কালিম্পং থেকে দার্জিলিং
কালিম্পং বাসস্ট্যান্ডের পাশেই পুরোনো হোটেল গোম্পু-তে মোমো খাওয়া যেত, বাজারে রেণু প্রধানের বিখ্যাত আচারের দোকানে জিলিপিপ্যাঁচ সেল রুটি আচার দিয়ে, মোটে দশটাকা প্লেট, রাস্তায় কাচারপাচার নামের মিক্সচার, যাতে রয়েছে নুডলস, আলুরদম, ফাম্বি নামের একধরনের মুগডালের তৈরি ব্যাপার। আলুরদম থেকে শুরু করে ছোলে, শশা পেঁয়াজ কেচাপ - যা যা পৃথিবীতে খাবার হওয়া সম্ভব সব নুডলসে ঢেলে খাওয়ার চল আছে ওখানে। বাজারের লার্ক’স প্রভিশন থেকে কালিম্পং চিজ কেনা যেত। স্থানীয় ললিপপেরও খ্যাতি আছে। খা জাং বলে একটা ভুটানী খাবারের দোকানে অথেনটিক এমা দাশি (নাকি দাৎশি?) পাওয়া যায় যা দিল্লিতে খেয়ে মনে হয়েছিল আবার খাব।
কিছুই খাইনি। খিদে ছিল না। সময় ছিল না। বা সিম্পলি বয়স হয়ে গেছে। চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা শুরুই হল রং ফুটে। আগের দিন বাসস্ট্যান্ডে নেমে গোম্পুতে গিয়ে শোনা গেল মোমো সোল্ড আউট। ভেজ ফ্রায়েড রাইস আর পর্ক নুডল সুপ দিয়ে কাজ সারতে হল।
তা বলে খারাপ খাইনি অবশ্য। ডুরপিন ভিউ পয়েন্ট থেকে ফিরে এসে মর্গ্যান হাউসের লাউঞ্জে বসলাম। নিভু নিভু আলো, পুরোনো ধাঁচের সোফা, সোজাসাপটা নিচু টেবিল, অকেজো ফায়ারপ্লেস। খানিকক্ষণ বসে বাঙালি দম্পতির ভিডিও কলে, যা তাঁরা ইয়ারফোন ছাড়াই চালাচ্ছিলেন, আড়ি পেতে ঘরে চলে এলাম।
লম্বা গোল ক্যাসারোলের ভেতর স্টিলের বাটিতে রুটি এল। সঙ্গে নেপালি স্টাইলের আলুরদম। আমাদের মতো অর্ধেক বা গোটা আলুর নয়, ছোট চৌকো কাটা আলুর কুটকুটে লাল ঝোল। ঠেসে ঝাল। পাঁপড় সহযোগে মচৎকার।
আমার সিরিয়াল না দেখার যুক্তিটা অনেকটা সিগারেট না খাওয়ার মতোই। যতবার খেয়েছি, বন্ধুদের থেকে নিয়ে, দিব্য লেগেছে। কাজেই বুঝেছি ধরা চলবে না, নেশা হবেই। সিরিয়ালও যতবার দেখেছি, ব্যাপারটার চৌম্বকশক্তি সম্পর্কে অবহিত হয়েছি। আগামাথা কোনও আইডিয়া না থাকলেও পাঁচ মিনিটের মধ্যে ধরে ফেলা যাবে গত হাজার এপিসোডে কী হয়েছে, নেক্সট হাজারে কী হবে। ক্যারেকটাররাও দিব্যি সাদাকালো। সংলাপও লাগবে না, সাজপোশাকই কাফি। শাড়ি ভালো, জিন্স খারাপ। সিঁদুর সতী, চুলে হাইলাইট মহিলার অন্যের বরের দিকে নজর। রুটি আলুরদম খেতে খেতে লক্ষ্মীকাকিমার দিদি নাম্বার ওয়ানে যাওয়ার প্রিপারেশন দেখছিলাম। ওঁর মূল মোটিভেশন হচ্ছে দিদি নম্বর ওয়ানে গিয়ে প্রেশার কুকার জেতা। আমার বাড়িতে প্রেশার কুকার নেই বলতে বলতে কাকিমার গলা ধরে আসছিল। এপিসোড শেষ হয়ে গেল। সেই থেকে মনের মধ্যে অল্প আনচান, কাকিমা প্রেশার কুকার জিতলেন কি?
