলাম যে সে বেনিফট অফ ডাউট দিতে আমি বাধ্য, কিন্তু যা-ই শিখে থাকি না কেন ও জিনিস শেখা না-শেখায় যে আমার কেরিয়ারের একচুল এদিকওদিক হওয়ার কোনও সম্ভাবনা ছিল না কোনওদিন সে নিয়ে আমার কোনও ডাউট নেই।<

তিনমাস অন্তে পরীক্ষার দিন ধার্য হল। গেলাম। প্রথম কথা, সিলেবাসে মারাত্মক হাবিজাবি জিনিসপত্র ছিল, দ্বিতীয় কথা, পরীক্ষায় না পড়ে যাওয়াটা একটা অপশন সেটা উপলব্ধি করতে তখনও বছরপাঁচেক দেরি ছিল। কাজেই আমি ওইসব হাবিজাবিও দুলে দুলে পড়ে গিয়েছিলাম।&

প্রশ্নপত্র ভরে মাল্টিপল চয়েস কোয়েশ্চেনস। প্রত্যাশিত। যে কোনও স্মার্ট পরীক্ষাতে ওই রকমই প্রশ্ন আসে। আমি চরম আনস্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থার অংশ ছিলাম, আমাদের কপালে জুটত কেবল ভাবসম্প্রসারণ আর টীকাটিপ্পনী। টিক মেরে বেরিয়ে যাওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না। সেইজন্যই ব্যাপারটার প্রতি সমীহ, গলবস্ত্রতা, আতংক, বিরাগ ইত্যাদি অনুভূতির মিশেল ছিল।

সেদিন একজায়গায় কথা হচ্ছিল শুনছিলাম, বাংলা মিডিয়ামের এক প্রাক্তন ছাত্র কোন প্রবেশিকা পরীক্ষায় ইংরিজি না বলতে পারা নিয়ে (পরীক্ষার বিষয় ইংরিজি ছিল না) কেমন হেনস্থা ভোগ করেছিলেন সেই নিয়ে বলছিলেন। ব্যক্তিগত দুঃখের স্মৃতিচারণার থেকেও ইংরিজি না বলতে পারাটা কেমন আমাদের সিস্টেমে হেনস্থা করার নেমন্তন্ন বলে প্রতিভাত হয় সেটারই একটা নমুনা দেওয়া তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বলে আমার মনে হচ্ছিল। ঘটনাটা মাথা নাড়ার মতোই, লোকে মাথা নাড়ছিলও। দলে দলে বাংলা মিডিয়ামরা এসে নিজেদের জমা দুঃখ উজাড় করে দিচ্ছিলেন।

চানাচুর খেতে খেতে অপেক্ষা করছিলাম কখন আলোচনাটা ইন্টারেস্টিং মোড় নেবে। নিলও অচিরেই।

একজন উল্টো শিবিরের লোক আর থাকতে না পেরেই নির্ঘাত বলে বসলেন, সবসময় যে এই জাতীয় বঞ্চনালাঞ্ছনা একই দিকে প্রবাহিত হয় তেমন নয়। #নটঅলইংলিশমিডিয়াম। প্রমাণ হিসেবে তিনি জানালেন যে ইন্টারভিউতে না হলেও কৈশোরের খেলার মাঠের বাংলা মিডিয়ামে পড়া বন্ধুরা তাঁকে একা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া পেয়ে কিছু কম বুলি করেনি।

অধোবদন হলাম। বুলি যে-ই করুক না কেন, অমার্জনীয় অপরাধ। ঘটনাটা যে ঘটেছিল এবং একা পেয়ে যে বাংলা মিডিয়ামেরা যে গায়ের ঝাল ঝেড়েছিল সে নিয়েও আমার কোনও ধোঁয়াশা নেই।

তবু ঘটনাটা শুনে তসলিমা নাসরিনের একটা লেখার অংশ মনে পড়ে গেল। প্রসঙ্গ বাংলা ইংরিজি মিডিয়াম ছিল না, কী ছিল সে আর আমার বানান না করে বললেও চলবে। তসলিমার ভাইপো/বোনপো গোছের, বয়সে নিতান্ত ছোট আত্মীয়, টিকটিকিকে পায়ে পিষে মারতে মারতে ভীষণ অবাক হয়ে আশেপাশের লোককে ডেকে দেখাচ্ছিল, দেখ আমি এত পায়ে পিষছি, তবু ব্যাটা কী জোরে জোরে ল্যাজ নাড়ছে!

