বল্লভপুরের রূপকথা ও হত্যাপুরী



বল্লভপুরের রূপকথা

শুরুতেই অপ্রিয় সত্যিটা ক্লিয়ার করে দেওয়া ভালো। বল্লভপুরের রূপকথা আমার সুবিধের লাগেনি।

অনেকেরই লেগেছে। সুন্দর দেখতে লোকজন সুন্দর জামাকাপড় পরে বড় পর্দায় ঘুরছে ফিরছে নাচছে গাইছে, অসুবিধে লাগবেই বা কেন। মা না হয় বাড়াবাড়ি অল্পে সন্তুষ্ট ছিলেন, মায়ের থেকে যদি আরেকটু কড়াও হই আর সুন্দরের বাড়তি অন্য কিছু খুঁজি তাতেও সুবিধের উপাদান কম পড়বে না।

যেমন ধরা যাক, ভালো অভিনয়। আমার মতে মনোহর বেস্ট। শ্যামল চক্রবর্তী নাটকের ভেটেরান, তিনি আমার সার্টিফিকেটের জন্য বসে নেই, তবু দিলাম। রাজকুমারের বন্ধুও চমৎকার। রাজকুমারীর বাবা মা, রাজকুমার ভালো, রাজকুমারীও খারাপ কী? মঞ্চসজ্জা সুন্দর। রাজবাড়ির ভাঙাচোরা জায়গাগুলো ভাঙাচোরাই মনে হচ্ছে, আলোকসম্পাতটম্পাতও কত ভালো যদি নাও বুঝি খারাপ হলে ধরতে পারতাম নিশ্চয়। হইচই-এর সিরিয়ালগুলোয় মধ্যবিত্তর প্রকাণ্ড হলঘরের তিন কোণে তিনটে পেপারফ্রাই-এর ঘোমটাপরা এথনিক ল্যাম্পপোস্টের আলোর অখাদ্যতা  যেমন পারি। রাতের মাঠের ছমছম, সকালবেলার স্পষ্ট সূর্যালোক সব যেমন চাই। বল্লভপুরের মুদিদোকানের মালিক থেকে কোটপ্যান্ট আঁটা নব্য ক্যাপিটালিস্ট - সবার মানানসই সাজপোশাক। সেকেন্ড হাফের একটুখানি ছাড়া বাকি গল্পটা হনহনিয়ে বলা হয়েছে, সংলাপ বুদ্ধিমান কিন্তু চালু নয় (যেটার কৃতিত্ব অরিজিন্যাল লেখকের সম্ভবতঃ)। রসিকতার জায়গাগুলোতে অ্যাকচুয়াল হাসি পায়।

তবে আমার সন্দেহ এ সব কিছু নয়, বল্লভপুরের রূপকথার রানঅ্যাওয়ে সাকসেসের আসল কলকাঠি সুরুচির। বলিউডি বিগ বাজেট থেকে ইউটিউব রিলে যা চলছে তার মধ্যে ফ্যামিলি নিয়ে দু’ঘণ্টার অস্বস্তিহীন আমোদের সুযোগ লুফে নেওয়ারই মতো। এ সব দিক থেকে মাপলে বল্লভপুরের রূপকথা সন্দেহাতীত মচৎকার। রুচিপূর্ণ, নির্মল বিনোদন।

এত নির্মল যে মন খুঁতখুঁত করছে। যেন হলে নয়, মাঠে ত্রিপলের ওপর বসে আছি, স্টেজে বাবা, কাকু, ঘোষজেঠু, পাখিকাকিমারা অভিনয় করছেন আর আমরা হেসে গড়াচ্ছি। কন্ডিশনিং-ই বলুন আর যাই বলুন, ধড়াচুড়ো পরে উজিয়ে হলে গিয়ে টিকিট কেটে দেখা সিনেমায় আরেকটু প্যাঁচপয়জারের আশা থাকে আমার। চেনা নাট্যমোদী হল থেকে বেরিয়ে আহত স্বরে বললেন, আহা এটা তো নাটক বানালেই বেস্ট হত। চার হাতপা তুলে একমত। এত জগঝম্প করে, প্রযোজকের এত টাকা খসিয়ে, এত লোককে এত মেক আপ করিয়ে, প্রোমোশনে এত জান লড়িয়ে এই নাটকটাকে সিনেমায় রূপান্তরের কারণটা আমি ধরতে পারিনি।