খেতে খেতে ঝুলিয়ে রাখা সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিলাম। কাল দার্জিলিং যাচ্ছি।
দার্জিলিং মনের কাছাকাছি জায়গা এবং ভিড়ে ভিড়াক্কার। নোংরা, ঘিঞ্জি। আমি বলছি না, অনেকেই বলছে। টুরিস্টরাও টুরিস্টদের নিয়ে তিতিবিরক্ত। দার্জিলিং ম্যালে একে অপরের সান্নিধ্যে ভাজাভাজা হওয়ার থেকে নিকটস্থ লেপচাজগৎ, তিনচুলে, চটকপুর, সুন্তালেখোলা - এ সব জায়গায় গিয়ে দুদিনের নিরালা প্রেফার করেন অনেকেই।
আশ্চর্যজনকভাবে, মানুষ সহ্য করার শক্তি যথেষ্ট না থাকলেও দার্জিলিং-এর ওই ম্যাডনেসটাই আমার পছন্দ। ওই গা ঘেঁষাঘেঁষি, ঠেলাঠেলি। ভিড়ে লুকিয়ে পড়ার সুবিধে তো আছেই। সুন্তালেখোলার টুরিস্ট লজের অন্য বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ না করলে খারাপ দেখায়, কেভেন্টারসে ঘাড়ের ওপর বসে হামহাম করে মিট প্ল্যাটার সাঁটানো লোকটার সঙ্গে আই কন্ট্যাক্ট করাটাই অভদ্রতা। তাছাড়া ছোটবেলার স্মৃতি, সাংস্কৃতিক স্মৃতি তো আছেই।
সারারাত ভোঁসভোঁস ঘুমোলাম। মিসেস মর্গ্যান আলাপ করতে এলেন না। কাজেই আপাতত যা আছে সেটুকুই।
ন'টায় দার্জিলিং-এর গাড়ি আসার আগে এক কিলোমিটার দূরের ডুরপিন গুম্ফা ঘুরে আসা যায়। মর্গ্যান হাউস থেকে নাকবরাবর হেঁটে গেলে গুম্ফার সিংহীদ্বার। খাড়া রাস্তা উঠে গেলে নীল আকাশের গায়ে ডুরপিন গুম্ফার লালসোনালি ঝলমলিয়ে ওঠে।
মনাস্টেরিতে লেখাপড়া শেষ হয়েছে তখন। শেষ একদুজন ছাত্রকে ব্যাগ গুছিয়ে বেরোতে দেখলাম মূল হল থেকে। একটু পরে একতলার বন্ধ দরজার ভেতর থেকে ভেঁপুর শব্দ শুরু হল। দূরের মাঠে আর্মি স্কুলের ছেলেমেয়েরা বাস্কেটবল প্র্যাকটিস করছিল। ভেঁপুর আওয়াজের সঙ্গে বল এবং কোর্টের সংঘাতের শব্দ অসামান্য নেপথ্যসংগীতের সৃষ্টি করেছিল। এই পরিশ্রমসাধ্য শিখন-পঠনের মাঝখানে কর্মহীন নিজেকে ক্ষমা করা শক্ত হত যদি না অদূরে একটা কুকুর টানটান হয়ে নাক ডাকাত।
কালিম্পং থেকে দার্জিলিং-এর রাস্তায় নিজের বিবেচনার বারণ না শুনে কয়েকটা পয়েন্ট দেখতে রাজি হয়েছিলাম। সকালসন্ধের উদ্দেশ্যহীন হাঁটা যদি পয়সা উশুলের পক্ষে অপ্রতুল হয়? একটা জায়গার সাতটা পয়েন্ট না দেখলে কি জায়গাটা আসলে দেখা হল আদৌ? কনফিডেন্সে টান পড়ার পরিণতি সর্বদাই যা হয় - আফসোস। প্রথম গেলাম ডেলো পাহাড়। কালিম্পং-এর সবথেকে উঁচু চুড়ো। চুড়োয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আরেকটা টুরিস্ট লজ। চূড়োটাকে চুড়ো হিসেবে রাখলেই ভালো হত, উদ্যোগ নিয়ে সেটাকে একটা পার্কে পরিণত করা হয়েছে। লালনীল রেলিং। ছাউনির তলায় বেঞ্চ। স্লিপ। দোলনা। রংচঙে মানুষপ্রমাণ অক্ষরে I❤️ KALIMPONG.
