নভেম্বর (২)



বাবা বললেন, জগদ্ধাত্রী পুজোতে আসিসনি অনেকদিন। নাকতলার মামার পঁচাত্তর বছরের জন্মদিন উদযাপনের দিনও ছিল কাছাকাছি। দুটো মিলিয়ে বাড়ি যাওয়া হল।

দুটোতেই ভালো জামাকাপড় পরার ব্যাপার আছে। আজকাল সাজের দিকে মন গেছে খুব। সাজ অর্থে টিপ। কুর্তা শাড়ি জিনস, বাকি শরীরে যাই থাকুক, কপালে একখানি টিপ ছাড়া বাড়ি থেকে বেরোই না। একটি নির্দিষ্ট রঙের, নির্দিষ্ট সাইজের টিপ। মা যেটা পরতেন। মায়ের মেয়ে হতে পারিনি। পারব না। আয়নায় আচমকা চোখ পড়ে গেলে যদি এক সেকেন্ডের জন্য নিজেকে বোকা বানাতে পারি সেই আশায় টিপ পরা।

টিপসর্বস্ব সাজের সুবিধে হচ্ছে ব্যাপারটা সরল ও সস্তা। সাজগোজের দাম নিয়ে কথা বলতে গিয়ে একবার বিপদে পড়েছিলাম। কসৌলি গেছিলাম। ফেরার পর অফিসে ফলাও করতে সহকর্মী হাহাকার করলেন। আগে বললে না? কসৌলিতে নাকি কসমেটিকসের কুটিরশিল্পের রমরমা। ওঁর কোন বন্ধু গিয়েছিল, গোটা মাসের মর্নিং অ্যান্ড নাইট বিউটি রুটিনের মালমশলা চারশো টাকায় কিনে এনেছে। যেটা দিল্লিতে এনি ডে চার হাজার।

যখনকার কথা তখন চুল কাটার সময় ঘনালে অর্চিষ্মানকে ধরি। তোমার নাপিত আমার চুল কেটে দিতে পারবে না? স্ট্রেট কাঁচি চালিয়ে দেওয়া তো। অর্চিষ্মান হিংসুটেমো করে। না কুন্তলা, পারবে না। শুধু সস্তার জন্য বলি না। যদিও সস্তাও একটা কনসার্ন। আমার নাপিত চুলে হাত দিলেই পাঁচশো টাকা। এক ইঞ্চি ছাঁটছি না ন্যাড়া হচ্ছি ম্যাটার করে না। টাকা দিতে গিয়ে দেখি বিল হয়েছে ছ'শো। পাঁচশো ফর ট্রিমিং, একশো ফর ব্লো ড্রাইং। একশো টাকা বেশি দেওয়ার থেকেও ছিঁচকেমোটা গায়ে লাগে।

অন্য কারণটা আরও জোরদার। পার্লারে গেলে নিজেকে যে রকম কুৎসিত মনে হয় তেমনটা আর জীবনে কোথাও মনে হয় না। আমি বলব, চুল কাটব। রং করাব না, ঢেউ খেলাব না। তাঁরা বলবেন, এই এবড়োখেবড়ো, দাগছোপ, ট্যাঁরাব্যাকা, এগুলোও সব এ রকমই এবড়োখেবড়ো, দাগছোপ, ট্যাঁরাব্যাকাই থাকবে? আমি গোড়ালি ঠুকে বলব, থাকবে থাকবে থাকবে। তাঁরা শ্রাগ করে, দুই হাত তুলে, চোখ ঘুরিয়ে কাঁচির খোঁজে যাবেন।

আমার ধারণা অর্চিষ্মানের সেলুনে, যার কাচের দরজার গায়ে উল্টোনো চাঁদের মতো করে লেখা 'বাবু সেলুন', সেখানের ভাইব অনেক পজিটিভ। সন্দেহ যে সত্যি সেটার প্রমাণ পেলাম যেদিন অর্চিষ্মান চুলদাড়ি কেটে হাসি হাসি মুখে ফিরল। বাবুর তিনজন পুত্রকন্যা, যাদের বয়স চার থেকে দশ, এমনিতে বিহারে থাকে, গরমের না কীসের ছুটিতে বাবার কাছে বেড়াতে এসেছে। অর্চিষ্মান বলল, যা মজার যদি দেখতে। বাবুর একজন সহকারী আছে। তার কাছে সবাই লাইন দিয়ে বসে নখ কাটছে। সহকারী খুব খেলিয়ে, নানারকম যন্ত্রপাতি মেলে বসে, ক্রিম, লোশনটোশন খুলে ছোট ছোট তিনজোড়া হাতের পরিচর্যা করছে আর নানারকম রসিকতা করছে। হাতের মালিকদের উত্তেজনা তুঙ্গে।

