বুবুনের মা
মূল গল্পঃ Why Herbert Killed His Mother
লেখকঃ Winifred Holtby
লেখকঃ Winifred Holtby
*****
বুবুনের মা’কে আমরা প্রথমে বুবুনের মা বলে চিনতাম না। শুধু আমরা না, কেউই চিনত না। আমরা মালবিকা বউদি বলে চিনতাম, বুবুনের দিদিমা দাদাই মিলি বলে চিনতেন, বুবুনের ঠাকুমা ঠাকুরদা, ছোটকা, রাঙাপিসি কেউ বড়বৌমা, কেউ বড়বৌদি ইত্যাদি নামে চিনতেন, বুবুনের বাবা প্রকাশ্যে মালবিকা এবং আড়ালে সোনা বলে চিনতেন, আর স্কুলের বন্ধুরা, যাদের সঙ্গে বুবুনের মা যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেননি, তারা মালবিকা, মালু, মালা ইত্যাদি নামে চিনত।
এ সবই বুবুন হওয়ার আগে।
আমাদের ইদানীং সন্দেহ হয়, একমাত্র বুবুনের মা-ই হয়তো নিজেকে বুবুনের মা বলে চিনতেন, গোড়া থেকেই। অন্য সব নামগুলোর আড়ালে তিনি তাঁর আসল পরিচয়টা লুকিয়ে রেখেছিলেন। না হলে মাতৃসদনের দোতলার জানালার ধারের বেডে বুবুনকে পরিষ্কারটরিশকার করে শুইয়ে রেখে যাওয়ার (বুবুনের মায়ের নির্দেশ ছিল, রক্ত, শ্লেষ্মা মাখামাখি অবস্থায় কেউ যেন বুবুনকে না দেখে) মুহূর্ত থেকে মালবিকা, মিলি, মালা এবং আরও যাবতীয় পরিচয় ঝেড়ে ফেলে, বুবুনের মা নিজেকে ‘বুবুনের মা’ হিসেবে যেভাবে পৃথিবীর সামনে উন্মোচিত করলেন, তা অসম্ভব।
বুবুনের মা নিজে কবে থেকে জানলেন? আমরা জিজ্ঞাসা করিনি। কৌতূহলের অভাবে নয়, চক্ষুলজার খাতিরে। বুবুনের বাবার স্পার্ম ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গিয়ে ভ্যাজাইনা, সারভিক্স পেরিয়ে ফ্যালোপিয়ান টিউবে দাঁড়িয়ে ঘন ঘন ঘড়ি দেখতে থাকা বুবুনের মায়ের ডিম্বাণুর সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার মুহূর্ত থেকেই কি? এ সব ভ্যাজাইনা, ফ্যালোপিয়ান, সেক্সটেক্সে অবশ্য বুবুনের মা বিশ্বাস করতেন না। ঈশ্বরের দান কোন নোংরা পথে এসেছে সেটা অবান্তর, এসেছে যে সেটাই সব।
প্রথমদিকে বুবুনের মায়ের স্বাস্থ্যে নানারকম জটিলতা দেখা দিয়েছিল। ডাক্তারদিদিমণি পরীক্ষা করে ওষুধ দিলেন। বললেন আয়রন কম আছে, ঠেসে রাজমা খান। রেললাইনের ওপারের মারওয়াড়ি পাড়ার দোকান থেকে রাজমা কিনে আনলেন কাকু, বুবুনের মায়ের পিসশাশুড়ি তারকেশ্বরের মাথার পচা ফুলের পাপড়ি মাদুলির ভেতর ঢুকিয়ে হাতে বেঁধে দিয়ে গেলেন। বুবুনের মা মুখে কিছু বললেন না, কিন্তু মনে মনে জানলেন এসবে আসলে কিছু হয় না। আসল হচ্ছে মায়ের মন। আর সেই মন তাঁকে বলেছিল যে বুবুনের কোনও ক্ষতি হবে না।
মায়ের মন ছাড়া আরও একটা ব্যাপারে বুবুনের মা গোড়া থেকেই বিশ্বাস করেছিলেন, তা হল নাড়ির টান। যা সম্ভাবনার প্রথম মুহূর্ত থেকে মা ও সন্তানের মধ্যে যোগস্থাপনা করে। বুবুনের মা সে টান দিবারাত্র অনুভব করতেন। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর ছাদে গিয়ে নিজের বাড়ন্ত পেটের ওপর হাত রেখে বুবুনের মা সে নাড়ির সাহায্যে বুবুনের সঙ্গে কথোপকথন করতেন। সারাদিন কী কী হল, আজ তিনি কী কী রান্না করেছেন, রান্নাগুলো কেমন হয়েছিল, ঠিকে ঝি এসেছিল কি না, শাশুড়ি এবং ননদের সঙ্গে তাঁর কী কী ঝগড়া হয়েছে, সে সব ঝগড়ায় তাঁর যুক্তির অকাট্যতা, বুবুনের বাবা আরেকটু চালাক হলে যে চাকরিতে উন্নতি করতে পারতেন এই সব।
কিন্তু বুবুনের সঙ্গে এসব কথা বলতে বুবুনের মায়ের ভালো লাগত না। বলতেন, আর কারও সঙ্গে এ সব বলা যায় না বলে। বুবুনের মায়ের কাছে কথোপকথনের সেরা অংশ ছিল বুবুনের ভাবী জীবন নিয়ে প্ল্যানিং। বুবুন বড় হয়ে কী হবে। ডাক্তার, নাকি ইঞ্জিনিয়ার? পেটে হাত রেখে বুবুনের মা অপেক্ষা করে থাকতেন, বুবুন কোনটায় সাড়া দেয়। প্রথমদিকে বুবুন চুপ করে থাকত। তবে কি ছেলে অন্য কিছু হতে চায়? পাশের বাড়ির মিতালির বরের মতো পেটরোগা প্রফেসর? বুবুনের মায়ের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গিয়েছিল। মাথা ঘুরে উঠেছিল। নেহাত পড়ে গেলে বুবুনের ক্ষতি হতে পারে ভেবে তিনি তাড়াতাড়ি অ্যান্টেনার থামটা ধরে নিজেকে সামলে নিয়েছিলেন। এরপর রাতের পর রাত ধরে শুরু হল বোঝানো। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার উপযোগিতা আর প্রফেসর হওয়ার অপকারিতা। বুবুনের মায়ের বাপের বাড়ির দিকে সকলেই হয় ডাক্তার নয় ইঞ্জিনিয়ার, তাঁদের কত বড় বাড়ি, গাড়ি, বিদেশভ্রমণ। আর উল্টোদিকে মিতালির বর। তাও যদি কলকাতার কলেজ হত। বনগাঁ লাইনের কোন ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুরের কলেজে পড়াতে যায়, ছাত্ররা সব চাষাভুষো। দোতলা তুলেই দম বেরিয়ে গেছে, প্লাস্টার করার পয়সা হয়নি। অথচ দেমাকের অন্ত নেই। মোটা কালো চশমার আড়াল থেকে এমন করে তাকায় আর খাবলা খাবলা দাড়ির আড়াল থেকে এমন করে হাসে যেন একা ও-ই মানুষ, বাকিরা সব পোকা।
বোঝাতে বোঝাতে বুবুনের মায়ের যখন সব যুক্তি শেষ, গলায় প্রায় রক্ত উঠে গেছে, যখন তিনি ভাবতে শুরু করেছেন, তাহলে কি বুবুন জেদী আর ঠ্যাঁটা? নাকি আরও সাংঘাতিক, নাড়ির টান বলে আসলে কিছু নেই? তখন এক রাতে পেটের ভেতর থেকে একটা মৃদু নড়াচড়া ভেসে এল। দিয়েছে দিয়েছে, ছেলে সাড়া দিয়েছে! উত্তেজনায় বুবুনের মায়ের গলা প্রায় বন্ধ হয়ে এল, তিনি পেট চেপে ধরে জিজ্ঞাসা করলেন,
ডাক্তার না ইঞ্জিনিয়ার?
বুবুন পেটের ভেতর নড়ে উঠল। বুবুনের মা বুঝতে পারলেন না। মায়ের মন, তবু ছেলের লাথির সংকেত উদ্ধার করতে পারছে না? গ্লানি গ্রাস করল বুবুনের মাকে। তারপর তিনি বুঝলেন, তাঁর প্রশ্নটা করায় ভুল হয়েছে। তিনি আরেকবার শুরু করলেন,
ডাক্তার?
সব চুপচাপ। দূরে একটা রাতজাগা পাখি ট্যাঁ করে উঠে থেমে গেল।
ইঞ্জিনিয়ার?
