Bondhu: কুণাল সেন




অর্চিষ্মানের জন্মদিনের আগের দিন পৌঁছল তিন্নির পাঠানো কেক। পরের দিন 'বন্ধু'। অ্যাকচুয়ালি, 'Bondhu'। বইটা ইংরিজি, কিন্তু বইয়ের নাম বন্ধু-র ইংরিজি 'ফ্রেন্ড' নয়। কারণ 'বন্ধু' এখানে একটা নামবাচক বিশেষ্য, প্রপার নাউন। যে নামে কুণাল সেন তাঁর বাবা মৃণাল সেনকে ডাকতেন।

'বন্ধু' তিনটি বিভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগ 'বন্ধু'। দ্বিতীয় ভাগ 'ফিল্মমেকার'। তৃতীয় ভাগ 'ফাদার'। একজন মানুষের জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ক্রোনোলজিক্যালি বলে যাওয়ার থেকে একেকটা দিকে একেকবারে আলো ফেলায় সে দিকটা অনেক ভালো করে আমাদের নজরে পড়ে। এ বিন্যাসের হয়তো অন্য কারণও ছিল। কুণাল সেনই লিখলেন নাকি অন্য কোথাও পড়লাম - তৃতীয় প্রজন্ম পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে আমরা অধিকাংশই সম্পূর্ণ বিস্মৃত হব। ঠিকই। ঠাকুরদার মায়ের শুধু নাম জানি, চপলা। আর একটা ছবি। আর একটা গল্প। একটাই গল্প। বরিশালের মাঠে তরোয়াল চালাতে চালাতে এক যাত্রাভিনেতার তরোয়ালশুদ্ধু স্টেজ থেকে ভদ্রমহিলার কোলে পড়ে যাওয়ার গল্প। ঠাকুমাও কিছু গল্প বলেছেন বটে কিন্তু সে সবই অত্যাচারিত বউমার পার্স্পেকটিভ থেকে জাঁদরেল শাশুড়ির গল্প। নৈর্ব্যক্তিক সোর্স থেকে জানা গল্প ওই একটি।

যেটা বলতে চাইছি যে বায়োগ্রাফির ক্লাসিক স্টাইলে মৃণাল সেনের জীবনের গোড়া থেকে শুরু করে লিখতে গেলে পারম্পর্যে ফাঁক পড়তে পারত। তাছাড়া 'বন্ধু' গতানুগতিক অর্থে যাকে জীবনী তাও তো নয়। একজন ছেলের বয়ানে পিতার স্মৃতিচারণ। সে স্মৃতিচারণে সেই পিতা, বা 'বন্ধু'র, খ্যাতির দিকটিও যেমন উঠে এসেছে, তেমনই উঠে এসেছে একজন মানুষের অন্তরপুরের দৃশ্যাবলী।

সে দৃশ্যাবলীর টানেই বইটা পড়তে বসা। একজন বিশ্বমানের বাঙালির বিহাইন্ড দ্য সিনস্‌ সম্পর্কে কৌতূহল। উইকিপিডিয়া পেজ এবং বিখ্যাত উত্তরসূরীদের ইন্টারভিউ থেকে পাওয়া তথ্য ও মিথের অতিরিক্ত কিছু তাঁর নিকটতম মানুষের কলম থেকে জানার উৎসাহ।

উৎসাহ আশাতীত তৃপ্ত হয়েছে। কারণ এ ধরণের 'নন-জীবনী' সফল ভাবে লিখতে গেলে তথ্যকেন্দ্রিকতা, নৈর্ব্যক্তিকতা, সত্যমুখিতা ইত্যাদি ব্যতিরেকে একটি বিশেষ স্কিল প্রয়োজন হয়। কুণাল সেন বইয়ের ভূমিকাতে যেটাকে "স্টোরিটেলিং" বলে চিহ্নিত করেছেন এবং যে স্কিল কুণাল সেনের দরকারের বেশি বই কম নেই।

নাকতলার বাবাও 'বন্ধু' পড়েছেন। তিন্নি বলল, "হুস্‌ হুস্‌ করে"। বাবার সঙ্গে ঝাণ্ডা উড়িয়ে একমত, বইটা পড়লে মৃণাল সেনের থেকে কুণাল সেনের প্রতি বেশি আগ্রহ জাগে। সেটার একটা কারণ হতে পারে যে মৃণাল সেন কী বা কেন অল্প হলেও আমরা অবগত ছিলাম, কিন্তু 'বন্ধু' কুণাল সেনকে এমন এক আশ্চর্য উজ্জ্বলতায় দাঁড় করায় যা অধিকাংশ বাঙালির কাছেই অজানা বলে আমার ধারণা।

কুণাল সেনের ক্ষমতার পরিচয় পেতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হবে না। একদম শুরুতে শৈশবের একটি ঘটনার স্মৃতিচারণা করছেন তিনি। কলকাতা শহরের শীতের ভোর। শেষরাতও বলা যেতে পারে। মৃণাল সেন ছেলেকে ঘুম থেকে তুলছেন, গীতা সেন সোয়েটার টুপি পরিয়ে দিচ্ছেন, তারপর মৃণাল সেন ছেলেকে নিয়ে ফার্স্ট ট্রামে চড়ে ময়দানে যাচ্ছেন। ঘোর কুয়াশা। হাত ছেড়ে দিয়েছেন মৃণাল সেন, কুণাল বাবাকে দেখতে পাচ্ছেন না, ভয় পেয়ে "বন্ধু" বলে ডেকে উঠছেন, আর অমনি মৃণাল সেন, এই তো আমি, বলে এসে পড়ছেন।

