পৌষমেলা ২০২৩
বাঁশত্রিপল জমা হলে টসকায় না কিছু। খাড়া হলেও ফাঁকেফোকরে হাঁটা, দৌড়, জাম্পিং জ্যাক চলতে থাকে। কার্টুন মুখওয়ালা পলিথিনের স্লিপ, কাঠের নাগরদোলা - উল্লম্ভ অনুভূমিক দুই ভ্যারাইটিরই - এসে যাওয়ার পর অবশ্য একদলকে পিছু হটতে হয়। জয়সূচক বাদ্যগীত জমে আর লেপের ভেতর থেকে বেরিয়ে সোয়েটার জিনস গলিয়ে আমি বলি, যাই একবার ঘুরে আসি।
পৌষমেলাটা একদিক থেকে দুর্গাপুজোর থেকেও ফুর্তির। পুজো সব ব্লকের মাঠে হয়, পৌষমেলা খালি আমার বাড়ির উল্টোদিকের মাঠে। পুজোর ভিড়টা দরকারের থেকে বেশি এবং সাড়ে বত্রিশ ভাজা, পৌষমেলার ভিড় প্রাদেশিক। সব চেনা পাপী।
তবু ফুর্তি খানিকটা কম হয়ে গেল। ঘুমচোখে মেলা মাথায় আসেনি, খাবারের খোঁজে সোজা বাজারে চলে গেছি। অন্নপূর্ণায় সংক্রান্তি উদযাপন চলছে তিনদিনব্যাপী। রাধাবল্লভীর সঙ্গে একেকদিন একেকরকম। সেদিন ছোলার ডাল। আগের দিন আলুর দম ছিল। আহা, একটা খবর দিলেন না? কাল আসুন বৌদি, মটর পনির থাকছে। কান চাপা দিই। চায়ের ভাঁড় হাতে মেলায় ঢুকি, সারি সারি খাবার টেবিল। এখানে খেলেই হত।
বন্যাটা মূলত ফিশ ফ্রাই, চিকেন চাপ, মাটন রোলের তবে আমার মতো কুলাঙ্গারদের জন্য পিঠেপুলি, চাট, ঝালমুড়িও আছে। খিদে নেই বলে তো মেলায় গিয়ে না খেয়ে থাকে না কেউ। কালা খাট্টা চুসকি দিয়ে শুরু করে বাউল গান শুনতে শুনতে আলু টিক্কি চাট সেরে ঘুরতে ঘুরতে দেখি নাইট্রো কফি লেখা একটা দোকানে খুব ভিড়। দোকান ভিড় দুইই চকচকে, তবু যে কেন সাবধান হইনি। একশো আশি টাকা জলে। নাকি নাইট্রোজেন গুলেই এমন মিষ্টি আর ক্রিমি হয়েছে যে দুধচিনি দেওয়ার দরকার হয়নি। মুখ শুদ্ধি করতে লিমকা খেতে হল।
বড় হয়ে যাওয়ার একটা সুবিধে, বসে আঁকতে হয় না। ছোটবেলার বসে আঁকোর তেত্রিশ কোটি খারাপ লাগার একটা ছিল বড়দের উঁকিঝুঁকি মেরে আঁকার খাতা দেখার চেষ্টা। এখন বুঝি কেন। ও কৌতূহল দমন অসম্ভব। এক কন্যার পাতাজোড়া শীত, সাদা তুলির টানে নীল আকাশের বুকে সে সারি সারি স্নোফ্লেক আঁকছে। আরেকজনের স্কুলবাস থেকে নামছে বাচ্চা, অদূরে অপেক্ষারত কুকুরছানা। আঁকিয়েরা কড়া চোখ তুলতেই তাড়াতাড়ি সামনের দিকে ঘাড় ঘোরালাম।
সামনের মঞ্চে অঞ্জলি জুয়েলার্সের সৌজন্যে ফ্যাশন শো চলছিল। সঞ্চালক জোক বলছিলেন, ধাঁধা ধরছিলেন, “উইল ইউ বি মাই গার্লফ্রেন্ড?” বলে ঠাকুমাদিদিমাদের দাঁড় করিয়ে খিলখিলাচ্ছিলেন, নিরপরাধ নন-বেঙ্গলিদের তুলে মাইকে তিনবার “আসচে বচর আবার হোবে” পড়িয়ে ইনক্লুশনের হদ্দমুদ্দ করছিলেন, অঞ্জলি জুয়েলার্স শব্দদ্বয়ের আগে মায়ের আঁচল পরে বাবার কানমলা বসিয়ে রচনা করছিলেন একের পর এক অত্যাশ্চর্য বাক্য। ভদ্রলোকের এক পার সেন্ট সাবলীলতা যদি পাই, জীবনে আর কিছু চাই না।
একটা ধাঁধা মনে আছে। ঘড়িতে যটা বাজবে ততটাই যদি বাজতে বাকি থাকে তাহলে ঘড়িতে ক’টা বেজেছে?
