কালিম্পং
ভূত থাকলে খুশি হব? নাকি না থাকলে?
থাকলে অন্তত একটা সান্ত্বনা থাকবে যে এই যা ঘটছে চারদিকে, যা দেখতে পাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছি, ছুঁতে পারছি, তার আড়ালেও, তার থেকে বেশি কিছুও আছে। নিজের জীবন সম্পর্কে এ আশ্বাস যত ক্ষীণ হয়ে আসছে, তত এই অন্য কিছুর খোঁজ জাগছে ভেতরে ভেতরে। ভুত যদি এসে ধরা দেয়, টপ করে বিশ্বাস করে নেব। জল যে দিকে গড়াচ্ছে কোনদিন না অন্যকিছুতে বিশ্বাস করে ফেলি।
প্রায় তিন বছর পর বেড়াতে যাওয়ার কথা উঠতে পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল পেরিয়ে ফাইন্যালি ভূতই টেনেছিল। কালিম্পং-এর মর্গ্যান হাউস জাগ্রত ভূতের বাড়ি। উনিশশো তিরিশ নাগাদ কলোনিয়াল ধাঁচের অট্টালিকা বানানো হয়েছিল মিস্টার এবং মিসেস মর্গ্যানের শুভবিবাহ উপলক্ষ্যে। উত্তরাধিকারীর অনুপস্থিতিতে বাড়িটি প্রথমে ট্রাস্টের, তারপর হাত ঘুরতে ঘুরতে আপাতত পশ্চিমবঙ্গ ট্যুরিজম বিভাগের সম্পত্তি।
প্রস্তুতি বলতে বাগডোগরার টিকিট আর মর্গ্যান হাউসে একরাতের বুকিং। মূল হাউস ফাঁকা পাওয়া যায়নি, কাজেই কটেজ। ইউটিউবে অঞ্জন দত্তর ট্র্যাভেল শো 'চলো অঞ্জন'-এর বেশ কয়েকটা এপিসোড। বিশেষ করে যে এপিসোডগুলোতে অপর্ণা সেন, কবীর সুমন, বিক্রম ঘোষ, ঊষা উত্থুপকে নিয়ে দার্জিলিং, কার্শিয়াং, কালিম্পং গেছেন অঞ্জন। ভদ্রলোক পশ্চিমবঙ্গের পাহাড় ভালোবাসেন বলতেই হবে, ওই অঞ্চলসংক্রান্ত ওঁর উত্তেজনা চারিয়ে দিতে সর্বদা সমর্থ হন।
যাওয়ার পথে উৎসাহ ও এনার্জি যখন তুঙ্গ, পয়সা বাঁচানোর সহি সময় ওটাই। শেয়ার ট্যাক্সি চড়ে শিলিগুড়ি বাস জংশন, সেখান থেকে 'কালিম্পং! কালিম্পং!' চেঁচানো বাসে উঠে পড়া। ঘণ্টা আড়াইয়ের ব্যাপার। রাস্তাঘাট দিব্যি সুন্দর। বাসস্ট্যান্ডে নেমে ট্যাক্সি নিয়ে মর্গ্যান হাউস। উঁচু উঁচু চিমনি, ধূসর পাথরের দেওয়াল বেয়ে চাপবাঁধা লতার ঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে সাদা বর্ডারের খোপ কাটা জানালা, যার ওপারের চৌকো অন্ধকারে কী আছে আপনি দেখতে পাবেন না, কিন্তু স্পষ্ট কল্পনা করতে পারবেন ওপার থেকে কেউ আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে তাকিয়ে আপনার ঘাড়ের লোম খাড়া করে দিচ্ছে।
জ্যান্ত যাঁরা আপাতত মর্গ্যান হাউসের দায়িত্বে আছেন তাঁরা অবশ্য রোমহর্ষক নন একেবারেই। যাওয়ামাত্র ওয়েলকাম টি দিয়ে, পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন দুশো দুই নম্বর কটেজে। ঘরদোর ঝকঝকে, বাথরুম তকতকে, বারান্দায় দাঁড়ালে ঢালু বেয়ে নেমে যায় জঙ্গল। পাহাড়ের ভিউ না থাকলেও কিছু কম পড়ছে বোধ হয় না। গিজার চালিয়ে দিলেন নিজেরাই। টিভি চলে কি? পাহাড়জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে চোখ ব্যথা হয়ে গেলে বেডসাইড ল্যাম্প জ্বেলে সঙ্গে আনা ক্ল্যাসিকে মননে শান দিলেই হয়, কিন্তু মননে শান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ল্যাসিক হাইও তোলাবে, তখন চারখানা রিমোটের চল্লিশখানা বোতাম টিপে টিভি চালাতে না পারলে পাহাড়জঙ্গলের দেওয়া শান্তি উধাও হতে নিমেষ লাগবে না।