জায়গাটা পড়লে কুয়াশা, শীতের শেষ রাতে কলকাতার গলি, দূর থেকে আসা ফার্স্ট ট্রামের ঘটাং ঘটাং, কুয়াশা সব শুনতে, দেখতে পাওয়া যায়। স্মৃতিচারণাটি ভালো লেখার "ইভোকেটিভ" গুণে গুণান্বিত তো বটেই, জীবনীকেন্দ্রিক লেখার পক্ষে একটি চরম দরকারি গুণেও। পারিবারিক পরিসরে ঘটা এই একটিমাত্র ঘটনা থেকে আমরা মৃণাল সেন নামের মানুষটির একটি মোক্ষম ছবি দেখতে পাই। একজন সংসারী মানুষ, একজন বাৎসল্যময় মানুষ, একজন অ্যাডভেঞ্চারাস মানুষ এবং সর্বোপরি একজন অরিজিন্যাল মানুষ।

কিছু গল্প চেনা। সেই যে গীতা সেন ভাতের জল বসিয়েছেন, মৃণাল সেন চাল কিনতে বেরিয়েছেন। গীতা সেন জল চাপিয়ে বসে আছেন। এদিকে বন্ধু এসে ফাঁস করে দিয়েছেন যে মৃণাল সেন চালটাল কিছু কিনতে যাননি, আড্ডা মারছিলেন। তারও বেশ কিছুক্ষণ পর বাড়ি ফিরে এসে মৃণাল সেন যখন খুব বলছেন যে অনেক খুঁজেও চাল জোগাড় করা যায়নি ততক্ষণে গীতা সেন জলটল ফেলে দিয়ে উঠে পড়েছেন।

অজানা গল্পও আছে। গীতা সেন যে উত্তরপাড়া ভদ্রকালীর মেয়ে (অতএব অনুপকুমারও যে উত্তরপাড়া ভদ্রকালীর ছেলে) জানা ছিল না। স্কুলের অর্ধেক মেয়ের বাড়ি ছিল ও পাড়ায়। নাটক করতে উত্তর কলকাতায় যেতেন গীতা সেন। বাসভাড়া থাকত না, হেঁটে উত্তরপাড়া ফিরতেন, সঙ্গে নাটকের দলের কেউ না কেউ থাকত। মৃণাল সেনও থাকতেন কোনও কোনও দিন।

গল্প বলার ক্ষমতা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন কুণাল, বইয়ের গোড়াতেই সে কথা স্বীকার করেছেন। রসবোধও। সেটা অবশ্য উনি লেখেননি, পাঠকের কাছে আপসেই স্পষ্ট। 'বন্ধু'র ছত্রে ছত্রে অনুচ্চকিত ও রুচিপূর্ণ হিউমার। মৃণাল সেনের রসবোধ অসামান্য ছিল, জমিয়ে গল্প বলতে পারতেন। এমন সব গল্প যেখানে হাসির পাত্র তিনি নিজে। যেমন ধরা যাক, মৃণাল সেনের কোনও একটা সিনেমা প্রকাশ পেয়েছে (মনে হচ্ছে ভুবন সোম, কিন্তু এই ঠাণ্ডায় লেপ থেকে বেরিয়ে ওই ঘর থেকে বই এনে কনফার্ম করতে ইচ্ছে করছে না)। সমস্ত স্রষ্টার মতোই মৃণাল সেনও উন্মুখ হয়ে রয়েছেন ফিডব্যাকের আশায়। আমি কোনার্ক ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখে ঘণ্টায় চারবার চেক করি কমেন্ট পড়ল কি না, মৃণাল সেন একটা আস্ত তাও ওই লেভেলের সিনেমা বানিয়ে ফিডব্যাকের জন্য উন্মুখ হবেনই। এই প্রসঙ্গে কুণাল সেন লিখেছেন যে বিখ্যাত হওয়ার আগে যদি বা সৎ ফিডব্যাকের আশা থাকে, বিখ্যাত হওয়ার পর সে আশা সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দেওয়াই ভালো। সবাই ভালো বলতেই ব্যস্ত। সে রকম অসৎ ফিডব্যাকও আসছে না। মৃণাল সেন অসহিষ্ণু ও মরিয়া। এমন সময় বাড়িতে একজন পরিচিত লোক এলেন। সবাই জানে যে তিনি 'মৃণাল সেন সুলভ' সিনেমার ধারকাছ ঘেঁষেন না।

এই ভদ্রলোক হয়তো 'ভালো লাগে না' বা 'বুঝতে পারি না' যুক্তিতে ওই ধরণের সিনেমা দেখতেন না, আমি এমন একজনকে চিনতাম যিনি নীতিগত ভাবে অ্যাওয়ার্ড উইনিং সিনেমা দেখতেন না। এমনকি যে পরিচালকের একটিও সিনেমা জীবনে একটি ফিল্মি পুরস্কারও পেয়েছে - ভেনিস, লোকার্নো, কান, কানাইপুর - সে পরিচালককে আজীবনের মতো দ্রষ্টব্যের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দিতেন।

সেনবাড়ির পরিচিত ভদ্রলোক ব্যানার্জিবাড়ির পরিচিত ভদ্রলোকের মতো গেরিলা ছিলেন না। তিনি সিনেমাটা দেখেছিলেন। মৃণাল সেন জানতেন যে ইনি তাঁর টার্গেটেড অডিয়েন্স নন। তবু নেই মামার থেকে কানা মামা ভালো লজিকে তাঁর কাছেই জানতে চেয়েছিলেন সিনেমাটা ভদ্রলোকের কেমন লেগেছে। ভদ্রলোক শরীরের সমস্ত ডিপ্লোমেসি খরচ করে বলেছিলেন, আমার কিন্তু অত খারাপও লাগেনি।

আরেকটা গল্প এখনও মনে পড়লে একা ঘরে মুচকি হেসে ফেলছি। একবার সেনপরিবার একটি ভাড়াবাড়িতে উঠে যান যার সমীপে একটি বালিকা বিদ্যালয় ছিল। এ বাড়িতে ফিল্মি লোকজন আসে এই খবর ছড়ানোর পর টিফিন হলেই বিদ্যালয়ের সবক'টি জানালার শিক ধরে বালিকারা ওঁদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। অনেকদিন দাঁড়িয়ে থাকার পর যখন কোনও তারকাকেই দেখা গেল না, জানালা ক্রমে ফাঁকা হয়ে গেল।