নেড়ি বাদে সি আর পার্কের যত কুকুর - দামড়া, পুঁচকে, দেমাকি, নিরীহ - উপস্থিত মাঠের কোণের ডগ প্যাজেন্টে। কেউ কার্পেটে গড়াচ্ছে, কেউ চেয়ারে বসে হাই তুলছে, কেউ গার্জেনের কোল থেকে নামছেই না। মনখারাপ হচ্ছিল কেউ প্রাইজ পাবে কেউ পাবে না ভেবে। প্রাইজ যে বড় কথা নয় অংশগ্রহণটাই যে আসল, সেই বক্তৃতাটাও কি এরা বুঝবে? টেবিলে সোনালি কাপের সারি দেখে চিন্তা ঘুচল। সকলেই প্রাইজ পেল, সকলেই হাততালি দিল। সে এক ফিলগুড ব্যাপার।
বানারসী পানের ওখানেও ভিড়। আমি খাই না, বানাতে দেখতে ভালোবাসি। সুপুরি কোথায়, জাঁতি কোথায়, চুন খয়ের কোথায়, এটা মাখাও, ওটা পোরো, সেটা গোঁজো, অন্তে শো অফের চূড়ান্ত করে দুই আঙুলে একটা পান শেপের ব্যাপারকে শিঙাড়া শেপ দিয়ে ফেলো। ঠাকুমা পানটা খেতেন, আমার ভাগে পানের বোঁটা। ফেলুদা পান খায় জেনে ধরার চেষ্টা করেছিলাম। পোষায়নি। না পোষানোর আরও একটা কারণ ছিল। কিছু কিছু খাবার খাওয়ার একটা লুক থাকে। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে, যে কোনও দেশ জাতি ধর্ম বর্ণের লোক ওই বিশেষ খাবারটি খেলে সবার চেহারায় সেই লুকটা ফোটে। ফুটতে বাধ্য। চুইংগাম খাওয়ার যে লুক সেটা মায়ের অপছন্দ ছিল বলে আমার ছোটবেলায় বিগ বাবল্ আর বড়বেলায় অরবিট খাওয়া হল না। পান চিবোলে চোখেমুখে যে বর্ডারলাইন বেআইনি সুখের আঁচ সে তো বাস্তবে পোয়াইনি কখনও কাজেই সেটার ইলিউশন দেওয়া একরকম লোকঠকানো।
রোগা বই তিরিশ মোটা বই পঞ্চাশ দরে লাইব্রেরির স্টল থেকে পুরোনো বই কিনলাম। সিন সিটি-র দুটো খণ্ড, মোটে একশো টাকায়, দাঁওই বলতে হবে। রোগা বইদের মধ্যে একটা পূর্ণিমা ঠাকুরের ঠাকুরবাড়ির রান্না। (বইতে শিমের একটা ছেঁচকি আর একটা কালিয়ার প্রণালী দেওয়া আছে আর আমার ফ্রিজে আছে শিম। কাল টস করে যে কোনও একটা বানালে হয়। ঘুমিয়ে উঠলে এই সব সদিচ্ছে উবে যাবে আশায় চশমা খুলে পাশ ফিরলাম।) বিকেলে দিল্লিবিষয়ক আলোচনাসভায় কেউ স্থাপত্য নিয়ে কথা বললেন, কেউ খাওয়াদাওয়া নিয়ে। দিল্লির ইতিহাস নিয়ে উপন্যাস লিখছেন মাঝবয়সী পুরুষ বৈজ্ঞানিক, সপ্তদশ শতাব্দীর ভাগ্যহত ষোড়শী তওয়ায়েফের জবানিতে। এ জীবনে পশ্চিমবঙ্গের মফঃস্বলে জন্মানো, বাংলা মিডিয়ামে পড়া, চশমাপরা মহিলার জবানিতে ছাড়া একলাইন লেখার কনফিডেন্স অর্জন করতে পারব বলে মনে হয় না। এ বছর লিখলে বেয়াল্লিশ বছর বয়সী মহিলার পারস্পেক্টিভ থেকে লিখব, দু’হাজার তেত্রিশে লিখলে নায়িকার বয়স বাহান্ন হয়ে যাবে।
রাতে খেয়েদেয়ে শুভমিতার গান শুনতে যাব ঠিক ছিল, সন্ধে নাগাদ বাড়ি ফিরে হিটার চালিয়ে লেপের তলায় ঢুকে টের পেলাম এর ভেতর থেকে আমাকে আবার বার করতে একা শুভমিতায় হবে না, রগে বন্দুকের ছোঁয়া লাগবে। ঝিমোতে ঝিমোতে একবার ‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে’ শুনতে পেলাম মনে হল, আরও গভীর রাতে ‘দেখেছ কি তাকে ওই নীল নদীর ধারে’।
Baah khub bhalo laglo pore. Melar bornona pore anekta Mumbai er kichhu durgapujo pandel er kotha mone porlo. Feluda paan khai bole paan khaoa ---- ei Feluda r proti anugotyo amader generation er ekta common theme.