দ্বিতীয় পয়েন্ট ক্যাকটাস নার্সারি। প্রায় দিল্লির তেজে রোদ উঠেছিল। তার তাপ ক্যাকটাসদের গ্রিনহাউসে আটকা পড়ে যা পরিস্থিতির উদ্ভব করেছিল, সে শুধু আমি জানি আর জানে ক্যাকটাসরা। তফাৎ, তারা মরুভূমির দেশের লোক, ওইটিই তাদের শরীরের পক্ষে উপকারী। কে জানে হয়তো মনের পক্ষেও। আমার যেমন শরীর মন দুইয়ের জন্যই চাই বৃষ্টি, মেঘ আর কুয়াশা। তাও পাব, তবে পরে।
পয়েন্ট ফুরোলো, মনে মনে ভগবানকে থ্যাংক ইউ দিয়ে রওনা দিলাম। এই পাহাড়ের চুড়ো থেকে যখন অজয়ভাইসাব বললেন, জাদা দূর নহি, উস পাহাড় মে যানা হ্যায়, বলে আকাশের গায়ে আরেকটা পাহাড়ের ধোঁয়া ধোঁয়া চুড়োর দিকে আঙুল তোলেন, মনে মনে মুখ হাঁ করলাম। বলে কি ছোকরা। এই পাহাড় যেমন ভাজাভাজা, ওই পাহাড় তেমন স্বপ্ন স্বপ্ন। ওই স্বপ্ন সত্যি হবে এ জন্মে বলে তো মনে হচ্ছে না।
অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে এসি চালাতে হয়। পাহাড়ি গাড়িতে একটা অদ্ভুত হিন্দি গানের প্লেলিস্ট থাকে, যার প্রত্যেকটি গান অচেনা। অথচ গাইছেন অরিজিৎ সিং টাইপের চেনা গায়কেরা। অজয়ের গাড়ির স্পেশালিটি ঢিমে তালের বিরহের গান। প্রেমের প্রতিদান না পেয়ে একটুও রাগ হচ্ছে না, বলছে চিরদিন নাকি ভালোবেসে যাবে। ইগো বলে বস্তু নেই শরীরে।
গাড়ি ব্রেক কষল। আঁতকে উঠলাম। আর পয়েন্ট নেহি চাহিয়ে। আরে এটা ভালো পয়েন্ট, ম্যাডাম। ভালো হলেও নেহি চাহিয়ে। গিয়েই দেখুন না। বাধ্য মেয়ের ইমেজটা এই বয়সে মাটি করে লাভ নেই বলে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম। একটা চত্বর। চারদিকে ছাউনি দোকান থেকে পানিপুরি, চানামসালা,ম্যাগি হাঁকাহাঁকি। আমাকে দেখে পানিপুরি কষ্টসৃষ্টের পুচকা হয়ে গেল। আসুন আসুন দিদি, পুচকা খেয়ে যান। নিজের মুখখানা এত ট্রান্সপারেন্ট মনে করে দীর্ঘশ্বাস চাপি।
রেলিং-এর ধারে গিয়ে অনেক নিচের দিকে তাকাই। একটা চ্যালিসের মতো ব্যাপার। পাত্রটা হচ্ছে তিস্তা, ডান্ডিটা হচ্ছে রঙ্গিত। ঘোলা তিস্তায় সবুজ রঙ্গিত এসে মিশেছে। এত ওপর থেকে মেশামিশির হইচইটা কেবল কয়েকটা সাদা ছলকানিতে পরিণত হয়েছে, বাকিটা শান্তির পোস্টার।
নিয়মরক্ষা দাঁড়িয়ে চলে আসার প্রতিশোধের মাইন্ড চেঞ্জ করে বসতে হল। রেলিং-এর ফাঁক দিয়ে নদী, ওপর দিয়ে আকাশ, পাহাড়, মাথার ওপর গাছের ছাউনি, পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ্দুর। প্লাস্টিকের চেয়ারটেবিলে খুব খাওয়াদাওয়া চলছে। মর্গ্যান হাউসের টোস্ট কফি হজম হয়ে গেছে কখন। চটপটা চানামসালা খেয়ে সারামুখ ঝালঝাল হতে বাধ্য হয়ে চাটমশলা ছড়ানো শশা নিতে হল। পথের জন্য লাল লংকাগুঁড়ো মাখানো লেবুর ফালিও এক প্যাকেট।
দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী ব্রিজ পেরোতেই এসি বন্ধ। এবার শুধু ওঠা। এসি চললে গাড়ি উঠতে চায় না নাকি, পেট্রোলও খায় রাক্ষসের মতো। অসুবিধে নেই, গরম অনেক কমে এসেছে। কাচ নামল। জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে উঠল লম্বা গাছের দল, মাথায় মাথায় সূর্যের আলো লোফালুফি। গরম আটকা পড়ে, এসে পৌঁছয় শুধু ঝিলিমিলিটুকু। বনের গন্ধওয়ালা ঠাণ্ডা হাওয়া। অবশেষে পাহাড়ের গায়ে লালনীলসাদা কুইন অফ হিলস। শাহরুখ খান গৌরী খানের হানিমুনের জায়গা। ভাবা যায়?