মৃণাল সেন শহুরে মানুষ ছিলেন। গ্রাম্য, শহুরে এই শব্দগুলোর অনেক রকম দ্যোতনা হয়। এখানে শহুরের দ্যোতনা হচ্ছে মৃণাল সেন শহর পছন্দ করতেন। শহরের জনবাহুল্য, জ্যামজট, ক্যাঁচরম্যাঁচর উপভোগ করতেন এবং না পেলে মিস করতেন। স্ক্রিপ্ট লেখার জন্য নির্জন জায়গায় যাওয়ার অ্যাটেম্পট নিয়েছিলেন, সে নিয়েও মজার গল্প আছে। সারাদিন কোটি কোটি লোক বাড়িতে এসে আড্ডা মারত। মৃণাল সেন আড্ডা খুবই পছন্দ করতেন কিন্তু আড্ডার চোটে কাজ করার সময় হত না। ভোর চারটেয় উঠে কাজে বসতেন। কুণাল সেন লিখছেন, তাতেও সুবিধে হত না কারণ কাজ থামিয়ে তাপস সেনের সঙ্গে একটি দীর্ঘ ফোন-আড্ডা চলত। বিশুদ্ধ বাঙাল ভাষায়। ততদিনে মৃণাল সেন পৃথিবীর সবার সঙ্গে নদীয়ার বাংলায় কথা বলতে শুরু করেছেন, খালি তাপস সেনের সঙ্গে ওই সকালবেলার আড্ডাটার জন্য বাঙাল তুলে রেখেছেন। ওয়ার্ম ফাজি ফিলিং হয়েছিল, মানছি।

বালক কুণালের পড়ার জায়গা ছিল ওই বসার ঘরেই। পড়তে বসে যাবতীয় আড্ডা কানে ঢুকত। পড়ায় বিঘ্ন ঘটার ব্যাপারটা অগ্রাহ্য করে কুণাল সেন সে সব আড্ডার স্মৃতিতে প্রশ্রয়ই পোষণ করেছেন। স্বাভাবিক। বিশ্বের দরজা খুলে যাচ্ছে, বিভিন্ন বিষয়ে বৌদ্ধিক আদানপ্রদান কানে ঢুকছে আর আড্ডার ফুর্তি তো আছেই। সব থেকে বড় কথা, সার্বিক আড্ডার চরিত্র এবং আড্ডার আঁশ ছাড়ালে আলটিমেটলি মনুষ্যচরিত্র সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা গড়ে উঠছে।

আমরা আকছার দুটো সময়কে পাশাপাশি তুলনা করি। এই সময়ের লোককে ওই সময়ের নিরিখে বিচার করি। দাবি করি গ্লোবালাইজেশনের আগে মানুষের কোয়ালিটি বেটার ছিল, মার্ক জুকারবার্গ না জন্মালে অধিকাংশ মানুষ দেবতা হত। শেফালি জরিওয়ালার 'কাঁটা লাগা'-র ভিডিওর নিচে নাইন্টিজ কিডজ্‌রা নিয়মিত আছাড়িপিছাড়ি খান। দোজ ওয়্যার দে ডেজ, নো ফোন, নো ইনস্ট্যাগ্রাম, নো পলিটিক্যাল কারেক্টনেস, নো ফেকুলার ফেমিনিস্টস, ওনলি গুড মিউজিক অ্যান্ড মাম্মি কা হাথ কা খানা।

এটা মানতে লোকের বুক ফেটে যায় যে ঝামেলাটা ইন্সটাগ্রামের নয়, মানুষের। আর ইন্সটাগ্রামের লোগো মাসে মাসে আপডেট হলেও মানুষ একশো বছরেও আপডেট হয় না, কাজেই রক হয়ে যায় ফেসবুক, স্কেলটা খালি ওয়ার্ল্ডওয়াইড। বাঙালি সিনেমার সেই স্বর্ণযুগেও লাগানিভাঙানি, ঘোঁটপাকানি প্রবল ছিল। কুণাল সেন লিখেছেন, তাঁদের বাড়ির বসার ঘরে কিছু লোক এসে জানেন তো অমুক চিত্রপরিচালক আপনার নামে এই বলেছেন, তমুক চিত্রপরিচালকের চ্যালারা আপনার চ্যালাদের নামে এই বলেছে, সারাদিন চালিয়ে যেতেন। কুণাল সেন নিশ্চিত, উল্টোদিকেও অবিকল এই নাটক চলত। কে জানে এই লোকগুলোই করত কি না।

রবীন্দ্রনাথ নাকি শেষ বয়সে লিখে গিয়েছিলেন, খ্যাতি প্রেতের অন্ন। যত খ্যাতি বাড়ে, পরগাছা বাড়ে। তত ক্ষীণ হয় সমমনস্ক, সমরুচির মানুষদের সঙ্গে কথা বলার স্কোপ। যত স্তাবক বাড়ে তত বন্ধুরা আড়ালে চলে যায়। শিখরে একাকীত্বের শীতলতা প্রবল। একবার কথোপকথনের সময় মৃণাল সেন সত্যজিৎকে একটা প্রশ্ন করেছিলেন। কথোপকথনটা নিশ্চয় বাংলায় হয়েছিল, কিন্তু যেহেতু 'বন্ধু'তে কুণাল সেন ইংরিজিতে লিখেছেন কাজেই আমিও ইংরিজিতেই লিখছি। মৃণাল সেন সত্যজিৎকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ডোন্ট ইউ ফিল লোনলি? সত্যজিৎ উত্তর দিয়েছিলেন, টেরিব্‌লি সো।

কুণাল সেন লিখেছেন, একটা বয়সের পর তিনি তাঁর বাবাকে এই বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন করেছিলেন। কাদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন তিনি? কাদের জায়গা দিচ্ছেন? এঁরা তো কেউ বুদ্ধিতে, চিন্তায় তাঁর নখাগ্রও নয়। স্রেফ প্রতিফলিত মহিমায় মহিমান্বিত হতে ঘুরঘুর করছে।

