উৎসর্গ


গত বছর অক্টোবরের শেষে বইকথা ওয়েবপত্রিকায় আমার এই ছোটগল্পটা বেরিয়েছিল। সম্পাদকের অনুমতি নিয়ে অবান্তরে ছাপছি।

***** 

শেষ দাঁড়িটা টাইপ করে শিরদাঁড়াকে নমনীয় হতে অনুমতি দিলেন লেখক। চোখ বুজলেন। পা দু’খানা হাঁটু থেকে সোজা করে টেবিলের তলায় ছড়িয়ে দিলেন যতক্ষণ না আঙুলের ডগা দেওয়াল ছোঁয়। দু’কাঁধ ঠেলে পেছনে নিয়ে গেলেন যতখানি সম্ভব। দশ আঙুল একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে কানের পাশ দিয়ে তুলে মাথার ওপর তুলে ধরলেন।  তাঁর গোটা শরীরটা এখন একটা স্ট্রেট লাইন। হাড়ের জোড়ায় জোড়ায়, তন্তুতে তন্তুতে একটা মোক্ষম টান। দীর্ঘ প্রশ্বাসে বুকের ভেতর বাতাস পুরে নিয়ে দম বন্ধ করে খুব ধীরে দশ গুনলেন লেখক। তারপর নিঃশ্বাস ছেড়ে দিলেন।

কেঠো চেয়ারের ওপর ভেজা ন্যাতার মতো এলিয়ে পড়ল তাঁর শরীর। দশ মাস পর এই প্রথম যেন তিনি প্রথমবার সম্পূর্ণ বিশ্রাম বোধ করছেন। দশ মাসের হিসেবটা মনে পড়তেই লেখকের ভুরু সামান্য কুঁচকে গেল। গুনতে নিশ্চয় ভুল হচ্ছে তাঁর, মোটে দশ মাস? চোখ খুললেন তিনি। সামনের দেওয়ালের গায়ে একখানা ক্যালেন্ডার। প্লাস্টিকের কালো রঙের স্প্রিং থেকে ঝুলন্ত চৌকো মোটা পাতা, পাতার ওপর মাসের নাম আর বছরের তলায় খোপ কাটা। বার নেই,শনিরবিতে লাল ছোপ নেই, তিথি সংক্রান্তি, ব্যাংক হলিডে কিচ্ছু নেই। খালি এক থেকে তিরিশ বা একত্রিশ বা আঠাশ পর্যন্ত নম্বর। চট করে এ রকম ক্যালেন্ডার দেখা যায় না। লেখক অন্তত দেখেননি। যদিও এর কাছাকাছি একটা কিছু তাঁর কল্পনায় ছিল। বহু খুঁজে শেষে যখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন, বছর পঁচিশ আগে, তখন একদিন অফিসের উল্টোদিকের ফুটপাথে, ভাবা যায়? ঠিক উল্টোদিকে, যেখানে তিনি রোজ চা খেতে যেতেন, একটা দোকানের সাইনবোর্ডের দিকে নজর পড়েছিল।  নীলের ওপর সাদা দিয়ে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা ‘এখানে ক্যালেন্ডার ছাপা হয়’। ব্যস।নাম না ধাম না কিচ্ছু না। কলকাতা শহরে লোকে কত অদ্ভুত কাজ করে লোকে বাঁচে ভাবতে ভাবতে চায়ের ভাঁড়খানা ছুঁড়ে ফেলে দোকানের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন লেখক। এগোতে এগোতে ছায়া ক্রমে দেহ ধরেছিল। রোগা মুখ,চোয়াল ঘিরে দাড়িতে মেহেন্দির ছোপ। মাথার পাতলা হয়ে আসা চুলের ওপর লেসের কাজ করা গোল টুপি।

লেখক জানিয়েছিলেন এমন একটা ক্যালেন্ডার তাঁর চাই যাতে খালি দিন সপ্তাহ মাস বছর ছাড়া আর কিছু নেই। যেখানে শনিরবি আলাদা করা যাবে না। ছুটির দিন আলাদা করা যাবে না। তিথি নক্ষত্র পূর্ণিমা অমাবস্যা, নাথিং। আছে?লেখককে চমকে দিয়ে বিষণ্ণ মুখ ওপর নিচে নেড়েছিলেন ভদ্রলোক। আছে। একবার চকিতে লেখকের মাথায় এসেছিল বলেন, ঈদ কিংবা মহরমের উল্লেখও থাকবে না কিন্তু। কথাটা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই যে ছিছিক্কার জন্মেছিল নিজের প্রতি, সেটাও অবিকল মনে করতে পারলেন লেখক।

