বইমেলার ছবি



দু’নম্বর মার্কেট থেকে বাড়ির পথটুকুতে সৌরভ স্টোর্সের ছেলেটা - শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, ভোট, দাঙ্গা নির্বিশেষে যার মুখ ঝলমলে - অনেকসময় মালপত্র এলোমেলো করে ফেলে। অবশ্য ওকে শুধু দোষ দিয়ে লাভ নেই, আমাদের হাতেও হয় হামেশাই, ব্যাগের মধ্যে মুখ উল্টে পড়ে থাকে দু'লিটারের লিমকা, বাড়ি এসে প্যাঁচ খোলা মাত্র সর্বত্র উদ্গারিত। দশের মধ্যে সাড়ে ন’বার আমার হাতেই। প্যাঁচ খুলছি, গলগল করে ফেনা বেরোচ্ছে, আর অর্চিষ্মান, 'দেখে দেখে!' চেঁচাচ্ছে - কমন ব্যাপার, আমাদের বাড়িতে।

ইন্দ্রাণীর বইমেলা ঘুরে আসার খবরে মনের ভাব সেই রকম উপচে উঠল।

কলকাতা আমাকে পাত্তা দিক না দিক, নিজের বলে স্বীকার করুক না করুক, “জিলা” কিংবা “মফো” বলে যত খুশি মুচকি হাসুক, একটি বিষয়ে আমি কলকাতার শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়েছি।

কলকাতা বইমেলার মতো মেলা আমি পৃথিবীর কোথাও দেখিনি। রথের মেলা দেখেছি, দোলের মেলা দেখেছি, শকুন্তলা কালীবাড়ির মেলা, হস্তশিল্প মেলা, কুটিরশিল্প মেলা, আরও গোটা পাঁচেক বাঘা বাঘা শহরের বাঘা বাঘা বইমেলা - কলকাতা বইমেলার মতো আর একটিও মেলা জীবনে দেখলাম না। দেখবও না, সে বাবদে আমি নিশ্চিত।

কতকিছুর জন্য বাবামাকে ধন্যবাদ দিই। প্রাণটার জন্য, লালনপালন, ভরণপোষণ, গ্রাসাচ্ছাদন, একা একা রাস্তায় ছাড়া, হিতৈষীদের সাবধানবাণী অগ্রাহ্য করে বাংলা মিডিয়ামে পড়ানোর কনফিডেন্স অর্জন করা। মুখে না বললেও, মনে মনে দিই। কিন্তু জ্ঞান হওয়া, কিংবা হওয়ারও আগে থেকে জীবনভরের সেরা মেলাটায় বছর বছর ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার পরিশ্রমটুকুর জন্য কখনও মুখে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ তো করিইনি, এ পরিশ্রমের মর্ম এবং আমার জীবনে তাৎপর্য, মনে মনেও উপলব্ধি করিনি।

লায়েক হওয়ার পর একা একা গেছি অনেকবার মেলায়। শেষবারের বইমেলাটায় গেছিলাম বাবামায়ের সঙ্গে। দু’জোড়া বাবামা। কখনও একসঙ্গে ঘুরেছিলাম, কখনও আলাদা আলাদা, কখনও ঘুরতে ঘুরতে দেখা হয়ে যাচ্ছিল। দেখা হলেই ভেজ/চিকেন পাফ আর লেমন টি খাচ্ছিলাম। আমি আর অর্চিষ্মান হাঁটছিলাম সন্ধেবেলা, মনোযোগী ছাত্রের মতো মুখস্থ করা স্টল নম্বর খুঁজতে গোটা মেলা অন্তত পাঁচবার চক্কর মেরেছিলাম।

সে কী অসামান্য পা ব্যথা, সে কী অপরিসীম ফুর্তি।

সব ছাপিয়ে একটা ছবি এখন জ্বলজ্বল করে মাথার ভেতর। একটা চৌকো বেদীমতো জায়গায় মা বসে, একা। ম্লান মুখ, নত। সামনে গিয়ে যেই না বললাম, কী গো কী ভাবছ? চমকে তাকালেন আর জীবনভরের প্র্যাকটিসে সারামুখ নিমেষে জ্বলজ্বলে করে বললেন, কই কী বই কিনলি দেখি?