তিন সেকেন্ড সব চুপচাপ। বুবুনের মায়ের হৃদপিণ্ডের ধড়াম, ধড়াম, ধড়াম দামামার আড়ালে অবশেষে প্রায় অস্ফুট একটি ছোট লাথি এসে ঠেকল বুবুনের মায়ের স্ফীত পেটের দেওয়ালে।
ফাঁকা অন্ধকার ছাদে একা একা দাঁড়িয়ে আনন্দে কাঁদতে লাগলেন বুবুনের মা। তাঁর ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে।
*****
ছেলের কেরিয়ার সেটল হয়ে যাওয়ার পর অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন বুবুনের মা। তাঁর গর্ভাবস্থাজনিত শারীরিক সমস্যা কমে এল। ডাক্তারদিদিমণি বললেন, রাজমায় কাজ দিয়েছে। পিসিশাশুড়ি বললেন, বাবা তারকনাথের জয়। বুবুনের মা মুচকি হাসলেন। তিনি আবার বুবুনের বাবার সঙ্গে হেসে কথা বলতে শুরু করলেন, রান্না করতে করতে গুনগুন করতে লাগলেন। একদিন দুপুরে খেয়েদেয়ে উঠে টিভি খুলে দেখলেন, তাঁর প্রিয় নায়িকার সিনেমা চলছে। সিনেমায় নায়কনায়িকার প্রেম হল। তারপর একই গানে বিয়ে এবং গর্ভসঞ্চার হল। বুবুনের মা আগেও অনেকবার দেখেছেন সিনেমাটা, কিন্তু এবার তিনি অনেক বেশি করে রিলেট করতে পারলেন। সুখবরটা পাওয়ার পর নায়িকা তাঁর খাটের সামনে নায়কের একটি প্রায় মানুষপ্রমাণ প্রতিকৃতি সাঁটলেন। যাতে সর্বক্ষণ, চলতেফিরতে, ঘুমোতে যাওয়ার আগে, ঘুম থেকে চোখ খুলেই সেই ছবির দিকে তাকাতে পারেন। (এই খানে বুবুনের মা নায়িকার সঙ্গে নিজের আরও একটি মিল দেখে রোমাঞ্চিত হলেন, দুজনের কারও মনেই সন্দেহ ছিল না যে তাঁদের ছেলেই হবে)। এ সব হাঙ্গামার উদ্দেশ্য যাতে ছেলে ছবির মানুষটির মতো দেখতে হয় তা সুনিশ্চিত করা।
এরপর অবশ্য বুবুনের মা একটা সমস্যার সম্মুখীন হলেন যেটা নায়িকাকে হতে হয়নি। নায়িকার হাতের কাছে সুদর্শন নায়ক ছিলেন, বুবুনের মাকে টাঙাতে হলে টাঙাতে হবে বুবুনের বাবার ছবি, আর তাহলে বুবুন হয়ে যাবে পাঁচ ফুট পাঁচ, মোটা, কালো, ঝুপোগোঁফওয়ালা, টাকমাথা, খয়েরজর্দার ছোপলাগা এবড়োখেবড়ো দাঁতওয়ালা একটা লোক।
অনেক ভেবে বুবুনের মা তাঁর ঘরের দেওয়ালে একটি ফুটফুটে ফর্সা, গোল গোল গালওয়ালা, নীল কাচের গুলির মতো চোখওয়ালা, পাখির ডানার মতো পলকওয়ালা একটি শিশুর ছবি সাঁটলেন।
মায়ের মন এবারেও কাজ করল। আমরা খবর পেয়ে হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম বুবুনের মায়ের খাটের পাশে রেলিং দেওয়া ছোট্ট কটে শুয়ে হাতপা নাড়ছে ফুটফুটে ফর্সা, গাবলুগুবলু, মোটাসোটা, মাথাভর্তি কুচকুচে কালো চুলওয়ালা একটা জ্যান্ত পুতুল। নীল চোখ আর সোনালি চুল হল না দেখে বুবুনের মা একটু হতাশ হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর বাপের বাড়ির দিকে কারওরই চোখের মণি নীল কিংবা চুলের রং সোনালি নয়, বিশেষ করে যারা ডাক্তারইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। সে কথা মনে করে নিজেকে সান্ত্বনা দিলেন।
দুঃখের বিষয়, সান্ত্বনার প্রয়োজন দিনের পর দিন ক্রমেই বেড়ে চলল। যখন বুবুন যখনতখন কাঁদত, যখনতখন বিছানা ভেজাত, রাতে ঘুমোতে দিত না। বুবুনের মাকে এ বিষয়ে অনেকে সাবধান করেছিলেন, বিশেষ করে তাঁর বন্ধুরা, যাঁরা কিছুদিন আগেই মা হয়েছেন। বুবুনের মা হাসিমুখে শুনেছিলেন এবং ধরে নিয়েছিলেন এসব মা হিসেবে তাঁর বন্ধুদের অক্ষমতার প্রমাণ। তিনি বুবুনকে এমন যত্নে রাখবেন যে সে কাঁদবে না। এমন ডিসিপ্লিনে প্রথম থেকেই বেঁধে ফেলবেন যে সে যখন ঘুমোনোর তখন ঘুমোবে, যখন খেলার তখন খেলবে, যখন বাথরুম পাবে ঝুনঝুনি নাড়িয়ে জানান দেবে। ইন ফ্যাক্ট, ছাদে দাঁড়িয়ে এ মর্মে বুবুনের সঙ্গে তাঁর রীতিমত চুক্তিও হয়েছিল, কিন্তু দেখা গেল বুবুন সে চুক্তির ধার ধারছে না। যখন ইচ্ছে হচ্ছে কাঁদছে, যখন ইচ্ছে ঘুমোচ্ছে, এবং যখন ইচ্ছে যেখানে ইচ্ছে বাথরুম করছে। বুবুনের মা লড়াকু মহিলা, তিনি শ্রেষ্ঠ মায়ের কমপিটিশনে তাঁর বাকি বন্ধুদের থেকে এগিয়ে থাকার মরণপণ করলেন, কিন্তু অচিরেই তাঁর আড়াই মাসের ছেলে তাঁকে হার মানাল। শেষে একদিন সেই ভয়ংকর ঘটনা ঘটল যেটা তিনি কল্পনাও করেননি। ন্যাপি পাল্টে দুধ খাইয়ে অতি সাধনায় ঘুম পাড়ানোর দু’মিনিটের মধ্যে বুবুন কাঁদতে শুরু করল, এবং বুবুনের মা পেছন ফিরে ঘুমের ভান করে শুয়ে রইলেন। যতক্ষণ না বুবুনের বাবা উঠে ছেলেকে দেখতে গেলেন।
বুবুনের মা ঝুমঝুমি হাতে তুলে দিয়ে ছেলেকে ভোলানোর চেষ্টা করলেন, হাত থেকে কেড়ে নিয়ে শাসনের চেষ্টা করলেন, বুবুন সকালবিকেলরাতদুপুর একাকার করে, দেড় বিঘৎ হাঁ করে চেঁচাতে থাকল। কেঁদে কেঁদে বুবুনের ওজন কমে গেল, মাথার চুল সব ঝরে গেল। বুবুনের মা বুবুনের কট চিলেকোঠায় বদলি করলেন, পাড়াপ্রতিবেশী দেখতে এলে বললেন, ছেলে ঘুমোচ্ছে। ক’মাস আগের ছাদের শান্তির সন্ধ্যেগুলো এখন স্বপ্ন মনে হতে লাগল। পাড়ার লোকেরা কেউ কেউ বুবুনকে ছিঁচকাঁদুনে বলল, কেউ রুগ্ন। কেউ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে বলল, পিসশাশুড়ি, প্রত্যাশিত ভাবেই, তারকেশ্বর যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। বুবুনের মা সব করলেন। বুবুনের কান্না থামল না।
এমন সময় একদিন টিভিতে বুবুনের মা 'হ্যাপিমমি' ব্র্যান্ডের বেবিফুডের বিজ্ঞাপন দেখলেন। এক সুন্দরী মডেল, আঠেরো বছর হয়েছে কিনা সন্দেহ, একটি গোল, ফর্সা, নীল চোখের বাচ্চাকে চামচে করে বেবিফুড খাওয়াচ্ছে। মা এবং বাচ্চা দুজনের মুখেই হাসি আর ধরছে না। বুবুনের মায়ের বুক মুচড়ে উঠল। ঠিক এমনই তো তিনি কল্পনা করেছিলেন। মায়ের মন কি তবে ভুল বলেছিল? নাড়ির টান তবে কি এতই দুর্বল?