পার্লারে আর যাই না। নিজের চেহারা নিয়ে লো এস্টিমে ভুগতে নিজেই কাফি, টাকা দিয়ে লোক রাখার দরকার নেই। তার মানে এই নয় যে মাথায় জটা নিয়ে ঘুরছি। প্রসেনজিতের বোন কৃষ্ণা, নিয়মিত চুল ছেঁটে দিয়ে যায়। আমি দরজা খুলে ঘাড় তিনতলার দিকে তুলে 'কৃষ্ণা কৃষ্ণা' বলে পাড়া মাথায় করি, কৃষ্ণা ওপর থেকে ভদ্রস্থ গলায় বলে, 'হ্যাঁ দিদি'। আমি বলি, 'আজ টাইম হবে গো?' কৃষ্ণা অ্যাফার্মেটিভ নয় নেগেটিভে জবাব দেয়। অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময় হলে আমি চিরুনি আর পুরনো খবরের কাগজ সাপ্লাই দিই, ও ওর কাঁচি নিয়ে আসে। কৃষ্ণা বিউটি পার্লারের কাজের ট্রেনিং নিয়েছিল। এখন মাসাজ, ভুরু ছাঁটা ইত্যাদির ফ্রি ল্যান্স করে। চুল কাটার অর্ডার খুব একটা আসে না। ও খুব উত্তেজিত থাকে সে জন্য আমার চুল কেটে দেওয়ার অর্ডার পেলে। পারিশ্রমিক যা নেয় সেটা আর লজ্জায় বলছি না।

এত কথা বললাম প্রসাধন সংক্রান্ত খরচখরচাসংক্রান্ত আমার প্রায়োরিটি বোঝানোর জন্য। একবারও দাবি করছি না যে সবার এই প্রায়োরিটি থাকতে হবে। আমি যে রোজ পঞ্চান্ন টাকা দিয়ে নাট ক্র্যাকারের দুশো গ্রামের গোটা প্যাকেট একা সাঁটাই সেটা কারও প্রায়োরিটি না হতে পারে। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের প্রায়োরিটি আলাদা হওয়াই স্বাভাবিক। বুদ্ধির পরিচয় হচ্ছে অন্যের প্রায়োরিটিতে বিচলিত না হওয়া।

এখনও নই, দশ বছর আগেও বুদ্ধিমান ছিলাম না। সহকর্মীর প্রসাধনসংক্রান্ত খরচের প্রায়োরিটিতে বিস্ময় চেপে রাখতে পারিনি। চার হাজাআআআর! বলে চোখ কপালে তুলে ফেলেছিলাম। সহকর্মী আমার থেকে এককোটি গুণ স্মার্ট ও কুল, খোলা হেসে উঠেছিলেন। ওই টেবিলেই আরেকজন ছিলেন যিনি প্রায় আমারই মতো ইনসিকিওর এবং ডিফেন্সিভ। তিনি ধরেই নিলেন যে এইবার আমি "মুখে রংমাখা খারাপ, বই পড়া ভালো" নামের হাই হর্সে চড়ে হইহই করে আসব। মুখ মেঘের মতো করে বলে উঠেছিলেন, নিজেকে প্রেজেন্টেবল রাখতে গেলে এইটুকু খরচ নেসেসারি। ইফ ইউ আর কমফর্টেব্‌ল উইথ বিয়িং আনপ্রেজেন্টেবল তাহলে অবশ্য . . .

আরও যাও মনের ভাব মুখে প্রকাশ করতে। পারি না, কিন্তু জানি অধিকাংশ কনভারসেশনেই ইনভলভ্ড হওয়ার একমাত্র রাস্তা হচ্ছে টিফিনবাক্স খুলে খাওয়া আর মাথা ওপর নিচে ননকমিটাল নাড়া।

সেদিন বাড়ি ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। তারপর আরও কতবার দাঁড়িয়েছি। ব্রাশ করতে করতে, মুখ ধুতে, আয়না মুছতে বা নিজেকে দেখতেই। কোনওবার নিজেকে আনপ্রেজেন্টেবল মনে হয়নি। দিব্যি মানুষের মতো। দুটো কান, একটা নাক, ওষ্ঠাধর, দুটো ভুরু, কপাল, চোখ, চশমা, গাল, সে গালে আবার ব্রণস্মৃতির আলপনা। মন্দ কী? মচৎকার, অ্যাকচুয়ালি।

টিপের আরও একটা সুবিধে, সর্বত্র লভ্য। দু'নম্বরেই একজন হাসিখুশি দিদির দোকান থেকে মাঝে মাঝে গ্লু-স্টিক, রিফিল, খাম ইত্যাদি কিনি। এই জিনিসপত্রগুলো থাকে দোকানের ভেতর, দেওয়ালে সাঁটা তাকে। আর কাউন্টারের ওপর রাখা থাকে সারি সারি লিপস্টিক, নেলপালিশ, হার দুল টিপ।

কিন্তু দিদির দোকান থেকে টিপ কেনা যাবে না। কারণ পয়েন্টটা টিপ না, পয়েন্টটা হল মায়ের অক্ষম অনুকরণ। বাড়ি গিয়ে একদিন বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ বিজলীদিকে বগলদাবা করে বেরোলাম। বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম কিছু লাগবে কি না। বাবা ভেবে বললেন, সামনের ঘরের ঘড়ির ব্যাটারি ফুরিয়ে গেছে, মনে থাকলে আনিস। পাছে ভুলে যাই, আগে ব্যাটারি কিনলাম। তারপর টিপের দোকানের দিকে রওনা দিলাম। মা যে দোকান থেকে টিপ কিনতেন সেই দোকান থেকে এক বছরের টিপের সাপ্লাই নিয়ে যাব। আমার জন্মেরও আগের দোকান। আছে এখনও, কিন্তু বন্ধ। পার্মানেন্টলি বন্ধ বলে মনে হল না। কারণ সামনের বারান্দায় বাজার বসেনি আর শাটারটাও ধুলোধূসরিত না। যেন পার্মানেন্টলি বন্ধ হয়ে না যায় ঠাকুর। পৃথিবীতে এখনও কিছু থাক যা আমার থেকেও পুরনো।

