পাড়াপড়শি
কোথায় থাক-র উত্তরের একটা চেনা প্রত্যুত্তর আছে। সেটা হচ্ছে আমি যেখানে থাকি তার আশেপাশের প্রশ্নকর্তার চেনা কেউ একজন থাকে, তাঁকে আমি চিনি কি না। “আশপাশ”-এর পরিধি জায়গা ভেদে বদলে যায়। নাকতলার আশপাশ ৮বি থেকে টালিগঞ্জ। রিষড়ার ক্ষেত্রে সেটা হয়ে যায় লিলুয়া থেকে তারকেশ্বর।
"ভদ্রেশ্বরে আমার পিসতুতো মামি থাকেন, চেনেন?"
"আচ্ছা, শ্রীরামপুরে মামাতো পিসি?"
কাঁহাতক আর লোককে হতাশ করা যায়। আমি পাড়ার নাম শুনে খানিকক্ষণ কপাল কুঁচকে থাকি, উনিশশো নিরানব্বইয়ে একবার গেছিলাম বটে ওই পাড়ায়। "কী রকম দেখতে বলুন তো আপনার পিসি? রসগোল্লার মতো মুখ, বাতাসার মতো টিপ?"
"বাতাসা টিপ মিলে গেছে, মুখটা খালি রসগোল্লার বদলে লর্ড চমচম। মনে পড়ছে?"
আমি সেকেন্ডখানেক সময় নিয়ে চোখ বিস্ফারিত করি, "হ্যাঁ হ্যাঁ, পড়ছে পড়ছে। তিন নম্বর বাসে করে যেতেন আসতেন তো? ওঁকে তো দেখেছি কতবার।"
খুশি হয়ে সামনের লোক চলে যান। আজ রাতে নির্ঘাত পিসির বাড়ি ফোন যাবে। "তোমাদের ওদিকের একজন, রিষড়ায় থাকে, মাশরুমের মতো নাক আর ছাগলের মতো চোখ। চেন নাকি?"
একমাত্র সি আর পার্কের ক্ষেত্রে দেখেছি পরিধিটা সি আর পার্কেই সীমাবদ্ধ থাকে। কেউ আমাকে কখনও সি আর পার্কে থাকি শুনে ময়ূরবিহারের বাঙালি কিংবা গাজিয়াবাদের বাঙালিকে চিনি কিনা জানতে চাননি। তবে ডি ব্লকে থাকি অথচ সি কিংবা ই ব্লকের লোককে চিনি না শুনলে অনেকেই আহত হয়। আমি তড়িঘড়ি বলি, "আসলে আমরা ভাড়া থাকি তো, বছর বছর পাড়া বদলে যায়, তাই কাউকে চেনা হয়ে ওঠে না।"
না চেনা নিয়ে আমার আফসোসই আছে। এক জায়গায় থাকলে, এক বাজারে বাজার করলে, এক ফুচকাওয়ালার থেকে ফুচকা খেলে, এক রসরাজ থেকে মিষ্টি কিনলে একে অপরকে চেনাই উচিত, অন্তত আমার তাই মত। অর্চিষ্মান শহুরে লোক, ওর এ সব না চেনায় কোনও অপরাধবোধ নেই। অত চেনাচিনির কী আছে। পাশ দিয়ে গেলে ফোন চেক করার ভঙ্গি করবে, নেহাত চোখে চোখ পড়ে গেলে কাষ্ঠ হাসবে, ব্যস।
রিষড়ার বাড়িতে একদিন সকালে ছাদে দাঁড়িয়ে আমগাহের মুকুল পরীক্ষা করার সময় সামনের বাড়ির একজনকে উল্টোদিকের বাড়িকে উদ্দেশ্য করে “আজ বিছানা কে তুলল, কর্তা না গিন্নি?” চেঁচাতে শুনে অর্চিষ্মান যত অবাক হয়েছিল, তত আর কিছুতে নয়।
কিন্তু পরিস্থতি সামান্য হলেও বদলাচ্ছে। এক পাড়ায় প্রায় সাড়ে তিন বছর কাটানোর পর আমি আমার প্রতিবেশীদের অল্প অল্প চিনতে শুরু করেছি। বেশিরভাগেরই সঙ্গে আলাপ চৌখিক, কারও কারও সঙ্গে কিঞ্চিৎ বেশি। এঁদের একজন থাকেন মোড়ের মাথার, যেখানে পাশাপাশি দাঁড়ানো একটা তুলো গাছ আর একটা ছাতিম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোক বিকেল হলেই মোটা ছুঁচে বিঁধিয়ে রজনীগন্ধার মালা