অবয়ব সরে গিয়েছিল। আবছা অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারে। দোকানের পেছন দিক থেকে একটা গোল পাকানো ডাণ্ডার মতো জিনিস হাতে নিয়ে আবার লেখকের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন ভদ্রলোক। গার্ডার খুলে কাগজটার পাক খুলছিল যখন শীর্ণ আঙুলগুলো লেখকের মনে হয়েছিল তিনি যেন সম্রাট আর এ যেন ভগ্নদূত, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদ বহন করে এনেছে। খবর এনেছে যে লেখক যা চাইছেন, সে রকম ক্যালেন্ডার পৃথিবীর কোথাও তৈরি হয় না।

পাক খুলে কাগজটা তাঁর দিকে ঘুরিয়ে ধরেছিল উসমান আলি। ক্যালেন্ডার আর উসমান  আলির মেহেন্দি দাড়িতে অশ্বত্থ গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে এসে পড়া ঝিলমিল রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে যে অনুভূতিটা হয়েছিল সেটা তাঁর লেখার কেরিয়ারে হাতে গোনা বারই হয়েছে। যখন লেখা শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি চরিত্রটার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেছেন। একে তো তিনি ভাবেননি। এ রকম একজনের কথা ভেবেছিলেন লেখা শুরুর আগে। এ রকম দেখতে,স্বভাবচরিত্রও এরই কাছাকাছি, কিন্তু এ নয়। এর গালে এই যে একটা লাল জড়ুল, যেটা না থাকলে গোটা চেহারাটা মাটিই হয়ে যেত প্রায়, সেটা তো কই তাঁর কল্পনায় ছিল না। কিংবা এই ঘাড় বাঁকিয়ে তাকানোটা অথবা আপাদমস্তক একটা নিরীহ কথোপকথনে হঠাৎ তীক্ষ্ণ রসবোধের ঝিলিক, এসব তো তিনি কল্পনা করেননি।

তিনি ঠিক যা চাইছেন, যা চেয়ে এসেছিলেন এতদিন, তার থেকেও পারফেক্ট ক্যালেন্ডার তাঁকে দেখিয়েছিল উসমান  আলি। যে ক্যালেন্ডারে কোনও ছুটি নেই,ফাঁকি নেই, আরামের আশ্বাস নেই, বিশ্রামের প্রতিশ্রুতি নেই, পালানোর কোনও জায়গাই নেই। খালি একেকটা দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর শেষ হয়ে যাওয়ার রিমাইন্ডার আছে। জীবনটা আরও একটা দিন ছোট হয়ে যাওয়ার চেতাবনী আছে।

হয় তুমি লিখলে, নয় লিখলে না।

চেয়ার থেকে উঠে, দেওয়ালের পেরেক থেকে ক্যালেন্ডারটা খুলে এনে দ্রুত পাতা উল্টে পেছোলেন লেখক। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়,এই তো, দশ নম্বর পাতার সাত তারিখের ওপর সবুজ কালি দিয়ে তাঁর সদ্য শেষ করা বইয়ের নাম লেখা। অর্থাৎ লেখা শুরু হল। অর্থাৎ সত্যি সত্যি মাত্র দশ মাস ধরে লিখেছেন তিনি গল্পটা। অথচ মনে হচ্ছে যেন দশ বছর। যবে থেকে গল্প বলতে শুরু করেছেন তবে থেকে যেন এই গল্পটাই বলতে চেয়েছেন তিনি। যতবার কাগজ কলম টেনে লিখতে কিংবা ল্যাপটপ খুলে টাইপ করতে শুরু করেছেন ততবার যেন এই গল্পটাই লিখবেন বলে বসেছেন, লেখা শেষ করার পর দেখেছেন কখন শব্দগুলো অন্য গল্প হয়ে গেছে। কখনও অজ্ঞাতে,কখনও জ্ঞাতসারে। কখনও এই গল্পটা বলতে ভয় পেয়েছেন, মনে হয়েছে এই গল্পটা লেখার জন্য যে ভাষা প্রয়োজন তা তাঁর এখনও শেখা হয়ে ওঠেনি। যে দক্ষতা দরকার তা এখনও আয়ত্ত্বে আসেনি।