পাশেই আরেকটা দোকানে আংটা থেকে টিপের পাতার সারি ঝুলছে। ঢুকলাম। আমার যা চাই নেই। ভদ্রলোক এমন খেঁচিয়ে কথা বললেন। একটার জায়গায় দুটো প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে যদি রাগ হয়ে যায় তাহলে তো বিপদ। বেরিয়ে এলাম। নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম, লোকে ক্রমাগত আজাইরা প্রশ্ন করে করে ভদ্রলোকের মেজাজ খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, আমি কিছু এক্সট্রা বোকামো করিনি। ইট'স নেভার মি, ইট'স অলওয়েজ দেম।

দু'দুবার বাধা পড়ল, টিপের প্ল্যান ক্যান্সেল করব কি না ভাবছি, বিজলীদি কনুই ধরে টানল। এটায় একবার দেখি সোনা।

দোকানটা ছোটবেলা থেকে দেখছি কিন্তু মা কোনওদিন এই দোকান থেকে টিপ কেনেননি। এই মুহূর্তে কোনও খদ্দের নেই। কাউন্টারের ওপারে এক ভদ্রমহিলা বসে আছেন। একফালি দোকান। ভদ্রমহিলা দু'পাশে হাত ছড়িয়ে দাঁড়াতে পারবেন না। কিন্তু ঠাসা জিনিস। মেঝে থেকে সিলিংজোড়া ক্যাবিনেটে কোটি কোটি প্লাস্টিকের বাক্সে ঠাসা দুল, হার, টিপের পাতা।

কাউন্টারের এপারের দুটো খালি টুলে আমি আর বিজলীদি বসলাম। বললাম, টিপ আছে? সুরুচি কোম্পানির? মেরুন রং? সাইজ পাঁচ নম্বর?

আছে আছে। ভদ্রমহিলা এই বাক্স ওই বাক্স টেনে বার করতে লাগলেন। ব্র্যান্ড মিলল, রং মিলল না। রং মিলল, সাইজ মিলল না।  ভদ্রমহিলা ওই ছোট্ট জায়গায় উবু হয়ে, উঁচু হয়ে, বসে, হাফ বসে আমার ফরমায়েশি টিপ খুঁজতে গিয়ে হাঁসফাঁস হয়ে গেলেন। আমারই খারাপ লাগতে লাগল। সুরুচির জায়গায় সুতৃপ্তি হলে, মেরুনের বদলে খয়েরি হলে, পাঁচ নম্বরের বদলে ছ'নম্বর হলে যে ব্রহ্মাণ্ডের একটি চুলও এদিক থেকে ওদিক হবে না সে সত্যটা বুকের মধ্যে বিঁধতে থাকল।

বললাম, থাক থাক, অত ঝামেলার দরকার নেই। এটাই বেশ কাছাকাছি হয়েছে। ভদ্রমহিলা বললেন, আরে কাছাকাছি হলে হবে, একেবারে ঠিকটা বার করতে হবে। আমার তো এটাই কাজ। অবশেষে বিজয়ীর ভঙ্গিতে একটা বাক্স হাতে ভদ্রমহিলা কাউন্টারের ওপর ভেসে উঠলেন।

সুরুচি। মেরুন। পাঁচ নম্বর।

থ্যাংক ইউ বলে নুয়ে পড়ছি, ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার বাড়ি কোথায় গো? বললাম। ওই মোড়টা চেনেন? ওই রিকশা স্ট্যান্ডটা? ওই স্কুলটা? আমার বাড়ি স্কুল পেরিয়ে তিন নম্বর। একতলা, সাদা দেওয়ালে নীল বর্ডার। তাড়াতাড়ি জুড়লাম, দু'হাজার এগারো সালের অনেক আগে থেকেই ওই রং। একদম ছোটবেলায় হলুদসবুজ ছিল। তারপর থেকে সাদানীল।

ভদ্রমহিলা পাঁচ সেকেন্ড ভেবে বললেন, যে বাড়ির গেটের সামনে ঝুপসি আমগাছ?

ঝুপসি আমগাছ। ভীষণ খুশি হয়ে সায় দিলাম।

আমি তো রোজ ও বাড়ির সামনে দিয়ে বাইকে করে আসি। আবার বোকার মতো চোখ কপালে তুলতে যাব, মহিলা বললেন, মানে আমার ছেলে বাইকে করে দিয়ে যায়।

শরীর ঘোরালেন মহিলা। শোকেসের বাক্সের ভিড়ে গোঁজা সাদাকালো ছবিটা দেখেছি টুলে বসামাত্রই। নিরীহ ও সিরিয়াস মুখের ভদ্রলোক, প্লাস্টিকের সাদা ফুলের মালা পরে সোজা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।

আমার স্বামী। দেড় বছর আগে চলে গেলেন। ছেলেরা চাকরিবাকরি করে। ব্যবসায় ইন্টারেস্ট নেই। খদ্দের খোঁজা শুরু হল। জলের দরও উঠছে না। কেউ বলে বেশি দাম। কেউ বলে অতটুকু জায়গায় কী হবে। আমার শরীর খারাপ। বিছানা থেকে উঠতে পারি না। বললাম, একটা লোক রেখে চালা। ছেলেরা বলল, বিশ্বাসী লোক এখন কে খুঁজে বার করবে মা? লোকের পেছনেও তো আমাদেরই দৌড়তে হবে। বাদ দাও ও সব ঝামেলা। এমনও নয় যে দোকান দারুণ চলছে।