কর্তৃপক্ষ নিশ্চয় ধরেছেন এবং ঠিকই ধরেছেন, রিলিজের এতদিন পরেও সাউথসিটির আইনক্সের প্রায় সব সিট ভর্তি। আমাদের যে রকম টুকলিবাজি স্বভাব, এরপর কী? সপরিবারে দেখার ব্লকবাস্টার 'ভাড়াটে বিদায়'? ছোটদের বাংলা সিনেমার পাশে ফেরাতে চকচকে প্রোডাকশন হাউসের ঝকঝকে উপস্থাপনায় 'অবাক জলপান'?

সমসময়ের সঙ্গে বল্লভপুরের সম্পূর্ণ যোগাযোগহীনতা আমার অস্বস্তি জাগিয়েছে। দোস্তজী দেখে এসে এই আমিই লিখেছিলাম যে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স নিয়ে কথা না বলার সংযম দেখানো সিনেমাটার প্লাস পয়েন্ট। সেই আমারই বল্লভপুর কেন কোনও কথাই বলল না নিয়ে নালিশ করা ভালো দেখায় না। (একজন বললেন, আহা একেবারে বলেনি ভাবছ কেন? ধরে নাও সিনেমাটা দেখাতে চাইছে কীভাবে সামন্ততন্ত্রের খণ্ডহরে পুঁজিবাদ এসে ঝাণ্ডা গাড়ছে।) কিিন্তু   দোস্তজীর সঙ্গে বল্লভপুরের একটা তফাৎ রয়েছে। ফোকাসে না রাখলেও দোস্তজী সমসময়টাকে অস্বীকার করে না। মূল চরিত্রদের মনোগহনে ডুব দেয়। বল্লভপুরের রূপকথা সে সব রাস্তায় হাঁটে না। সমস্যাটা রিলেটেবল নয়, চরিত্রগুলো ফ্ল্যাট। গোটা ব্যাপারটার আধুনিকীকরণের কোনও চেষ্টাই নেই। এ যেন লেটেস্ট আইফোনে মোনালিসার পেন্টিং-টার ছবি তুলে এনে, ছবিটা কী ভালো উঠেছে মর্মে লোকজনের প্রশংসা আদায় করা। পরিচালক নিজের কথা কিছু বলতে পারতেন। মন্দার-এ যেমন সাহস করে বলেছিলেন। তবে হতে পারে শেক্সপিয়ারের পিণ্ডি দেশে দেশে এত লোকে এত বার চটকে ফেলেছে যে ভয় কেটে গেছে। কিংবদন্তীর কর্মভূমিতে বসে কিংবদন্তীর সৃষ্টির ওপর কারিকুরি চালালে ফেসবুকে কল্লা নেমে যেত। সেটা এড়াতেই সম্ভবতঃ সিনেমা শুরুর আগে "জয় বাদল জয় বাদল" ডিসক্লেমারের জগঝম্প। ফাইনপ্রিন্ট মিস করে গেছি বলতে পারবে না কেউ।

নাটকের কলাকুশলীদের ব্যবহার করে সিনেমাটা বানানো প্রশংসনীয়। শেষের ক্রেডিট দেখানোর সময় কার্টেন কলের ভঙ্গিটা অভিনব । সিনেমার লাইনের একজন লোক সঙ্গে গিয়েছিলেন, বললেন অভিনেতা ছাড়াও নেপথ্যের কলাকুশলীরাও ওই সময় সামনে এসেছেন নাকি, যেটাও অভিনব এবং সাধু উদ্যোগ।

সিনেমাটা কত ভালো হয়েছে সেটা না জেনে দেখতে গেলে হয়তো আরেকটু ভালো লাগত। এখন যা লাগছে না। উল্টে পশ্চিমবঙ্গের এই মুহূর্তের শ্রেষ্ঠ সেরিব্রাল হিরোর বদলে অন্য কেউ এটা বানালে জনগণের প্রতিক্রিয়া কী হত সে নিয়ে কূট সন্দেহ জাগছে।


হত্যাপুরী

প্রত্যাশা পূরণ না করতে পারার যে সমস্যাটায় বল্লভপুর ভুগেছে, হত্যাপুরী ভোগেনি। ভোগার কথাও ছিল না। যেমন লাগবে ভেবে দেখতে গেছিলাম এক্স্যাক্টলি তেমনই লেগেছে।

