অনভ্যাস অতিক্রম করে



ঘটনাটা যে ঘটছে শুরুর দিকে টের পাইনি।

অবান্তরে কী নিয়ে লিখব ভাবতে বসলে যে জিনিসগুলোর কথা মনে পড়ছে, অর্থাৎ জীবনে যা ঘটছে সে নিয়ে লিখি ভাবলে মনে হচ্ছে, ধুস্‌ এ নিয়ে আবার কী লিখব। মনে হচ্ছে, ধুস, এ নিয়ে আবার কী ফেনাব?

মনে হওয়াটা এই জন্য সমস্যাজনক নয় যে মনে হওয়াটা ভুল। ফেনানো সব নিয়েই যায়। যদি না ফেনানোর অরুচি বা অক্ষমতা থাকে। কোনওটাই আমার নেই।

মনে হওয়াটা অন্য কারণে সমস্যাজনক। রীতিমত সমস্যাজনক। যে সমস্যার শুরুতেই কোপ না মারলে বিপদ। সে নিয়ে পরের (পরের) পোস্টে ফেনাব, আজ সারাৎসারটুকু বলি।

কোনও বিষয়কে অবান্তরে লেখার পক্ষে তুচ্ছতর দাগানো, বা অবান্তরকে কোনও বিষয়ের পক্ষে সিরিয়াস বলে চেনানো, এটা খতরনাক। দুর্দমনীয় খতরনাক। প্রায় এ বই আমার পড়ার যোগ্য না বা আমি এই বইয়ের থেকে বেশি বুদ্ধিমান; এই মানুষ আমার শ্রদ্ধার যোগ্য না বা আমি এই মানুষের থেকে দরে ভারি লেভেলের খতরনাক।

আসল কথাটা তো অন্য। আসলে তো গুঁড়ি মেরে ঢুকেছে ফাঁকিবাজি। এবং ফাঁকিবাজি সাম্যবাদী। গুরুত্বপূর্ণ অগুরুত্বপূর্ণ নির্বিচারে নিজের কাজ করে যায়।

কাজেই তার খপ্পর থেকে বেরিয়ে যা যা তুচ্ছ ঘটছে জীবনে সেই নিয়েই ফেনাতে বসি। খবরাখবর দিই আপনাদের।

এবং দিতে বসে যা হয় তাই হল। উপলব্ধি করলাম খবর তুচ্ছ তো না-ই, বরং রীতিমত সিরিয়াস। রাজ-শুভশ্রীর ছেলের নার্সারিস্য প্রথম দিবসের টিফিনে কী দেওয়া হয়েছে (চিজ ও অলিভ, কৌতূহলীদের জন্য) জাতীয় পুঁজিবাদী শক্তির বানানো জোরজবস্তি ব্রেকিং খবর না, এমন খবর যা সত্যি সত্যি আমার (এ ক্ষেত্রে আমার প্রতিবেশীর) জীবনে প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে।

খবরটা হচ্ছে ১৪২৯ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখ দু’নম্বর মার্কেটের বিরিয়ানি ফুরিয়ে গিয়েছিল।

কোনও ঘটনা বা আবেগের তীব্রতা দাগিয়ে বোঝাতে গেলে বোঝানো তো হয়ই না, উল্টে তা খেলো হয়। পাছে রসিক মিস করে যান সে আতংকে রসের পারা চড়িয়ে যত শিল্প মাটি হয়েছে তত আর কিছুতে হয়নি।

ভাগ্যিস এখানে শিল্প হচ্ছে না। কাজেই সংযম দেখানোর দায় শূন্য। কাজেই ওপরের সাত শব্দের বাক্যটির গুরুত্ব অবান্তরের পাঠকরা মিস করে যাওয়ার আগে বুঝিয়ে দিই।

সি আর পার্কে যখন হাওয়াই চটি পাওয়া যেত না, যা প্রাণধারণের জন্য বিরিয়ানির থেকে জরুরি বলে আমি মনে করি, তখনও বিরিয়ানি পাওয়া যেত। সি আর পার্কে এখনও অল্পবয়সীদের প্রেম করার মতো একটা চা কফি খাওয়ার নিভৃত জায়গা পাওয়া যায় না, বুড়োদের প্রেম না হয় ছেড়েই দিলাম, বিরিয়ানি পাওয়া যায়।