আমি (আমি নই, ভদ্রমহিলা) বললাম, এখনই কিছু করিস না, আমাকে ক'দিন দেখতে দে। চল্লিশ বছরের দোকান। কত কষ্টের দোকান। যখন কিচ্ছু ছিল না, তোরাও ছিলি না, এই দোকান ছিল।

সেই থেকে ছেলে সকালবেলা অফিস যাওয়ার আগে বাইকে করে দোকানে দিয়ে যায়। সারাদিন দোকানে থাকি। লোকজন আসে। বেচাকেনা হয়।  বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে আসি। সন্ধেবেলা ছেলে আবার বাইকে করে নিয়ে যায়।

অনতিদূরে লেভেল ক্রসিং-এর গেট খুলল, বন্ধ হল। আবার খুলল। মানুষের জীবনের দাম যে গত তিরিশপঁয়ত্রিশ বছরে বেড়েছে রিষড়ার লেভেল ক্রসিং দেখলেও টের পাওয়া যায়। আগে ডাণ্ডা ফেলা থাকলেও দিয়ে পাশের ফোঁকর দিয়ে পায়ে হেঁটে তো বটেই, সাইকেল বাইকও মহানন্দে যাতায়াত করত। ফোঁকর বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে, সাইকেল যদি বা গলতে পারে, বাইক নেভার। কাজেই যখন গেট খোলে, একটি আশ্চর্য গুলজারের জন্ম হয়। সরু মোটা হর্ন, চিৎকার, দাদা এগোন চিৎকার। ব্যস্তসমস্ত লোক থাকলে অনুরোধ বর্ণময় হয়।

সে সব রংবেরঙের কলরবের মধ্যে বসে বসে আমরা গল্প করতে লাগলাম। ভদ্রমহিলা বললেন, আচ্ছা একটা কথা বলব? বললাম, নিশ্চয় বলবেন। ভদ্রমহিলা বললেন, তুমি ঠিক এই টিপটাই পরতে চাও বুঝেছি, কিন্তু আরেক রকমও ট্রাই করতে পার। সাইজ একই থাকুক, শুধু মেরুনের জায়গায় কফি কালার। নিজের কপালে আঙুল ছোঁয়ালেন। এই যে আমি যেটা পরে আছি । ফর্সা কপালের নরম, পাতলা ত্বকে গাঢ় একটি টিপ ফুটে আছে।

একটা নিয়ে গিয়ে পরেই দেখ না। মানাবে।

নিলাম। কফিও নিলাম, মেরুনও নিলাম। সুরুচিও নিলাম, সুতৃপ্তিও নিলাম। পাঁচ নম্বর তো নিলামই, সাহস করে ছ'নম্বরও নিলাম এক প্যাকেট। সব মিলিয়ে ছাব্বিশটাকা বিল হল।

বিজলীদিকেও গছালাম দু'পাতা কফি কালার। মা থাকলে মায়ের জন্যও নিতাম। মায়ের রিঅ্যাকশন কী হবে জানা সত্ত্বেও। মা চিরদিন আঙুলকাটা মোজা পরে এসেছেন, যা গোড়ালি ছাড়িয়ে এক বিঘৎ ওপর পর্যন্ত যায়। রিসেন্টলি জেনেছি মোজার রংটাকে "পিচ কালার" বলে, আমরা চিরদিন "স্কিন কালার" বলে এসেছি। একবার কী ভেবে, নিজের সঙ্গে মায়ের জন্যও ক'জোড়া অ্যাংকল সকস্‌ কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। মা হাসির চোটে খাট থেকে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন। এখন আমি এই পুঁচকে মোজা পরব সোনা? তুই পর।

টিপের পাতা দেখলেও মা তাই বলতেন। এখন আমি মেরুন ছেড়ে কফিরঙের টিপ ধরব সোনা? তুই পর। মায়ের কথা শুনব বলেই কফি রঙের টিপ পরেই এই মুহূর্তে কফিশপে কফি খেতে খেতে টাইপ করছি। মামার জন্মদিনের ফাংশানেও ওই টিপ পরেই গেছিলাম। জগদ্ধাত্রী ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছিলামও ওই টিপ পরেই।

*****

প্রথমটা উচ্চাশা ছিল চন্দননগরে যাওয়ার। অনেক ছোটবেলায় গেছিলাম একবার। বিজলীদি, শ্যামলী দুজনেই চন্দননগরের মেয়ে। দুজনেই উৎসাহী ছিল আমাকে চন্দননগরের ঠাকুর দেখতে নিয়ে যাওয়ায়। রিষড়া অনেকদিন ধরে জগদ্ধাত্রী পুজোয় সেকেন্ড চন্দননগর হওয়ার চেষ্টা করছে। অক্ষম চেষ্টা। ফ্রেঞ্চটেঞ্চ নিয়ে চন্দননগরের ঐতিহ্যই আলাদা। রিষড়ার ঐতিহ্য, কাল যা বললাম, রঘু ডাকাত আর হুব্বা শ্যামল। ভিড় টানতে রিষড়ায় পুজোর হুলাবিলা শুরু হয় নবমী থেকে। অষ্টমী পর্যন্ত সবাই চন্দননগরের ঠাকুর দেখে নিয়ে তারপর রিষড়ায় আসবে, এই যুক্তিতে। বছরের পর বছর এ জিনিস চলতে চলতে এমন হয়েছে, অনেককে বলতে শুনেছি, চন্দননগরের ষষ্ঠী তো অমুকদিন শুরু হচ্ছে জানি, আমাদের ষষ্ঠী যেন কবে?