সত্যজিৎও নিজের সৃষ্টির প্রতি এতটা নিষ্ঠ ছিলেন না, যতটা সন্দীপ রায়। একজন ঠিকই বললেন, এই সিনেমাগুলো হচ্ছে সিনেমা ফর্মে সানডে সাসপেন্স। হত্যাপুরী আমার টপ তিন ফেলুদার একটা, তার ওপর গত পাঁচ বছর ধরে সপ্তাহে তিনবার সানডে সাসপেন্সে শুনছি, হাইফেন সেমিকোলন পর্যন্ত ঠোঁটস্থ। অঞ্জলি দেওয়ার সময় বাকিরা যখন টুকাইদার পিছু পিছু বিড়বিড়িয়ে বা ঠোঁট নেড়ে মন্ত্র পড়তেন, আমার বাড়ির অনেকেই তাঁদের যে এই সব মন্ত্র কণ্ঠস্থ প্রমাণের জন্য টুকাইদার সঙ্গে সঙ্গে চিল্লিয়ে মন্ত্র বলতেন এবং উপস্থিত ভক্তমণ্ডলীর দিকে গর্বিত চোখে তাকিয়ে দেখতেন লোকে কতটা ইম্প্রেসড হচ্ছে।

আমার যদি তাঁদের মতো কনফিডেন্স থাকত (বা কনফিডেন্সের অভাব, দুটো উপসর্গই আজকাল কাছাকাছি দেখতে লাগে) আমিও হলে বসে চিৎকার করে চরিত্রদের সঙ্গে সঙ্গে সংলাপ বলতে পারতাম। এর আগে গোরস্থানে সাবধান, বোম্বাইয়ের বোম্বেটে ইত্যাদিতে গল্পের অর্ডার আগুপিছু করেছেন পরিচালক, দুষ্কৃতীর পরিচয় গোড়াতেই ফাঁস করে, হত্যাপুরীতে সেটাও হয়নি। অফ কোর্স, তাতে কিছু এসে যায় না। কে করেছে জানার কৌতূহলে তো কেউ ফেলুদাব্যোমকেশ দেখতে যায় না, গোটা জঁরটাই চলছে একটা এজ গ্রুপের লোকদের নস্ট্যালজিয়া ভাঙিয়ে।

তবু, সন্দীপ রায়ের ফেলুদার কিছু কিছু জিনিস আমার ভালো লাগে। ফেলুদার সেনসিবিলিটিটা উনি রক্ষা করেছেন। যে সেনসিবিলিটিটা গোটা বাঙালিজাতির মধ্যে থেকেই উবে যেতে বসেছে। বস্তুগত লোভ যাকে গ্রাস করতে পারেনি। চেহারায় টাকার বদলে এখনও বুদ্ধির দীপ্তি ফুটছে।

ফেলুদার সিনেমা নিয়ে মতামত প্রকাশের একটাই জায়গা পড়ে আছে, ফেলুদা এবং লালমোহনবাবুর চরিত্রে অভিনেতাদের মানালো নাকি। ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তকে ফেলুদা হিসেবে ভালো লেগেছে আমার। চেহারা শার্প, হাইট খারাপ না, সৎ চেষ্টা আছে। সাজপোশাক হাঁটাচলা কথাবার্তা টোটার থেকে বেটার। টোটার দোষে না। টোটার মধ্যেও আমার পছন্দের ফেলুদা হওয়ার গুণাবলী আছে, কিন্তু অন্য কারও হাতে পড়তে হবে। ওইরকম কোট পরে, স্কার্ফ জড়িয়ে, চুল ফাঁপিয়ে এসে দাঁড়ালেই আমি ক্যান্সেল করে দেব। আর যার হয় হোক, ওটা আমার ফেলুদা না।

জটায়ুর ব্যাপারটা তুলনায় সহজ। সন্তোষ দত্ত একশোয় একশো পেয়েছেন, এবার তুলনাটা তিরিশ পানেওয়ালাদের মধ্যে। কে আঠাশ পেলেন, কে চব্বিশ। অভিজিৎ গুহর মধ্যে তাঁর পূর্বসূরীদের কোডোপাইরিন মার্কা বাড়াবাড়িটা নেই। একজন বললেন ওটা খানিকটা থাকাই নাকি প্রেফারেবল। আরেকজন বললেন বাবা জটায়ুর এত ভুঁড়ি? সন্তোষ দত্ত তো টিংটিং-এ ছিলেন। বাঙালিদের গড় ওজন সন্তোষ দত্তর আমল থেকে কতখানি বেড়েছে মনে করালাম। জটায়ু বাদ পড়বেন কেন?

