পদস্খলনের পর



যত বুড়ো হচ্ছি, পদস্খলনের প্রবণতা তত বাড়ছে। এই যেমন সেদিন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে দুম করে পড়ে গেলাম।

অর্চিষ্মান বলল, তুমি অ্যাকচুয়ালি হাঁটলে?

হাঁটার সম্ভাবনা নিয়ে ভার্চুয়ালি জল্পনা হয়েছিল। একজায়গায় যাওয়ার ছিল। গুগল ম্যাপে দেখাল পায়ে হেঁটে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের রাস্তা। একেবারে অগস্ত্যযাত্রায় যাব না যখন, ফিরতেও হবে। আবার পঁয়তাল্লিশ।

একমত হয়েছিলাম, পিঠে ভারি ব্যাগ না থাকলে ব্যাপারটা ডুয়েবল।

ডুয়েবল মানেই যে করতে হবে, তেমন দিব্যি নেই। অধিকাংশ ডুয়েবল জিনিসই আমি করি না। করলে সারাদিনে অনেক রকম কাজ করা যায়, করি না। অনেক বেশি গল্পের বই পড়া যায়, পড়ি না। অনেক বেশি লেখা যায়, লিখি না।

কিন্তু হেঁটে যাতায়াতের অ্যাটেম্পটটা নিলাম। এই ভেবে যে পৌনে একচল্লিশ বছর বয়সে পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাঁটতে পারব না?

ছোটবেলায় এই করে আলাদা রান্নার ঝামেলা এড়াত বাড়িতে। সোনা এটা খেতে পারবে না, ঝাল হয়েছে। সোনা সেই ভয়াবহ ঝাল তরকারি খেয়ে বসে থাকত। চোখ ছাপিয়ে জল আসত কিন্তু টুঁ শব্দ করত না, কারণ প্রমাণ করার ব্যাপার ছিল যে সোনা বড় হয়ে গেছে।

পৌনে একচল্লিশের কুন্তলাও যে এদিকে পঁয়তাল্লিশ, ওদিকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট হেঁটে ম্যানেজ করতে পারে, সেটা প্রমাণ করার ব্যাপার ছিল।

অনেক পৌনে একচল্লিশের কাছে হয়তো এটা প্রমাণের মতো জরুরি হবে না। কারণ সবার পৌনে একচল্লিশ একরকম দেখতে হয় না। মিলিন্দ সোমনের পঞ্চান্নর সঙ্গে আমার চেনা অধিকাংশ পুরুষের পঞ্চান্নর আকাশপাতাল। আপনার পৌনে একচল্লিশ তারুণ্যে ডগমগ হতেই পারে, আমার পৌনে একচল্লিশ ফিটনেসের রেসে হুড়হুড়িয়ে হারছে।

ফিটনেস না থাকাটাকে আমি রসাতল মনে করি না। শারীরিক আনফিটনেসটাকে বরং চিরদিন বেশ প্রশ্রয়ের চোখেই দেখে এসেছি। মনের গভীরে একটা প্রেজুডিস প্রোথিত আছে যে শরীরের ফিটনেস আর মন বা মস্তিষ্কের ফিটনেসের সম্পর্কটা একটা জিরো সাম গেম। একজন জিতলে আরেকজন হারবে। একজন এগোলে আরেকজন পিছোবে।

কোনও কারণ নেই এমন মনে হওয়ার, কিন্তু এ একেবারে অন্তরের প্রেজুডিস, এ থেকে বেরোতে, যদি পারিও, অনেক সময় লাগবে। একটা সমাজের সবাই হাঁই হাঁই করে জিমে দৌড়চ্ছে কিংবা সকালবিকেল মাঠে ম্যাট পেতে কপালভাতি করছে দেখলে আমার ভেতরে সে সমাজের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনওরকম আশাবাদের রোশনি জ্বলে না।

বরং সেই সমাজের জন্য জ্বলে, যেখানে একদল রুগ্ন মানুষ পৃথিবীর সব বিষয় নিয়ে মতামত পোষণ এবং ব্যক্ত করে, খেয়ে উঠে জেলুসিল খায়, অক্টোবর পড়লে ফ্যান একে নামায়, যাদের শৈশবের অ্যালবাম টাইগার হিলে মাংকি ক্যাপ পরা ছবিতে ঠাসা থাকে এবং যারা মাথাভর্তি তত্ত্বের কচকচি নিজস্ব প্রতিধ্বনি প্রকোষ্ঠে উগরে যায় বিকেলের পর বিকেল, সন্ধের পর সন্ধে। এ ফ্যাসিনেশনের সূত্রপাত কবে থেকে জানি না, তবে রিসেন্ট নয়। চাঁদের পাহাড় পড়ে শঙ্করকে দেখে মচৎকৃত হয়েছি, কিন্তু প্রেমে পড়িনি। অমলমার্কা চিররুগ্নতার প্রতি আমার প্রেম চিরদিন ধাবিত হয়েছে।