অবশেষে সে গল্প বলা শেষ হয়েছে।  এবং, স্বীকার করতে বাধা নেই, ভালো করেই বলা হয়েছে। অন্তত তাঁর কোনও অতৃপ্তি থেকে যায়নি।  আবার একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন লেখক। বুকের ভেতরটা খালি লাগছে। তারপর খুব ধীরে,প্রায় শীতের কুয়াশার মতো নিঃশব্দে, একটা ভাবনা গুঁড়ি মেরে ঢুকল সে ফাঁকায়। এতদিন যে ভাবনাটা মাথাতেই আসেনি। কী করে? প্লট নিয়ে, চরিত্র নিয়ে ভাবতে ভাবতে, প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ  বিশ্লেষণ করতে করতে, যা লেখা হল আর যা বুনে দেওয়া হল লেখার ফাঁকে ফাঁকে, সে সব নিয়ে চুল চিরতে চিরতে এই অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটাই তাঁর মাথা থেকে বেরিয়ে গেল?

কাকে উৎসর্গ করে যাবেন তিনি তাঁর এই মাস্টারপিস?

***

তাঁর লেখার ঘরে একটাও জানালা নেই। ইচ্ছে করেই রাখেননি। যাতে বাইরের দিকে তাকিয়ে লেখার মহার্ঘ সময় নষ্ট না হয়। ওই ক্যালেন্ডারটা ছাড়া এই ঘরের দেওয়ালে আর কোনও ছবি নেই, কোনও তাক, কুলুঙ্গি, কুলুঙ্গিতে দৃষ্টিনন্দন সজ্জাবস্তু, বুককেস কিংবা বই, কিছুই নেই। সারা ঘরে এমন কিছুই নেই, রাখতে চাননি লেখক, যাকে আঁকড়ে ধরে তাঁর লেখার বাইরের চিন্তা লকলকিয়ে বাড়তে পারে। এমনি সময় এই ব্যবস্থায় তাঁর অসুবিধে হয় না,মনঃসংযোগে সুবিধে হয়, কিন্তু এখন অস্বস্তি হতে লাগল। ঘর যেন আর ফাঁকা নেই, তাঁর টেবিলের ওপর বন্ধ করে রাখা ল্যাপটপ আর নোটখাতার ভেতর থেকে কালো কালো অক্ষরগুলো যেন বেরিয়ে এসে যেন এই বন্ধ ঘরের হাওয়ায় মিশে গেছে। লেখককে ঘিরে ঘুরছে,কানের কাছে বিনবিন করছে, চোখের সামনে কালো মাছির মতো ঝাঁক বেঁধে আসছে।

কার জন্য গত দশ মাস ধরে নিশ্চিন্ত ঘুম খুঁড়ে আমাদের জাগিয়ে খোলা পাতায় মেলে ধরেছ? কার হাতে দিয়ে যাবে আমাদের?

আক্রমণ থেকে বাঁচতে লেখক দ্রুত ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। আর চৌকাঠের বাইরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে একটা শব্দের ঢেউ তাঁর ওপর  আছড়ে পড়ল। রান্নাঘরের ছ্যাঁকছোঁক, কলের জলের ছরছর, বাসনের ঠনঠন, কাকের চিৎকার, পাশের ফ্ল্যাটের কনস্ট্রাকশনের ধাঁই ধাঁই ধপ ধপ। আর এসবের সঙ্গে একটা বেসুরো টুং টাং। লেখকের একমাত্র পুত্র, সঙ্গীতসাধনা করছে।

এই বেসুরো গিটারবাদককে তিনি তাঁর জীবনের বেশ ক’টি বই উৎসর্গ করেছেন। চৌকাঠে দাঁড়িয়ে চিবুক চুলকোতে চুলকোতে লেখক ভাবতে লাগলেন,কেন করেছেন? সে সব বইয়ের বিষয় কিংবা প্রস্তুতিতে তাঁর সন্তানের কোনওরকম অবদান তো ছিলই না, জন্মের পর থেকে এই সন্তান তাঁর লেখায় ব্যাঘাত ঘটানো ছাড়া আর কিছু করেনি। খেলাচ্ছলে ম্যানুস্ক্রিপ্ট জানালার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। ইদানীং অবাধ্য টিনএজার সুলভ আচরণ করে তাঁর মানসিক শান্তি যারপরনাই বিঘ্নিত করছে। এমন সময় লেখকের দৃষ্টি পড়ল ফ্রিজের মাথায় রাখা একটা ছবির দিকে। এই গিটারবাদকের মুখেভাতের ছবি। হাঁ করে কান্নার মাঝপথে তোলা। তিনি আর তাঁর স্ত্রী একমত হয়েছিলেন, সারা অনুষ্ঠানের এইটাই বেস্ট ছবি। তাই এটাকে বাঁধিয়ে ফ্রিজের ওপর রাখা হয়েছে।