চোখের জল মুছে বুবুনের মা বুবুনের বাবাকে ফোন করলেন। ফেরার পথে হ্যাপিমমি ব্র্যান্ডের বেবিফুড আনতে বলে দিলেন। রাতে মা-ছেলের ঝলমলে মুখের ছবিছাপা নীল রঙের প্যাকেট খুলে বেবিফুড বুবুনকে খাওয়ানো হল। সেদিন রাতে দু’ঘণ্টার বদলে বুবুন আড়াই ঘণ্টা অন্তর অন্তর কাঁদল। পরের রাতে তিন ঘণ্টা পরপর। বুবুনের মা হ্যাপিমমির ডোজ বাড়ালেন। ঠিক তিনদিন হ্যাপিমমি ডায়েটে থাকার পর, তৃতীয় রাতে বুবুন একবারও কাঁদল না।
ডাক্তারদিদিমণি বললেন, ওষুধে কাজ দিয়েছে তার মানে। পিসিশাশুড়ি কী বললেন সেটা আর বলার দরকার নেই। বুবুনের মা মুচকি হাসলেন। মাসতিনেক পর বুবুনের মা রাতে শুতে যাওয়ার আগে বুবুনের বাবাকে বললেন, হ্যাপিমমি বেবিফুড কোম্পানির আরেকটি প্রোডাক্ট আছে, ‘প্রাউডমমি’ প্র্যাম, সেটা তাঁর দরকার। তারপর একদিন বিকেলে হ্যাপিমমি বেবিফুড খাইয়ে, বুবুনকে নতুন জামা, নতুন মোজা, নতুন টুপি পরিয়ে, প্রাউডমমি প্র্যামে চড়িয়ে বুবুনের মা পাড়ায় বেরোলেন।
এত সুন্দর বাচ্চা, সত্যি বলছি, আমাদের পাড়ায় আগে কেউ কখনও দেখেনি। ফুটফুটে, নাদুসনুদুস, চকচকে চোখ, কুচকুচে চুল। রাস্তার লোক থেমে বুবুনের মাকে এমন সুন্দর নিখুঁত বাচ্চার জন্ম দেওয়ার জন্য অভিনন্দন জানাতে লাগল। বাড়ি বাড়ি থেকে প্রতিবেশীরা বেরিয়ে এসে বুবুনকে কোলে নেওয়ার জন্য, বুবুনের গাল টেপার জন্য মারামারি করতে লাগল। বুবুন কিন্তু একটুও কাঁদল না, ফোকলা মুখে খিলখিলিয়ে হেসে হাতপা নেড়ে খেলা করতে লাগল।
সেদিন সান্ধ্যভ্রমণ সেরে বাড়ি ফিরে এসে বুবুনকে হ্যাপিমমি খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে বুবুনের মা কাগজ পেন নিয়ে বসলেন। হ্যাপি মমি এবং প্রাউড মমির মূল কোম্পানি ‘মমি’জ ওয়ার্ল্ড’কে একটা চিঠি লিখলেন। তাঁদের কোম্পানির প্রোডাক্ট যে বুবুনের মা আর বুবুনের জীবন বদলে দিয়েছে, সে বাবদে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে।
*****
চিঠিটা পড়লেন মমি’জ ওয়ার্ল্ড-এর চিঠিচাপাটি বিভাগের একমাত্র কর্মচারী ছোটেলাল সাহু। তিনি গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে, মমি’জ ওয়ার্ল্ড-পত্তনের সময় থেকে এর এই বিভাগে চাকরি করছেন। মেন অফিস বিল্ডিং-এর পেছনদিকে একটা ঘুপচি ঘরে ছোটেলালের অফিস। রোজ কাঁটায় কাঁটায় সকাল ন’টায় তিনি আসেন, আর সন্ধ্যে ছ’টায় ঘরে তালা লাগিয়ে বেরোন। হাতে একটা প্লাস্টিকের বাজারের ব্যাগ থাকে। ছোটেলালের মতো ব্যাগটাও টেকসই। গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে।
পঁয়ত্রিশ বছর ধরে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, কচ্ছ থেকে কিবিথু পর্যন্ত ভূখণ্ডের প্রায় প্রতিটি জেলা, প্রতিটি শহর, প্রতিটি গ্রাম থেকে আসা চিঠি পড়েছেন ছোটেলাল। যে সব জায়গার নাম কোনও ম্যাপে লেখা থাকে না, কোনও খবরে বা রেডিওর গানের অনুরোধের আসরে যে সব গ্রামের নাম কেউ কখনও শোনেনি, যে সব গ্রামের কোনও মেয়ে ধর্ষণ হয়নি কিংবা কুস্তিতে পদক জেতেনি, সে সব অদ্ভুত অলৌকিক সব জায়গার ঠিকানা লেখা চিঠি পড়েছেন ছোটেলাল। কোথায় শিশুরা হ্যাপি মমি খেয়ে পোলিও রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে, কোথায় হ্যাপিমমির প্যাকেট খোলামাত্র জ্যান্ত ধেড়ে ইঁদুর লাফ দিয়ে বেরিয়ে প্যাকেটখোলকের গলা টিপে ধরেছে, কোথায় হ্যাপি মমি বাটিতে ঢেলে দুধের সঙ্গে গুলতে শুরু করা মাত্র ফুটে উঠেছে সাঁইবাবার মুখ।
কিন্তু বুবুনের মায়ের চিঠিটা তিনি বুঝতে পারলেন না। একবার, দু’বার, তিনবার পড়লেন। উল্টেপাল্টে দেখলেন। ভারতবর্ষের একটি মফস্বল শহরের একজন মা এবং একটি শিশু, হ্যাপিমমি এবং প্রাউডমমি ব্যবহার করে উপকার পেয়েছে, না শুধু উপকার নয়, মাইনাস সতেরোর ঘোলাটে চশমার খুব কাছে পোস্টকার্ডটা নিয়ে এসে আবার একবার পড়ে দেখলেন, “জীবন বদলে দিয়েছে।”
অবশেষে ছোটেলাল চিঠিখানা নিয়ে ওপরমহলে যাওয়া সাব্যস্ত করলেন। পঁয়ত্রিশ বছরে ছোটেলাল তিন বারের বেশি মেন অফিসে যাননি। অফিসের দারওয়ান, যে তিনমাস হল ডিউটি জয়েন করেছে সে ছোটেলালের কোঁচকানো জামা আর ঝোঁকা কাঁধ দেখে হাঁকিয়েই দিচ্ছিল প্রায়, এমন সময় অফিসের বড়বাবু, যিনি প্রায় বারো বছর আছেন, সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। ছোটেলালের আনা চিঠি দেখে বড়বাবুর ভুরু কোঁচকালো। তারপর চিঠি দেখলেন সুপারিন্টেনডেন্ট, তারপর ম্যানেজার, তারপর হেড ম্যানেজার, তারপর আরও কত কত লোকের কাছে চিঠি গেল আমরা জানি না। কারণ মমি’জ ওয়ার্ল্ডের হায়ারার্কি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বেশি নেই।
*****
আমরা শুধু জানলাম একদিন দুপুর-বিকেলের দিকে দুজন সুটবুট পরা লোক এল পাড়ায়। একজনের কাঁধে একটা ঢাউস ব্যাগ, ব্যাগের গায়ে লেখা ‘মমি’জ ওয়ার্ল্ড’। মিসেস মালবিকা সেনের বাড়িটা কোথায়? মালবিকা নামটা ততদিনে লোকে বিস্মৃত হয়েছে, মাসছয়েকের বাচ্চা আছে শুনেটুনে মনে হল বুবুনের মা হলেও হতে পারেন। পথনির্দেশ নিয়ে লোকদুটো চলে গেল বুবুনদের বাড়ির দিকে, আমরা গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে জটলা করতে লাগলাম।
আধঘণ্টা পর লোকদুটো আবার রাস্তায় বেরিয়ে এল। সঙ্গে প্বুবুনের মা, প্রায় বিয়েবাড়ির সাজে সজ্জিত, আর ‘প্রাউড মমি’তে শোয়া বুবুন। লোকদুটোর একজনের কাঁধে এখন একটা লম্বা নল লাগানো ক্যামেরা। প্র্যাম-ঠেলারত অবস্থায় তাঁরা বুবুনের মা ও বুবুনের ছবি নিলেন। বসে, দাঁড়িয়ে, রাস্তায় শুয়ে পড়ে, ভটচাজদের পাঁচিলে চড়ে।
পরের মাসে শহরের প্রায় সবক’টি জনপ্রিয় কাগজে, ম্যাগাজিনে বুবুনের মা আর বুবুনের পাতাজোড়া ছবি বেরোলো। বুবুনের মায়ের মাথার ওপর একটা নীল রঙের মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, মেঘের ভেতর উদ্ধৃতি চিহ্ন দিয়ে লেখা, “মমি’জ ওয়ার্ল্ড আমার বুবুনের স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যের একমাত্র সিক্রেট।”