চলে বৈকি। আমার হাত থেকে উদ্যত রিমোট কেড়ে নিয়ে গাইড খুলে রিজিওন্যাল, রিজিওন্যালে বেংগলি, বেংগলিতে জি চ্যানেল বেছে দিলেন। যেখানে ক্রসপ্রোমোশনের হদ্দমুদ্দ করে লক্ষ্মীকাকিমা দিদি নাম্বার ওয়ানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ধড়াচূড়া ছেড়ে, জঙ্গলের দিকের জানালাদরজা হাট করে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম যখন ভাঙল রোদ পড়ে এসেছে। লক্ষ্মীকাকিমা তখনও শাড়ি পছন্দ করে চলেছেন দিদি নাম্বার ওয়ান-এ যাবেন বলে। আমার জিন্স রেডি ছিল। গলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
কালিম্পং-এ দেখার অনেক কিছু আছে। মনাস্টেরি, ক্যাক্টাসের নার্সারি, ভিউ পয়েন্টস, গলফ কোর্স, চার্চ, ডাক্তার গ্রাহামের স্কুল। মর্গ্যান হাউসও একটা পয়েন্ট। হাউস থেকে নাকবরাবর হাঁটলে ডুরপিন গুমফা, যেটাও একটা দ্রষ্টব্য, কিন্তু সেটা দেখার পক্ষে দেরি হয়ে গেছে মনে করে উদ্দেশ্যহীন হাঁটাই সাব্যস্ত করলাম। মর্গ্যান হাউসের গা ঘেঁষে শুরু হয়েছে ক্যান্টনমেন্ট। ভারতীয় আর্মির সাতাশ নম্বর ডিভিশন, যার ভালো নাম স্ট্রাইকিং লায়ন ডিভিশন। শুরু হয়েছিল কালিম্পং-এই। মেজর জেনারেলের বাজখাঁই বাড়ি, আর্মি মেস। মেসের সামনে খোলা জিপের ভেতর থেকে ঢিকচিক ঢিকচিক ইংরিজি গান, শনিবারের সন্ধে উদযাপন করছে।
এস বি আই এ টি এম-এর পাশ দিয়ে ডাইনে বাঁকলাম। ছোট একটা পাড়া। খুদে বাড়ির রেলিং-এ লালনীল ফুলের টব, পাপোশের ওপর ঝুপো কুকুর। বাচ্চারা স্কেটবোর্ডে নামছে। মেয়েরা কনুই জড়িয়ে হেসে গড়াচ্ছে। বোর্ডে তীরচিহ্নের নিচে লেখা ‘ডুরপিন ভিউ পয়েন্ট’। যাক একটা গন্তব্য পাওয়া গেল।
ঘুরপথে নামতে নামতে দু’চারজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ঠিক দিকেই যাচ্ছি কিনা। ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম, রাস্তা একটাই। ভুল হলেও অসুবিধে কিছু নেই। ভিউ পয়েন্ট ছাড়াও চারদিকে দিব্য ভিউ। তবু জিজ্ঞাসা করা। আসলে ফাঁকা রাস্তায় উল্টোদিক থেকে লোক আসছে দেখলে কথা বলার ছুতো খুঁজি। যতটা নিভৃতচারী ভাবতে ভালো লাগে নিজেকে ততটাও নই। হিন্দিতে প্রশ্ন করলে উল্টোদিক থেকে ভাঙা বাংলায় উত্তর আসে। কোথা থেকে? আদতে পশ্চিমবঙ্গ, আপাতত দিল্লি। উল্টোদিকের লোক ধরে ফেলে খুশি, আমি ধরা পড়েও। বলেন, সোজা যান, কিন্তু খবরদার ঘাস পাড়াবেন না। জোঁক পাতা হ্যায়?
অনেকটা নেমে দূরে ছাউনি চোখে পড়ে। নির্ঘাত পয়েন্টের ছাউনি। পা রাখতেই, মেঝে থেকে উঠে ল্যাজ নেড়ে আমন্ত্রণ জানায় কালো কুকুর। মাথায় হাত বুলোলে আবার গিয়ে নিজের জায়গায় বসে। অদূরে ঘাস থেকে উঠে পড়ে নবদম্পতি, আশেপাশের দুয়েকটা বোতল, অন্য লোকের ছড়িয়ে যাওয়া, জড়ো করে নেয়। মেয়েটি স্কুটির সিটে বসে, ছেলেটি জড়ো করা আবর্জনা বুকে নিয়ে পেছনে, কোনও ডাস্টবিন দেখলে ফেলে দেবে। দুই ভদ্রলোক, সম্ভবত স্থানীয়, একে অপরের সঙ্গে হাসিঠাট্টা থামিয়ে উঠে চলে যান।
এ সমস্ত চমৎকার ডিস্ট্র্যাকশন সরে গেলে প্রকৃতিতে মন পাতি। বাতাস ঠাণ্ডা। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়ানো পাহাড়ের মাথা থেকে কুয়াশা উঠে চারপাশ গিলে নিতে উদ্যত হয়। ইতিউতি মোটরবাইক যায় মিনিট পাঁচেক বাদে বাদে। ভটভট মিলিয়ে গেলে নৈঃশব্দ্য আরও গভীর, হেডলাইটের আলো মিলিয়ে গেলে অন্ধকার আরও ঘন হয়।
Jaak ... etodin e berote perecho jene bhalo laglo. Tomar lekha theke pahar ar jongol er thanda hawa pelam. Next post er opekkhaye roilam.