একটা ঝামেলা আছে। ঝামেলা ভাবলে ঝামেলা, না ভাবলে নয়। আমি ভাবছি। দুম করে দার্জিলিং ঠিক করার প্রধান যে অসুবিধেটা হবে ভেবেছিলাম, হয়েছে। সরকারি থাকার জায়গা ফাঁকা নেই। দার্জিলিং-এ থাকার জায়গার অভাব নেই। কিন্তু সেটা ঝামেলা বাড়ায় বই কমায় না। কারণ বাছাবাছির প্রশ্ন ওঠে। কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ। কোনটার লোকেশন কোথায়। খোঁজা থামিয়ে আরেকবার ডাবলিউ বি টি ডি সি-র সাইটে ঢুঁ মারি। যদি কোনও মন্ত্রবলে রুম অ্যাভেলেবল হয়ে গিয়ে থাকে আধঘণ্টার মধ্যে। হয়নি। অবশেষে একটা হোটেলের নেগেটিভের থেকে পজিটিভ রিভিউ বেশি পাওয়া গেল। ফোন করলাম। দুবার রিং হতে কেটে দিয়ে আবার চেক করলাম। সরকারি এখনও আনঅ্যাভেলেবল। উল্টোদিক থেকে ফোন এসে গেল। মুড ভালো থাকলে যা কাস্টমার কেয়ারের পরাকাষ্ঠা, পরিবর্তিত মানসিক পরিস্থিতিতে তা-ই ডেসপারেশন। এবং আতংকের। কিছু করার নেই। ওখানেই উঠব রাজি হয়ে লোকেশন জেনে নিলাম। গাড়ি যেখানে নামিয়ে দিল, খাড়া রাস্তা ধরে তিন মিনিট হেঁটে গিয়ে প্ল্যান্টার্স হাসপাতালের পাশে হোটেলের খিড়কিদুয়ার। ঘরে ঢুকে জানালা খুলে দিলাম, সরু রাস্তার ওপার থেকে গ্লেনারিজের ঝলমল আর টুংটাং ঘরে ঢুকে এল।
এই সিরিজে চোখ রাখছি আগা-গোড়া। হ্যাঁ, ছবি বাছাইয়ের কাজ সত্যিই ঝামেলার। কিন্তু পাঠকদের আবদারও বটে! এই সিরিজে কি ক্যাং - ড্যাং - গ্যাং তিনজনেই আছে, নাকি গ্যাং বাদ? 😅
ReplyDeleteগ্যাং বাদ, হংসরাজ 🙂
DeleteDekhecho kando. Ghorer eto kachhe Shahrukh Gourir honeymoon er jayga jantam-i na! Ei series tar porer kistir opekkhay roilam.
ReplyDeleteএই তথ্যটা জানার পর থেকে দার্জিলিংকে আমি অন্য চোখে দেখি, সত্যি বলছি বিম্ববতী। আমাদের দীপুদা-র অন্তাক্ষর দিয়ে তাকে আর মাপি না।
DeleteDaruuuuuuuuun lagchhe ei seriesta. Kintu chhobi koi? Amra kuyasha makha meghla diner chhobi dekhte chai :)
ReplyDeleteহাহা, থ্যাংক ইউ, সায়ন। তবে পাগলকে সাঁকো নাড়াতে মানা করলেন, এবার কুয়াশা কুয়াশায় ছয়লাপ করে দেব।
Delete