একটা জিনিস এতদিনে বুঝে গেছি, আমার পছন্দের ফেলুদার সিনেমা বানানোর জন্য ফেলুদার মতো একজন লোক লাগবে। বাঙালিদের মধ্যে ও জিনিস চিরকালই আঙুলে গোনা ছিল, এখন পাওয়া অসম্ভব। কাজেই আমার আশা নেই। আশাভঙ্গও নেই। খালি এটুকু জানা আছে পরের ফেলুদাটা রিলিজ করলে আবারও দেখতে যাব। সিনেমার ভালোমন্দ ইমমেটেরিয়াল, কারণটা নেহাতই ব্যক্তিগত।

Comments

  1. আমার আবার বল্লভপুর ভাল্লেগেছে বেশ। মানে ফুরফুরে মেজাজে হল ছাড়া গেল। পাকামো নেই কোনোখানে যা কিনা আজকাল বাংলা সিনেমায় মাস্ট হয়ে গেছে। প্লাস যত্নের অভাব যেটা খুব থাকে সেটাও নেই।
    তোমার পয়েন্টটা ভ্যালিড, নাটককে সিনেমা বানাতে হবে কেন। উত্তর জানা নেই অবশ্য।
    হত্যাপুরী দেখা হয়নি।
    -প্রদীপ্ত

    ReplyDelete
    Replies
    1. ফুরফুরে আর যত্নসহকারে, দুটো বিষয়েই একমত, প্রদীপ্ত।

      Delete
  2. নাটক থেকে ছবি বাংলায় আগেও হয়েছে যেমন বাঞ্ছারামের বাগান - মনোজ মিত্রের নাটক থেকে তপন সিংহের ছবি । বা ইবসেনের নাটক থেকে সত্যজিতের গণশত্রু। সেগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে ছবি হিসেবে বল্লভপুরের রূপকথা বারবার দেখার মত ছবি নয়। এসভিএফ না বানালে এই ছবিটা আদৌ কেউ দেখতে যেত না ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমি নাটক টু সিনেমা নিয়ে কিছু বলিনি, নাটক থেকে সিনেমা হয়, বই থেকে সিনেমা হয়, সিনেমা থেকেও সিনেমা হয়। আমি এই পারটিকুলার নাটকটাকে এই ভাবে সিনেমার রূপ দেওয়া নিয়ে কৌতূহল প্রকাশ করেছি।

      Delete
  3. ¨ওইরকম কোট পরে, স্কার্ফ জড়িয়ে, চুল ফাঁপিয়ে এসে দাঁড়ালেই আমি ক্যান্সেল করে দেব ¨- একমত, একমত, একমত! দেখেই গা জ্বলে গেছিলো ! একটা এপিসোড এর পরে আর দেখিনি।
    বল্লভপুর ভালো লেগেছে, সমসময়ের সঙ্গে যোগাযোগ নেই টাই বেশি ভালো লাগলো, নাহলেই ভয় লাগে রাজনীতি , LGBTQ , psychological drama ইত্যাদি প্রভৃতির জগাখিচুড়ি হয়ে যাবে, যেমন বেশিরভাগ বাংলা webseries বা নতুন সিনেমা গুলো হচ্ছে :(
    তবে তোমার কয়েকটা ভাবনা, যেমন এক্ষেত্রে নাটকের পরিকাঠামো থেকে একেবারেই না বেরিয়ে নাটক থেকে সিনেমা করার প্রয়োজনীয়তা এগুলো আগে ভাবিনি, অন্য রকম চিন্তা করালে, as usual.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমার একসময় এই চোখ বন্ধ বিনোদন ভালো লাগত, কাকলি, এখন আর লাগে না। কারণ আমি দেখেছি সময়কে অগ্রাহ্য না করেও চরম ভালোলাগার জিনিসপত্র বানানো যায়। যে কোনও সার্থক শিল্পের সময়ের সঙ্গে যোগ থাকাটা দরকারি না? এ ছিন্নমূল ভালোলাগা ভুলতে কদ্দিন লাগবে?