ছবিটা দেখতে দেখতে মুচকি হাসি ফুটল লেখকের মুখে। স্পষ্ট দেখতে পেলেন, অফিস থেকে ফেরার পর মায়ের কোল থেকে দু’হাত বাড়িয়ে তাঁর কোলে ঝাঁপিয়ে আসছে এই শিশু। তাঁর কোলে উঠে ফোকলা হাসিতে মুখ ভরিয়ে, তাঁর গলা জড়িয়ে ধরছে। তাঁর গলার চারপাশে সেই নরম ছোঁয়াটা আবার যেন পেলেন লেখক। সেই বেবি পাউডারের গন্ধটাও যেন ঘ্রাণ ছুঁয়ে গেল।

-‘খাবে তো?’

রান্নাঘরের দরজা থেকে একটা মুখ উঁকি মারল।

দাও, বলে টেবিলে এসে বসলেন লেখক। হাত-ঘোরা সকালের কাগজ হাত ঘুরে এসে টেবিলে অগোছালো পড়ে আছে। কিছুই পড়ার নেই, তবু অভ্যেসে নেড়েচেড়ে দেখা। খানিকক্ষণ পর একজোড়া হাত এসে খবরের কাগজটা তাঁর হাত থেকে কেড়ে নিল। কাগজের আড়াল সরে যেতে লেখক দেখলেন তাঁর সামনে স্টিলের কানাতোলা জলখাবারের থালা। চেয়ার টেনে ধপাস করে বসলেন লেখকের স্ত্রী। ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত মুখ। বিরক্ত দৃষ্টি সিলিং ফ্যান থেকে ঘুরে লেখকের মুখের ওপর এসে থামল। লেখক চোখ নামিয়ে নিলেন। ফ্যানটা সত্যি বাড়াবাড়ি রকম আস্তে চলছে। ইলেকট্রিশিয়ান ডাকার দায়িত্বটা তাঁর স্ত্রীই পালন করেন, কিন্তু এও দাবি করেন যে মহিলারা ডাকলে লোকজন অত গুরুত্ব দেয় না, যত বাড়ির কর্তাকে দেয়। সে কর্তাগিরিটা ফলাতে যাওয়া হচ্ছে না তাঁর।
আজ কিন্তু মাছ লাগবেই’। হাতপাখার বদলে খবরের কাগজ দ্রুতগতিতে নাড়তে নাড়তে জানালেন লেখকের স্ত্রী।

এই ভদ্রমহিলাকেও বই উৎসর্গ করেছেন তিনি একাধিক। রুটি বেগুনভাজা চিবোতে চিবোতে লেখক ভাবতে চেষ্টা করলেন কেন করেছেন। লেখক নিশ্চিত নন তাঁর স্ত্রী তাঁর লেখা একটাও বই আদৌ পড়েছেন কি না। তাঁর বইয়ের সমালোচনা অবশ্য উনি পড়েন এবং খুঁটিয়েই পড়েন। যে সব সমালোচক উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন সভাসমিতি পুরস্কার বিতরণী উৎসবে তাঁদের সঙ্গে হেসে কথা বলেন, আর যাঁরা কড়া কথা লেখেন অনুষ্ঠান শেষ হলে তাঁদের পোশাকআশাক চলনবলনের নিন্দে করেন। এছাড়া লেখকের সৃষ্টিশীল জীবনের সঙ্গে এই ভদ্রমহিলার কোনও সম্পর্ক নেই, কোনও অবদানও নেই। বরং আজকাল লেখকের মনে হয় সংসার করে হয়তো ভুলই করেছেন তিনি। সংসারের দিকে মনোযোগ দিতে পারলেন না, আবার লেখাকেও সর্বস্ব দেওয়া হল না।