*****
আমাদের অনেকেরই জীবনের একমাত্র সেলেব্রিটি-সংসর্গ ঘটেছিল ওই সময়টাতেই, যখন বুবুন আর বুবুনের মা মমি’জ ওয়ার্ল্ডের মডেল হয়ে আমাদের ছোট্ট মফস্বলের নিউজস্ট্যান্ডের মলাট দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। মমি’জ ওয়ার্ল্ডের কন্ট্র্যাক্ট শেষ হতে না হতে বুবুনের জন্য আরও মডেলিং-এর অফার আসতে লাগল। বাচ্চাদের জামাকাপড়ের, জুতোর, চুষিকাঠির, লালাপোষের। লোকে আমাদের পক্ষপাতদুষ্ট বলতে পারে, কিন্তু সত্যি তখন দেশের কোনও শিশু মডেলই বুবুনের থেকে মিষ্টি ছিল না। বুবুনের মা অবশ্য মডেলিং-এর অফার পেলেন না, অফারগুলো ছিল শুধু বুবুনের জন্যই, কিন্তু বুবুনের মা কখনওই ছেলের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে চাননি। নিজে নেপথ্যে থেকে বুবুনকে লাইমলাইটে পৌঁছে দেওয়াই ছিল তাঁর লক্ষ্য।
বছরখানেকের মধ্যেই তিনি তাঁর লক্ষ্যপূরণ করে ফেললেন। লাইমলাইটে ভাসতে লাগল বুবুন। মডেলিং-এর পর বুবুনের মা বুবুনকে বেবি কম্পিটিশনে নাম দেওয়ালেন। প্রথমে ভদ্রকালী ‘আমরা সবাই’ সংঘের বেস্ট বেবি কম্পিটিশন জিতল বুবুন। তারপর জেলা সদর এবং নিখিল বঙ্গ পেরিয়ে সারা ভারত বেবি কম্পিটিশন। যেটা হবে নাগপুরে। কম্পিটিশনের তিনমাস আগে থেকে প্রিপারেশন চলল। সকাল আটটার আগে আর সন্ধ্যে ছ’টার পর বুবুনকে নিয়ে বুবুনের মা হাঁটতে বেরোতেন, যাতে রোদ লেগে বুবুনের সানট্যান না নয়, অথচ ভিটামিন ডি এবং খোলা হাওয়ার সাপ্লাই যথেষ্ট থাকে। কম্পিটিশনের তিন দিন আগে গাড়ি চেপে বুবুনের বাবামা বুবুনকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন, বাড়ি পাহারা দিতে রেখে গেলেন পিসশাশুড়িকে। গাড়িতে ওঠার আগের মুহূর্তে পিসশাশুড়ি বুবুনের মায়ের মাথায় জয়তিলক কেটে দুগ্গা দুগ্গা বলে দিলেন।
কম্পিটিশন টিভিতে সম্প্রচারিত হল। টাইমিং ভালো ছিল, শনিবার সন্ধ্যে ছ’টা। আমরা মুড়িমাখার বাটি হাতে নিয়ে বসে, বাংলা সিনেমার বদলে বুবুনের কম্পিটিশন দেখলাম। বেবিদের ওজন, দৈর্ঘ্য, চোখ ও চামড়ার ঔজ্জ্বল্য ইত্যাদি পরীক্ষার পর বেবির মায়েদের পরীক্ষা হল। বেবির শারীরিক, মানসিক, বৌদ্ধিক সমস্ত বিকাশসংক্রান্ত কুইজে বুবুনের মা হান্ড্রেড পার সেন্ট স্কোর করলেন। নিতাইজেঠু উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, “পারবেই তো, ‘শিশুর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ বইখানা তো লাইব্রেরি থেকেই নিয়ে গিয়েছিল বুবুনের মা।” এই বলে তিনি পাড়ায় পাঠাগারের উপযোগিতা বলে একখানা বক্তৃতা শুরু করতে যাচ্ছিলেন, আমরা তাঁকে থামিয়ে দিলাম কারণ তখন লাস্ট রাউন্ড শুরু হতে চলেছে। মায়েরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছেন। বিচারকরা জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁদের প্ল্যান কী। আমরা অনেকেই বুবুনের ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানতাম, বুবুনের মা-ই জানিয়েছিলেন। লাইনের অন্তে বুবুনের মায়ের পালা এল। স্ক্রিন জুড়ে এখন বুবুনের মায়ের মুখ। ব্যাকগ্রাউন্ডে প্রশ্ন শোনা গেল, “আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?”
বুবুনের মা চুপ করে রইলেন। আমরা উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। কারও কারও আঙুলের নখ ছিটকে উঠে দাঁত ছুঁল। টেনশন সহ্য করতে না পেরে লাস্ট মোমেন্টে বুবুনের মায়ের কি নার্ভ ফেল করল? আমরা কেউ কেউ চিৎকার করে উঠলাম, “ইঞ্জিনিয়ার! ইঞ্জিনিয়ার!” যেন আমাদের গলা টিভি স্ক্রিনের ওপাশে পৌঁছে বুবুনের মাকে সাহায্য করবে।
ধীরে, অতি ধীরে, বুবুনের মায়ের মুখে একটা আলো ফুটে উঠল। মঞ্চের আলো নয়, তার থেকে অন্যরকম, ভেতরের আলো। একটা কিছু যে ঘটতে চলেছে সেটা ক্যামেরাম্যান ও টের পেয়েছিলেন নির্ঘাত, রক্তের গন্ধ পাওয়া বাঘের দৃষ্টির মতো তিনি শিকারের ওপর নিশ্চল হলেন। পুরোনো ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট অস্কার টিভির নন এল সি ডি ঝাপসা পর্দাতেও আমরা স্পষ্ট দেখতে পেলাম বুবুনের মায়ের কাজলটানা চোখের কোণায় একটা কী যেন চকচক করে উঠছে। জলের ফোঁটাটা ক্রমে বড় হল, কিন্তু চোখের কোণা ছেড়ে পড়ল না। বুবুনের মায়ের ঠোঁট নড়ে উঠল। ক্যামেরা জুম ইন করল, আমরা টিভি সেটের দিকে ঝুঁকে পড়লাম। প্রায় অস্ফুট আর আবেগে বুজে আসা গলায় বুবুনের মা বললেন, “আমার বুবুন মানুষের মতো মানুষ হবে।”
টিভি স্ক্রিনে যেন একটা বিস্ফোরণ হল। অন্য মায়েরা চারদিকে ছিটকে পড়লেন, জাজেরা যে যার চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন, মঞ্চের আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হতে লাগল, মডেলরা চারদিক থেকে মুহুর্মুহু শঙ্খ এবং হুলুধ্বনি করতে লাগলেন। একজন মডেল এসে বুবুনকে বুবুনের মায়ের কোলে চড়িয়ে দিয়ে গেল। প্রতিযোগিতার স্পনসর রনসন অ্যান্ড রনসন বেবি প্রোডাক্টসের কান্ট্রি হেড এসে বুবুনের মায়ের হাতে তুলে দিলেন যশোদাগোপালের মূর্তি, সলিড সোনার। বুবুনের মাথায় সোনার মুকুট পরিয়ে দেওয়া হল, বুবুনের মায়ের মাথাও ফাঁকা রইল না। বেস্ট বেবি, বেস্ট মমি।
*****
মুকুট মাথায়, গালে গাল ঠেকানো বুবুনের মা আর বুবুনের হাসিমুখের ওই ছবিটা বুবুনদের বসার ঘরে টাঙানো ছিল আরও বেশ কয়েক বছর। বুবুনের মায়ের জীবনের চরম সার্থকতার মুহূর্তের ছবি।
ওই মুহূর্তটা আরও একটা কারণেও ইম্পরট্যান্ট, কারণ তার পর থেকেই একটু একটু করে সব বদলে যেতে লাগল। সবথেকে অসুবিধেজনক যেটা হল, বুবুন বড় হয়ে গেল। প্রাণীজগতের একটা অদ্ভুত নিয়মের কথা বুবুনের মায়ের খেয়াল হয়নি, সেটা হচ্ছে বয়সের সঙ্গে কিউটনেসের ব্যাস্তানুপাতিক সম্পর্ক। বুবুনের মা অ্যামেরিকার বড় বড় ল্যাবে চিঠি লিখলেন, সকলেই তাঁকে উত্তরে জানালেন যে অনেক গবেষণার পর অবশেষে বিজ্ঞানীরা এর প্রতিষেধক বার করার চেষ্টায় ক্ষান্ত দিয়েছেন।