      আর তোমার ওই পয়েন্টটায় অস্বস্তি আমার সবথেকে বেশি হয়েছে। শুটিং করা নাটক মনে হয়েছে গোটা ব্যাপারটা। সেটাই উদ্দেশ্য ছিল হয়তো।

      Delete
    2. মাথায় রাখব তোমার কথাটা । btw,তুমি কি The Makanai দেখেছ? যদি লেখ ওটা নিয়ে, আমি রেডি পড়ার জন্য🙏

      Delete
    3. না না মাথায় রাখার কিছু নেই। আমিই বা বলার কে কোনটা শিল্প কোনটা নয়, সার্থক অনর্থক তো দূরের ব্যাপার। সোজা কথাটা হচ্ছে আমার ভালো লাগেনি, মিটে গেল।

      আমি এই সিরিজটা দেখিনি গো, দেখব'খন।

      Delete
  4. আমি আজ দেখলাম সিনেমাটা। আমার বেশ পুরনো দিনের মতো ফীল গুড লাগলো, মিষ্টি মত। আজকাল সব সিনেমার মধ্যে পরিমিতির এত অভাব, এত "অনেককিছু বলতেই হবে"- র বাধ্যবাধকতা, সেটা নেই বলে হয়তো এরকম লাগলো।
    অনেকটা শীর্ষেন্দু-শরদিন্দু ধরণের, যেটা অবশ্য ভৌতিক ব্যাপারটার জন্যও হতে পারে।

    সিনেমাটা না বানানো হলে হয়তো আমার মত অনেক লোকের কাছে নাটক হিসেবে ব্যাপারটা পৌঁছতে পারতোনা, অন্তত যারা এদিক ওদিক ছিন্নমূল হয়ে বসে আছে।
    নাটক হিসেবেই পাবলিশ করা যেতে পারত হয়তো, আর সেটা ভাবতেই ছোটবেলার দম্পতি নাটকটা মনে পড়ে গেলো, ডিডিতে দেখেছি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. মুশকিল হচ্ছে, বৈজয়ন্তী, তুলনাটা যদি আজকালকার বাংলা সিনেমাদের সঙ্গে হয় তাহলে ভালো প্রতিভাত হতে খুব পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় না, বল্লভপুরেরও হয়নি। কিন্তু ঠিকই তো, ভালোমন্দ একে অপরের নিরিখেই হয়, আর নিরিখটাও কাছাকাছি জিনিসের মধ্যেই ঘটে। বল্লভপুরের কমপিটিটর তো আর ওয়ার্ল্ড সিনেমা হবে না, ওয়ার্ল্ড ছাড়ুন, ভারতবর্ষের অন্য ভাষায় আজকাল যে সব ভালো সিনেমা তৈরি হচ্ছে তার সঙ্গেও হবে না, হবে উইনডোজ আর এস ভি এফ-এর বাকি হিট সিনেমাদের সঙ্গে। ফেলুদাব্যোমকেশ আর ওটিটি দাপিয়ে বেড়ানো কোটি কোটি থ্রিলারের সঙ্গে। সে তুলনায় অস্কার না হলেও, ফিল্মফেয়ার আর ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডওয়র্দি তো হেসেখেলে বিবেচিত হবে বল্লভপুর।

      শরদিন্দু-শীর্ষেন্দুর নামদুটো করলেন বলে বলি, ধরুন এখনকার একজন লেখক শরদিন্দু-শীর্ষেন্দুর ভাষা, বিষয়, সময়, ধ্যানধারণা, সাজপোশাক, মূল্যবোধ অবিকল রেখে সাহিত্য সৃষ্টি করতে শুরু করলেন। (আমি কিন্তু শরদিন্দু-শীর্ষেন্দুর কোয়ালিটির কথা তুলছি না, ওঁরা দুজনেই স্ব স্ব সময়ে সেরা ছিলেন এবং ওই সময়েও বাজে লেখক কম ছিলেন না, যেমন এখনও ভালো বাজে সবরকম লেখকই আছেন।) আমি বলছি যে যদি এখনকার একজন লেখক (কোয়ালিটির বিচার ছেড়ে দিয়ে) শরদিন্দু-শীর্ষেন্দুকে চোখ বুজে টুকে সাহিত্যসৃষ্টি শুরু করেন এবং হইহই হাততালি পান, সেটা সংশ্লিষ্ট লেখক, বাংলা সাহিত্য এবং শরদিন্দু-শীর্ষেন্দু, কোনও পক্ষের পক্ষেই গর্বের (এমনকি স্বস্তিরও) হবে কি?