দুষ্টু লোকেরা বলবে দরকারের বেশিই পাওয়া যায়। বাজারে বিরিয়ানির বিস্ফোরণ ঘটেছে বললেও অত্যুক্তি হয় না।

এখন সম্ভবত চটির দোকান হয়েছে একটা। কিন্তু আয়না, চিরুনি, ছুরি কাঁচির দোকানের মতোই খেয়ালী, কোনওদিন খোলে কোনওদিন খোলে না। কিন্তু বিরিয়ানির দোকান খোলে। প্রতিদিন। টাইম বেঁধে। অন্ততঃ সাতখানা। দাঁড়ান, আটও হতে পারে।

সেই সাত সাতটা দোকানের বিরিয়ানি, ১৪২৯ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখ ফুরিয়ে গিয়েছিল।

একেবারে ফুরিয়ে গেলে তবু একরকম হত। যদি খদ্দের গিয়ে দেখতেন দাদা ঝাঁপ ফেলছেন বা হাঁড়ি উল্টে মারুতির ছাদে বাঁধছেন, সে তবু সহ্য করা যেত, প্রেমের স্মৃতি নিয়ে সেঁটে থাকার থেকে হাত ঝেড়ে উঠে চলে যাওয়া যেমন যায়, কিন্তু তা হল না।

এক প্লেট মাটন বিরিয়ানির অর্ডার শুনে হাঁড়ির ভেতর কয়েক সেকেন্ড দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে, চোখ তুলে ভদ্রমহিলার দিকে লজ্জিত চোখ ফেলে দাদা বললেন, ফুল তো হবে না বৌদি, হাফ দিতে পারব। ফুল-এর মতো মাংস নেই।

দুঃখ হয় মানছি, কিন্তু তাতেও ভদ্রমহিলার এর পরের খারাপ কাজটা সমর্থন করা যায় না। তিতিবিরক্ত মুখ করে তিনি বলে বসলেন, আর কী? সব এসেছে !@#৳ থেকে হুল্লোড় করতে, এখন পাড়ার লোকেরা না খেয়ে মরুক।

আরও খারাপ করলেন, নিজের বহিরাগত প্রেজুডিসের দল ভারি করতে আমার দিকে উৎসাহী দৃষ্টিপাত করলেন।

চোখ সরিয়ে নিলাম। এ যাবত বিবেককে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছি, আরও অনেক দেব। এইসব ছিঁচকে চিমটি না কাটলেও চলবে।

এক, বিরিয়ানি না খেয়ে কেউ, সে যতই পয়দায়েশি পাড়ার লোক হোক না কেন, মরে না। দুই, উনিও, আমিও হুল্লোড় করতেই গেছি। অন্য পাড়ার লোকরা যদি ঝাঁক বেঁধে, সেজেগুজে, হইচই করে আমাদের পাড়ায় উৎসব করতে না আসতেন, তাহলেই আমাদের পয়লা বৈশাখ ভিজে কম্বল জড়িয়ে কোণায় বসে কাঁদত। আমরা যে যাই একটু বাজারে ঘুরে আসি ভান করে পয়লা বৈশাখের ভর সন্ধেবেলা হাই তুলে, যেন আমাদের কিছু এসে যায় না, বাজারে গিয়ে উপস্থিত হয়েছি, তার এক এবং একমাত্র অভিসন্ধি হচ্ছে “!@#৳” থেকে যাঁরা দলে দলে সুন্দর সেজেগুজে, সেন্ট মেখে, হাসিহাসি মুখে আমাদের পাড়ায় বেড়াতে এসেছেন, হাসতে হাসতে বিরিয়ানি ফুচকা সাঁটাচ্ছেন, তাঁদের উল্লাসের ওমে গা সেঁকা।