আর সাতটা মাস।

বইমেলা ঘনালে প্রকাশকরা নিজেদের বইয়ের বিজ্ঞাপন দিতেন কাগজে। তার মধ্যে থেকে চোখে পড়া, মনে ধরা বইয়ের লিস্ট বানাতেন মা। মেলা থেকে কিনবেন বলে না কিন্তু, কিনবেন সারাবছর যেখান থেকে বই আসে বাড়িতে, কলেজ স্ট্রিট, কারণ সেখানে বেশি কমিশন। অধিকাংশ বই মা একাই কিনতেন। কখনও কখনও আমি সঙ্গে থাকতাম, বাচ্চুকাকু সর্বদা হাসিমুখে ফুটপাথের একটা অংশে বসে থাকতেন, মা লিস্ট ধরালে দৌড়ে সব জোগাড় করে আনতেন, আমি আর মা ততক্ষণে কফি হাউসে বসে কফি খেতাম আর লোক দেখতাম।

মেলায় গেলে মায়ের সংসারী মন ব্যাকফুটে চলে যেত, সত্যিকারের মন দখল নিত মাথার। রথের মেলায় পাঁপড়ভাজা প্রত্যাখ্যান করতে অমানুষিক প্রতিভার প্রয়োজন, দোলের মেলায় মাটির ট্র্যাফিক পুলিস অন্তত একবার হাতে তুলে দেখার যার ইচ্ছে করে না সাইকোপ্যাথ হতে তার বেশি দূর নেই। বইমেলায় গিয়ে পকেটে টাকা থাকা সত্ত্বেও বই না কিনে, চা, প্যাটিস, মাছভাজা কিংবা আইসক্রিম না খেয়ে ফিরে আসার ক্ষমতা যে দেখাতে পারে, ওয়েল, তাকে আমি দূর থেকে গড় করি।

একবছর, অফিস থেকে আগেভাগে বেরিয়ে মেলায় গিয়েছিলেন মা। বাড়ির সেট আলুভাজা হয়ে গেছে, এক সেট ঝকঝকে রবীন্দ্রনাথে সোনার জন্মগত অধিকার, নিজেকে এই সব ভুজুংভাজুং দিয়ে আঠেরো খণ্ড কিনে ফেলেছিলেন। বাঁধাবাঁধি সারা হলে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সঙ্গে লোক আছে?

না তো।

গাড়ি?

তাও নেই।

কোথায় যাবেন?

রিষড়া।

নিজের অংশের কাজের দায়িত্ব অন্য কাউকে সমর্পণ করে, বই-বাহক জোগাড় করে আঠেরো খণ্ড রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বইমেলার বাইরে বেরিয়ে, রিষড়া পর্যন্ত যেতে রাজি এমন ট্যাক্সি, না অ্যাপ ছিল না, গোটাটাই হাত নেড়ে আর মুখ চালিয়ে, মাকে ধরে দিয়েছিলেন।

আমাকে রবীন্দ্রনাথ পড়ানোর কৃতিত্ব অনেকটা মায়ের। তার থেকেও বেশি হয়তো রবীন্দ্রনাথের,  আফটার অল লিখেছিলেন বলেই না।

ওই ভদ্রলোকেরও কি কম?

