তিনদিনের ছুটি + মেঘনাদ বধ রহস্য



কেমন আছেন? আমি ভালো আছি। শনিরবিসোম তিনদিন টানা ছুটি ছিল, তাই একটু বেশিই ভালো আছি। আই এস বি টি-তে গিয়ে ঝট করে একটা বাসে উঠে পড়ার জন্য ছুটিটা আদর্শ ছিল। অফিসে সবাই জিজ্ঞাসা করেছিল, উইকএন্ডে কী করবে, কোথায় যাবে। বলেছিলাম, বাড়িতেই থাকব, যাব না কোথাও। তাছাড়া একটা পোস্টও লিখতেই হবে। দ্বিতীয়টা অবশ্য মনে মনে বলেছিলাম, মুখে বলেছিলাম, "কিছুই করব না, জাস্ট চিল করব।"

শনিরবি এমনিতেই একগাদা কাজ থাকে, বাড়ি পরিষ্কার, কাবাড়ি ভাইসাবদের ডাকাডাকি, গাছে জল দেওয়া, ব্যাগের জিপ সারানো, ছেঁড়া চটি সেলাই। আনন্দ করার চান্স পাওয়াই শক্ত। ছোটবেলার শনিরবিবারগুলোয় বরং আনন্দ হত। এখনকার মতো খেতে যাওয়া কিংবা সিনেমা দেখতে যাওয়ার আনন্দ নয়, তখন আনন্দের অপশন বলতে ছিল শুধু আত্মীয়স্বজন। 

প্রায় প্রতি শনিবার যাওয়া হত জেঠুর বাড়ি। তখন জেঠুরা থাকত সোদপুরে। রিষড়া ঘাট থেকে ভটভটি চেপে গঙ্গা পেরিয়ে খড়দা, তারপর বাসটাস কিছু একটা চড়ে সোদপুর। ফোনটোন করে যাওয়ার কোনও ব্যাপারই নেই। যদি ওরা বাড়িতে না থাকে, কিংবা ব্যস্ত থাকে, কিংবা অন্য অতিথি থাকে, এই সব সন্দেহ কখনও হয়নি। তাছাড়া শনিবার জেঠুরাও মাঝেমাঝে গঙ্গা পেরিয়ে আমাদের বাড়ি আসত। খবর না দিয়ে চলেছি, হয়তো মাঝগঙ্গায় দুই ভটভটিতে দেখা হয়ে গেল, আমরাও ওদের বাড়ি যাচ্ছি, ওরাও আমাদের বাড়ি আসছে। এখন হলে ফোন না করে গেলে এইসব গোলযোগের একটা না একটা ঘটতই, কিন্তু তখন কিছুই ঘটেনি। দিব্যি খবরটবর না দিয়ে বিকেলবেলা যেতাম, গিয়ে মনা-টুনার সঙ্গে খেলে, জেঠির হাতের ডবল ডিমের অমলেট খেয়ে সন্ধ্যে পার করে ফিরে আসতাম। ফিরতে ফিরতে আটটা বেজে গেলে সে রাতের মতো আর পড়তে বসতে হত না। 

আরেক জায়গায় শনিরবিবার খুব ঘনঘন যাওয়া হত, সেটা মামাবাড়ি। সোদপুরের বদলে কসবা। যাওয়ার ঝঞ্ঝাট অনেক বেশি, ভটভটিতে হাওয়া খাওয়ার বদলে ট্রেন, মিনিবাসের গুঁতোগুঁতি। হাওড়া ব্রিজ পেরোনোর আড়াই মিনিট শুধু কসবা রথতলা মিনির সিকি জানালার ভেতর দিয়ে খানিকটা হাওয়া। তবু আমরা দেদার যেতাম। কারণ পথের কষ্টের ওপারে, সমস্ত আক্ষরিক এবং অনাক্ষরিক মোহমায়া নিয়ে মামাবাড়ি অপেক্ষা করে থাকত। সুমন-দোলনের সঙ্গে খেলা, ভূতের গল্প, মেজমামি-ছোটমামির হাতে ননস্টপ খাওয়া, ফেরার সময় আবার মিনিবাসের মৃত্যুযন্ত্রণা। হাওড়া ষ্টেশনে নেমে লিমকাটা তখন শখ নয়, প্রয়োজন। সে ট্রেন চলে গেলেও। বাড়ি ফিরতে ডেফিনিটলি দশটা বাজত, পড়তে বসার প্রশ্নই নেই। 