পয়লা বৈশাখ আমার প্রিয়তম, ওকে, দ্বিতীয় প্রিয়তম পার্বণ। সপ্তমীর সকাল এক ইঞ্চি হলেও পয়লা বৈশাখকে মাত দিয়েছে। কেন পয়লা বৈশাখ আমার প্রিয় সেটা ভাবতে বসে নিজের মনকে যেমন সদাসর্বদা ঠারাই, তেমনই চোখ ঠারাচ্ছিলাম। পয়লা বৈশাখ আচারবিহীন, পচা প্রসাদ বিহীন, সন্দেহজনক সিন্নি বিহীন, স্রেফ আগে জন্মানোর সুবাদে যাকে তাকে ঘাড় ব্যথা করে প্রণামবিহীন এক পার্বণ, যা আমার প্রগতিশীল, নাস্তিক ও ওক মেডেল, যা নিজেই নিজেকে ভয়ানক আদর করে পরিয়েছি, তার সবক’টা পছন্দের খোপে টিক ফেলে।

বিবেক স্থির চোখ ফেলল চোখে।

পয়লা বৈশাখ আমার সে জন্যই প্রিয়, যে কারণে মহালয়া প্রিয় (ইন ফ্যাক্ট, তৃতীয় প্রিয়তম পার্বণ)। যে কারণে রামায়ণ মহাভারত প্রিয় সিরিয়াল ছিল। দুটোই যে বসে দেখার অযোগ্য, দেখতে দেখতেই, হ্যাঁ ওই বয়সেই, হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া সত্ত্বেও।

এরা সবাই আমার সকালসকাল টিভি দেখতে বসার লাইসেন্স।

রামায়ণ মহাভারতের আগে তবু ঘণ্টাখানেক বই খুলে বসতে হত, পয়লা বৈশাখ, মহালয়ায় দাঁত মেজেই পত্রপাঠ।

বিরিয়ানির আনন্দে বঞ্চিত, কিন্তু ফুচকা তো খাওয়াই যায়।

ফুচকাওয়ালার কেন্দ্র থেকে তৈরি হওয়া সপ্তম দূরতম কক্ষবৃত্তে আমি দাঁড়ালাম। নিকটতম বৃত্তে পৌঁছতে পৌঁছতে ফুচকা ফুরিয়ে যেতে পারে, না ফুরোলেও ফুচকার কোয়ালিটি নিশ্চিতভাবেই অন্যদিনের মতো হবে না, যদি হয়ও একশো জনের মিষ্টি, টকমিষ্টি ইত্যাদি জলের প্যাকনা সামলাতে গিয়ে আমার প্লেটে একআধখানা মিষ্টি ফুচকা এসে পড়ার সম্ভাবনা দগদগে জেনেও, নিজেকে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম।

সান্ত্বনার ট্যাকটিক্স জেনেছিলাম হোস্টেলে একজনের থেকে। এসিবিহীন জুনে সবাই যখন হাঁসফাঁস, সে আড্ডা ছেড়ে উঠে কোথায় চলে যেত, দশ মিনিট পর ঘরে ঢুকত। হাসি হাসি মুখ। হাঁসফাঁসবিহীন।

গরম সহ্যসীমা ছাড়াচ্ছে দেখলে সে বদ্ধ বাথরুমে গিয়ে দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকত যাতে ফিরে এলে ঘরের তাপমাত্রা সহনীয় লাগে।

কাজেই দু’নম্বরের ফুচকাওয়ালার থেকে সপ্তম দূরতম বৃত্তে দাঁড়িয়ে, নিকটতম বৃত্তে পৌঁছতে পৌঁছতে ফুচকা ফুরিয়ে যেতে পারে, না ফুরোলেও ফুচকার কোয়ালিটি নিশ্চিতভাবেই অন্যদিনের মতো হবে না, যদি হয়ও একশো জনের মিষ্টি, টকমিষ্টি ইত্যাদি জলের প্যাকনা সামলাতে গিয়ে আমার প্লেটে একআধখানা মিষ্টি ফুচকা এসে পড়ার সম্ভাবনা দগদগে জেনেও, নিজেকে মনে করালাম, তবু তো এক নম্বরের ফুচকাওয়ালার সামনে দাঁড়িয়ে নেই।

এক নম্বরের ফুচকাওয়ালা সম্পর্কে এক লাইন যদি বলতে হয় তাহলে বলব, সি আর পার্কে এর থেকে সফলতর মানুষ আমি দেখিনি।

কেন বলছি সে নিয়ে পরের পোস্টে ফেনাব। অনভ্যাসে আঙুল অলরেডি চড়চড় করছে।

Comments

  1. পরের, naki পরের (পরের) post er opekhyae roilam...