গাঁথেন, চারতলা বাড়িটার দোতলায়। বারান্দায় একগাদা টব আর গাছ আর একটা হেলানো চেয়ার, চেয়ারের ওপর ছড়ানো একগাদা পেপারটেপার খেয়াল করেছিলাম আমি আগেই, একদিন দু’হাতে ভারি বোঝা নিয়ে ফিরছি, এমন সময় ওপর থেকে ঘোঁক করে একটা শব্দ এল। সংক্ষিপ্ত এবং গম্ভীর। মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি ঘৃতকুমারীর ঝাড়ের ফাঁক থেকে উঁকি মারছে একটি প্রাজ্ঞ মুখ। বাদামি রঙের ছোটখাটো শরীরের আগায় গোল মুণ্ডুতে গোলতর চোখ, ভুরু সর্বক্ষণ কোঁচকানো, ঠোঁটে সর্বদা বিরক্তি। আমি মুখ তুলে, মুখ নামিয়ে, এদিকওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, "আমাকে কিছু বলছেন দাদা?" আরেকবার ঘোঁক শব্দ হল। এবার বিরক্তির মাত্রাটা বেশি। "আশেপাশে আর কি কেউ আছে, যে তাকে ডাকব? আর দেখে কি মনে হচ্ছে আমি অকারণে ডাকাডাকি করার লোক?"
মোটেই নয়। পাগ আমাকে তারপরেও অনেকবার ডেকেছে। একদিন ঝালমুড়ি খেতে খেতে আসছিলাম, বারান্দা থেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, "কী খাচ্ছিস?" নিরামিষ মুড়ি তাও আবার ঠেসে লংকা দেওয়া শুনে ছ্যাৎরানো মুখ আরও ছেতরে চলে গেল বারান্দার ওদিকে।
প্রতিবেশী বটে, কিন্তু পাগকে আমি রীতিমতো সমীহ করে চলি। আমি নিশ্চিত পাগ গ্রাফিক নভেল ছাড়া আর কিছু পড়েন না, তাও শুধু ইংরিজিতে হলেই।
স্যার জেমস-এর সঙ্গে আমার দেখা হয় সাধারণত সফল-এর দোকানে। আমি ঝুড়ি নিয়ে আলুপটল টমেটো কুড়োই। মা বলেন গোল টমেটো পোড়াতে ভালো। গোল টমেটো আজকাল আর পাওয়া যায় না, সব শক্ত, ছুঁচোলো। আমি টমেটো টিপে টিপে পরীক্ষা করি, স্যার জেমসের বকলস লাগোয়া পার্কের রেলিং-এ বাঁধা থাকেন। আমি মাঝেমাঝে আই কন্ট্যাক্টের চেষ্টা করেছি, বিশেষ সুবিধে হয়নি। একদিন ঘাড় ঘোরাতে গিয়ে চোখে চোখ পড়েই গেল আর তখন এক বিরাট হাই তুলে নিজের ধারালো দাঁত বিকশিত করেই মুখ ফিরিয়ে স্যার জেমস আবার নিজের কাজে মন দিলেন। কাজ বলতে পাশ দিয়ে একটা নেড়ি যাচ্ছিল তাকে দেখে একবার ঘ্যাঁক করে নিজের আপত্তি জানান দেওয়া।
এত দেমাক কীসের, সত্যি বলছি, ভেবে পেতাম না। তারপর রহস্য উদ্ঘাটন হল। যিনি স্যার জেমসকে পার্কের রেলিং-এ বেঁধে সফল-এ ঢোকেন তাঁকে দেখে। তিনি কুমড়ো/সিতাফলকে পাম্পকিন বলেন, ঢ্যাঁড়স/ভিন্ডিকে বিন্ডি, গোবি গোওবি হয়ে যায় অসতর্ক হলেই। বুঝলাম স্যার জেমস বহুদিন বিদেশে থেকে ফিরেছেন। আমার মতো নেটিভের সঙ্গে মেশার উৎসাহ নেই। মনের দুঃখ খানিকটা কমল। স্যার জেমস নামটাও তখনই স্থির করলাম।