ReplyDeleteযুগযুগান্ত পরে বেড়াতে গেলাম, শর্মিলা। তুমি পড়লে দেখে ভালো লাগল।
DeleteOnekdin pore berate gelen... khub bhalo laglo pore lekhata...
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, সায়ন। সত্যি অনেকদিন পর বেরোনো হল।
DeletePakoda?
ReplyDelete-Parama
হাহা, খেয়েছি, খেয়েছি, পরমা। সময় বাঁচাতে স্কিপ করে গেছি। ঘুম থেকে ওঠা আর বেরোনোর মাঝখানে চা আর পেঁয়াজির পর্ব ছিল। পেঁয়াজির সমস্যাটা হচ্ছে, এক প্লেট বড় বেশি হয়ে যায়। শেষ দুটো প্রায় ঠুসতে হল। আর তক্ষুনি ইউটিউবে জন অ্যাব্রাহামের একটা ইন্টারভিউর রিল এল, যেখানে কপিল শর্মা জন অ্যাব্রাহামকে জিজ্ঞাসা করছেন, এক লাখ টাকা দিলে দুটো গুলাব জামুন খেয়ে নেবে? জন অ্যাব্রাহাম বলছেন, না। কপিল শর্মা বলছেন, দশ লাখ? জন অ্যাব্রাহাম অনড়। আচ্ছা এক কোটি? জন অ্যাব্রাহাম চুপ করে তাকিয়ে আছেন। লোকে হয়তো ভাবছে ওঁর উইল পাওয়ারে টান পড়েছে, কিন্তু আমি জানি পড়েনি। উনি অবাক হয়ে ভাবছেন এ লোকটা আমাকে দুটো গোলাপজাম খাওয়ানোর জন্য কতদূর যেতে পারে।
Deleteঅনেকদিন পরে মনে হয় আবার ঘুরতে ! তবে ট্রাভেল ব্লগ এর সাথে ছবি দিলে আরো ভালো লাগবে।
ReplyDeleteঠিকই হংসরাজ। তবে আমি এবার বেড়ানোর ছবি প্রায় তুলিইনি। পরের পর্ব থেকে অন্যের তোলা ছবি দেব হয়তো কিছু। ছবি তোলা, বাছা, গল্পের মাঝে মাঝে গোঁজা - খুবই এনার্জি-ইন্টেনসিভ কাজ। আর পারি না।
DeleteDarun byapar! Ami kokhono Kalimpong ey jaini- mane cross korechhi Darjeeling jawa-ashar pothey, kintu konodin thakini. Wishlist ey aachhe onekdin. Dekhi kokhono hoye ki na!
ReplyDeleteকালিম্পং শুধু গেলে একটু কম পড়তে পারে, কেকা। নাও পড়তে পারে, আবার পড়তেও পারে। আশেপাশে আরও কিছু জায়গা জুটিয়ে যাওয়াটা বেটার হবে মনে হয়।
DeleteBah onekdin por beronor golpo, kalimpong Amar besh bhalo legechilo, chobi na dekhleo bujhe nite parchi motamuti, tao chobir ashay thaklam.. bhuter ashay o.. :)
ReplyDeleteআমারও কালিম্পং ভালো লেগেছে, ঊর্মি। প্রায় কিছুই দেখিনি, তবু যেটুকু। ছবি আছে গুটিকয়েক, ভূত একটাও নেই। আমিও স্যাড।
Deleteমর্গ্যান হাউসের ছবি দিলেননা? ওই বাড়িতে আমার বাবা মা হানিমুনে গেছিল, ভাবা যায়? শাহরুখ-গৌরী খানের মতন রোমহর্ষক ব্যাপার না হলেও... তখন অবশ্য মর্গ্যান হাউসও এত বিখ্যাত ছিলনা। যাই হোক, অনেকদিন পর আপনাদের ভ্রমণকাহিনী পড়তে খুব ভাল লাগল। আর আমরা তো একেনবাবু আর ফেলুদার সঙ্গে প্রায় দার্জিলিং ঘুরেই এলাম সবে করে, তাই আরও ভাল লাগছে।
ReplyDeleteকাকু কাকিমা মর্গ্যান হাউসে মধুচন্দ্রিমায় গেছিলেন! তখন ও বাড়ির নাম কেউ জানত? নিশ্চয় আরও সুন্দর ছিল জায়গাটা। ছবি তুলিইনি, দেব আর কোত্থেকে। আমি ক্যামেরা বারই করিনি। যা তোলার পরদিন থেকে অর্চিষ্মান তুলেছে। আমার আর এনার্জি নেই, বুঝলেন কি না।
Deleteহ্যাঁ, একেনবাবু আর ফেলুদার চোখ দিয়ে দার্জিলিং দেখার পরপরই দার্জিলিং যাত্রাটা আমাকেও উত্তেজিত করেছে খুব।