কাকে সময় দেব আর কাকে দেব না, দাম্ভিক শুনতে লাগলেও, টপ থ্রি লাইফ স্কিলের একটা। ও জিনিস আয়ত্ত না করতে পারলে দুঃখ আছে। মৃণাল সেন বিশ্বমানের ছিলেন, তাকে ঘিরে ভনভনানিও সেই লেভেলের ছিল। পাড়া লেভেলের হরেদরেদেরও এই বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত বলে আমার ধারণা।

সেনপরিবারের জীবনযাপন নিরাভরণ ছিল। এক্ষুনি লাফিয়ে পড়ে কেউ না কেউ বলবে আভরণ নিরাভরণ আপেক্ষিক। আম্বানির মেয়ের বিয়ের বাজেট আমার কাছে অশ্লীল হলে আমার বিয়ের বাজেটও অগুন্তি লোকের কাছে অশ্লীল। হক কথা। তা সত্ত্বেও, এ বিষয়টায় কিছু শব্দ খরচ করছি।

ভাড়াবাড়ির এককামরার ফ্ল্যাট, বসার ঘরে কুণাল সেন পড়ছেন, মৃণাল সেন কাজ করছেন, সারাদিন আড্ডা চলছে। এমনকি কুণাল সেন যখন বড় হয়ে গেছেন, বান্ধবী আসছে বাড়িতে, দুজনকে প্রাইভেসি দিতে একটিমাত্র শোওয়ার ঘর দুজনকে ছেড়ে দিচ্ছেন গীতা ও মৃণাল। বড় বাড়িতে উঠে যাওয়ার কথা উঠছে, টাকা জমানো হচ্ছে, যতদিনে টাকা জমছে ততদিনে মনোমত বাড়ির দাম বেড়ে যাচ্ছে।

আমি ঘটনাটাকে গ্লোরিফাই করছি না। বড় বাড়ি থাকলে, আলাদা কাজের ঘর থাকলে কে বলতে পারে মৃণাল সেন হয়তো আরও বেশি, আরও ভালো সিনেমা বানাতে পারতেন, বিশ্বের দরবারে বাঙালির মুখ আরও উজ্জ্বল করতে পারতেন। যেটা পয়েন্ট আউট করছি সেটা হচ্ছে প্রায়োরিটির মইতে টাকার অবস্থানের কথা। ইউটিউবের বাংলা সিনেমার রিভিউ চ্যানেলগুলোর প্রতিটিতে দশম অবতার, রক্তবীজের দুটো করে রিভিউ ভিডিও আপলোড হয়েছে (ট্রেলার ভিডিও আর প্রোমোশনাল ভিডিও বাদ দিয়ে)। তেরো মিনিট সতেরো সেকেন্ডের প্রথম ভিডিওতে সিনেমাটা কেমন হয়েছে, পরিচালনা আকাট না মূর্খ, লাইট স্ট্রোব না বাউন্স, সাউন্ড সিংক না ডাবিং, গল্প ঢিলে না টানটান, অভিনয় ভালো না বস্তাপচা, ডায়লগ চালাক না ওপরচালাক, সে সবের তুল্যমূল্য আচারবিচার। পরের দিন একটা নতুন ভিডিও-য় সতেরো মিনিট তেরো সেকেন্ড ধরে দুটো সিনেমার কালেকশন নিয়ে ডিপ ডাইভ। সোশ্যাল মিডিয়া, ইন্টারভিউ, নিউজ পোর্টালে পরিচালকদর একে অপরের নাম না নিয়ে ও নাম্বার ভাঁড়িয়েছে, এ হাউসফুল শো-এর সংখ্যা বাড়িয়েছে মর্মে চুলোচুলি তো ছেড়েই দিলাম।

আবার কথা উঠবে। সিনেমা একটা রিসোর্স-ইনটেনসিভ শিল্প। একজন টাকা দিয়েছেন, তাঁর টাকা উদ্ধার করে দেওয়াটা পরিচালকের কর্তব্য। সে সব মহৎ মোটিভেশনের কথা যদি বাদও দিই, স্রেফ দক্ষতা ভাড়া নিতে গেলেও বাজেট লাগে। হয়তো স্ক্রিপ্ট ও সংলাপের জন্য ট্রেইন্ড লেখক ভাড়া নেওয়ার ক্ষমতা নেই বলে গল্প এ রকম ছেতরে যায়, ডায়লগ শুনলে 'ছেড়ে দে মা' ভাব হয়। ভুল বানানওয়ালা বই ছেপে বেরিয়ে যায়, হয়তো কোয়ালিফায়েড এডিটর বেশি টাকা চায় বলে।

আবার সেটা যদি হত তাহলে সব একশো কোটির সিনেমাই বসে দেখা যেত। ঝাঁ চকচকে বেস্টসেলার বই দু'পাতা পড়ে "গড়পাড়ের ছেলে, তুমি দ্যাখালে ভায়া" বলে উঠে পড়তে হত না। আবারও চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের কথা টুকে বলতে হয়, বোকা লোককে ডবল টাকা দিলে সে বুদ্ধিমান সিনেমা বানাবে না, ডবল বোকামো করবে। কাজেই টাকার সঙ্গে যেমন গুণমানের সম্পর্ক আছে তেমন আবার নেইও। টাকার অভাব অন্য কিছু দিয়ে চাপা দেওয়া না গেলে বুদ্ধির দৈন্যও টাকা দিয়ে চাপা দেওয়া যাবে না।