তা বলে কি সুস্বাস্থ্য অ্যাপ্রিশিয়েট করি না? মিলিন্দ সোমনকে দেখে হাঁ করে থাকি না? আগেও বলেছি, মালচা মার্গের প্রিয় দোকানে ব্রাঞ্চ খেতে গিয়ে কোণের টেবিলে সরদার সিং, তৎকালীন ভারতীয় পুরুষ হকি টিমের অধিনায়ককে বসে থাকতে দেখেছিলাম। আমি না হয় হাঁ করা পাবলিক, অর্চিষ্মানও দেড় মিনিট বাদে বাদে চোরা চাউনি না দিয়ে পারছিল না। কী শরীর! কী স্বাস্থ্যের সৌন্দর্য!

কিন্তু সে অ্যাডমিরেশন, অনুরাগ নয়।

মিলিন্দ সোমন আর যারই মাথায় থাকুন, আমার মাথা জূড়ে রোগা ইন্টেলেকচুয়ালরা বসবাস করবেন। (সে রকম একজনের হরর সিনেমাসংক্রান্ত সাম্প্রতিক দীর্ঘ বক্তৃতাখানি শুনেছেন কি?  এই রইল লিংক।)

তবু হেঁটে যাতায়াতের সিদ্ধান্ত নিলাম। কারণ ওই যে বললাম, দু’রকমের চর্চা হয়, শারীরিক আর মানসিক। এখন, কোনও একরকমের চর্চা করে তো টাইমপাস করতে হবে। মনের চর্চার অজুহাত দিতে পারব না, তাই শরীরের চর্চার দিকে নজর দেব ভাবছি। তাছাড়া মাথার চর্চা করলে অন্যভাবে অমর হওয়ার একটা চান্স থাকে, সেও হলাম না, এদিকে শরীরটাকে অবহেলা করতে করতে অকালে ফস করে মরে গেলাম, সে বড় করুণ হবে। আজকাল মনে হয়, আরেকটু বেঁচে থাকলে মন্দ হত না। কী হবে বেঁচে থেকে জানি না, যুক্তিগ্রাহ্য কোনও কারণ নেই বেঁচে থাকার, তবু থাকতে ইচ্ছে করে।

আর যদি বেঁচেই থাকি, সচল সবল হয়ে থাকলেই ভালো। শরীরচর্চার সঙ্গে সচলতা সবলতার কোনও সম্পর্ক আছে কি না শিওর নই। অনেক লোককে বলতে শুনি, দেখেছ, জীবনে একটাও সিগারেট খায়নি, তাও লাং ক্যান্সারে গেল। হতেই পারে, সকাল বিকেল কপালভাতি করলাম তবু কেঁদেককিয়েই মরলাম, আশেপাশের লোকের ঘাড়ে বডি ফেলে।

ফেললেও, অবাক হওয়ার একটা সুযোগ থাকবে। (আমার না, বাকিদের)। না করলে তাও থাকবে না। তাই ভাবছি কপালভাতি ধরব। নিদেনপক্ষে হঠযোগ, যা আমার এ যাবতের জীবনে একেবারে অপরিচিত নয়, হঠাৎ হঠাৎ হড়কা বানের মতো জীবনে আসে, সেটাকে আবার শুরু করলে কেমন হয়। ভাবছি। করিনি। ভাবছি।

অর্চিষ্মানের সঙ্গে সেদিন উঠকবৈঠক চ্যালেঞ্জ হল। আমরা নিজেদের মধ্যে স্ট্রিক্টলি বাংলাতেই কথা বলি, কিন্তু কিছু কিছু বিষয় অন্য ভাষাতেই মানায় ভালো। গানবাজনা, বিশেষ করে মার্গসংগীতের কথাবার্তা হিন্দি ঘেঁষা হয়, মাস্টারমশাইকে সবাই গুরুজি বা ওস্তাদজি ডাকে, সারেগামা প্র্যাকটিস করার থেকে সরগম রেওয়াজের ভার বেশি। রাগপ্রকাশের ক্ষেত্রেও বাঙালি অন্য ভাষার গালিতে বেশি স্বচ্ছন্দ মনে হয়। তেমনি শরীরচর্চা ব্যাপারটা বাঙালির ভেতর থেকে আসে না বলেই হয়তো ওঠবোস বললেই শাস্তির অনুষঙ্গ মাথায় আসে, উঠকবৈঠক বললে শরীরচর্চার।