বাড়িতে গেলে বিছানা থেকে নামতেই অর্ধেক এনার্জি খরচ হয়ে যায়, ট্রেনে চড়ে চন্দননগর গিয়ে হেঁটে হেঁটে ঠাকুর দেখার কল্পনাতেই কান্না পাচ্ছিল। এদিকে কমিট করে ফেলেছি। শরীরমনের শলায় ঠিক সময় গা গরম হল, সঙ্গে ঘং ঘং কাশি। কাশি থামিয়ে বললাম, আমি পারব, কখন বেরোতে হবে বল। সেন্টেন্স শেষ না হতে হতে আবার কাশির বন্যা। সবাই আদাকুচি নিয়ে দৌড়ে এসে বলল, পাগল নাকি, এই শরীরে কেউ বেরোয়? মশারির ভেতর শুয়ে শুয়ে ফোনে ইউটিউব দেখ সোনা, কোথাও বেরোতে হবে না। সমস্ত মনের জোর খরচ করে চোখেমুখে হতাশা ফোটালাম। বাবা বললেন, আচ্ছা, না হয় একবেলা বেরোনো যাবে। চন্দননগরের প্রশ্নই ওঠে না, এমনকি রেললাইনের ওপারের ভিড়ভাট্টায় যাওয়ারও দরকার নেই। এপারের কয়েকটা প্যান্ডেল দেখা হবে, ব্যস।

তাই দেখা হল। রিষড়ার প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে এবার সাসটেনেবিলিটির আঁচ। ঝাড়লন্ঠনের বদলে ঝাড়। দিল্লি রোডের পাশের বাঁশবন খালি করে এনে প্যান্ডেলে পুঁতে দিয়েছে। রাতের রেনফরেস্টের ফিলিং আনার জন্য টিমটিমে দু'চারটে টুনি জোনাকির মতো জ্বলছে নিভছে। ঝাড়ের ভেতর থেকে উঁকি মারছে বাঘ ভাল্লুক, ডাল থেকে ঝুলছে বাঁদর। একসাইডে ছোট পুকুর থেকে কুমীরের করাল হাঁ-মুণ্ডু ভেসে রয়েছে। গণ্ডার আছে, জলহস্তী আছে, পেঙ্গুইনও দেখলাম একটা প্যান্ডেলে। সর্বপ্রজাতিসমন্বয়।

বাগপাড়ার প্যান্ডেলের সামনে চমৎকার একটা শাড়ি (আর কফি কালারের টিপ) পরে বিজলীদি দাঁড়িয়ে ছিল। ছোটবেলায় বাগপাড়ার প্যান্ডেলে প্রত্যেকবছর একটা সারপ্রাইজ থাকত। কোনও বছর মা দুর্গা স্কার্টব্লাউজ পরতেন, কোনও বছর দিব্যা ভারতীর মতো দেখতে হতেন,  এক বছর মেধা পাটকরের লুক অ্যালাইকও হয়েছিলেন মনে আছে।

এ বছর জগদ্ধাত্রী ঠাকুরের মুখে বিশেষ কিছু সারপ্রাইজ দেখলাম না, তবে প্যান্ডেল খুবই কায়দার। যে রকম কায়দার প্যান্ডেলে ঘন ঘন অ্যানাউন্স করতে হয়, দয়া করে প্যান্ডেলের গায়ে হাত দেবেন না, আমাদের স্বেচ্ছাসেবীরা চারদিকে চরকি ঘোরা ঘুরছেন, প্যান্ডেলে হাত ছুঁইয়েছেন কি আপনাকে অপমানের একশা করবেন।

স্বেচ্ছাসেবীতে মনে পড়ল। বাগপাড়ায় পৌঁছনোর আগে একটা প্রায়ান্ধকার গলির ভেতর একটা ছোট প্যান্ডেলে ঢুকেছিলাম। প্যান্ডেলটা আছে যে বুঝিনি। বাবা বললেন শর্ট কাট হবে তাই গলিতে ঢুকেছিলাম। প্যান্ডেল বেরিয়ে পড়ল। ছোট প্যান্ডেল, ছোট বাজেটে যত্ন করে সাজানো। জগদ্ধাত্রীও বড় প্যান্ডেলের মত ডাকাবুকো নন, নার্ভাস হেসে বেদীর সামনে মেঝের একটা বিন্দুতে টানা টানা দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছেন। সিংহের পিঠে চড়ে আছেন তো কি, ভক্তদের সঙ্গে আই কনট্যাক্ট করার লজ্জা পুরো কাটিয়ে উঠতে পারেননি। দেখছি, এমন সময় বাবার দিকে একজন স্বেচ্ছাসেবী দৌড়ে এলেন। হাইট আড়াই ফুট, মাথায় ভাইসার টুপি, ক্লাবের নাম লেখা ফ্রি-সাইজ ব্যাজ বুকের পুরোটা ঢেকে ফেলেছে।