অন্যমনস্ক হয়ে বেরোনোর মুখে নিচু হতে ভুলে গিয়ে দরজার ফ্রেমে মাথাটা ঠুকে গেল। রক্তও বেরোলো সামান্য। স্ত্রী দৌড়ে এসে ক্ষত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেড সেঁটে দিলেন। সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললেন, মাথাটাথা ঘুরছে নাকি,তাহলে বাজারে গিয়ে দরকার নেই। লেখক শুনলেন না। বেরিয়ে পড়লেন। প্রথম শীতের সুন্দর রোদ গায়ে পড়তে আরাম লাগল। বাজারের ব্যাগ হাতে হাঁটতে হাঁটতে আবার নতুন করে ঝালিয়ে নিলেন তিনি সত্যিটা। এই সংসারের মধ্যে লেপটে না থাকলে তিনি যা লিখেছেন, যেটুকু লিখেছেন, সেটুকুও লিখতে পারতেন না। তিনি হচ্ছে আদুরে ফুল, যত্নে, ছায়ায় বাড়েন। সংসার তাঁকে সেই ছায়াটুকু দিয়েছে। মুক্তবিহঙ্গ হওয়ার কপাল যেমন তিনি করে আসেননি, সে ক্ষমতাও তাঁর ছিল না। কত লেখক মুক্তবিহঙ্গ হতে গিয়ে সুতো ছেঁড়া ঘুড়ি হয়ে গেল, তাঁর পরিণতিও ওই একই হত।

মাথার দপদপানিটা অগ্রাহ্য করে বাজারের দিকে চললেন লেখক। চালডাল আলুপটল কিনলেন। মাছের কানকো তুলে, পেট টিপে পরীক্ষা করলেন। বাক্যালাপের খণ্ডাংশ এসে কানে ঢুকতে লাগল। কান খাড়া করে রাখতে হয় না আজকাল, অভ্যেস হয়ে গেছে। রিয়েল লাইফে লোকের কথা বলার সঙ্গে বইয়ের চরিত্রের কথা বলার কত তফাৎ এটা প্রথম খেয়াল করে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন লেখক। বেশিরভাগ লোক “কোথায়”-এর পর যাচ্ছ/যাচ্ছিস/যাচ্ছেন যোগ করে না, শুধু কোথায়-এর য়-এর সময় গলাটা সামান্য তুলে দেয়। ওই গলার মোচড়টা যদি ভাষায় তুলে আনা যেত। মাছওয়ালার বঁটির ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত কেমন একটানে মাছটাকে নামিয়ে আনে আর মাছটা দু’টুকরো হয়ে যায়। বঁটির গায়ে মরা মাছের যাত্রাপথের ম্যাপটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন লেখক। ওটার কি কোনও নাম আছে? ওটা নিয়ে কোনওদিনও গল্প লিখতে পারবেন না ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল তাঁর।

ফেরার পথে বইয়ের দোকানে থামলেন। পত্রিকার নতুন সংখ্যা বেরিয়েছে। ছেলেটা চেনা। খুচরো ফেরত দিয়ে বলল এবারের পুজোসংখ্যার লেখাটা দারুণ ভালো রিভিউ পেয়েছে স্যার। অনেকে ওইটার জন্যই কিনে নিয়ে যাচ্ছে। তাই?লেখক হাসলেন। ফেরার পথে আরও দু’চারজন একই কথা বলল। এবার পুজোর উপন্যাসটা খুব ভালো হয়েছে।

লেখকের মন ভালো হয়ে গেল। আর তখনই উত্তরটাও পেয়ে গেলেন তিনি।

এত ভাবার তো কিছু নেই। এই বইটা তিনি পাঠককে উৎসর্গ করবেন। আসলে কি বইটা তিনি পাঠকের জন্যই লেখেননি? বা এতদিন তিনি যা যা লিখেছেন,সবই কি পাঠকই তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়নি? লেখক ছাড়া বই অকল্পনীয় হতে পারে, কিন্তু পাঠক ছাড়া বই? লেখক ভাবতে চেষ্টা করলেন তাঁর ওই শব্দ, গন্ধ,বর্ণহীন রুদ্ধকক্ষে বসে তিনি লিখে চলেছেন। পাতার পর পাতা, ফাইলের পর ফাইল। সবার চোখের আড়ালে। তখনও কি তিনি নিজেকে লেখক বলার অধিকারী হতেন? তখনও কি তিনি এ-ই হতেন, আজ তিনি যা?