একবার বসে উঠলাম, দু’বার বসে উঠলাম, তৃতীয়বার উঠতে গিয়ে খাটের কোণা ধরতে হল, কোথা থেকে মটমট শব্দ এল। এদিক ওদিক তাকিয়ে শব্দের উৎস সন্ধান করছি, অর্চিষ্মান তর্জনী তুলে দেখাল, উৎস আমার শরীর।

দু’বছর আগেও যখনতখন, বিনা নোটিসে পায়ের আঙুল ছুঁতে পারতাম। ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে স্লো মোশনে দশ গুনতে পারতাম। চেষ্টা করলাম। প্রথম চার বার মেঝে থেকে পাঁচ ইঞ্চি ওপর আঙুলের ডগা ঝুলে রইল। পঞ্চমবারের বার বুড়ো আঙুল ছুঁল, তিন গুনতে না গুনতে ছিটকে গেল।

মহাকাল ঘনাবেই। ঘনিয়েছে। তারই পরিণতি হিসেবে সম্ভবতঃ ওই পদস্খলন। যাওয়ার পথ উতরাই ছিল, আসার পথ চড়াই, অসমান বাঁধানো রাস্তা, ক্লান্ত পদক্ষেপ, অমোঘ ঠোক্কর। নিজে উঠে পড়ে হাঁটু ঝাড়ার গরিমায় মসমসিয়ে লাভ নেই, আর ক’বছর পর লোককে দৌড়ে এসে তুলতে হবে।

এখনও জল সে অব্দি গড়ায়নি, আশেপাশের বারান্দা ও গাড়ির জানালার নামানো কাচের ওপার থেকে, আর ইউ ওকে? আর ইউ ওকে? ভেসে আসাতেই স্থগিত আছে। প্রশ্নকর্তাদের দোষ দিচ্ছি না, না জিজ্ঞাসা করলে অমানবিকতার প্রকাশ হত, কাজেই তাঁরা জিজ্ঞাসা করেছেন যে ভালোই করেছেন। তবু আমার অসুবিধে হল কারণ জোড়া জোড়া চোখ আমার দিকে পড়ল। পদস্খলনের পরিণতি। স্বাস্থ্যের মুখ চেয়ে যদি নাও পারি, ওই দৃষ্টিপাত এড়াতেও রোজ কুড়ি মিনিট ব্যয় করার মোটিভেশন আমার পাওয়া উচিত।

 

Comments

  1. EKhon kemon aachhen?
    Lekhati khub bhalo laglo Kuntala. Apnar lekha jemon sundor hoy...

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে, তেমন গুরুতর কিছু হয়নি,সায়ন, দুই হাঁটু ছড়ে যাওয়া ছাড়া। নতুন জিনসখানা ফুটো হয়েছে, তার প্রতি আমার হাঁটুর থেকে বেশি মায়া হচ্ছে সত্যি বলতে কি। ব্যস ওইটুকুই।

      লেখা আপনার ভালো লাগলে আমারও বরাবর যেমন ভালো লাগে তেমনই লাগল। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  2. Daaaaruuuun bhalo laglo lekhata.. puropuri ekmot..

    ekhon mone hoy aarektu beshi bnachle, na kora kaaj kichu kore phela jaabe.. jodio se asha kom e

    amra kichudin sokalbelay youtube chaliye 30-40 min workout korar chesta korechilam.. attendance up down niyeo maash duyek para gechilo.. tarpor aabaar punarmushiko bhobo ekhon

    bhalo thakben

    Indrani

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওইটাই তো বিপদ, ইন্দ্রাণী। কিছুতেই ধরে রাখা যায় না ভালো অভ্যেস। সব কাজ যদি দাঁত মাজার মতো সিস্টেমে ঢুকে যেত, কী ভালোই না হত। আমিও যদি কিছু করি, ইউটিউব দেখেই করব, হাই ফাইভ।

      Delete
  3. "মনের গভীরে একটা প্রেজুডিস প্রোথিত আছে যে শরীরের ফিটনেস আর মন বা মস্তিষ্কের ফিটনেসের সম্পর্কটা একটা জিরো সাম গেম। একজন জিতলে আরেকজন হারবে। "- একেবারে সব বাঙালির জীবন দর্শন !
    তবে মিলিন্দ সোমান একটু কেমন যেন দেখতে হয়ে গেছে, পাগলাটে টাইপ :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, তোমার কমেন্ট পড়ে মনে করে দেখলাম, অল্প পাগলাটে টাইপ দেখতে লাগছে বটে ভদ্রলোককে, কিন্তু ওটুকু অগ্রাহ্য করে নিতে রাজি আছি।

      Delete

Post a Comment