      আর ওই নাটক হলে বেশি লোকে দেখতে পেত না সিনেমা বলে পারল-র পয়েন্টটা আরেকটা কথা মনে করাল। ঋত্বিক ঘটক নাকি বলতেন যে মুহূর্তে এমন কোনও আর্ট মাধ্যমের খোঁজ পাবেন যা সিনেমার তুলনায় বেশি মানুষের কাছে পৌঁছতে পারে, সেই মুহূর্তে সিনেমার মুখে লাথি মেরে তিনি ওই মাধ্যমে শিফট করবেন। এই যুক্তিতে বলতে হবে বল্লভপুরকে সিনেমায় তুলে এনে পরিচালক শিল্পকৃত্যই করেছেন। এই প্রসঙ্গে আরেকটা কথাও না বলে পারছি না, আজকাল প্রচুর গল্প উপন্যাসের (উপন্যাস কম, গল্প বেশি) নিচে প্রশংসা হিসেবে লেখা থাকে দেখবেন, এই গল্প থেকে চমৎকার সিনেমা/সিরিজ/টেলিফিল্ম হতে পারে। অদূর ভবিষ্যতে চলন্ত চিত্র ছাড়া অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের ঔৎকর্ষ মাপার এটা একটা মাপকাঠি হতে চলেছে সম্ভবত, যে সেটাকে কত সহজে চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করা যায়।

      অনেক এঁড়ে তর্ক করলাম, রাগ করবেন না যেন।

      Delete
    2. বরং ভাবছি, চায়ের কাপ আর চাপড়ানোর জন্য বালিশ নিয়ে বেশ একটা সন্ধ্যে জমজমাট কাটিয়ে দেওয়া যেত এই নিয়ে।

      Delete
  5. বল্লভপুরের রূপকথা দেখলাম। খারাপ না, তবে যেরকম সব রিভিউ দেখেছিলাম সেরম কিছুই লাগলো না। তাছাড়া, একটু ছোট করতে পারতো, অন্তত ফার্স্ট-হাফটা তো বটেই (নয়তো আমার ধৈর্য্যের অভাব দিন-দিন বাড়ছে, এটাও হতে পারে)।

    বহুযুগ আগে সন্দীপ রায়ের শুরুর দুচারটে ফেলুদা ফিল্ম আর টেলিফিল্ম দেখেছিলাম, আর তখন এতটাই আশাহত হয়েছিলাম যে ওনার সিনেমা দেখাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। কে জানে, তখন হয়ত মনের মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের করা সিনেমার মতো এক্সপেকটেশনস ছিল। আজকাল অবশ্য শুনি, যে আরেকটু ভালো হয় সিনেমাগুলো। তাও, দেখার উৎসাহ আর জেগে ওঠে না।

    আর আপনার আগের কমেন্টের শিল্প মাপার মাপকাঠির কথাটায় বেশ মজা লাগছে (বেপারটা মজার না, কিন্তু ভেবে হাসিই পাচ্ছে)। কি কান্ড! তবে কেউ যদি কখনো একটা আঁকা ছবি থেকে চলচ্চিত্র বানিয়ে ফেলে, তাহলে সেটার কৃতিত্ব (সত্যি কৃতিত্ব, কোনো কটাক্ষ নেই) দুই শিল্পীকেই না দিয়ে আমি পারবো না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আঁকা ছবি থেকে না হলেও, স্থিরচিত্র দিয়ে তো ছবি হয় শুনেছি, রাজর্ষি। Still image film রীতিমত একটা ঘরানা। আমি দেখিনি, চন্দ্রিল ভট্টাচার্য একটা কোথায় বলছিলেন, তখন উইকিতে গিয়ে দেখলাম ব্যাপারটা সত্যি।