মনস্থির করে ফেললেন লেখক। তিনি তাঁর আজ সকালে শেষ হওয়া উপন্যাস,তাঁর সারাজীবনের সাধনার ফল, তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি উৎসর্গ করে যাবেন তাঁর পাঠকদের। আজ যারা তাঁর বই পড়ছে,  আবেগে ভেসে গিয়ে খানিকটা দিবাস্বপ্নই দেখে ফেললেন লেখক, এই পৃথিবী থেকে তিনি চলে গেলেও যারা তাঁর বই পড়বে।

***

বুকের ভারটা নেমে গেল। মগজের ভেতর জমা ধোঁয়াশাটা কেটে গেল। আর তখনই লেখক আবিষ্কার করলেন ভাবতে ভাবতে বাড়ির দিকে হাঁটার বদলে ঠিক উল্টোদিকের রাস্তায় চলে এসেছেন তিনি। একমুহূর্ত লাগল তাঁর ধাতস্থ হতে। তিনি সামান্য বেখেয়াল বটে, তাই বলে বাড়ির রাস্তা ভুলে যাওয়া?উৎসর্গের ব্যাপারটা কতখানি ভুগিয়েছে তার মানে। কিন্তু সমাধান হয়ে গেছে। আর ভাবনার কিছু নেই। এবার বাড়ি যাওয়া যাক।

আচ্ছা, এই রাস্তাটাতেই তাঁর এক স্কুলের বন্ধুর বাড়ি ছিল না? কতদিন আসেননি এদিকে। তাঁর বাড়ির এত কাছে, অথচ আসা হয়নি, আসার কোনও কারণই ঘটেনি কত বছর। এত অবিশ্বাস্য লাগল ব্যাপারটা তাঁর যে লেখক আবার চারদিক ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন। নাঃ, এটাই সেই রাস্তা। বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছিলেন, থমকে দাঁড়ালেন। একটা কথা তাঁর মনে পড়ে গেছে। যদি এটাই সেই রাস্তা হয়ে থাকে তাহলে এই দিক দিয়ে সোজা হেঁটে গেলে . . .

প্রায় সাড়ে তিন মিনিট হাঁটার পর বাঁ দিকে গাছপালার আড়ালে জল চিকচিক করে উঠল। রাস্তা থেকে নেমে কাঁচা মাটির ওপর দিয়ে হেঁটে গাছের আড়াল ভেদ করে পুকুরঘাটে এসে দাঁড়ালেন লেখক। লাল রঙের বাঁধানো ঘাট,ভেঙেচুরে গেছে। স্কুল ছুটির পর, বা কখনও কখনও ক্লাস কেটেই বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যখন আসতেন লেখক তখনও অবিকল এ রকমই ছিল। গত তিরিশ চল্লিশ বছরে একটুও বদলায়নি। সিঁড়ির এক কোণে বটের ছায়া পড়া সিঁড়ির কোণে একটা শীর্ণ কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। মৃদু হাওয়ায় ঘাটের একদম নিচের সিঁড়ির গায়ে জল আলতো আলতো দুলছে। সেই হাওয়া এসে লাগল লেখকের মুখে। জুড়িয়ে দিল। দু’তিনটে সিঁড়ি নেমে এসে মাছের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে, হাতের পত্রিকাটা দিয়ে এপাশ ওপাশ ঝেড়ে, বসলেন।

পাতা খুলে প্রথমেই নামটা চোখে পড়ল। ইনি একটা ধারাবাহিক লিখছেন এ পত্রিকায় জানতেন লেখক। বরাতটা তাঁর কাছেই প্রথমে এসেছিল। কিন্তু তিনি ততদিনে মনস্থির করে ফেলেছেন এবছর পুজোবার্ষিকীর একটা ছোট উপন্যাস ছাড়া আর কিছু লিখবেন না কোথাও, সমস্ত মনোযোগ দেবেন এই লেখাটায়। সম্পাদক প্রায় হাতে পায়ে ধরেছিলেন, মনে পড়ে সূক্ষ্ম একটা হাসি ফুটে উঠল লেখকের ঠোঁটে। তারপর সম্পাদক এই অন্য লেখকটির কাছে যান এবং বোঝাই যাচ্ছে অনুরোধ বিফলে যায়নি।