বাবার দিকে ঘাড় প্রায় সমকোণে তুলে স্বেচ্ছাসেবী বললেন, দাদু, ঠাকুর দেখা হয়ে গেলে ওই দরজা দিয়ে বেরোতে হবে। স্বেচ্ছাসেবীর ছোট তর্জনী ফলো করে প্যান্ডেলের গায়ে সেলোটেপ সাঁটা এ ফোর কাগজটা চোখে পড়ল, যাতে বাহাত্তর ফন্টে 'বাহির' লেখা আছে।

বাবা বললেন, নিশ্চয় দাদু, ওই দরজা দিয়েই বেরোব। আশ্বস্ত হয়ে স্বেচ্ছাসেবী চেয়ারে গিয়ে বসলেন। পা মাটি থেকে এক বিঘত ওপরে দুলছে। দেখা শেষ করে নির্দিষ্ট দরজা দিয়ে বেরোচ্ছি, প্যান্ডেলে নতুন দর্শনার্থী ঢোকার শব্দ হল। অমনি স্বেচ্ছাসেবী চেয়ার ছেড়ে তাঁদের দিকে দৌড়ে গেলেন। পেছন ফিরে দেখলাম ঘাড় প্রায় সমকোণে তোলা, ছোট তর্জনী 'বাহির'-এর দিকে নির্দেশ করছে।

ততক্ষণে সন্ধে গাঢ় হয়েছে। রাস্তার দুপাশে আলোর ময়ূর পূর্ণ মহিমায় পেখম মেলেছে। বাবা জানালেন নেক্সট গন্তব্য নাকি মিউনিসিপ্যালিটির ইম্পরট্যান্ট কোনও ভদ্রলোকের ক্লাব। কাজেই বাজেট আনলিমিটেড। প্যান্ডেলে ঢোকার গলি ওপচানো লাইন ধীরে এগোচ্ছে। লাইনের সামনে দিকে সবার হাতে মোবাইল আকাশে। যদিও মূর্তি সেখান থেকে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কাজেই মূর্তির ছবি তুলছে না কেউ। কীসের তুলছে বুঝলাম আরেকটু এগিয়ে।

গলির দুপাশে মানুষপ্রমাণ পুতুল দাঁড় করানো। নিশ্চয় কোনও রোমহর্ষক ঘটনা পুতুলের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কাঠগড়ার আভাস পাচ্ছি কাজেই হয় ক্ষুদিরাম নয় ধনঞ্জয়। ধৈর্য ধরে এগোলাম। কালো কোট পরা একজন উকিল পুতুল, কয়েকজন পুতুলের হাতে প্ল্যাকার্ড। ব্রিটিশ ভারত ছাড়ো। যাক, ধনঞ্জয় নন। কয়েকজন পুলিস লাঠি তুলে উদ্যত। কাঠগড়ায় একজন ডোরাকাটা ফতুয়া আর হাফ প্যান্ট পড়ে দাঁড়ানো। উকিলের মেক আপ দেখেই বোঝা যাচ্ছে বদ লোক, কয়েদীর মেক আপ দেখেই বীর। গলির অন্তে লাস্ট পুতুলটি, অর্থাৎ ক্ষুদিরাম, গলায় ফাঁসি দিয়ে ঝুলছেন। পুতুলগুলো কেমন অবিকল জ্যান্ত মানুষের মতোই বানিয়েছে সে নিয়ে বিজলীদির কানে কানে বলতে যাব, এমন সময় স্পষ্ট দেখলাম, এই এখন কফিশপের টেবিলটপের জিগজ্যাগ মোজাইক যে রকম স্পষ্ট দেখছি, ক্ষুদিরাম চোখের পাতা ফেললেন।

ক্ষুদিরাম জ্যান্ত। পুলিশ জ্যান্ত। উকিল জ্যান্ত। জনতা জ্যান্ত। সকলে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বাবা বললেন এরা সবাই নাকি যোগব্যায়াম করেন তাই এতক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন। ভদ্রলোকদের ক্ষমতা আছে, পলকও ফেলছেন অনেক পরপর। তবু যখনই ক্ষুদিরাম চোখের পাতা ফেলছেন জনতা হই হই করে উঠছে। ফ্ল্যাশ চমকাচ্ছে ঘন ঘন। কেউ কেউ আবার কিউরিয়াসভাবে ব্যাপারটার ভিডিও তুলছেন। গুজগুজ ফুসফুস চলছে, ক্ষুদিরামের বয়সটা একটু বেশি হয়ে গেছে না?

প্যান্ডেলের দিকে হাঁটলাম। এই রোমহর্ষক আর্ট ফর্মটা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছিলাম কী করে? ছোটবেলায় প্যান্ডেলে জ্যান্ত দুর্গা সরস্বতী দেখেছি কত। কিন্তু এখন হর্ষের থেকে হরর বেশি জাগছে। বিজলীদির কনুই ধরে টানছি কিন্তু বিজলীদি পাত্তা দিচ্ছে না, হাসি হাসি মুখে ছবি তুলছে। বলছে, রাইকে কাল নিয়ে আসব। রাই হচ্ছে বিজলীদির দশ বছরের নাতনি। বাবাও উত্তেজিত। উঁকিঝুঁকি মেরে বোঝার চেষ্টা করছেন ক্ষুদিরাম ফাঁসির দড়ি থেকে ঝুলছেন কী করে। বলছেন, বুঝলি সোনা, বুঝলে বিজলী, পায়ের তলায় ট্রান্সপারেন্ট বাক্সমতো কিছু রেখেছে। না হলে ইমপসিবল।