অর্চিষ্মানরাও নাকি খুব যেত মামাবাড়ি। গড়িয়া টু তেঘরিয়া। পঁয়তাল্লিশ নম্বর বাস, চলেছে তো চলেছেই। অনন্তকাল পর জানালা দিয়ে তাকিয়ে সবে শেয়ালদা! শনিবার সকালে মামাবাড়ি যাওয়ার স্ট্রাগলের গল্প করে করে আমাদের বেড়ানো পেয়ে গেল। বেড়ানোর একটা ছুতোও ছিল হাতের কাছেই,  'মেঘনাদ বধ রহস্য' চলছিল পি ভি আর নয়ডায়। গত দু’সপ্তাহ ধরেই চলছে, নয়ডা আর গুরুগ্রামের হলে। আমরা গত দু’সপ্তাহ ধরে ঘাপটি মেরে আছি, কখন এদিকে আসে আসে, কিন্তু দু’সপ্তাহ পরেও এল না দেখে পরিস্থিতি নিজেদের হাতে নিতে হল। এরপর চলে যাবে, আর দেখা হবে না। 

গুরুগ্রাম একটু দূর, কিন্তু নয়ডা অ্যাকচুয়ালি আমাদের বাড়ির কাছেই, মোটে বারো কিলোমিটার। প’নে সাতটায় শো। আমরা হাতে বেশি সময় নিয়ে সোয়া পাঁচটায় বেরোলাম। ভাগ্যিস বেরোলাম। প্রথমে জামিয়া মিলিয়ার সামনে, তারপর যমুনা ব্রিজে ওঠার মুখে, কী জ্যাম কী জ্যাম। আমরা ভেবেছিলাম গিয়ে, মলের ফুড কোর্টের পিটা পিট-এ খেয়ে হলে ঢুকব, মলের সামনে ওলা ব্রেক কষল যখন তখন কাঁটায় কাঁটায় প’নে সাতটা। তিনটে সিকিউরিটি পেরিয়ে, তিনবার পার্স খুলে দেখিয়ে, এসক্যালেটরের তিনটে করে সিঁড়ি লাফিয়ে কোনওমতে হল। তখনও হলের দরজা খোলেনি। পপকর্ন আর পেপসি নিলাম। খেতে খেতে চারদিকের বাঙালি মুখ জরিপ করলাম। আমরা বাকিদের করলাম, বাকিরা আমাদের করল। সবাইকেই চেনা চেনা লাগে, কাউকেই চিনি না। তারপর দরজা খুলে গেল, আমরা ঢুকে পড়লাম। কী দেখলাম, আপনাদের এবার ব্যাখ্যান করে বলব।