বুবুনের মা দমলেন না। চেহারায় না হলেও তাঁর বুবুন অন্য সব দিকে সেরা হবে।
এইবার কিন্তু বুবুনের মা সমস্যায় পড়লেন। কারণ দেখা গেল বুবুন কিছুতেই সেরা নয়। তলানিও নয়। একেবারে মাঝখানে। বাংলা, ইংরিজি, অংক, ভূগোল, জীবনবিজ্ঞান, তবলা বাজানো, সাবান বানানো, লং জাম্প, টাগ অফ ওয়ার, সবেতেই বুবুন একেবারে অটল মধ্যপন্থী। বুবুনের মা বুবুনকে নিয়ে প্রাইভেট টিউটরের কাছে ছুটে ছুটে হন্যে হয়ে গেলেন, বিজ্ঞাপন দেখে দেখে ব্রাহ্মীর জুস খাইয়ে খাইয়ে ক্লান্ত হয়ে গেলেন, বুবুন কিছুতেই মাঝখান থেকে নড়ল না।
বুন যখন সেরা হতে অস্বীকার করল, তখন বুবুনের মা স্থির করলেন তিনি ছেলেকে সেরা বানাতে না পারলেও সেরাদের সান্নিধ্যে রাখবেন। বুবুন স্কুল কামাই হলে পরদিন তিনি গিয়ে কেবল ফার্স্ট বয়ের খাতা থেকেই আগের দিনের পড়া টুকতেন। ফার্স্ট বয়ের পাশে না বসলে বুবুনের গায়ে নানারকম অজানা ফুসকুড়ি দেখা দেয় এ অভিযোগ লিখিতভাবে দায়ের করলেন। বুবুনের ক্লাসটিচার অভিযোগ পড়ে খানিকক্ষণ হাঁ করে থাকলেন, কিন্তু তিনি প্রবীণ শিক্ষক, প্রায় চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতায় তিনি জানতেন কোন গার্জেনকে ঘাঁটাতে নেই। বুবুনের বসার জায়গা ফার্স্ট বয়ের পাশে বাঁধা হয়ে গেল।
এই সব যখন হচ্ছিল তখন বুবুনের জীবনে একটা ছোট্ট ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল। রবিকাকুর রিকশায় চেপে বুবুন স্কুলে যেত, আর যেত মৃত্যুঞ্জয় বলে একটি ছেলে। বুবুন স্বভাবতই শান্ত আর লাজুক ছিল, মৃত্যুঞ্জয়ও। গোড়াতে কেউই কারও সঙ্গে কথা বলত না বিশেষ। মাসখানেক কাটার পর ধীরে ধীরে আড় ভেঙে দুজনে দুজনের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। এবং আবিষ্কার করে আশ্চর্য হয়ে গেল যে নিজেদের মধ্যে কত মিল। দুজনেই ক্রিকেট ভালোবাসে, দুজনেই অংকের মাস্টারমশাইকে যমের মতো ভয় পায়, দুজনেই মাছের কাঁটা ম্যানেজ করতে পারে না। দ্রুত বুবুন আর মৃত্যুঞ্জয়ের বন্ধুত্ব গাঢ় হল।
একদিন জানালা দিয়ে বুবুনের মা দেখলেন, রিকশা থেকে নেমে বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে বুবুন অনেকক্ষণ মৃত্যুঞ্জয়কে টা টা করছে। মৃত্যুঞ্জয়ও রিকশার পেছনের পর্দা তুলে টা টা করছে।
ক’দিন বাদেই অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোলো। রেজাল্ট নিয়ে একে একে সবাই বেরোল ক্লাস থেকে। বুবুন আর মৃত্যুঞ্জয়ও বেরোলো পাশাপাশি। বুবুনের মা বুবুনের রেজাল্ট খুলে পরীক্ষা করলেন। তারপর মৃত্যুঞ্জয়ের রেজাল্ট। বাংলা, অংক সবেতেই মৃত্যুঞ্জয় বুবুনের প্রায় সমান সমান, হঠাৎ একজায়গায় এসে বুবুনের মায়ের আঙুল থমকে গেল। ইংরিজিতে ছেলেটা কুড়ি পেয়েছে! কুড়ি! বুবুনের মায়ের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। তিনি বুবুনের কবজি চেপে ধরে বাড়ি ফিরে এলেন। পরদিন থেকে বুবুনের যাওয়ার জন্য অন্য রিকশা স্থির হল। আর বুবুনের মা বুবুনকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন যে মৃত্যুঞ্জয়ের সঙ্গে সে আর মিশবে না।
*****
স্কুলের স্যারেরা বলেছিলেন, কমার্স শুভজিতের জন্য বেটার ফিট, কিন্তু বুবুনের মা সায়েন্স ছাড়া আর কোনও ফর্মই তুললেন না। উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট বুবুনের খারাপ হল। জয়েন্টের কহতব্য নয়। বুবুনের মা দাঁতের ফাঁক দিয়ে থেমে থেমে উচ্চারণ করলেন, "আমার . . . ছেলে . . . ইঞ্জিনিয়ার . . . হবে।" বুবুনের বাবা ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে বুবুনকে প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি করে দিয়ে এলেন।
আর সেখানেই বুবুনের দেখা হয়ে গেল সংহিতার সঙ্গে। মিডিয়া টাইকুন অরবিন্দ ঘোষালের একমাত্র সন্তান সংহিতা ঘোষাল। দামি গাড়ি থেকে নেমে, দামি জুতোয় খটখট আওয়াজ তুলে যখন হাঁটত সংহিতা, সবাই পথ ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াত। খালি অতি সাহসী কয়েকজন, যাদের মধ্যে একজন অজাতশত্রু সমাদ্দার, 'সমাদ্দার সর্ষের তেল' সাম্রাজ্যের সেএকমাত্র ওয়ারিস, নিয়মিত জিমে গিয়ে টি শার্টের হাতা ফুলিয়েছে, সংহিতার পাশে পাশে হাঁটার সাহস দেখাত।
আমাদের বুবুনও সংহিতাকে দেখেছিল, কারণ সংহিতাকে না দেখে কে-ই বা থাকতে পারে। কিন্তু সুন্দরী মেয়ে দেখলেই প্রেমে পড়ে যেতে হবে এ যুক্তিতে বুবুনের মন চলত না। কাজেই সংহিতা রইল সংহিতার মতো। বুবুন বুবুনের মতো। মাঝে মাঝে কথাবার্তা হত। ক্লাসমেটদের যেমন হয়। একবার মুকুটমণিপুরে পিকনিকে গিয়ে অন্তাক্ষরীতে বুবুন গান গাইল। গানটা অ্যাকচুয়ালি বুবুন মাঝারির থেকে ভালো গাইত, কিন্তু গান-গাওয়া ছেলে বুবুনের মায়ের দুচক্ষের বিষ বলে তিনি সে দিকে ছেলেকে উৎসাহ দেননি। সংহিতা জোরে জোরে হাততালি দিল। অজাতশত্রু ভুরু কোঁচকালো, কিন্তু সংহিতা যখন কনুইয়ের খোঁচা মেরে জিজ্ঞাসা করল, “ভালো না?” তখন তাড়াতাড়ি, “অস্স্সাম্” বলে নিজেও চটাপট হাততালি দিল। তারপর মাঝে মাঝে সংহিতা আশেপাশে কেউ না থাকলে বুবুনের কাছে এসে নোটটোট চাইত। ক্রিকেট, ফুটবল, যে সব বিষয়ে সংহিতার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই, কিন্তু বুবুনের থাকলেও থাকতে পারে, সে সব বিষয়ে কথা বলত।