উঁচু মানের বুদ্ধির চর্চা, সংস্কৃতিচর্চা যারা করেছেন তাঁরা কেউই টাকাকে মাথায় বসাননি। হৃষীকেশ মুখার্জি (যদিও তিনি পরে বম্বে গিয়ে বিস্তর টাকাপয়সা করেছিলেন), তাপস সেন, মৃণাল সেন, নৃপেন গাঙ্গুলি, এবং আরও সমসাময়িক সহশিল্পীরা দলে দলে দুনিয়াদারির তোয়াক্কা না করে বাঁচছে, কী খাবে, চাকরি কী পাবে নিয়ে বিলকুল মাথা ঘামাচ্ছে না, এটা কী করে সম্ভব? কুণাল নিজেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। ব্যক্তিগত প্রোগ্রামিং একটা ফ্যাক্টর বটেই। রিস্ক, সিকিউরিটি ইত্যাদি শব্দের মানে প্রত্যেকের কাছে আলাদা আলাদা। কুণাল সেন আরেকটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সকলেই যেহেতু সময়ের সন্তান, হয়তো গোটাটাই এঁদের ব্যক্তিগত খেয়াল না। এঁদের প্রত্যেকের একটা বিশেষ রাজনৈতিক বিশ্বাস, আদর্শ কমন ছিল। পুঁজিকে পুজোর বেদীতে না বসানোর স্পর্ধা ছিল। সেই স্পর্ধা, সেই আদর্শটার থেকে সময়ের বিশ্বাস উঠে যাওয়াও কি কালেকশনের শেষ কথা হয়ে ওঠার একটা কারণ?

একটা লোককে দেখে সে কী রকম হবে সেটা নাকি মৃণাল সেন বলে দিতেন এবং সে আইডেন্টিফিকেশন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্ভুল হত। মৃণাল সেন নাকি এটাও বলতেন একজন পরিচালকের বাড়ির ভেতরটা দেখলে বলে দেওয়া যায় লোকটা কী ধরণের সিনেমা বানাবে।

লাইনটা পড়ে মাথায় টিং টিং বাল্ব জ্বলল। সপ্তাহকয়েক আগে ইউটিউবে একটি বাংলা পডকাস্ট দেখছিলাম। সমকালীন বাংলা সিনেমার একে সিরিয়াস তায় সফল পরিচালকের ইন্টারভিউ নিচ্ছিলেন, থুড়ি, পরিচালকের সঙ্গে আড্ডা মারছিলেন পডকাস্টার। কথায় কথায় তাঁর আসন্ন মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার কথা উঠল। যেটাকে মৃণাল সেনের একটি বাংলা সিনেমার সিকোয়েল বললেও বলা যেতে পারে। অরিজিন্যাল সিনেমার চরিত্রদের নিয়ে নতুন গল্প।

সিনেমা বানানোর সিদ্ধান্তের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে পরিচালক বললেন সমসাময়িক পরিচালকদের মতো বায়োপিকের নামে 'গো অ্যাজ ইউ লাইক' আয়োজন না করে (ঠিক এ ভাবে বলেননি) মৃণাল সেনের জন্মশতবর্ষে তিনি ইন্টেলেকচুয়ালি সুপিরিয়রতর (আবারও, প্যারাফ্রেজ) রাস্তায় হেঁটেছেন। এ সিনেমাটির মাধ্যমে সেনমহাশয়ের সামাজিক, রাজনৈতিক দর্শনকে হোমাজপ্রদানই তাঁর উদ্দেশ্য।

এত বুদ্ধি খরচ করে একজন একটা সিনেমা বানিয়েছে, সে সিনেমা আমার না দেখার প্রশ্ন ওঠে না। কেমন দেখলাম, সিনেমা মৃণাল সেনের দর্শন প্রতিফলিত হল কি না লিখতে বসলে আজও পোস্ট পাবলিশ করা যাবে না । বরং বাড়ির আকার ইজুক্যালটু সিনেমার প্রকার সংক্রান্ত মৃণাল সেনের স্টেটমেন্টটার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়টি নিয়ে বিলাবিলা করা যাক।

যদিও আড্ডা, একটুআধটু টাফ কোশ্চেন না করলে থাম্বনেলে রোমহর্ষক ফন্টে ক্লিকবেট দেওয়া যাবে না। পডকাস্টার জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা শুনলাম আপনি সম্প্রতি একটি খুব দামি বাড়িতে উঠে গেছেন, সে ব্যাপারে যদি কিছু বলেন।

প্রশ্নটা নতুন না। শিল্পীদের পয়সাকড়ি থাকা উচিত কি না, থাকলেও আপার লিমিট কত, বেশি বড়লোক হয়ে গেলে শিল্পীর সততা চোট খায় কি না, সমাজে শিল্পীর দারিদ্র্য ফেটিশাইজ করার প্রবণতা আছে কি না (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুমুহূর্ত বাংলা সংস্কৃতিশালায় মিথ হয়ে ওঠা যার বহুব্যবহৃত উদাহরণ) নিয়ে যুগে যুগে হইচই চলেছে।

নবারুণ ভট্টাচার্য গাড়ি চড়ে যাতায়াত করেন জেনে কেউ নাকি মন্তব্য করেছিল, এই তো অবস্থা, বিজন ভট্টাচার্যের ছেলে, মারুতি চড়ে ঘুরছে। নবারুণ বলেছিলেন, নাহ্‌, বিজন ভট্টাচার্যের ছেলে ঘেমেনেয়ে বাসেট্রামে ঝুলে ঝুলে ঘুরলে দারুণ হত।

অগ্রগণ্য পরিচালক জানালেন, তাঁর বিলাসী বাড়িতে শিফট করার উদ্দেশ্য হচ্ছে নতুন ছেলেমেয়েদের ফিল্ম পরিচালনায় আসতে উদ্বুদ্ধ করা। অর্থাৎ ভবিষ্যতের যে সব সম্ভাবনাময় পরিচালক, যাঁরা বাংলা সিনেমার নতুন ভাষা তৈরি করবেন, ফ্রন্টিয়ার ভাঙবেন, বিশ্বের দরবারে বাংলা সিনেমার হৃত মহিমা পুনরুদ্ধার করবেন তাঁরা যদি নার্ভাস বোধ করেন যে সিনেমা বানাব? যদি সাউথ সিটিতে ফ্ল্যাট না কিনতে পারি? নাহ্‌, তার থেকে এম বি এ-ই পড়তে যাই। নয়তো আই টি।