মরে যেতে যেতেও টিকটিকির ল্যাজ নাড়ানোর বেয়াদবি শিশুটির কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকেছিল। যে ভদ্রলোককে খেলার মাঠে ইংরিজি মিডিয়ামে পড়া নিয়ে গঞ্জনা শুনতে হয়েছিল তাঁর প্রতি অন্তরের সবটুকু সমবেদনা উজাড় করে দিয়েই আমি বলছি, আপনি যদি ওই গঞ্জনার পেছনের যন্ত্রণাটুকু নজর করেন তাহলে আপনার কষ্ট একটু কম হলেও হতে পারে। ভাবুন, আপনি যাদের সঙ্গে খেলতে গিয়েছিলেন, তারা জানে বাংলা বোর্ডের, বাংলা মিডিয়ামের স্কুলে পড়ে। বিবর্ণ বর্তমান, ভবিষ্যৎ কুচকুচে। সে জায়গায় চোখের সামনে ইংরিজি মিডিয়ামের সোনার তরী ভাসিয়েছেন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে। রাগ, ক্ষোভ, হতাশা হওয়া কি খুব অদ্ভুত?

ভাবগতিক দেখে যদি সন্দেহ হয় যে এম সি কিউ প্রশ্নে পরীক্ষা দেনেওয়ালাদের প্রতি আমার গোপন তিক্ততা লালিত আছে, ঠিকই সন্দেহ হচ্ছে। ক্লাস নাইনে আমরা যখন অমিয় চক্রবর্তীর 'গাছ' কবিতার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে পাঁচ নম্বর পাচ্ছিলাম তখন ওইসব স্মার্ট বোর্ডের স্মার্ট স্কুলের পড়ুয়ারা 'ভুবন ও মাসি'-র গল্পের একটা প্যারাগ্রাফ পড়ে 'মাসি কাকে বলে?' প্রশ্নের উত্তর লিখেও পাঁচ নম্বর পাচ্ছিল। তিক্ততা না থাকলেই আশ্চর্য।

আমরা অক্ষমের প্রতিশোধ নিতাম। মরবই যখন, মেরেই মরি। বিরসবদনে বসে মশা মারতে মারতে নিজেদের সান্ত্বনা দিতাম, নম্বর দিয়ে কী হবে, যদি অন্তরে জ্ঞানের প্রদীপই প্রজ্বলিত না হয়? (সকলেই একবাক্যে একমত হতাম যে টিক মারা প্রশ্নপত্রে নম্বর বেশি হলেও জ্ঞান বেশি হয় না। জ্ঞানলাভের জন্য আট নম্বরের ভাব সম্প্রসারণই একমাত্র রাস্তা।) ভারতীয়রা যেমন মনে করে যে অ্যামেরিকানরা বড়োলোক বেশি হলে কী হবে, অংক পারে না মোটে। আর ইংরিজি বানান? রামোঃ, ওদের স্পেলিং বি কম্পিটিশনে সব ভারতীয় বংশোদ্ভূত বাচ্চারা জেতে বছর বছর দেখিসনি?

এ সবই আসলে মরে যেতে যেতে টিকটিকির ল্যাজ নাড়া।

যাই হোক, পরীক্ষা শুরু হল। কম্পিউটারেই পরীক্ষা, পরীক্ষা শেষ হলে কম্পিউটারেি সাবমিশন, কম্পিউটারই পরীক্ষক এবং নম্বরদাতা।

হলে ঢোকার আগে বলা হল উত্তর সাবমিট করার জন্য অত্যধিক হাঁকপাঁক করার দরকার নেই। পরীক্ষা শেষ হলে হাত তুলবে, দিদিমণি গিয়ে সব দেখবেনটেখবেন, তোমরা কম্পিউটারের ভুলভাল বোতামটোতাম টিপেছ কি না পরীক্ষা করবেন, তারপর যেমনটি নির্দেশ দেবেন তেমনটি করবে। আশেপাশে অনেকেই পরীক্ষা দিচ্ছিল। বিভিন্ন ক্যান্ডিডেট বিভিন্ন সময়ে পরীক্ষা শুরু করেছিল তাই শেষও হচ্ছিল বিভিন্ন সময়ে। দিদিমণি এসে তাদের পরীক্ষা শেষ করার আগে পরীক্ষা নিচ্ছিলেন।