উৎস গুগল ইমেজেস

মেঘনাদ বধ রহস্যের কেন্দ্রে রয়েছেন প্রফেসর অসীমাভ বসু (পি এইচ ডি)। ইংল্যান্ডে থাকেন, সফল প্রফেসর, সফল কল্পবিজ্ঞান লেখক। আর্থার সি ক্লার্ক প্রাইজ পাওয়া। ওঁর ‘বিগ বং থিওরি’ বইয়ের বাংলা অনুবাদের উন্মোচন হচ্ছে পার্ক স্ট্রিটের অক্সফোর্ড বুক শপে। সেখানে অসীমাভ বসু (সব্যসাচী চক্রবর্তী) আছেন, অসীমাভ বসুর বইয়ের তর্জমাকার সাংবাদিক এলিনা (সায়নী ঘোষ) আছেন, মঞ্চে বিশিষ্টদের মধ্যে শিবাজি বন্দ্যোপাধ্যায় একজন বিশিষ্ট ঘোষকের ভূমিকায় আছেন (এঁর চরিত্রের নাম সম্ভবত প্রবুদ্ধ)। দর্শকদের মধ্যে আছেন অসীমাভ বসুর দ্বিতীয় পক্ষের প্রায় কুড়ি বছরের ছোট স্ত্রী, বিখ্যাত নায়িকা রাণী (গার্গী রায়চৌধুরী) আর অংকবিদ এবং অংকনশিল্পী বন্ধুর ভূমিকায় (এঁর চরিত্রের নামও ভুলে গেছি) কল্যাণ রায়। এই সিনেই স্পষ্ট হয়ে যায় আগের পক্ষের ছেলে ঋকের (বিক্রম চট্টোপাধ্যায়) সঙ্গে বাবা অসীমাভ বোসের সম্পর্ক খুব একটা মসৃণ নয়। অসীমাভ বোসের একমাত্র সন্তান হওয়া সত্ত্বেও এত গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষ্ঠানে সে অনুপস্থিত। এবং সেলিব্রিটি সৎ মা সে ব্যাপারটা মোটেই অ্যালাউ করতে রাজি নন। সৎ মায়ের ফোন পেয়ে ঋক অনুষ্ঠানে আসে। এখানে বসুপরিবারের আরেকটি চরিত্রের সঙ্গে আমাদের আলাপ হয়, সে হচ্ছে ধীমান, ডাকনাম সম্ভবত বুলু (অনিন্দ্য ব্যানার্জি)। অসীমাভর লতায়পাতায় ভাগ্নে, আদতে আশ্রিত এবং কলকাতার বাড়ির কেয়ারটেকার। (গোটা সিনেমায় এঁর অভিনয় আমার সবথেকে ভালো লেগেছে। সেই ওয়াই টু কে -তে ফোনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথোপকথন শুনেই আমি এঁর ফ্যান হয়ে গিয়েছিলাম, এখনও পর্যন্ত ইনি আমাকে হতাশ করেননি।) এ ছাড়াও আরও কয়েকজন চরিত্রকে আমরা বুক লঞ্চে দেখি। রাণীর “উওম্যান ফ্রাইডে” জানকী (আমি এই শিল্পীর নাম জানি না, নেটে খুঁজে পেলাম না), রাণীর এন জি ও-তে গত দেড় বছর ধরে কাজ করছে। বাদল বিশ্বাস (কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়), সাই ফাই লিটল ম্যাগাজিনের জন্য অসীমাভ বসুর লেখা ধার করতে এসেছেন। এর পর আরও চরিত্ররা আসবে, রাণীর আগের পক্ষের মেয়ে গুলি, দুই পুলিস, এক্স পুলিস, এক্স নকশাল ইত্যাদি।

অবশেষে আসবেন, লাস্ট এবং মোটেই লিস্ট নন, রাণীর পুরোনো ছবির পরিচালক এবং বন্ধু কুণাল সেন (আবীর চট্টোপাধ্যায়)। আবীর ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে অর্চিষ্মানের পাশে বসা কিশোরীটি “আবীর! আবীর!” বলে সিটের ওপর যে রকম লাফালাফি শুরু করল, দেখলেও মন ভালো হয়ে যায়।

মেঘনাদ বধ রহস্যের রহস্যটা এক কথায় বলা একটু দুষ্কর, কারণ রহস্য বিবিধ। গোটা ফার্স্ট হাফ লেগেছে সে রহস্য ফাঁদতে। এক নম্বর রহস্য, কে বা কারা অসীমাভকে পোস্টে ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ বইটা পাঠায়। ইংল্যান্ডের ঠিকানায় একবার পাঠিয়েছে। দ্বিতীয়বারে কলকাতায়।

দু'নম্বর, সিনেমার বাকি চরিত্ররাও যথেষ্ট রহস্যময়। কল্যাণ রায় ভারি রহস্যভরে ফোনে কার সঙ্গে কথা বলেন। চাপা গলায় সব বন্দোবস্ত হয়ে গেছে কি না জানতে চান। এলিনা ফোনে অ্যাবিউসিভ বরের সঙ্গে ঝগড়া করে, আবার কার সঙ্গে প্রেমও করে। রকমসকম দেখে রাণী আর কুণাল সেনের সম্পর্কেও সন্দেহ করার মতো মালমশলা ভরপুর পাওয়া যায়। এরই মধ্যে অসীমাভ-র জন্মদিন পালন হয়, জন্মদিনের পরদিন সকালে উঠে দেখা যায় আরেকটা মেঘনাদ বধ কাব্য বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছে, এবার একেবারে পাতায় বুকমার্ক গুঁজে, একটা লাইন হাইলাইট করে। লাইনটা হচ্ছে ‘মারি অরি, পারি যে কৌশলে।’