দেমাক অবশ্য যে কেবল বিদেশে গেলেই হতে হবে তেমন নয়। বা স্যার জেমসের মতো দশাসই হলেই নয়। দেমাকের ক্ষেত্রে সাইজ ডাজ নট ম্যাটার। আমাদের বাড়ির পেছনের গলিতে একজন প্রতিবেশী থাকেন, দেমাকে যিনি স্যার জেমসের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেন, অথচ সাইজের দিক থেকে স্যার জেমসের দশ ভাগের এক ভাগ। ইন ফ্যাক্ট, দূর থেকে তিনি যখন তাঁর মানুষের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে আসেন অনেক সময় তাঁকে দেখাই যায় না, খালি মনে হয় মাটির ওপর কুচকুচে কালো রঙের একটা কম্পমান বল চলেছে। কাছে এলে বলটার নিচে চারটে পা দেখা যায় আর একেবারে ঘাড়ের কাছে এলে স্পষ্ট হয় বলের সামনে একটা গোল মুখ, ঝুপো লোমের মধ্যে থেকে গোল গোল কাচের গুলির মতো একজোড়া চোখ। অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এঁর দেমাক চেহারার। ধরাকে সরা এবং আমাকে মাছি জ্ঞান করেন।
আরও অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। সকাল বিকেল আমাদের গলি পেরিয়ে আসেন যান। কেউ কেউ খেয়ে খেয়ে এত মোটা হয়েছেন যে জানুয়ারির শীতেও এক হাত লম্বা জিভ বার না করে হাঁটতে পারেন না। কেউ ভয়ানক ফিট, সঙ্গের মানুষকে ছুটিয়ে সারা করেন। কেউ বুড়োবুড়ির বাড়িতে থাকেন, বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার লোক নেই, সারা বিকেল গ্রিলের দরজায় নাক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আশপাশের বাড়ির প্রতিবেশীরা বেড়াতে বেরোলে কথোপকথন চালান। বা চালানোর চেষ্টা করেন। কারণ যাদের সঙ্গে ইনি কথা বলেন তারা বেশিরভাগ সময়েই উত্তর দেয় না, ল্যাজ নাড়তে নাড়তে নাক আকাশে তুলে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায়। এঁর সব কথা যে বুঝি তা নয়, তবে শুনে মনে হয় কথাগুলো বিশেষ মোলায়েম নয়। সারাদিন বন্দী থেকে থেকে বেচারার মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে।
আরও অনেকে আছেন, যারা রাস্তায় কিংবা বাজারে থাকেন, মনুষ্যসঙ্গের ধার ধারেন না। বাজারের ঠিক মাঝখানটায় কাত হয়ে শুয়ে থাকেন চার পা যতখানি সম্ভব ছড়িয়ে, বাকিরা কোথা দিয়ে হাঁটবে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র কনসিডার না করেই। আমি মাঝে মাঝে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, ভাবি, ঘুমন্ত যখন অভদ্রতা হবে না নিশ্চয়। কাছে যাওয়া মাত্র ভুল ভাঙে। লোক গেলে পা সরাচ্ছেন না, কিন্তু চোখ খুলে রেখেছেন অল্প করে। আমি যে ওঁকে দেখছি, সেটা উনিও দেখে রাখছেন।
পাড়াপড়শির খবরাখবর না রাখাজনিত যে গ্লানিটা আমার ছিল সেটা খুব ধীরে হলেও কাটতে শুরু করেছে। সি আর পার্কে আপনার চেনাজানা দুপেয়ে কেউ যদি থেকে থাকেন তাহলে খুব সম্ভবত আমি তাঁকে চিনি না, কিন্তু সেই দু’পেয়ের চারপেয়ে যদি কোনও সঙ্গী থাকে তাহলে খুব সম্ভব আমি সেই চারপেয়েকে চিনি।
Khubi bhalo ei lekhata :-) Onyorakam. Khub khub bhalo.