কোর্সের শেষে ক্যাম্পাসিং হল। যে যার চাকরি নিয়ে চলে গেল দেশের এদিকসেদিক। আমাদের বুবুনের ডাক পড়ল পুনেতে। বুবুনের মা আত্মীয়দের সবাইকে ফোন করে খবর দিলেন। পাড়ার কেউও বাদ পড়ল না। সংহিতা গেল না কোথাও। ইঞ্জিনিয়ারিং ওর ভালোই লাগে না। অরবিন্দ ঘোষাল কাগজের অফিসে মেয়েকে ঢুকিয়ে নিলেন। ছিটকে যাওয়ার আগে একদিন সব বন্ধু মিলে কলেজে খাওয়াদাওয়া হইহল্লা হল। সংহিতা সেদিন বুবুনের সঙ্গে একটা কথাও বলতে পারল না। ফেরার পথে সারারাস্তা গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকল। বাবামা কাকাপিসির ঠাকুমাঠাকুরদার হাজার সাধাসাধিতেও দাঁতে কুটোটি না কেটে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। পরদিন সকালে বিছানা তুলতে গিয়ে সংহিতাদের বাড়ির বহুদিনের পুরোনো মাসি, সংহিতাকে যিনি কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন, দেখলেন, বালিশে গাঢ় হয়ে জমেছে নোনা জলের দাগ, তুলো তখনও স্যাঁতসেঁতে।
বছরখানেকের প্রবেশন শেষ হলে বুবুনের চাকরি পাকা হল। বুবুন বাড়িতে খবর দিল। বুবুনের মা পৃথিবীসুদ্ধু সবাইকে খবর দিলেন। গত এক বছরে বুবুন আর সংহিতার ইমেল চালাচালি হত মাঝে মাঝেই। খবরটা পেয়ে সংহিতা অকারণেই বাবার গলা জড়িয়ে চুমু খেল, গাড়ি থামিয়ে রাস্তার কুকুরগুলোকে এক্সট্রা খাবার দিল, এক্সট্রা আদর করল। অফিসে পৌঁছ মেলে লিখল, “কই দেখি তোর কোয়ার্টারের ছবি?” বুবুন ফিরতি মেলে ছবি পাঠালো। দু’কামরার ছোট্ট কোয়ার্টার। রান্নাঘরটা একটু বেশিই ছোট। কিন্তু ব্যালকনি আছে একটা। সেখানে দাঁড়ালে দূরে দিগন্তে দেখা যায় বেতাল পাহাড়ের চুড়ো।
পাকাপাকি যোগ দেওয়ার আগে বুবুন বাড়ি ফিরল। বুবুন সংহিতার দেখা হল শপিং মলে। বুবুন অনেকটা রোগা হয়ে গেছে এক বছরে, আর মুখে ফুটেছে আত্মবিশ্বাসের আলো। হাসিঠাট্টা, খাওয়াদাওয়ার পর বুবুন সংহিতাকে তুলে দিতে গেল পার্কিং লটে। যেতে যেতে বুবুন হাতপা নেড়ে অনেক কথা বলছিল, সংহিতা কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছিল না। ওর কান ভোঁ ভোঁ করছিল, বুক ধড়াস ধড়াস করছিল, কপাল আর ঠোঁটের ওপর ঘাম জমছিল, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল। সংহিতার এস ইউ ভি-র সামনে এসে দাঁড়াল যখন ওরা, তখন বুবুনের কথার স্রোত থামল। আর ও নজর করল যে সংহিতাকে রীতিমত অসুস্থ দেখাচ্ছে। বুবুন সংহিতার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করল, “কী রে? কী হয়েছে তোর?”
সংহিতা বড় করে একটা শ্বাস নিল, তারপর ওই পার্কিং লটের ধুলোভরা মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে বুবুনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “উইল ইউ ম্যারি মি?”
*****
বুবুনের বাবা উল্লসিত হলেন। বুবুনের মা থমকে গেলেন। ছেলের বিয়ের ব্যাপারটা কোনও দূর ভবিষ্যতে ছায়ার মতো ছিল, সেটা হঠাৎ বাস্তব হয়ে ওঠার ধাক্কা তাঁকে টলিয়ে দিল। পাকা কথা বলতে বুবুনের বাবামা গেলেন সংহিতাদের বাড়ি। বাড়ি, গাড়ি, দাপট দেখে বুবুনের বাবার আনন্দ আরও বাড়ল, আরও চুপসে গেলেন বুবুনের মা। ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে হিল খটখটিয়ে নেমে সংহিতা যখন সামনে এসে দাঁড়াল, বুবুনের মায়ের গলা শুকিয়ে গেল। একবার তিনি ভেবেছিলেন তাঁকে জিজ্ঞাসা করে ডিসিশন নেওয়া হয়নি বলে ব্যাপারটায় ভেটো দেবেন কি না, কিন্তু এক বছরের দূরত্ব বুবুনের সঙ্গে তাঁর নাড়ির টানকে সামান্য হলেও দুর্বল করে দিয়েছিল। তিনি চুপ করে রইলেন।
অরিন্দম ঘোষালের কাগজে, সাহিত্য ম্যাগাজিনে, টিভি চ্যানেলে সংহিতার বিয়ের খবর ফলাও করে ছাপা হল। ঘোষাল মিডিয়ার মহিলা ম্যাগাজিন সংহিতার সংগীত থেকে বিদাই পর্যন্ত পাঁচদিনের বিয়ের নির্ঘণ্ট ছাপা হল এবং ওই পাঁচদিন সংহিতা যে পাঁচজন ডিজাইনারের পোশাক পরবে তাঁদের ঠিকুজিকুষ্ঠি এবং সাক্ষাৎকারও। বিরোধী খবরের কাগজ ইকনমিস্ট লাগিয়ে বিয়ের আনুমানিক খরচ এস্টিমেট করিয়ে ঘোষাল মিডিয়ার কালো টাকা ইনভেস্টিগেট করার জন্য মামলা ঠুকল। লিটল ম্যাগাজিনেরা এই নির্লজ্জ পয়সার আস্ফালনকে ধিক্কার জানাল, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোষালের নামে ছড়া কেটে, হ য ব র ল-র প্যারাগ্রাফ পালটে প্যারডি লেখা হল।
কিন্তু সব মামলা, সব ধিক্কার, সব আস্ফালনের পরে সকলেই যে প্রশ্নটা করল, এই শুভজিৎ কে? যে উড়ে এসে ঘোষালসাম্রাজ্যের সিংহাসনে জুড়ে বসল? স্ট্রাগলিং অভিনেতা? ব্যর্থ মডেল? অনূর্ধ্ব তেরোয় বাংলার প্রতিনিধিত্ব করা ক্রিকেটার? বাংলা ব্যান্ডের গ্রুপি?
সকলেই নিজের নিজের সার্কেলে খোঁজ নিল, কেউ কোনও উত্তর পেল না। সবাই মেনে নিতে বাধ্য হল, অরবিন্দ ঘোষালের একমাত্র মেয়ে একজন নোবডিকে বিয়ে করছে।
*****
সত্যিটা মেনে নিয়ে সবাই যখন চুপ করে গেছে, আন্দোলন, বিক্ষোভ থিতিয়ে এসেছে অনেকটা, তখন বাংলা ভাষার মোটামুটি চেনা খবরের কাগজগুলোর প্রায় প্রত্যেকটার অফিসেই একটা বেশ বড়সড়, পেটমোটা খাম এসে হাজির হল। খাম খুলে বেরোলো গাদা গাদা পেপার কাটিং আর বিভিন্ন কাপ, মেডেলের ছবি, সার্টিফিকেটের জেরক্স। সঙ্গে একটি অস্বাক্ষরিত চিঠি। অতি বিনয়ী ভাষায় কেউ একজন মাননীয় সম্পাদককে জানিয়েছেন, শ্রী অরবিন্দ ঘোষালের একমাত্র কন্যা কল্যাণীয়া সংহিতা ঘোষালের ভাবী স্বামী কল্যাণীয় শুভজিৎ নোবডি নন, তিনি এককালের ভারতসেরা বেবি বুবুন।
*****
সংহিতার ফোনটা নিয়ে চেনা আধচেনা সাতাত্তরটা ফোন রিসিভ করে, শেষপর্যন্ত ফোনটা সুইচড অফ করে, মুখ যথাসম্ভব আড়াল করে নিউজস্ট্যান্ড থেকে সেদিনকার কয়েকটা কাগজ ঝটপট তুলে নিয়ে বুবুন যখন বাড়িতে ঢুকল তখন ভেতরের ঘর থেকে তারস্বরে টিভির আওয়াজ ভেসে আসছে। দৃঢ় ‘স’ উচ্চারণসহ ঘোষক আজকের ব্রেকিং নিউজ পরিবেশন করছেন। “অরবিন্দ ঘোষালের জামাইয়ের আসল পরিচয় ফাঁস হয়েছে। ঘটনাস্থলে আছেন আমাদের প্রতিনিধি তাপস, হ্যালো হ্যালো, তাপস? শুনতে পাচ্ছ? হ্যাঁ আমিও পাচ্ছি। আমাদের দর্শকরা জানতে চান ভারতসেরা বেবি বুবুন তাঁদের বাড়ির জামাই হতে চলেছেন শুনে ঘোষাল পরিবারের কী প্রতিক্রিয়া?”