এরই মধ্যে মধ্যে একটা দ্বিতীয় গল্প চলে, যে গল্পটা লিখছেন অসীমাভ স্বয়ং। গল্পের নাম "স্বীকারোক্তি", স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে একটি বিদ্রোহী ছেলে পুলিসের গুলিতে মারা যায়, আরেকজন জেল থেকে বেরিয়ে বিদেশ যায়। এর মধ্যে একবার শান্তিনিকেতন থেকে ফেরার পথে অসীমাভর গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট হয়, সন্দেহ হয় মার্ডার অ্যাটেম্পট না তো? দ্বিতীয় বার মেঘনাদ বধ কাব্য উপহার পাওয়ার পর অসীমাভর আচারব্যবহারেও পরিবর্তন আসতে শুরু করে। মাঝরাতে চিৎকার করে ঘুম ভেঙে উঠে বসেন, হঠাৎ করে মেজাজ হারিয়ে ফেলেন ইত্যাদি। নানা ঘটনায় বোঝা যায় ভাগ্নে আর বাড়ির চাকরেরও অসীমাভর ওপর রাগ আছে।

সেকেন্ড হাফ শুরু হওয়ার খানিক পর আরেকটা রহস্যজনক ঘটনা ঘটে, এবং বোঝা যায় এতক্ষণ ফাঁদ পাতা চলছিল, এটাই আসলে কেন্দ্রীয় রহস্য। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে রাণী আবিষ্কার করেন যে অসীমাভ বসু নিখোঁজ হয়ে গেছেন। 

তদন্ত শুরু হয় এবং রহস্য সমাধান হয়। 

সমাধান হয় কি না সে নিয়ে অবশ্য মতান্তর আছে, আমার চেনা যারা সিনেমাটা দেখেছে তাদের অর্ধেকের মতে সমাধান হয়নি, অর্ধেকের মতে হয়েছে। আমি নিজে একরকম 'হয়েছে'-র দলেই আছি। সমাধান আরেকটু স্পষ্ট হলেও অসুবিধে ছিল না, কিন্তু যা হয়েছে তাও মেনে নেওয়া যায়, কারণ এই ধোঁয়া ধোঁয়া সমাধানটাই সিনেমাটার সবথেকে বড় সমস্যা নয়, এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ গোলযোগ সিনেমাটায় আছে। 

প্রথমে প্রশংসার জায়গাটা সেরে নিই। বিজ্ঞাপনের লোক বলেই হয়তো, অনীক দত্তর সিনেমা দেখলে একটা ফিল গুড অনুভূতি হয়। পুজোর শালিমারের অ্যাড দেখার মতো। যদিও গল্পের মধ্যে সাবস্ট্যান্স অ্যাবিউজ, দুরারোগ্য ব্যাধি, পুরোনো পাপের কামড় ইত্যাদি প্রচুর ফিল ব্যাড ব্যাপার আছে, কিন্তু সিনেমাটা দেখতে দেখতে আপনাকে সেগুলো বেশি জ্বালাবে না। মানে যখন ইংরেজের পুলিস গুলি করে স্বাধীনতা সংগ্রামীকে মারছে, তখনও করুণ রসের থেকে ব্যাকগ্রাউন্ডের পুরোনো জমিদারবাড়ি ভাঙাচোরা পোড়া থাম আপনার মনে সশ্রদ্ধ বিস্ময় জাগাবে বেশি। পুরোনো পাপে দগ্ধ হওয়া লোকগুলোর জ্বলুনি থেকে পিছলে পিছলে চোখ কেবলই চলে যাবে বাড়ির অপরূপ অন্দরসজ্জায়। দেওয়ালের অরিজিন্যাল পেনটিং আর হলের পিয়ানোয়। অন্তত আমার যাচ্ছিল। তাছাড়া, পার্ক স্ট্রিট, অক্সফোর্ড বুক স্টল, শান্তিনিকেতন, লন্ডনের প্রফেসর, বাড়িতে পিয়ানো ইত্যাদি শহুরে বাঙালিয়ানার ওয়ার্ম ফাজি ফিলিং তো আছেই। তাতেও মুগ্ধতা কম পড়লে বাঁচাতে আসবে আলুপোস্ত আর অথেনটিক আওয়াধি বিরিয়ানির আলু। বিরিয়ানির আলুতেও কোনও বাঙালি বোল্ড আউট না হলে তার বাঙালিত্বের অথেনটিসিটি পরীক্ষা করানোর দরকার।