      Delete
    2. আমি আসলে ছবির ভাব-সম্প্রসারণ করে সিনেমার কথা ভেবে বলেছিলাম (যেটা এখন ভেবে দেখলে মনে হচ্ছে করতেই পারে), তবে আপনি যেটা বললেন সেটা আরো অনন্য।

      Delete
    3. বুঝলাম। হ্যাঁ, ফোটো দিয়ে সিনেমার ব্যাপারটা অভিনব লেগেছিল আমারও। মানুষের মাথা থেকে কত কিছু বেরোয়।

      Delete
    4. আঁকা ছবি থেকে চলচ্চিত্র বলতে কি বোঝাচ্ছেন জানিনা, তবে এরকম একটা কাজ কিন্তু হয়েছে অলরেডি: https://youtu.be/0CQKHWvK8Ro

      Delete
    5. কী ভালো লিংক, থ্যাংক ইউ, সুগত।

      Delete
    6. ইউটিউব লিংকটা দেখলাম - সত্যিই বিস্ময়কর ব্যাপার। অনেক ডিটেইলড কাজ, আর সময়সাপেক্ষ।

      Delete
  6. Eta niye joto hoichoi hovhche, seta Goynar baxo niye howa uchit chhilo. Udor credit budho pachche

    ReplyDelete
    Replies
    1. আহা, আমার একটা প্রিয়, প্রিয়, প্রিয় সিনেমার কথা মনে করালেন, শিবেন্দু। মনে পড়ে বল্লভপুরকে আরও একটু বেশি খারাপ লাগছে, ঠিকই বলেছেন।

      Delete
  7. কলকাতা-হুগলি মিলিয়ে দেড় মাস কাটিয়ে এলাম, কিন্তু একবারও সিনেমা যাওয়ার সময় হলনা। শেষে এখানে ফিরে হৈচৈতে বল্লভপুর দেখলাম। হত্যাপুরীর জন্য কতদিন অপেক্ষা করতে হবে জানিনা। ডাবল ফেলুদার দেখার মতন প্রিন্ট সবে কে ইউটিউবে ছেড়েছে, তাই সেটা সবে করে দেখতে পেলাম।

    বল্লভপুরের রূপকথা ভাল লেগেছে, যদিও আমি মানছি যে ওটা নাটকেরই মতন। ভালোলাগার প্রধান কারণ হল, বহুদিন পরে এমন একটা বাংলা ছবি দেখলাম যেটা সপরিবারে বসে দেখা চলে, ন্যাকা ন্যাকা প্রেম বা হঠাৎ করে হিংসাত্মক ব্যাপারস্যাপার বা অস্বস্তিকর যৌনসুড়সুড়ি দেওয়া দৃশ্য এসে পড়েনা। এবার সেটাকে সিনেমার গুণ বলতে পারেন, বা আমার পরিস্থিতির দোষ বলতে পারেন যে আমি এরকম সিনেমার খোঁজ করছি।

    হত্যাপুরী না দেখলেও, ফেলুদার বিষয়ে আপনার কমেন্টটার সঙ্গে একমত। এটা যেরকমই হোক, পরের ফেলুদা বেরোলেও দেখতে যাব। সিনেমার ভালোমন্দ ইমমেটেরিয়াল, কারণটা নেহাতই ব্যক্তিগত।

    ReplyDelete
    Replies
    1. মন্তব্য পেয়ে ভালো লাগল, সুগত। আপনার সঙ্গে একমত, যেটা পোস্টে লিখেওছি, বল্লভপুরের সাকসেসের কারণ সপরিবার বিনোদনের সুযোগ করে দেওয়া। সংসারী লোকজন সংসারসহযোগে টাইমপাসের উপকরণ খুঁজবেন সেটাই স্বাভাবিক, এবং সেই উপকরণ হাতের কাছে পাওয়া যাওয়াটাও ভালোই ব্যাপার।

      আমি বলছি, শুধু এই ক্রাইটেরিয়াটা দিয়ে একটা সিনেমা ভালোমন্দ বিচার করা যায় না। যুক্তিটা এই পথে চলেছে - বক্তব্য রাখতে গেলেই সিনেমা খারাপ হয়ে যায়, বল্লভপুর কোনও বক্তব্য রাখেনি কাজেই বল্লভপুর ভালো সিনেমা। বক্তব্য রাখতে গেলে যে সব সিনেমা খারাপ হয়ে যায় তাদের খারাপ হওয়ার সঙ্গে বক্তব্য রাখার কোনও সম্পর্ক নেই, তারা কোনও বক্তব্য না রাখলেও খারাপ হত। কারণটা আমার মতে ক্ষমতার অভাব, তবে আজকাল অনেকে টাকার অভাবের দোষও দিয়ে থাকেন।