যাকগে মরুকগে। মৃণাল সেনের একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, যা 'বন্ধু' না পড়লে আমি জানতে পারতাম না, সেটার বিষয়ে বলে পোস্টটা শেষের দিকে নিয়ে যাই। বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছে, নিজের অসাধারণত্ব সম্পর্কে নিজের ধারণা থাকা। কুণাল সেন বলছেন, যখন কেউ চিনত না তখনও মৃণাল সেন জানতেন তিনি সাধারণ নন। যখন সত্যজিৎ রায় বিশ্বস্বীকৃত এবং মৃণাল সেনকে কেউ চেনে না তখনও তিনি সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার সমালোচনা করেছেন। ঘটনাটাকে শুধু সেলেব্রিটির সমালোচনা করার উপমা দিলে আজকের যুগে ব্যাপারটার খুব একটা দাম থাকবে না। কারণ আজকাল নিন্দে করার জন্য কোনও ক্রেডেনশিয়াল লাগে না। আমিও সবার নিন্দে করে বেড়াই। এই যে আগের প্যারায় করলাম। করলাম কারণ আমার একটা আনলিমিটেড ইন্টারনেট কানেকশন আছে, ব্যস্‌। তখন নিন্দে করতে গেলে গম্ভীর পত্রিকায় সারবত্তাসম্বলিত প্রবন্ধ লিখতে হত, তাও আবার কে বলতে পারে হয়তো ইংরিজিতে। সে সাহসের সঙ্গে আজকালকার সমালোচনার সাহসের তুলনা করা যায় না।

যদি ধরেও নিই সিনেমা সম্পর্কে মৃণাল সেনের পড়াশোনা, ব্যুৎপত্তি ছিল বলে সত্যজিৎ রায়কে ইনটিমিডেটিং লাগেনি, কুণাল সেন জানিয়েছেন জীবনের সব ক্ষেত্রেই এই আত্মসচেতনতার ছাপ পড়ত। ফোন সারানো, ইলেকট্রিকের সমস্যা, রোজকার জীবনযাপনের দিনরাতেও মৃণাল সেন কখনও নিজেকে বিস্মৃত হতেন না এবং সেটা "মৃণাল সেন" হয়ে ওঠার অনেক আগে থেকেই। কুণাল স্বীকার করেছেন, এই কনফিডেন্স কোথা থেকে আসে তিনি জানেন না।

আমার সন্দেহ (এবং মনখারাপ) এ জিনিস নিয়ে জন্মাতে হয়। বহির্জগতের ভ্যালিডেশন বা জাজমেন্টের ভরসায় না থেকে আমি কী সেটা নিজে জানা। এ জিনিস বিরল। বেশিরভাগ মানুষই জঙ্গলের অলৌকিক গাছের মতো, কেউ দেখলে আছে, না দেখলে নেই। কেউ হাততালি দিলে আমি ভালো, হাততালি না দিলে পাতে দেওয়ার অযোগ্য, এ থেকে মুক্ত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা সব ভুক্তভোগীই জানে। চাইলেই সে মুক্তি পাওয়া যায় কি না অধিকাংশ ভুক্তভোগীরই অজানা।

'বন্ধু' পড়ার ফাঁকে ফাঁকে অ্যানি আর্নোর 'Happening'-ও পড়া চলছিল। নিজের জীবনের একটা ঝঞ্ঝাবাত সময়ের কথা লিখতে বসে আর্নো লিখছেন, 

"When I write, I must guard against lyrical outbursts such as anger or pain. I would not want crying and shouting to feature in this text because they barely featured in my life at the time. Above all I wish to capture the impression of a steady row of unhappiness, conveyed by a pharmacist’s inquisitive attitude or the sight of a hairbrush by a steaming basin of water. The distress I experience on recalling certain images and on hearing certain words is beyond comparison with what I felt at the time: these are merely literary emotions; in other words they generate the act of writing and justify its veracity."

কুণাল সেনের ভাষা লিটারেরি ইমোশন বর্জিত। কেউ বলতে পারে হয়তো রক্তমাংসের জীবনের কথা, নিজের চোখে দেখাশোনা ঘটনা লিখছেন বলেই কাগুজে আবেগের আশ্রয় নিতে হয়নি। হয়তো বানানো চরিত্রের ইমোশনও বানিয়ে লিখতে হয়।

আমার তা মনে হয় না। আমরা অধিকাংশ সময়ে নিজের জীবনটাকেও বানানো জীবনের মতো করেই বাঁচি। লেখাটেখা দূর অস্ত, প্রেম, দুঃখ, শোক, ঈর্ষা সৎভাবে অনুভবই করি না। নাটকনভেল থেকে টুকে কাজ চালাই। আর যদি ফিলই না করতে পারলাম লিখব কী করে। যাঁরা পারেন তাঁরা ওই জন্য অর্ডিনারি নন, এক্সট্রাঅর্ডিনারি।

'বন্ধু'র ছত্রে ছত্রে লেখকের এক্সট্রাঅর্ডিনারি জীবনবোধ, বুদ্ধি, দৃষ্টির ছাপ। এবং মায়ার। জীবনাশ্রয়ী সাহিত্যের ক্ষেত্রে সততার প্রসঙ্গটা ওঠেই। সঙ্গে সঙ্গে নির্মমতার প্রসঙ্গ। সততার সঙ্গে সামহাউ সর্বদাই একটা নেগেটিভ আবেগের ধ্বজা ওড়ে। নির্মম সত্য। ব্রুটাল অনেস্টি। অভিজ্ঞতায় দেখেছি যাঁরা নিজেদের সততায় ইমপ্রেসড, নির্মমতার প্রতি তাঁদের চোরাগোপ্তা টান আছে। অনেস্টির থেকে ব্রুটালিটির ভাগটাই যেন বেশি।