দ্বিতীয় পরীক্ষাটার রকম বুঝতে বেশিক্ষণ লাগল না। বেসিক্যালি, আসল পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর দিদিমণি এসে পরিক্ষার্থীর উত্তরপত্র পরীক্ষা করবেন তারপর যে যে উত্তরগুলো ভুল হয়েছে সেগুলো ঠিক করে দেবেন। বোকার মতো সব উত্তর ঠিক করে দেবেন না, তাহলে সন্দেহজনক দেখতে লাগবে, দুয়েকটা বাদ রাখবেন বিশ্বাসযোগ্যতার খাতিরে। সবশেষে রেজাল্ট বেরোবে, একশো শতাংশ ছেলেপিলে সাতানব্বই শতাংশ নম্বর পেয়ে পাশ করবে।

পরীক্ষা অন্তে দিদিমণি এসে আমার কাঁধের ওপর ঝুঁকে পড়ে উত্তরপত্র পরীক্ষা করলেন এবং সাবমিট করার অনুমতি দিলেন। রেজাল্ট বেরোলো। রেজিস্টারে নম্বর টোকার দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক সবার নম্বর শুনেই বাঁকা হাসছিলেন, আমার বেলাতেই বা অন্যথা করবেন কেন। দিদিমণি পাশ থেকে বললেন, না না, ও নিজেই করেছে।

গোটা ব্যাপারটার পেছনে কত টাকা লেগেছিল আমার মনে নেই, যদি পাঁচটাকাও লেগে থাকে পাঁচটাকাই জলে। কারণ ওই পাঁচটাকা আমার বাবামাকে রক্ত জল করে রোজগার করতে হয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে যদি রক্ত জল না করে স্রেফ কুড়িয়ে পাওয়াও হত, পাঁচের জায়গায় পাঁচশো টাকাও কেউ হাতে গুঁজে দিয়ে বলত যাও গিয়ে কম্পিউটার শিখে এস, তবুও ওই তিনমাস জলে। কারণ তখন ঘুমোতে পারতাম। কবিতা পড়তে পারতাম। বাংলা মিডিয়ামে কেন পড়ালে বলে বাবামাকে গঞ্জনা দিতে পারতাম। সবই ওইরকম রামঠকা ঠকার থেকে ভালো হত।


Comments

  1. IIHT বলে একটা একই রকম ফ্রড জায়গায় উচ্চমাধ্যমিকের পরে গেছিলাম। বাবা ঠেলে পাঠিয়েছিল। একাই গেছিলাম। সেখানে তখন কোন অস্ট্রেলিয়ান universityর ডিগ্রির ব্যবস্থা ছিল। কথাবার্তার পরে বুঝলাম কেস জন্ডিস।
    বাড়ি এসে বলে দিলাম ও আমি কিছুতেই করব না।
    এখন আপনার লেখা পড়ে মনে হল ভাগ্যিস করিনি।

    "সফল পার্টনারশিপের একটা প্রধান আরামের (এবং সফলতার) জায়গা হল নিন্দেমন্দ করার টপিক/মানুষ কমন পড়া।" - আমার বউ পড়লে হাই ফাইভ দিত। নিন্দে করলে হুঁ হাঁ করে ছেড়ে দি' বলে মাঝে মাঝেই বকা খাই। কিন্তু কথাটা একদম সত্যি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. নিন্দে সম্পর্কের স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক জরুরি জিনিস বলে আমি মনে করি, চন্দ্রচূড়। ওতে যেমন বন্ডিং বাড়ে তেমন আর কিছুতে বাড়ে না।

      Delete
  2. টিকটিকির ল্যাজ নাড়ার গল্পটা আগে পড়িনি। একদম ঠিক বলেছ। আমার গেছিলো এমন "ল্যাঙ্গুয়েজ" শিখে। না কোনো ইন্সটিটিউটে না, সেই অর্থে ঠকানোও না। কিন্তু আমার সময় নষ্ট হয়েছে, বেকার গেছে ওই সময়টা। আমার তো মনে হয় পুরো স্কুল কলেজ সময়টাই বেকার পড়াশোনা করিয়েছে ভাব সম্প্রসারন করিয়েছে, স্রেফ এক্সেল শেখালে, কিংবা এখনকার লোকেদের মতো করে রাজনীতি শেখালেই পারতো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, এটা ভালো বলেছ, প্রদীপ্ত। তবে এক্সেল শেখালে বোরিং হত। তার থেকে আরেকটু বেশি মাঠে ছুটতে দিলে ভালো হত মনে হয়।