নিজের লেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণেই, অন্তত লোকে সেইরকমই ভাববে,উপন্যাসটা ফলো করেননি লেখক। এখন এই শান্ত পুকুরধারে বসে পাতার নম্বর খুঁজে পড়তে শুরু করলেন তিনি। ধারাবাহিক অনেক এগিয়ে গেছে, গল্প ফলো করা আর সম্ভব হবে না। লেখকের তা উদ্দেশ্যও নয়। তিনি দেখবেন লেখা। শব্দচয়ন। বাক্যের ছন্দ। দুটি বাক্যের মধ্যের বিরাম। সংলাপ। সংলাপের সাবটেক্সট। এবং যত দেখলেন তত তাঁর মনে শান্ত ভাবটা সরে গিয়ে একটা উল্লাস জেগে উঠল। কী খারাপ, কী খারাপ। এই লিখেও যে বিখ্যাত হওয়া যায় এটা ভেবে, চোখের সামনে দেখে, কেমন একটা অবিশ্বাসের ভাব হল। এবং এই ভেবে গর্ব হল যে বাকিদের থেকে কতখানি ভালো। কতখানি এগিয়ে। আর তখনই নিজের সৃষ্টির আসল অনুপ্রেরণা স্পষ্ট হয়ে গেল লেখকের কাছে। সন্তানের হাসি নয়, সংসারের নিরাপত্তা, পাঠকের অনুরাগ নয়। তাঁর লেখার প্রধান অনুপ্রেরণা তিনি নিজেই। তাঁর খ্যাতির লোভ। অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা। ঈর্ষা। কবে তিনি সিরিয়াসলি লিখতে শুরু করেছিলেন মনে পড়ে গেল লেখকের। গাঁজা খেতে খেতে শেষমেশ এম এ পরীক্ষাটাই দেওয়া হল না। তারপর যখন বন্ধুরা সবাই চাকরিবাকরি নিয়ে কলকাতা, দিল্লি, বিদেশ, তখন তিনি ভাড়াবাড়িতে ভাইবোনের সঙ্গে ভাগ করা ঘরের মেঝেয় তিন ইঞ্চি পুরু তোশকের ওপর শুয়ে সিলিং-এর ছ্যাতলার মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে আছেন। ঠিক ওই ভঙ্গিতে শুয়ে থাকতে থাকতে প্রথম ডুবে যাওয়ার অনুভূতিটা হয়েছিল। খটখটে শুকনো দুপুরে স্পষ্ট টের পেলেন নাকমুখ জড়িয়ে যাচ্ছে শ্যাওলায়, গলা পর্যন্ত উঠে আসছে পাঁকভর্তি ঘোলা জল। এই পৃথিবীর কেউ তাঁর নাম জানার আগে, তাঁকে চেনার আগে এই ভাঙা তক্তপোষে শুয়ে তিনি মরে যাচ্ছেন, তাঁর বাবা কাকা ঠাকুরদা যেমন গেছে। ওই মৃত্যুসুড়ঙ্গ থেকে বেরোনোর একমাত্র অস্ত্র ছিল লেখা। তাঁর প্রথম প্রেমের উপন্যাসে লেখক হাত দিয়েছিলেন প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর। হানিমুনে দার্জিলিং-এর টিকিট কাটার পয়সা জোগাড় করতে না পারার পর তিনি ফেঁদেছিলেন পাহাড়ের পটভূমিকায় এক ঐতিহাসিক উপন্যাস। লেখা কোনওদিন তাঁর মোক্ষ হয়ে ওঠেনি, মোক্ষলাভের পথ হয় রয়ে গেছে। জীবনের প্রতিটি আঘাতের প্রত্যুত্তর তিনি দিয়েছেন লেখা দিয়ে। শুধু শ্রেষ্ঠ কেন, তাঁর জীবনের প্রতিটি লেখাই যদি কাউকে উৎসর্গ করতে হয় তাহলে সেটা করা উচিত তাঁর এই কাটাগোল্লা পাওয়া জীবনটাকে। তাঁর প্রতিটি পরাজয়কে, প্রতিটি অপ্রাপ্তির অবসাদকে, অজ্ঞাতসারে মরে যাওয়ার আতংককে। আর কাউকে না।

***

পরদিন শেষরাতে বিছানা ছাড়লেন লেখক। বহু বছর হল আর অ্যালার্মের প্রয়োজন পড়ে না। সারা বাড়ি, সারা পাড়া, সারা চরাচর অচৈতন্য। এ রকমই থাকবে বেশ কয়েকঘণ্টা। লেখক পা টিপে টিপে বাথরুমে গেলেন। রান্নাঘরে ঢুকে চা বানালেন। তারপর লেখার ঘরে ঢুকে দরজায় ছিটকিনি তুলে চেয়ারে এসে বসলেন।