ভালো লাগানোর জন্য এত কিছু থাকা সত্ত্বেও মেঘনাদ বধ রহস্য আমার ভালো লাগেনি। কেন লাগেনি তার কারণ নিচে বলার চেষ্টা করছি। 

এক, লেখার ক্ষেত্রে একটা জিনিসে নাকি এজেন্টরা খুব দাম দেন, সেটা হচ্ছে ‘ভয়েস’। বাই লাইন না দেখেই যদি কারও লেখা পড়ে চিনতে পারা যায় সেটা সাধারণত একটা গুণ বলেই বিচার্য হয়। মুশকিল হচ্ছে যে উল্টোটাও সময় সময় ঘটতে পারে। যখন একেকজনের মুদ্রাদোষ তাঁদের সৃষ্টিকে চিনিয়ে দিতে শুরু করে। 

অনীক দত্তর মুদ্রাদোষ, শব্দ দেখলে তিনি নিজেকে সামলাতে পারেন না। এলিনা দেখলে সেটাকে এলি না-র সঙ্গে না মিলিয়ে থাকতে পারেন না, জানকী শুনলেই সেটাকে 'জান কি?' ওয়ালা সেন্টেন্সের পাশে বসাতে ইচ্ছে করে, একজিবিশন শুনলেই রিফ্লেক্সে মুখ থেকে 'ইস-কী-ভীষণ' বেরিয়ে আসে। অংক আর অংকনকে পাশাপাশি বসানোর বিন্দুমাত্র সুযোগ আর যে-ই ছাড়ুন, অনীক দত্ত ছাড়বেন না। মেঘনাদ বধ রহস্যের ছত্রে ছত্রে এই শব্দের বীভৎস খেলা। গুচ্ছ গুচ্ছ পান। এমনকি এমন সন্দেহও আমার হয়েছে যে এই খেলাটা খেলবেন বলে উনি নিজেকে সুযোগ করে দিয়েছেন কি না। ঋকের ব্যান্ডের নাম “মাটি” দেওয়া কি শুধু “মা মাটি মানুষ” সংক্রান্ত পচা রসিকতাটা করবেন বলে?

অসীমাভর সঙ্গে আসিমভ-এর মিল তো ছেড়েই দিলাম, অসীমাভর বাঁহাতি ডানহাতিপনা নিয়ে “সব্যসাচী” রসিকতাও বাদ পড়েনি। আর আছে আলুপোস্তর জন্মরহস্য, কলকাতা বিরিয়ানির আলু। আর কলকাতা বিরিয়ানির কথা উঠেছে এবং ওয়াজেদ আলি শাহ বেচারা বাদ পড়েছেন, এ ঘটনা আমি আমার জন্মে দেখিনি। মেঘনাদ বধ রহস্যও ব্যতিক্রম নয়।

বাঙালির মুগ্ধতায় ইন্ধন জোগানোর আরও একটা শিওর শট উপায় পরিচালক ব্যবহার করতে ভোলেননি, তা হল দলে দলে বুদ্ধিজীবী লেলিয়ে দেওয়া। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা তো বললামই, বুক রিলিজের দৃশ্যে নাকি মৈত্রীশ ঘটকও ছিলেন। তাছাড়া এক্সিজিবিশনের উদ্বোধনের সময় সব্যসাচী আর কল্যাণ রায়ের মাঝখানে একজন ফাঁদে পড়া পাখির মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন, উনি নির্ঘাত নামকরা কোনও শিল্পী, শিল্পীদের সম্পর্কে আমার জ্ঞান ক অক্ষর গোমাংস বলে আমি তাঁকে চিনতে পারিনি। সবাই খুব "গণেশদা" "গণেশদা" করছিলেন। যাঁদের ডেট পাওয়া যায়নি, যেমন অমর্ত্য সেন, তাঁদের স্পিরিট ক্যাপচার করতে পরিচালক ভোলেননি। সব্যসাচীকে দিয়ে আড়াই প্যাঁচ প্যাডল করিয়েছেন স্রেফ শান্তিনিকেতন + অমর্ত্য সেন + সাইকেলের রোম্যানটিকতা বাঙালিকে আরেকবার মনে করিয়ে দেবেন বলে।
  