তাপস ভেসে উঠলেন স্ক্রিনে। অরবিন্দ ঘোষালের বাংলোর বন্ধ গেটের সামনে শ’দেড়েক লোক ধাক্কাধাক্কি করছে। কারও ঘাড়ে ক্যামেরা, কারও হাতে মাইক। মাথার ওপর গদার মতো নেমে আসা অন্য এক চ্যানেলের বুম পরম দক্ষতায় কাটিয়ে তাপস বললেন, “হ্যালো হ্যালো, অনামিকা, হ্যাঁ, হ্যালো হ্যালো… আমরা কিন্তু এখন আছি অরবিন্দ ঘোষালের বাড়ির ঠিক সামনেই…হ্যালো……হ্যাঁ…এখানে কিন্তু উত্তেজনা রুদ্ধশ্বাস আকার ধারণ করেছে। তবে ঘোষাল পরিবারের কারও সঙ্গেই কিন্তু এখনও পর্যন্ত যোগাযোগ করা যায়নি। না, আমাদের রাইভ্যাল চ্যানেলও কিন্তু…(আবার ধেয়ে আসা বুম নিখুঁত ফুটওয়ার্কে এড়িয়ে)… ব্যর্থ হয়েছে। তবে আমরা কিন্তু একজন ঘোষাল পরিবারের খুব গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে কিন্তু আমাদের মধ্যে পেয়েছি…” হাত বাড়িয়ে একজন সিকিউরিটি গার্ডকে স্ক্রিনের ভেতর টেনে আনলেন তাপস। “ইনি কিন্তু গত তিন মাস ধরে ঘোষালবাড়ির গেটে ডিউটি দিচ্ছেন। ইনি এখন আমাদের জানাবেন বেবি বুবুনের পরিচয় ফাঁস হওয়ার পর ঘোষালবাড়ির কার কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে…”
স্ক্রিনে আবার স্টুডিওর ছবি ফুটে উঠল। এখন অনামিকা আর অনামিকার ল্যাপটপের সঙ্গে ইন সেটে আরও চারজন। সকলেই সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে, রাজনীতিতে বাংলার মাথা। কানের হেডফোন অ্যাডজাস্ট করে নিয়ে অনামিকা বললেন, “হ্যালো হ্যালো তাপস, তুমি ওঁর সঙ্গে কথা চালিয়ে যাও, আমরা এখানে বিশেষজ্ঞদের থেকে জেনে নিই, বেবি বুবুনের আত্মপ্রকাশের কী প্রভাব পড়তে পারে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সমাজ ও রাজনীতিতে…”
বুবুন ঢুকে দেখল সারা ঘর, মেঝে, খাটে, চেয়ারে টেবিলে পেপার কাটিং, সার্টিফিকেট, মেডেল, বেবি বুবুনের ছবি ছত্রাকার। তার মাঝখান যশোদাগোপালের সোনার মূর্তি আঁকড়ে বুবুনের মা বসে আছেন। তাঁর মাথায় বেস্ট মমি মুকুট। টিভির দিকে তাকিয়ে তিনি একই সঙ্গে হাসছেন এবং কাঁদছেন।
বুবুনকে দেখে আলো হয়ে উঠল বুবুনের মায়ের মুখ। “বুবুন, বুবুন, তুই আর নোবডি নোস বুবুন। এখন সবাই জানে তুই ভারতসেরা বেবি বুবুন। আমি ভারতসেরা মা। কে ওই অরবিন্দ ঘোষাল আর তার মেয়ে?” বুবুনের মায়ের মুখ থেকে মাতৃত্বের আলো মুহূর্তের জন্য মুছে গিয়ে ক্রোধ ফণা তুলল।
“তুই আমার কাছে আবার ফিরে আয় বুবুন, মায়ের কাছে। বাকি সব সম্পর্ক দুদিনের বুবুন, একমাত্র অমর হল নাড়ির টান। বুবুন…বুবুন…” বলতে বলতে দুই হাত প্রসারিত করে বুবুনের দিকে দৌড়ে এলেন বুবুনের মা।
আত্মরক্ষার জন্য বুবুন হাত বাড়ালো। বাড়ানো হাতটা গিয়ে ঠেকল যশোদাগোপালের মূর্তিতে। মূর্তিটা বুবুনের মায়ের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে একবার মাথার ওপর তুলেই নামিয়ে আনল নিচে বুবুন। ছিটকে গেল সোনার মুকুট। গোপালের সোনার থাবা আর কপালের সংঘাতে ছিটকে বেরোলো রক্ত। বিস্ফারিত চোখে মাত্র একবার “বু…বু…ন” বলে মাটিতে পড়ে গেলেন বুবুনের মা। বেস্ট মমি মুকুটটা মেঝের যেখানে পড়েছিল, মাথাটা ঠিক তার নিচে সেট হয়ে গেল।
*****
পুলিশ এল। স্থানীয় থানার নতুন ফার্স্ট অফিসার, ইন্সপেক্টর দত্ত। বুবুন থম মেরে মায়ের মৃতদেহের পাশে বসে ছিল, মুখ তুলেও দেখল না। দেখলে হয়তো চিনতে পারত, এ সেই মৃত্যুঞ্জয়। বুবুনের রিকশার বন্ধু। সেকেন্ড অফিসার সান্যাল সারা বাড়ি ঘুরে এসে মৃত্যুঞ্জয় দত্তের কানে কানে বললেন, “ওপেন অ্যান্ড শাট কেস, স্যার।”
সেই রেজাল্টের ঘটনাটা মৃত্যুঞ্জয়কে গভীর আঘাত করেছিল। জীবনে প্রথমবার বন্ধু হারানোর শোক সবাইকেই যেমন করে। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ইংরিজিটা শিখেই ছাড়বেন। ইংরিজি শেখার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তিনি প্রথমেই বাংলাটা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলেন আর চেষ্টায় কী না হয়। এখন একমাত্র বউয়ের রান্নায় নুন কম হলে মৃত্যুঞ্জয় বাংলায় মুখব্যাদান করেন, বাকি সব জায়গায় ওনলি ইংলিশ।
তিনি গম্ভীর মুখে জবাব দিলেন, “লেটস শাট ইট দেন।”
বুবুনের হাত থেকে আস্তে করে রক্তে মাখামাখি মূর্তিটা বার করে সান্যালের বাড়িয়ে ধরা এভিডেন্স বস্তায় ফেলে দিলেন মৃত্যুঞ্জয় দত্ত। এই এভিডেন্স বস্তা স্পেশাল “শাট কেস”-এর জন্য। এর ঠিকানা থানার পেছনের ডোবা।
বুবুনের গম্ভীর কিন্তু শান্ত মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে বুকপকেট থেকে ভাঁজ করা কালো সানগ্লাসটা, যেটা ‘দাবাং’ দেখার পর তাঁর বউ শ্রীরামপুরের শপিং মল থেকে কিনে এনে দিয়েছে, পরে বাইরে বেরিয়ে এলেন মৃত্যুঞ্জয়। হাবিলদার লাঠি উঁচিয়ে রাস্তা খালি করে রেখেছিল। জিপের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মৃত্যুঞ্জয় দত্ত ভাবলেন, এতদিন যে সময় লাগল, সেটাই আশ্চর্যের। কিন্তু চার বছর আট মাস কেরিয়ারে তিনি এত আশ্চর্যের জিনিস দেখেছেন যে এই ঘটনাটা তাঁকে বেশি আশ্চর্য করল না। মোড়ের ঠিক মাথায় “কী হয় দেখাই যাক না” ভঙ্গিতে লাস্ট মোমেন্ট পর্যন্ত বসে থাকা একটা সাহসী নেড়িকে হর্ন দিয়ে তাড়িয়ে (এবং উত্তরে “ঘ্যাঁক” প্রতিবাদ পেয়ে) জিপ পাড়া ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাটা মৃত্যুঞ্জয় দত্তর মাথা থেকে বেরিয়ে গেল।