      বক্তব্যহীন পারিবারিক সিনেমা ২০২৩ এ দাঁড়িয়ে কেন বানানো গেল না সেটা আমার একটা প্রশ্ন। আর নাটকটাকে হুবহু নাটক রেখে দেওয়ার অসুবিধেটা তো অনেকেই পয়েন্ট আউট করেছেন।

      Delete
    2. "বক্তব্য রাখতে গেলেই সিনেমা খারাপ হয়ে যায়", এরকম কথা যাঁরা বলেছেন, তাঁদের জিজ্ঞাসা করবেন তো, তাঁরা হীরক রাজার দেশের ব্যাপারে কি ভাবেন? অবশ্য দোষটা আমারই, কিসে আর কিসে তুলনা করছি। আর ইয়ে, আমি হয়ত বোঝাতে পারিনি, আমার বক্তব্য রাখা নিয়ে কোনও অসুবিধে নেই, আমার অসুবিধে সেটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর ব্যাপারে। দেখালেই যে সিনেমা খারাপ হয়ে যায় তাও বলছিনা, কিন্তু এটা নেহাতই আমার ব্যক্তিগত অসুবিধে।

      Delete
    3. আপনার কমেন্ট পড়ে যে বিরাট উপকারটা হল সেটা হচ্ছে কাল রাতে হীরক রাজার দেশে আরেকবার দেখে ফেললাম। কী ভালো, কী মজা। আপনার সঙ্গে তর্ক করছি না, অন গড ফাদার মাদার, কারণ আমি শিওর আপনি আমার সঙ্গে একমত হবেন, এই সব বক্তব্য অবক্তব্য সবই ভালো এবং মন্দ হয়ে ওঠে ব্যাপারটা কার হাতে পড়েছে তার ওপর। ঈশপের গল্পও গেলাতে জানলে এমন গেলানো যায় যে একটুও অসুবিধে হবে না। আরও একটা কথা আমার মনে হচ্ছিল জানেন, জ্ঞান দেওয়ার ব্যাপারেও কমিটমেন্ট দেখানোর দরকার। 'জ্ঞান দেওয়া দরকার মনে হয়েছিল তাই সিনেমা বানিয়েছি' একরকম, আর গুপ্তধন থ্রিলারের ফ্রেমে ফ্রেমে ডিমনিটাইজেশনের কুফল থেকে থেকে সুকুমার রায়ের মূল্যায়নে বাঙালির অপারগতা, বাঙালির কিসু হবে না কারণ সে ইতিহাস বিস্মৃত হয়েছে --- এইসব গুঁজতে থাকলে কানের গোড়ায় দিতে ইচ্ছে করে সত্যি।

      Delete
  8. Aamaro ballavourer rupkotha besh bhalo laglo.. aamaar main pawa holo je aamaar moha-tnyash 8 bochorer bhaijhi puro cinemata dekhlo, tarpor nije theke aaro 4 baar dekhlo.. amra oboshyo TV te dekhechi tai hall er jawata gaaye laageni..
    aami borong overly hyped howay besh bhoye bhoye dekhte bosechilam. tarpor khub bhalo lege gyalo.. bodh hoy probasi bangali hisebe bangla natok dekhar sujog o kom e hoyeche.. sob cheye bhalo jeta holo je sotti sotti bhishon hasi pelo..

    Hatyapuri hoichoi e ele dekhbo bote.. tobe ekhono Srijitertar trauma kaateni, kaajei dekhte onek deri hobe

    bhalo thakben khub

    Indrani

    ReplyDelete
    Replies
    1. চার বার! কত ভালো লেগেছে বুঝতে পেরেছি। ভালো লাগা সর্বদাই ভালো ব্যাপার, বিশেষ করে এই বাজারে, কাজেই এত ভালো লাগা যে বল্লভপুর থেকে পেলেন সেটার জন্য খুশিই হলাম।

      Delete

Post a Comment