ReplyDeleteআরে থ্যাংক ইউ, সায়ন। সত্যি ভালো লাগল।
Deletemishti lekha
ReplyDeleteধন্যবাদ, চুপকথা।
DeleteKi sundar lekha.
ReplyDeleteধন্যবাদ, প্রিয়াঙ্কা।
DeleteDarun likhechen. Monib chinte hoi kukur diye. (Deshe Bideshe obosho ektu onyo version ache). G(n)opher ami G(n)opher tumi tai diye jai chena.
ReplyDeleteসে তো বটেই। আমি এতদিন উল্টো ভাবতাম, ধীরে ধীরে সোজাটা টের পাচ্ছি।
DeleteBesh ekta onyorokom bishoye lekha. Besh bhalo laaglo pore.
ReplyDeleteAar prothome oi para concept byaparta amar khub bhalo legechhe. Erokom adbhut abhigyota amar o hoyechhe. USA te ek probaasi (Banglar baire born and brought up) aami kolkata theke gechhi shune bollen onar kono nikotamiyo kolkatai thake. Jaigar naam jiggesh korate bollen Bandel!! Ebar tahole para bolte ki bole bujhun....
হ্যাঁ, ভূগোল ব্যাপারটা বইয়ের পাতায় তো বটেই, আমাদের মাথার ভেতরেও ভয়ানক গোলমেলে, সুস্মিতা।
Deleteবেশ লাগল কিন্তু!!
ReplyDeleteধন্যবাদ, ধন্যবাদ।
Deleteaha aha aha. akkebare moner moto post likhecho pore dil khush hoye gelo.
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, কুহেলি।
Deletekhub mojar ar mon bhalo kora lekha
ReplyDeleteধন্যবাদ, চুপকথা।
Deleteআরে হাত মেলান মশাই, হাত মেলান! আমারও যে তাই! মানুষের সঙ্গে ভাব জমাতে সময় লাগে, চারপেয়েদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটালেই দেখি ল্যাজ নেড়ে কান খাড়া করে আদর খেতে প্রস্তুত|
ReplyDeleteহাত মেলালাম, অন্বেষা। আমি অবশ্য মনোযোগ দূর থেকেই দিই, যা সব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন প্রাণী, কাছে যেতে ভয় লাগে।
Deletebah, khub suswadu, onyorokom ekta lekha. :)
ReplyDeletekhub bhalo laglo.
থ্যাংক ইউ, অরিজিত। আমারও খুব ভালো লাগল।
Deleteইন্টারেষ্টিং বিষয়বস্তু। খুব ভালো লাগলো। ছোট দুপেয়েরাও কিন্তু খুব মজার হয়। ওই ভূগোলের ব্যাপারে আমার একটু বক্তব্য আছে। আমি তো আসামে থাকতাম আর কলকাতায় কয়েকবারই এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে - আমার এই বন্ধু কি মাসতুতো দাদা কি কেউ একজন আসামে থাকে, আমি কি চিনি? বোঝো ঠ্যালা। আমি থাকি ডিগবয় আর সেই কেউ থাকে তেজপুর কি নগাঁও কি শিলচর যেখানে আমি কোনোদিন যাইনি। অবশ্য আমি যাকে কলকাতা বলি সেটা শুনলেও অনেকেই নাক কোঁচকাবে যতই সে কলকাতার পিনকোড হোকনা কেন।
ReplyDeleteকলকাতার বাইরে গেলেই ভূগোল গুলিয়ে যায়, পশ্চিমবঙ্গের বাইরে গেলে তো এ সব সমস্যা হবেই, অমিতা।
Delete