ReplyDeleteAapni likhun Delhi samporke aapnar chokh diye. Setao khub upadeo hobe. Apekkhai roilam Poschimbnonge jonmano, bangla medium, 40 er oporer er lokjon.
এই যে আপনার মতো বন্ধুরা প্রশ্রয় দেন, এইটাই অবান্তর লেখার সবথেকে বড় পাওনা, সুস্মিতা। আমার চোখ দিয়েই লিখব, কারণ এক, তাতে পরিশ্রম সবথেকে কম, দুই, দেখতেও সবথেকে ওই চোখ দিয়েই পাই বেশি।
DeleteEktu out of context comment korchi - tomar purono Paris er post gulor chobi udhao:((( konobhabe pherot aana jabe ki ? Thankuu - Parama
ReplyDeleteওই এপিসোডটার প্রায় সব ছবিই হাওয়া, পরমা। কে জানে কেন। আমার কোনও আইডিয়া নেই ছবিগুলো কোথায় বা কী করে ফিরিয়ে আনা যাবে।
DeleteJaah :(
Deleteবড় ভালো লাগলো। তোমার বাংলা মিডিয়মের চশমা পরা চোখেই গল্প শুনিয়ো। এই ব্লগে লেখা না পেলে আমার মতো অনেকেই অপেক্ষা করে আবার কবে আসবে! তুমি সাধারণ অতি সাধারণ কথাই লিখো আমাদের জন্য, আমরা যারা অপক্ষায় থাকি।
ReplyDelete-প্রদীপ্ত
থ্যাংক ইউ, প্রদীপ্ত। তোমাদের মনোযোগ আমার প্রাপ্য নয়, সত্যি।
Deleteরসিকতাটা হয়নি, অ্যাজ ইউজুয়াল, কিন্তু আমি ওই দৃষ্টির ব্যাপারটা রসিকতা করেই লিখতে চেয়েছিলাম। উপন্যাস লিখতে বসে যাঁদের একশো আশি ডিগ্রি উল্টো দৃষ্টি ধার নেওয়ার কথা ঝপাং করে মাথায় আসে, তাঁদের প্রতি আমি সহজাত সন্দেহ পোষণ করি। ব্যতিক্রম আছেন, যাঁরা আমার সন্দেহকেই ভ্যালিডেট করেন।
বাংলা মিডিয়ামের চশমাপরা দৃষ্টি নিয়েও একদমই জড়োসড়োভাব নেই। আমার দৃষ্টি পচা হলেও এ জগতে আমার ফেভারিট দৃষ্টিরা প্রায় নিয়ম করে বাংলা মিডিয়াম, প্রায় নিয়ম করে চশমাপরা।
ভারী আরাম লাগলো লেখাটা পরে। এটা আমার জন্যে একদম "কমফর্ট রিড" বলবো। ("কমফর্ট ফুড" বলে জিনিস হলে "কমফর্ট রিড" না থাকার কোনো কারণ নেই।)
ReplyDeleteএটা বেশ ভাবিয়ে তুললো তো - যে বড়দের জন্যে কেন বসে আঁকা নেই, আর ছোটরা খালি বসেই বা কেন আঁকবে?
'সিন সিটি' বলতে কার লেখার কথা বলছেন? 'সিন সিটি' নামক একটা কমিক্স সিরিজ ছিল, যেটা থেকে একটা সিনেমাও হয়েছে। আবার অন্য লেখকদেরও লেখা আছে। বই কোনোটাই পড়া নেই, কিন্তু সিনেমাটা কলেজে পড়া সময়ে দেখেছিলাম।
ওই কমিক্স সিরিজটার কথাই বলছি, রাজর্ষি। গ্রাফিক নভেল বললে অবশ্য আরেকটু জাতে ওঠা লাগে। ওটার দুটো খণ্ড, ধূলিধূসরিত, পাওয়া গেছে কুল্যে একশো টাকায়।
Deleteকম্ফর্ট রিড হয়ে উঠতে পারার গরিমার আঁচ পোহালাম। বসে আঁকো ইমিডিয়েটলি ব্যান করা উচিত।