এইখানেও কুণালের দৃষ্টি আশ্চর্য উজ্জ্বল উদ্ধার। একবারও যেমন তিনি তাঁর চারপাশের মানুষদের দেবতা করে তোলার চেষ্টা করেননি, তাঁদের প্রতি কোনওরকম নালিশও ফুটে বেরোয়নি। নেই বলেই বেরোয়নি, ও জিনিস চাপা দেওয়া যায় না। কাছের লোকদের নিয়ে লিখতে গেলে পুজো বা নালিশ, দুটো অ্যাভয়েড করাই কঠিন। 'বন্ধু'-তে মৃণাল সেনের রুথলেস নাস্তিকতার কথা যেমন এসেছে, বাড়ির লোকের বিশ্বাসে হস্তক্ষেপ না করার তাঁর প্রাণপণ চেষ্টার কথাও। ছোটবেলায় পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে কুণালের সরস্বতীপুজোর অ্যাডভেঞ্চার, রাত্রিজাগরণের অ্যাটেম্পট এবং সে বিষয়ে বাবাছেলের একটি অসামান্য আদানপ্রদানের স্মৃতিচারণ আছে। একজায়গায় কুণাল লিখছেন, তিনি কৃতজ্ঞ যে মৃণাল সেন কোনও মত চাপিয়ে না দিয়ে ছেলেকে নিজের মতো, নিজের মতে অবিশ্বাসী হয়ে ওঠার সুযোগ দিয়েছেন। সবসময় যে এই চেষ্টায় সফল হতে পেরেছেন তাও নয়। বাড়িতে এক বছর সরস্বতীপুজোর সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েও, শেষটায় সুসজ্জিতা সরস্বতীর ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট গুঁজে দেওয়ার রসিকতার লোভ সামলাতে পারেননি। কাছের লোকেরা কষ্ট পাবেন জেনেও। আবার এই মৃণাল সেনই, বহু বছর পর রাশিয়ায় গিয়ে যখন দেখছেন স্তালিনের মূর্তির মুখে অবলীলায় সিগারেট গুঁজে দিচ্ছে নতুন প্রজন্ম, টলে যাচ্ছেন। এই দ্বন্দ্বগুলোর কথা কুণাল লিখছেন কিন্তু বিচারের দাঁড়িপাল্লা নিয়ে বসছেন না। মৃণাল সেন অগোছালো ছিলেন, গীতা সেনের দু'দণ্ড বিশ্রামের নিভৃতি ছিল না, গীতা সেনের প্রথাগত শিক্ষার খামতি, ইংরিজি বলতে না পারা নিয়ে চাপা টেনশনের প্রসঙ্গ যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে গীতা সেনের শৈল্পিক বুদ্ধি ও সংবেদনশীলতার প্রতি মৃণাল সেনের অটল শ্রদ্ধার প্রসঙ্গ। বোঝা যায়, কী অসম্ভব ভালোবেসেছেন কুণাল সেন এই দুটি মানুষকে। এতই ভালোবেসেছেন যে তাঁদের অস্তিত্বের খরখরে, অমসৃণ দিকগুলো তুলে ধরতে  একটুও অস্বস্তিতে ভোগেননি।

'বন্ধু'র শেষ পাতাগুলো পড়ছিলাম সকাল ছ'টা নাগাদ। দিন ছোট হতে শুরু করেছে, বাইরে আলো ফোটেনি। গীতা সেন শেষ শয্যায়, মৃণাল সেনকে জরা গ্রাস করেছে। দ্রুত ফুরিয়ে আসছে বর্ণময়, দীর্ঘ, একনিষ্ঠ পার্টনারশিপ অথচ সে ভাঙন টেরও পাচ্ছেন না আরেকজন। ওই জায়গাটা পড়ে হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। কত কিছু যে টেকেন ফর গ্র্যান্টেড নিয়েছি, নিচ্ছি প্রতিমুহূর্তে। গীতা সেন চলে যাওয়ার পর মৃণাল সেনের শেষের কয়েক বছরের অসীম একাকীত্ব, তারপর সেটাও ফুরিয়ে গেল। সব কাজ সেরে ফিরে শিকাগোর বাড়ির চাবি খুলে ঢোকার পরের মুহূর্তটা জাস্ট দুটো বাক্যে বর্ণনা করেছেন কুণাল সেন। ওহ্‌।

আলো কখনওই নিজের দিকে ঘোরাননি, কিন্তু ছোট ছোট ঘটনার মাধ্যমে কুণাল সেনের শৈশব, বড় হয়ে ওঠা, দেশছাড়া, দীর্ঘ প্রবাস মিলিয়ে 'বন্ধু'তে তাঁর জীবনের একটা আউটলাইন ফুটে উঠেছে। তাঁর জীবনবোধ, মনন, চেতনার আভাসও। প্রবাসে পাড়ি দেওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই বাঁধন আলগা হচ্ছে। বন্ধুর সিনেমার প্রথম দর্শক এবং বিশ্বস্ত সমালোচক আর থাকছেন না। সম্পূর্ণ হওয়ারও হয়তো অনেক পরে ছবিগুলো দেখার সুযোগ হচ্ছে, দর্শকের মতো। বিখ্যাত ব্যক্তির সন্তান হিসেবে খ্যাতির সঙ্গে সম্পর্ক বিষয়েও আলোচনা করেছেন। লিখেছেন মৃণাল সেনের ইংরিজি ভাষ্যে বাঙালি টানের কথা। দীর্ঘদিন অ্যামেরিকায় থাকা সত্ত্বেও কুণাল সেন অ্যাকসেন্ট বদলানোর চেষ্টা করেননি, মনে হয়েছে আগের জীবনটার সঙ্গে একটা এলিয়েনেশন ঘটবে।

পড়ার দিনক'টা বইটা টেবিলই রাখা থাকত। টেবিলল্যাম্পের হলুদ বৃত্তের জাস্ট বাইরে। কাজের ভঙ্গি করতাম আর আড়চোখে মলাটের আউট অফ ফোকাস ছবিটার দিকে তাকাতাম। বইটা পড়তে পড়তে একটা বিষাদ ক্রমশঃ বাসা বাঁধছিল। একটা সময়। কয়েকটা লোক। আরও অনেক কিছু যা চিরদিনের মতো চলে গেছে। গো ওয়েন্ট গন। যত পায়ে ধরো, মাথা খুঁড়ে মরো, সে রকমটি আর হবে না।