      Delete
  3. Amaro eirokom ekta phase giyecchhilo. Amar chhoto bhai kono ekta extra curricular activity jite prize peyechhilo 1 mash na kotor jonyo computer shekha. Bechara NOIDA theke North Campus, prak-Metro juge, duto bus bodle jeto. Or koshto alada, amar maayer ki chinta!! O to computer shikhe nilo, tor ki hobe? Tuio course ta kore ne!! Amar ek kotha, ja hobe, dyakha jaabe, ekhon ami paarbo na!!
    Pore mone hoy, nije jed kore je kota jinish korechhi, eita one of the best!!! Ma aaj jokhon amake ghontar por ghonta computer niye pode thaakte dyakheen, pray-i oi shomoy ta mone koren!!
    it
    Shuteertho

    ReplyDelete
    Replies
    1. এইখানে জেদ করে খুবই কাজের কাজ করেছিলেন, সুতীর্থ। এই টুপি পরাগুলোর কোনও মানে হয় না। মায়েদের চিন্তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাজে দেয়, কিন্তু এই জায়গাটায় আপনার আর আমার মায়ের দুজনের চিন্তাই অবান্তর প্রমাণিত হয়েছে। "O to computer shikhe nilo, tor ki hobe?" পড়ে হাসছি খুব। কারণ পাত্রপাত্রী পরিস্থিতি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।

      আপনার মায়ের সঙ্গে একবার মেলে কথা হয়েছিল মনে পড়ছে, সুতীর্থ। কেমন আছেন উনি? আমার তরফ থেকে উৎসাহিত-হাত-নাড়া পাঠালাম।

      Delete
  4. Amio erokom akta institute e gechhilam kichudiner jonno. Khub beshi kichhu sikhini tobe khub kharap lageni :) bhoy kete gechhilo, ektu confidence esechhilo.. kono conversation e relate korte partam..

    Ta chhara eta jene bhalo lagto je eta level playing platform, ekhane English medium er advantage nei.

    Khub bhalo lekha!!

    ReplyDelete
    Replies
    1. Akdom level playing field nischoi noi..tobe...

      Delete
    2. আমি এ ব্যাপারে একমত, রণদীপ। এটা ওই সেন্টারগুলোর একটা ভালো ব্যাপার। তবে যারা ডিসঅ্যাডভ্যান্টেজিয়াস পজিশনে আছে তাদের জিজ্ঞাসা করলে হয়তো তারা মানতে চাইবে না।

      Delete
  5. "ব- দিয়ে নাম শুরু হওয়া একটা কোম্পানি যারা শিশুদের কোডিং শেখানোর নামে চিটিং করে বেড়াচ্ছে। কোন শিশু ওদের ক্লাসে কোডিং শিখে অ্যাপ লিখে মিলিয়ন বিলিয়ন ডলার রোজগার করেছে ঢাক পেটানোর পর বাবামায়েরা নোলা সকসকিয়ে টাকার থলি আর বাচ্চা বগলে ছোটার পর বেরিয়েছে সব ভাঁওতা। অ্যাপ লিখে বড়োলোক হওয়া বাচ্চার নাম থেকে শুরু করে সবটুকু কোম্পানির কারও উর্বর (এবং বাবামায়ের চরিত্র গুলে খাওয়া) মস্তিষ্কের অবদান।"
    sotyi naki ?

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই রে, সত্যি মিথ্যে বলতে পারব না। টুইটারের খবর। ফেক কি না কে জানে।

      Delete
  6. Aha amio gechhilam madhyamik er por orokom ekta institute e. sekhane abar spoken english ar computer er combo sekhato. dudin pore english sir er jhogra kore english class theke resign korechhilam. Sei somoy ta computer e bose email korte shikhechhilam ar net search korte. Ar joddur mone pore DOS ar C+ shikhiyechhilo kichhuta. Tobe biotech porate seduto ar kaje lageni pore. Tobe net search er sei experience ta B.Sc porbar somoye besh kaje legechhilo. Tokhon deshe sodyo B.Sc biotech khulechhey. Beshibhag boipotro, article sob e bidesher. Kajei prochur net ghantte hoto. Okhane shikhe bhoy bhenge jaoyate college e ekebare jole pore jaini amar baki onek classmate er moton.

    ReplyDelete
    Replies
    1. যাক, এটা ভালো ব্যাপার, চুপকথা। কাজের জিনিস কাজে লাগলেই ভালো।

      Delete

Post a Comment