    Achha iye...ekta proshno kora hoyni...wordle ekhono khelchho ki? ( Shuru ke korechhile eta jiggesh na koreo jani)

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, আমারও ওই পরের (পরের) পোস্টটা লেখার উৎসাহই বেশি, ঠিকই ধরেছ, অর্পণ। কিন্তু মাঝখানে নিমের পাঁচন গেলার মতো করে আরেকটা পোস্ট লিখতে হবে। অবশ্য এও জানি লিখতে শুরু করে আর পাঁচন লাগবে না।

      কিন্তু যেটা ধরতে পারোনি, তোমার দোষ নেই, কারণ এ বিষয়টাতে আমি আমার সমস্ত স্বাভাবিকতার উল্টোদিকে হেঁটেছি। কাজেই ধরতে ভুল হওয়াই প্রমাণ করে যে তুমি আমাকে ঠিক চিনেছ, সেটা হচ্ছে আমি অ্যাকচুয়ালি ওয়ার্ডল ধরিনি কখনও। কেন ধরিনি সেটা অবিশ্বাস্য রহস্য নিজের কাছেও। দেখেছি লোককে খেলতে, নিজে বার চারেক খেলেছি, কিন্তু ওর বেশি ধরা দিইনি। আসলে খুব অদ্ভুত একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, তাই বোধহয় সব গোলমাল হয়ে গেছে। যা যা করার কথা কিছুই করে উঠতে পারছি না।

      বাই দ্য ওয়ে, ভালো দিনে কমেন্ট করেছ। আমার তোমার দুজনেরই (এটা আমি শিওর ঠিক ধরেছি) জীবনে আলোর এক অনির্বাণ উৎসের জন্মদিন মুবারক, কমরেড।

      Delete
    2. Odbhut shomoyer modhye diye gele shob golmaal hoye jaye...sheta thik.
      Aar hya...Happy Doshra May, comrade!

      Delete
  2. bhalo thakben Kuntala.. amra aapnake khuuub bhalobasi.. golmele somoy ke knachkola dekhiye din..

    Biriyani phuriye geche poRe hese phelechi.. sorry :).. kintu phuchkar line e erokom zen dhoirjo konodino hobe ki na jani na..

    belated shubho nababarsha..

    Indrani

    ReplyDelete
    Replies
    1. নববর্ষের বিলম্বিত শুভেচ্ছা আপনাকেও, ইন্দ্রাণী। অনেক ভালোবাসা। ভালো থাকবেন।

      বিরিয়ানি ফুরিয়েছে শুনে হাসবেন না, লাইফ অ্যান্ড ডেথ ব্যাপার। ফুচকার জন্যই এখনও তবু দাঁড়িয়ে থাকা জাস্টিফাই করতে পারি কি না, তাই দাঁড়াই। থাক অভ্যেসটা।

      Delete
  3. Ki kothin muhurto.. singara sesh, kochuri nei esob age sunechi, kintu biriyani sesh sunle kenon lage ke jane.. nababarsher subheccha niyo..

    ReplyDelete
    Replies
    1. শুভ নববর্ষ তোকে আর তোর বাড়ির সবাইকেও, ঊর্মি। খুব ভালো থাকিস। খুব বিরিয়ানি খাস।

      Delete
  4. সান্ত্বনার ট্যাকটিক্সটা কিন্তু অসাধারণ। একদম অকাট্য !!

    আচ্ছা, "ওক মেডেল" টা কি?

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওক হচ্ছে গিয়ে 'Woke', যা আমি নিজেকে মনে করি। নিজেই করি, এ যাবত অন্য কারও থেকে কনফার্মেশন না পাওয়া সত্ত্বেও।

      সান্ত্বনার ভরসাতেই জীবনটা চলছে কি না, এই সব টোটকা শিখে রাখতে হয়েছে।

      Delete

Post a Comment