*****
‘শুভজিৎ ওয়েডস সংহিতা’, হলুদের ছোপ দেওয়া প্রজাপতির ডিজাইন আঁকা হালফ্যাশনের কার্ড আমাদের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছোলো ক’দিন পরই। “মা মারা যাওয়ার ছ’মাসও হয়নি, চোখের চামড়া বলে কি কিছু নেই এদের?” বলাবলি করতে করতে পাড়া ঝেঁটিয়ে আমরা নেমন্তন্ন খেতে গেলাম। স্টেশন রোডে তিনতলা বারোয়ারি বিয়েবাড়ি “মঙ্গলদীপ”-এর গা বেয়ে শতশত হলুদ উজ্জ্বল টুনির মালা আর গেটে পুলিশ। (সংহিতার কোন মামা নাকি এম পি, খবরটা তাহলে সত্যি?) এম পি মামা এসে পড়লে পাছে খাওয়ার জায়গায় কারফিউ জারি হয়, তাই আগে খাওয়া সারা হল। এক দেওয়ালে চাউমিন, আরেক দেওয়ালে পিৎজা, আরেক দেওয়ালে কুলচা। ইয়ংস্টারেরা চুটিয়ে খেল, যে সব বুড়োবুড়িরা নকল দাঁত দিয়ে কুলচা চিবোতে পারল না, তারা ভুখা পেটে কোণের চেয়ারে বসে নরম ময়দার লুচি আর ছোলার ডাল দিয়ে মাখা কালোজিরে চালের ভাতের কথা ভেবে হাহুতাশ করল।
দোতলার সিংহাসনে রানীর মতো বসে ছিল সংহিতা, আর ডিজাইনার ধুতির কোঁচা হাতে ধরে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে ছিল আমাদের বুবুন। ভিড় ঠেলে কোনওমতে সামনে গিয়ে সংহিতার হাতে বেডকভার আর 'শীর্ষেন্দুর দশটি উপন্যাস' গুঁজে আমরা চলে এলাম। বাইরে বেরোনোমাত্র আলো আর চিৎকার আর সুগন্ধী দমবন্ধ বাতাসের জায়গায় শেষ অঘ্রাণের হাওয়া জাপটে ধরে আরাম দিল। রিকশাস্ট্যান্ড ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল ততক্ষণে, আমরা হেঁটেই ফিরলাম।
ফিরতে ফিরতে ছবির মতো বিয়েবাড়ির দৃশ্য মাথার ভেতর ভেসে ভেসে যাচ্ছিল সবারই। বুবুনের বাবার হাসি, সংহিতার রং বুলিয়ে উঁচু করা গালের হাড়ের অহংকার। কিন্তু সব ছাপিয়ে আমাদের বারবার মনে পড়ছিল বুবুনের মুখ। সারা ঘরের আলো হাসি রং কোলাহল সিলিং-এর পলকাটা ঝাড়লন্ঠনে প্রতিফলিত হয়ে যেন জড়ো হয়েছিল বুবুনের মুখে।
নাঃ, কোনও সন্দেহই নেই, বুবুন আমাদের দেখা বেস্ট বর।
রেললাইনের পাশের হনুমানমন্দিরের গা বেয়ে ওঠা অশ্বত্থগাছটার পাতা সরসরিয়ে উঠল। লোকে বলবে হাওয়া, কিন্তু আমরা স্পষ্ট শুনলাম কে যেন বলছে, “জানি জানি জানি…”
রেললাইনের পাশের হনুমানমন্দিরের গা বেয়ে ওঠা অশ্বত্থগাছটার পাতা সরসরিয়ে উঠল। লোকে বলবে হাওয়া, কিন্তু আমরা স্পষ্ট শুনলাম কে যেন বলছে, “জানি জানি জানি…”
আহা! রোববার দুপুরে পড়লাম, ঠিক যেন মাংসভাতের পর শেষপাতে দই।
ReplyDeleteসারেগামা-র কুমার শানুর মত - ফাআটাআফাআটিই
হাহা, থ্যাংক ইউ, দেবাশিস।
Deletedarun.... darun....- Bratati.
ReplyDeleteধন্যবাদ, ব্রততী।
Delete"অসাধারণ" শব্দটা বহু-ব্যবহারে ক্লিশে হলেও এক্ষেত্রে আর কিছু লেখা যাচ্ছেনা। গোগ্রাসে গিললাম।
ReplyDeleteআমার ধন্যবাদও ক্লিশে মনে হতে পারে, ঋজু, কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা আন্তরিক।
Deleteমূল গল্পের এই অসাধারণ ভাবানুবাদ আর এভাৱে বাঙালিয়ানা দিয়ে মুড়ে ফেলা একমাত্র তোমার পক্ষেই সম্ভব কুন্তলা! কি যে অপূর্ব!
ReplyDeleteধন্যবাদ, কাকলি।
Delete'ইচ্ছের গাছ' এর পর 'বুবুনের মা' | চমত্কার, চমত্কার|
ReplyDelete'ইচ্ছের গাছ'টা কী ব্যাপার?
Deleteইচ্ছে সুচিত্রা ভট্টাচার্য্যের লেখা একটা ছোটগল্প। এটা নিয়ে একটা সিনেমাও হয়েছিল।
Deleteওহ।
DeleteOnoodyo :)
ReplyDeleteধন্যবাদ, অরিজিত।
Deleteখুব ভালো হয়েছে। এক নি:শ্বাসে পড়ে ফেলা গেলো।
ReplyDeleteধন্যবাদ, কৌশিক।
Deletedarun
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, চুপকথা।
Deletekhub khub khub bhalo hoyeche... pore boro kore lekhar icche aache
ReplyDeleteIndrani
থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, ইন্দ্রাণী।
DeleteKi compliment dile lekha ta koto bhalo legechhe seta bojhatey parbo, seta bujhtey parchhi na bole kichhu bollam na ar!!!
ReplyDeleteপাড়ার লোকের এমন কমপ্লিমেন্ট পেলে যে কত মন ভালো হয় সেটা আমিও বোঝাতে পারব না, আত্মদীপ।
Deleteলোকে বলবে হাওয়া, কিন্তু আমরা স্পষ্ট শুনলাম কে যেন বলছে, “জানি জানি জানি…”
ReplyDelete- লালমোহনবাবুর মতো আমারও একটাই বিশেষণ বলার আছে - Sublime!
ধন্যবাদ, ধন্যবাদ, অনীশ।
DeleteDarun hoyeche. Ami mul golpo ta porini, kintu apni osadharon at(m)ikoronn korechen. Ei ta bideshe golpre onubad noi, 'chaya obolombone likhito' .
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, ঘনাদা। হ্যাঁ, অনুবাদ বলাটা টেকনিক্যালি ভুলই হচ্ছে, কারণ প্লট এবং চরিত্রের ক্ষেত্রে আমি কারিকুরি চালানোর লোভ সামলাতে পারছি না। এগুলোকে "ছায়া অবলম্বনে" ধরাই ঠিক হবে।
Deleteosadharon . emon chomotkar onubad koro tumi monei hoy na onubad porchi . Thank you :) - PB
ReplyDeleteআরে, ধন্যবাদ, প্রদীপ্ত।
DeleteSpeechless.
ReplyDeleteধন্যবাদ, অর্পণ।
Deleteহ্যাঁ ছায়া অবলম্বনেই ঠিক কথা। গল্প নিয়ে কি বলব। আসল গল্প পড়লে খারাপ লেগে যাবে মনে হয়। আশা করি শিগগিরি তোমার গল্পের বই বেরোবে।
ReplyDeleteতোর মুখে ফুল চন্দন পড়ুক, ঊর্মি।
DeleteDarun laglo
ReplyDeleteধন্যবাদ, সুহানি।
DeleteAnubad bolben ki chhaya abolombone seta apnar byapar, kintu asambhab bhalo hoyechhe taate sandeho nei. Ekbaro mone hoyna onyo bhashar ba onyo desher galpo porchhi.
ReplyDeleteধন্যবাদ, সুগত।
Deleteসুন্দর একটি অনুবাদ গল্প উপহার দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আরও ভালো ভালো এবং মনোরঞ্জক লেখা আমাদের উপহার দিন এটাই কামনা। ভালো থাকবেন।
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, বিলাস। খুব ভালো লাগল।
Deleteআমার একজন প্রিয় লেখক এই লেখাটি সাজেস্ট করেন এবং পড়ে পুরো ছিটকে গেছি। মূল লেখাটি পড়িনি, কিন্তু সম্ভবত আমার পড়া শ্রেষ্ঠ অনুবাদ এটি!
ReplyDeleteআরে ধন্যবাদ, শঙ্কর। খুব ভালো লাগল আপনার ভালো লেগেছে জেনে। আমার নিজেরও গল্পটা বেশ প্রিয়...
Delete