মেলা থেকে বিস্তর বই কেনা হত। নিজেদের জন্য। আমার জন্য। বছরভর আত্মীয়বন্ধুদের বাচ্চাদের উপহার দেওয়ার জন্য। কমিশনের কমবেশি ভুলে মেরে দিয়ে। দরকারের বেশি হচ্ছে বুঝেও। আমার বইয়ের প্যাকেটটা আমি কাউকে বইতে পারমিশন দিতাম না। শিশু সাহিত্য সংসদ আর দেব সাহিত্য কুটির-এ ঝুড়ি ঝুড়ি বই কিনে ফেলার পর যখন বাবামা একমত, এবার চোখ বুজে দৌড়ে না বেরিয়ে পড়লে বিপদ, নজরে পড়ল আমি একটা বই নাড়ছিচাড়ছি। আগের দোকানেও এই বইটাই নাড়ছিলাম চাড়ছিলাম। বাবামা দেখেও না দেখার ভান করেছিলেন। আমিও, বলা বাহুল্য, চাইনি। যন্ত্রণা চেপে বেরিয়ে এসেছি। পরের দোকানে পড়বি তো পড় সেই বইটার মুখোমুখি। আবার।

হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ভৌতিক গল্পসমগ্র।

বইটার গায়ে হাত বোলাচ্ছিলাম, দোকানে দাঁড়িয়েই  প্রথম গল্পটার প্রথম পাতাটা পড়ে নিলে কেউ বকবে না আশায় বুক বেঁধে। এগিয়ে এসে বইটা উল্টেপাল্টে দেখলেন বাবামা।

ও দোকানে দাম কম ছিল না?

এটায় ছবি আছে, ওটায় ছিল না।

সংযমের বাঁধ মুহূর্তে খানখান। ছবি লাগবে না, আর্তস্বরে বলে উঠেছিলাম আমি।

বইটা ঢুকে গিয়েছিল আমার হাতের প্যাকেটে। ছবিওয়ালা সংস্করণটাই।

Comments

  1. দারুন লাগলো। অনেক কিছু মনে পড়লো। পরে এসে আরেকবার কমেন্ট করবো। অন্য পোস্টে সুদীর্ঘ কমেন্ট করে ফেলেছি অলরেডি।

    আমি সম্পূর্ণ একমত যে কলকাতার বইমেলার কোনো তুলনা নেই। ছোটবেলায় জামশেদপুরের বইমেলায় বাপি প্রত্যেক বছর নিয়ে যেত। ছোট হলেও দেব সাহিত্য কুটির, ভস্তক এবং আরো অনেক বাংলা বইয়ের প্রকাশকরা আসতেন। আমি চেষ্টা করতাম যত সম্ভব কম ছবিওয়ালা এবং ছোট ছাপার অক্ষরের বই কিনতে। সারা বছর অপেক্ষা করে থাকতাম। সেই তুলনায় কলকাতা বইমেলায় কম যেতে পেরেছি।

    খুব ভালো থাকবেন

    ইন্দ্রানী

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই তো, আরেকজন বুঝদার বাচ্চাকে পাওয়া গেছে। কম ছবিওয়ালা এবং ছোট ছাপার অক্ষরেও আমরা দমব না, বই যদি পড়তে পাই, বলুন, ইন্দ্রাণী?

      বইমেলা একটা সিরিয়াস সেন্টিমেন্টের জায়গা, আমার আপনার মতো আরও অনেকের আমি নিশ্চিত। কেন, আমি ভেবে খুব একটা ভালো উত্তর পাইনি, তাই খোঁজা ছেড়ে দিয়েছি। জামশেদপুরের বইমেলার গল্প শুনে ভালো লাগল। প্রবাসে বাংলা বই কিনতে পেলে যে কী তৃপ্তি হয়, প্রবাসীরা জানে।

      ভস্তক! আমাদের বাড়িতে বই ছিল কত ভস্তকের, কিন্তু সবথেকে বেশি মনে আছে ভস্তকের একটা বুকমার্কের কথা, শ্বেতাঙ্গ সুন্দরী সাদা গাউন পরে উদাস দৃষ্টিতে হাতে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ওটা শোকেসের কাচের গায়ে সাঁটা থাকত। খুবই আরবিট গৃহসজ্জা, কিন্তু এখন মনে পড়লে ওয়ার্ম ফাজি ফিলিং হচ্ছে।