আলোছায়ামাখা ছবিটার দিকে আড়চোখে তাকাতে তাকাতে আমি রিয়েলাইজ করলাম আরও একটা জিনিস হয় না এখন। বাঙালি পুরুষদের আর এ রকম দেখতে হয় না। এই চোখ। এই আত্মবিশ্বাস। এই দীপ্তি।

সেই থেকে অর্চিষ্মানকে জপাচ্ছি, ধুতি অবধি না যাও, অন্ততঃ বাঙালি পাঞ্জাবী, প্রেফারেবলি সাদা, আঁকাজোকা গদ্যপদ্য বিহীন, পরা শুরু কর। হাতা গুটিয়ে। আপাততঃ জিনসের ওপরেই পরো। ধাতে সয়ে গেলে ধুতিতে না হলেও পাজামায় শিফট করতে পারো। আমিও শাড়িতে শিফট করে যাচ্ছি। হ্যান্ডলুমটুম না, রিষড়া বাজারের তনুশ্রী বস্ত্রালয়ের শাড়িতে। আঁকাজোকা গদ্যপদ্য বিহীন।

'বন্ধু' পড়িয়ে তিন্নি যে লেভেলে পুণ্য করেছে, সে পুণ্যের ভাগ আমারও চাই। তাই চোঙা নিয়ে বিজ্ঞাপন করে বেড়াচ্ছি। আপনাদেরও বলছি। 'বন্ধু' একটি পড়ার মতো বই। না পড়লে চমৎকার একটা কিছু মিস হয়ে যাওয়ার মতো বই। ‘বন্ধু’ পড়ুন এবং পড়ান।

Comments

  1. বাঙালি পুরুষদের আর এ রকম দেখতে হয় না। - agreed, agreed.

    ReplyDelete
    Replies
    1. দুঃখবিষয়ক মিলে কি হাই ফাইভ দেওয়া চলে, অন্বেষা? আই গেস, লো ফাইভ মানাবে বেশি।

      Delete
  2. "আমার কিন্তু অত খারাপও লাগেনি" - এটা অসাধারণ!
    "তাঁর বিলাসী বাড়িতে শিফট করার উদ্দেশ্য হচ্ছে নতুন ছেলেমেয়েদের ফিল্ম পরিচালনায় আসতে উদ্বুদ্ধ করা" - এটাও ইকুয়ালি অসাধারণ।

    "লেখাটেখা দূর অস্ত, নিজের ইমোশন, প্রেম, দুঃখ, শোক, ঈর্ষা সৎভাবে অনুভবই করি না। নাটকনভেল থেকে টুকে কাজ চালাই।" - এটা নিয়ে লিখতে গেলে থিসিস হয়ে যাবে।
    তার থেকে কবিগুরুর কয়েকটা লাইন যেটা মনে আসল, যেখানে মনে হল হয়তো সৎ অনিভূতির কথা ফুটে উঠছে, সেটার সাহায্য নি:
    যে কথা ভাবি নি বলি সেই কথা,
    যে ব্যথা বুঝি না জাগে সেই ব্যথা,
    জানি না এনেছি কাহার বারতা
    কারে শুনাবার তরে।

    আর যেরকম লিখেছেন, সেটা এই বইটা পড়ার কৌতূহল জাগানোতে একশো শতাংস সার্থক। যে বইটা এখন পড়ছি, সেটা শেষ হাওয়া অবধি কৌতহলটা থাকলে, এই বইটা পড়া হয়ে যাবে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, রাজর্ষি। লাইনগুলো কী সুন্দর। কৌতূহল থাকলে বইটা পড়ে দেখতে পারেন, মনে হয় ভালো লাগবে। যদি পড়েন, জানাবেন কিন্তু।

      Delete
  3. "Terribly so" ---এটা সত্যজিৎ বাংলায় কী বলেছিলেন ভাবতে থাকলাম পড়ার পর থেকে। "তা তো বটেই " নাকি "ভীষণ" বা অন্য কিছু। অনেকদিন পর কিছু একটা পড়ার তাগিদ পেলাম আপনার রিভিউ পরে!!

    ReplyDelete
    Replies
    1. এক্স্যাক্টলি এই কথাটা আমিও ভেবেছিলাম, জানেন। তেমন সাহস থাকলে কুণাল সেনকে যোগাযোগ করে জানতে চাইতাম, বাংলা ভার্শানটা কী ছিল।

      বইটা পড়লে ভালোই লাগবে মনে হয়। জানাবেন।

      Delete
  4. "Terribly so" comment ta onekta bhabalo. Mrinal ar Satyajit goppo korchen bhabtei modhyobitto bangali self ta kirom hu hu kore othe.

    Boita porte hochche.

    ReplyDelete
    Replies
    1. 'বন্ধু' গোটাটাই আমাকে ভাবিয়েছে, বিম্ববতী। পড়লে জানিয়ো কেমন লাগল।

      Delete
  5. আমাদের ক্লাসের এক বন্ধু ছিল অনুপকুমারের তুতো ভাইঝি। ওদের বাড়ি গেছি অনেকবার, পরের দিকে একটা পেন্সিল স্কেচ করা অনুপকুমারের মুখ আঁকা থাকত ওদের নাটকের রিহার্সাল ঘরে। তোমার বই নিয়ে লেখার মধ্যে এইটা চরম লাগল, সত্যজিৎ রায় আর মৃণাল সেন গল্প করছেন এটা একটা দৃশ্য বটে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ও মা তাই বুঝি? কে রে? নাম বললে চিনব আমি?

      দৃশ্যের ব্যাপারটা ঠিকই বলেছিস। অরণ্যদেব আর ম্যানড্রেক গল্প করার ফিলিং দেয়।

      Delete
    2. বিদিশা দাস, চুল কোঁকড়া ছিল স্কুলে, হাই পাওয়ার চশমা। ওর দিদির নাম মোনালিসা দি, তোমাদের সিনিয়র ছিল। 😊

      Delete
    3. আবছা আবছা দুজনকেই মনে পড়ছে মনে হচ্ছে, জানিস।

      Delete

Post a Comment