চায়ের ওম হাতের তেলোয় আরাম দিচ্ছে। টেবিলের ওপর বন্ধ ল্যাপটপটার দিকে তাকিয়ে লেখকের মনে পড়ে গেল উৎসর্গের স্লট এখনও খালি। কিন্তু এখন সেই নিয়ে ভাবার সময় নয়। ক্যালেন্ডারটা তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। একটা নতুন খোপ। নতুন সংখ্যা। নতুন দিন। হয় তিনি লিখবেন, নয় লিখবেন না।


দ্বিতীয়টা কোনও বিকল্পই নয়। নতুন ফাইল খুলে টাইপ করতে শুরু করলেন লেখক। একটা আইডিয়া অনেকদিন ধরে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। লেখকের শিরদাঁড়া টানটান হল, হাতের আঙুল গতি নিল, মস্তিষ্ক সংহত হল তীব্র মনঃসংযোগে। 

***

লেখকের মৃত্যুর দশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে যখন রাজ্য জুড়ে আবার তাঁর লেখা নিয়ে সেমিনার আর আলোচনাসভার বান ডাকল তখন আবার নতুন করে প্রশ্নটা উঠল। স্ত্রী বলেছিলেন, কী জানি বাবা, গাদাগুচ্ছের লোক আসত, লক্ষবার চা করে দিতে হত, ও নাম কখনও শুনেছি বলে তো মনে পড়ে না। লেখকের রকস্টার ছেলে, যিনি একসময় বুর্জোয়া বাবার বুর্জোয়া সাহিত্যের বিরুদ্ধে গান বেঁধে গেয়েছিলেন, এখন অনেকটা পোষ মেনে এসেছেন, সাহিত্যসভায় বাবার ছেলে হওয়ার অনুভূতিজ্ঞাপনে আপত্তি করেন না, তিনিও বলেছেন যে যদিও তিনি আর তাঁর বাবা খুবই “ক্লোজ” ছিলেন, এই নামের কোনও লোকের কথা বাবা কখনও বলেননি। মোস্ট প্রব্যাবলি ইট ইজ আ মেড আপ নেম।

সবদিক বিবেচনা করে সেটাই বিশ্বাসযোগ্য মনে করছেন গবেষকরা। লেখককে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, একাধিকবার, তিনি কোনওদিন জবাব দেননি। হেসে এড়িয়ে গেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ডায়রি ঘেঁটে, চিঠি হাঁটকে কোথাও কোনও উল্লেখ পাওয়া যায়নি। তাঁর বাড়ির বুককেস উষ্টুমধুষ্টূম করে খুঁজে, শেষে তাঁর লেখার ঘরে ঢুকে থামতে হয়েছিল। খোঁজার মতো কিছু নেই, শ্মশানের মতো শূন্য  একটা ঘর। দেওয়ালে একটা ক্যালেন্ডার ঝুলছিল, অতি উৎসাহী একজন ছোকরা সাংবাদিক সেটাই উল্টে দেখেছিল। যেন ওর আড়ালে একটা জলজ্যান্ত মানুষ লুকিয়ে থাকলেও থাকতে পারে।

ফক্কা!

তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি যাকে উৎসর্গ করে গেছেন লেখক সেই উসমান  আলির চিহ্ন কোথাও পাওয়া যায়নি।


Comments

  1. দুর্দান্ত হয়েছে লেখা। খুব ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।

    ইন্দ্রানী

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন কী, ইন্দ্রাণী, ওটা গোটাটাই আপনার প্রাপ্য। থ্যাংক ইউ। মন ভালো হয়ে গেল।

      Delete
  2. Like a noir film. Reminds me of "Abstraction".

    ReplyDelete
  3. darun likhechho. so detailed...ekjon lekhak lekhar bhalo mondo kemon kore bichar koren sesob gyan o tomar achhe!! tumi seriously sahitye mon dao... tabe abantor theke amader bonchito na kore... ami to chhai nije engaged thaklam kina eita bhebei thik kore nii je amar kache bhalo na kharap...critical bichar kori but occasionally - Bratati.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, ব্রততী। আমারও ভালোমন্দ বিচারটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তোমার মতো।

      Delete
  4. Khub bhalo laglo porey. Khub shundor likhecho.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, শর্মিলা।

      Delete
  5. Replies
    1. থ্যাংক ইউ, প্রদীপ্ত ।

      Delete
  6. chomotkar lekha hoyechey. ebar tomar lekha goyenda gopper ashay roilam :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, থ্যাংক ইউ, শর্মিলা। আমিও বসে আছি গালে হাত দিয়ে, কবে মাথা থেকে একটা প্লট বেরোবে।

      Delete

Post a Comment