      Delete
  2. Lekhata pore anekbochhor aager ek boimelar bhire hariye gechhilam. Aneker moto amar boimela jabar haatekhori babar sathe. Babader bank chhilo boimelar banker. sei subaade school er ektu boro class theke shani-rabi jaoa. Boimelar dinshurur aage theke babar sathe giye boimelar dinsesher pore fera. amar puro byaparta asadharon lagto. stall sajano theke dinseshe stall gotano...dekha. AAr tarsathe somane mukh chalano. Tarpor college e uthtei baba bodli hoye head office chole gelo aar amar laayek hoye boimela ghorar shuru...amar jiboner onyotomo boijatiyo sera jinis boimela theke kena....Oxford publications er ekta dhhaus Atlas....aajker projonmer kaachhe tar daam nei...kintu tokhon 1994 saale class 9 e pora kishorir kaachhe setar aparisim mulyo. Jar dam kono taka diye kena jaina. aajo amar kaachhe sera upohar er ekta holo oi Atlas babar deoa.
    2017 saaler boimela te hothat kore jaoar sujog hoi prai 12 bochhor por...chhele ke niye gechhilam. barbar or chokh-mukher dike takachchilam aar bhabchhilam o ki amar motoi khushi ekhane ese. Tar bideshe jonmo-bere otha. Kintu seshe jokhon dekhlam o jor kore tindin amake niye gelo sathe ekdin tar dida, ekdin tar thammi ke niye. Tate khub relief bodh holo.

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই যে আপনি বললেন, ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আপনি বোঝার চেষ্টা করছিলেন, ওরও আপনার মতোই ভালো লাগছে কি না, এই ছবিটা এত ভালো লাগল। অ্যাটলাসের ব্যাপারটা সত্যি। এখনকার বাচ্চারা এর মর্ম বুঝবে না, কিন্তু আমাদের কাছে ও জিনিস অমুল্য ছিল। আমার খুব গ্লোবের শখ ছিল। আমার অনেক বন্ধুর বাড়িতে ছিল, আমার ছিল না।

      খুব ভালো লাগল আপনার কমেন্ট পড়ে, সুস্মিতা।

      Delete
  3. Amar chhotobelar koto mlan hoye asha smri abar jholmole hoye uthlo ei lekhata pore. Besh kobar pore gechhi, chokhe jol aschhilo. Ekhon Eka boimela jaai, kokhono RAkar sange, Puttus-o thake... ebare prothom boimela gelo o. Baba-maar haat dhore oibhabe boimelar din ar fire asbe na. Kotto kotto smriti. Thank you Kuntala...

    ReplyDelete
    Replies
    1. শুনুন সায়ন, একবার দেখা করি চলুন বইমেলায়। আইসক্রিম খাওয়াব, প্রমিস।

      Delete
    2. পরের বছর, ডিল।

      Delete
  4. সত্যি, কলকাতার বইমেলাটা একটা দারুন বেপার। গত চার পাঁচ বছর বাদ দিলে, স্কুলের সময় থেকে শুরু করে প্রত্যেক বছর অন্তত একবার যাওয়া এবং বই কেনার প্রথা চালু ছিল। ইদানিং আর সেটা আর নিয়মিত হচ্ছে না।

    আপনার লেখাটা পড়তে পড়তে অনেকদিন আগে পড়া এই লেখাটার কথা মনে এসে গেছিলো: https://www.nobelprize.org/prizes/literature/2007/lessing/25434-doris-lessing-nobel-lecture-2007/
    এটার কয়েকটা জায়গা এবং শেষটা খুব ভালো লেগেছিলো। প্রাসঙ্গিক বলে লিংকটা দিয়ে দিলাম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আহা, কী ভালো জিনিস পড়ালেন, রাজর্ষি। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি যতির সঙ্গে একমত। থ্যাংক ইউ। আবার বইমেলা ধরে ফেলুন। সারাদিন কত হাবিজাবি জিনিস ধরে থাকি, বইমেলাকে ছেড়ে কী লাভ?

      Delete

Post a Comment