একা একাই প্যান্ডেলের ভেতর ঢুকে পড়লাম। এখন মাটির প্রতিমা দেখে প্যালপিটেশন কমাতে হবে। একমুহূর্তের জন্য একটা ভয়ানক সন্দেহ গুঁড়ি মেরেছিল বুকের ভেতর। না বাবা। জগদ্ধাত্রী নিথর। পাষাণবৎ। ঠুঁটো। ঠাকুরদেবতাদের ঠিক যেমন আমি পছন্দ করি। তাঁদের জ্যান্ত হয়ে ওঠার মজা কুন্তী অহল্যা টের পেয়েছেন। আর কাউকে যেন না পেতে হয়।

লাস্ট স্টপ ব্রহ্মানন্দ স্কুলের মাঠ। সে মাঠে পুজোর লাগোয়া মেলা বসে। মেলায় ডিনার সেরে বিজলীদি নিজের বাড়ি চলে যাব, আমি আর বাবা আমাদের বাড়ি চলে আসব। ডিনারের আগে আরও একটা মজা হবে অবশ্য, তবে শুধু আমার।

শকুন্তলা কালীবাড়ির মেলায় আমাকে নিয়ে সেজকাকু জায়ান্ট হুইলে চড়েছিলেন, নেমে বলেছিলেন, এই শেষ সোনা, আর কোনওদিন আমাকে চড়তে বলবি না, বাপ রে বাপ রে বাপ। সেজকাকু হাতে চকোলেট বোমা ফাটাতেন আর পাড়ায় কারও বাড়িতে ডাকাত পড়লে খালি হাতে সেদিকে দৌড়ে যেতেন। তারপর আমি আর কাউকে আমার সঙ্গে জায়ান্ট হুইল চড়তে জোর করিনি। আগেরবার মনসা না আর কোনও দেবীর পুজোয় ওই ব্রহ্মানন্দের মাঠেই সম্পূর্ণ একা চড়তে হল। গোটা হুইল খালি। একা আমি ঘুরছি। এবার অন্ততঃ কিছু লোক আছে। পাশের কাত করে রাখা বড় গোল জায়গায় জোড়া জোড়ায় লোক গাড়িতে বসে এলোপাথাড়ি ঘুরছে। গাড়িতে গাড়িতে  ধাক্কা খাচ্ছে। আবার সরে আসছে। লোকজনের মুখ দেখে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা খুবই থ্রিলিং। কিন্তু আমার কখনও উৎসাহ হয়নি এগুলোতে চড়ার। কারণ আমার ছোটবেলায় আমি এই খেলাটা খেলিনি। আর আমি নতুন থ্রিল খুঁজছি না। পুরোনো থ্রিল ফিরে পেতে চাইছি।

টিকিট কেটে খাঁচার ভেতর ঢুকলাম। পনেরো থেকে কুড়ি বছরের কিছু পাটকাঠি সাইজের ছেলে গোটা ব্যাপারটার তত্ত্বাবধান করছে। একজন একটা দুলন্ত খোপ স্টেডি করে ধরল। ঢুকে গেলাম। অলরেডি দুটো মেয়ে বসে আছে। এত ছোট আর এত রোগা যে খুঁটিয়ে না দেখলে মিস হয়ে যেতে পারে। আমি মেয়েদুটোর উল্টোদিকের বেঞ্চে বসলাম। এই বয়সের মেয়ে দেখলে পারসোন্যাল বাউন্ডারি ক্রস না করে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। নাম জিজ্ঞাসা করলাম। ক্লাস নাইনের অস্মিতা মোদক আর ক্লাস সিক্সের দীপা দাস। অস্মিতা বলল, ওরা নাকি শিওর হতে পারছিল না এটাতে চড়বে না পাশেরটায়। কোনওটাতেই আগে চড়েনি কোনওদিন। সাহস করে এটাতেই চড়েছে। আমি বললাম, ভেরি গুড চয়েস। কীসের সঙ্গে কীসের তুলনা।

এক পাক ঘুরতে না ঘুরতে নাগরদোলা থামল। আমাদের ঠিক পরের খোপে এক ভদ্রমহিলা ও পুরুষসঙ্গী উঠেছিলেন, হাত তুলে নেমে গেলেন। অস্মিতা জিজ্ঞাসা করল, আপনি নেমে যাবেন না তো? তাহলে আমরাও নেমে যাব। আমি বললাম, শেষ না দেখে নামছি না। গ্যাঁট হয়ে বসে থাক।

হুইল ঘুরে চলল। আমরা স্মলটক করে চললাম। দুজনেরই পরীক্ষা শুরু হবে সামনের সপ্তাহে। দীপা সন্দেহ প্রকাশ করছিল, যদি ঠাণ্ডা লেগে যায়। আমি যথাসাধ্য আশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। লাগবে না মনে হয়, হলে ক্যালপল খেয়ে নেবে। কথোপকথন রীতিমত উচ্চগ্রামে চালাতে হচ্ছিল কারণ মেলা থেকে জনতা, মাইক থেকে কিশোরকুমার গলা ফাটিয়ে চেল্লাছিলেন। নাগরদোলা মাঝে মাঝে থামছিল। লোক উঠছিল, নামছিল। একবার থামল, যখন আমি অস্মিতা আর দীপা একেবারে টঙে। আশপাশের সমস্ত বাড়ির মাথা ছাড়িয়ে, সমস্ত নারকেল গাছের মাথা ছাড়িয়ে। খালি তিন নম্বরের ট্যাংক আমাদের থেকে লম্বা। আর চাঁদ। নিচে কাত হওয়া গোকার্ট থেকে জনতার উচ্ছ্বাস লাফ দিয়ে আমাদের ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করল। কিশোরকুমার গাইতে লাগলেন, মিলনতিথির পূর্ণিমা চাঁদ ঘোচায় অন্ধকার। পূর্ণিমার বদলে নবমীর আধখাওয়া চাঁদ মাথায় নিয়ে আমি, অস্মিতা আর দীপা, শূন্যের মধ্যে অল্প অল্প দুলতে লাগলাম।

নামার আগে অস্মিতা আমাকে বলল, আপনি ছিলেন ভাগ্যিস। আমি বললাম, তোমরা ছিলে ভাগ্যিস।

তারপর মেলার দোকানে যখন বসে ঢাকাই পরোটা খাচ্ছি, বাবা বললেন, সোনা, দেখ তোর বন্ধুরাও এসেছে। এখানে আমার বন্ধু কোথা থেকে এল ভেবে আমি মুখ তুলে গেটের দিকে তাকালাম। অস্মিতা আর দীপা একটা ছেলের সঙ্গে ঢুকছে। আমিও তাকিয়েছি আর ছেলেটাও ওদের খোঁচা মেরে আমার দিকে দেখাচ্ছে। অস্মিতা আর দীপা আমাকে দেখে হাসিমুখে হাত নাড়ল। আমিও জোরে জোরে হাত নাড়লাম।

Comments

  1. Anek anek din por Abantor e elam. Ki je bhalo laglo ese. Ei lekhata bhari bhalo laglo. Bhalo thakben.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে সুস্মিতা যে, সত্যিই অনেকদিন পর। আমারও খুব ভালো লাগল।

      দেখুন, অনেকদিন পর এলেন আর এসে একগাদা টাইপো ভর্তি পোস্ট পড়তে হল। কাল পাবলিশ করে শুয়ে পড়েছিলাম, সকালে উঠে ভুলগুলো চোখে পড়ল। সারিয়েছি, তবু কিছু রয়ে গেল কি না কে জানে। ভেরি সরি।

      আপনিও খুব ভালো থাকবেন, সুস্মিতা।

      Delete
  2. সকাল সকাল পরে মনটা ভালো হয়ে গেলো।

    "আরে কাছাকাছি হলে হবে, একেবারে ঠিকটা বার করতে হবে" - খুব আশ্বাসদায়ক লাগলো এই লাইনটা।

    ছবিটা কি পাশের বাড়ির?

    ReplyDelete
    Replies
    1. এটা টুকাইদার বাড়ি, রাজর্ষি। বেড়ালটা কুকুরদের হাত থেকে বাঁচতে বোধহয় ওই টঙে উঠে ঘুমোয়।

      নিজের ওয়ার্ক এথিক জঘন্য বলে ভদ্রমহিলাকে দেখে আমারও কমপ্লেক্স আর মনখারাপ একসঙ্গে হয়েছিল। লোকে কত মন দিয়ে কাজ করে, ভাবা যায় না।

      Delete
    2. আপনার ব্লগে সার্চ করে নিয়ে, মনে হচ্ছে টুকাইদা আপনার প্রতিবেশী। :)

      Delete
    3. হ্যাঁ হ্যাঁ, টুকাইদাকে জন্মে থেকে দেখছি। এটা আমাদের একেবারে পাশের বাড়ি। ছবিটা আমাদের বাড়ির ছাদ থেকে তোলা। অবান্তরে মাখনদাদুর বাগানের কথা লিখেছি আগে, এখানে সেই বাগানটা ছিল। উঁচু উঁচু তালগাছে শকুন বসে থাকতে প্রথম দেখেছি এখানেই। টুকাইদা তখন একটু দূরে থাকত, তারপর এখানে জমি কিনে বাড়ি করে। টুকাইদার মেয়ের নামও সোনা, সেটা পাড়ার কোনও কোনও বাড়িতে কনফিউশনের সৃষ্টি করে এখনও।

      Delete
  3. ভালোই করেছেন। চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী ঠাকুর সুস্থ মানুষে দেখতে যায়না, আর যদি যায় তাহলে তারা অসুস্থ হয়ে ফেরে। তবে সামনের কয়েক মাসের মধ্যে অ -পুজো সময়ে যদি চন্দননগর কি চুঁচুড়ার দিকে আসেন, তাহলে আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে (সেই ভয়ে আবার জ্বর বাধিয়ে বসবেননা যেন)।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, জ্বর বাধানোর কোনও সম্ভাবনা নেই (বাই দ্য ওয়ে, আপনি জ্বর 'বাধানো'তে চন্দ্রবিন্দু দেননি দেখে আমার ইমোশনাল প্রতিক্রিয়াটা বর্ডারলাইন ইনঅ্যাপ্রোপ্রিয়েট হল। আজকাল পত্রপত্রিকাতেও উদারহস্তে চন্দ্রবিন্দু বসানো হয়। ) আপাতত দিল্লিতেই আছি।

      আপনাদের চারজনকে দেশে সুস্বাগতম। খুব ভালো কাটুক সময়।

      Delete

Post a Comment