এত রেফারেন্স আর রসিকতা গোঁজার বিপদ হচ্ছে, কখনওই নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না যে সবাই সব বুঝল কি না। না বুঝলে এত পরিশ্রম মাটি। কাজেই বলে বুঝিয়ে দিতে হয়। এই বলে বোঝানোটা শুধু রসিকতা বা রেফারেন্সেই আটকে থাকেনি, প্লটেও বিস্তৃত হয়েছে। গোটা সিনেমা দেখার পর যদি রামায়ণের মেঘনাদ বধের সঙ্গে বর্তমান রহস্যের মিল কারও চোখে না পড়ে তাহলে তাঁকে “ক্ষুর দু’খানা বাড়ান, স্যার” ছাড়া আর কিছু বলার থাকে না, অথচ শেষের দিকের একটা দৃশ্যে আমরা দেখি দুজন চরিত্র গৌতম হালদারের "মেঘনাদ বধ কাব্য" নাটকটা দেখছেন এবং ঝুঁকে পড়ে কানে কানে সঙ্গীকে বলছেন, “কী রকম মিল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না?”

যাই হোক, এসব পরিচালকের ব্যক্তিগত পছন্দঅপছন্দের ব্যাপার। এগুলো বাদ দিয়ে অন্য অসুবিধেগুলোয় আসা যাক, যেগুলো রহস্য সম্পর্কিত। সিনেমা না হয়ে মেঘনাদ বধ রহস্য যদি একটা উপন্যাস হত, তার জন্যও এই অসুবিধেগুলো খেটে যেত।

অসুবিধে বললাম বটে, কিন্তু শুরু করব একটা সুবিধে দিয়েই। সিনেমার গোড়া থেকে ক্রিস্টি ঘরানা অনুসরণ করে প্রচুর চরিত্র আনা হয়েছে, প্রতিটি চরিত্রকে বেশ যত্ন করে এঁকেছেন পরিচালক, তাতে সবার মোটিভটোটিভগুলো, পারস্পরিক সম্পর্কের চলনগমনগুলো বেশ স্পষ্ট হয়ে চোখের সামনে ফুটে ঊঠেছে। এই পর্বে মূলত দুটো গোলমাল ঘটেছে বলে আমার বিশ্বাস।  

এক, অন্য মোটিভগুলোর তুলনায় একটা মোটিভকে অত্যন্ত বেশি ফুটেজ দেওয়া হয়ে গেছে। ডাকে বই আসা, অসীমাভর নতুন গল্পের প্লটে স্বাধীনতা সংগ্রামে দুই বন্ধুর দুই নিয়তি, ফার্স্ট সিন থেকে অসীমাভর নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে থাকার উল্লেখ এবং নিজের জীবনের সেই দিকটিতে কোনওমতেই আলো ফেলতে না দেওয়ার চেষ্টা, সর্বোপরি বর্তমানে লিখতে থাকা উপন্যাসের নাম "স্বীকারোক্তি" সব মিলিয়ে বাকি সব মোটিভের থেকে এই মোটিভটি যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটা ভীষণ রকম স্পষ্ট হয়ে গেছে। এর পর মোটে দুটো জিনিসই ঘটতে পারত। এক, দর্শকের আন্দাজকে সঠিক প্রমাণিত করে বাকি মোটিভদের ভাঁওতা প্রমাণিত করে এটিকেই সেরার মুকুট পরানো যেত, দুই, পেছনের সারির একটা মোটিভকে সামনে তুলে এনে এই মোটিভটাকে ভাঁওতা প্রমাণিত করে দর্শকদের চরম বোকা বানানো যেত। কোনটা হয়েছে আন্দাজ করার জন্য হাততালি নেই।

খেলিয়ে সাসপেক্ট আর মোটিভের মেলা সাজাতে গিয়ে দ্বিতীয় যে অসুবিধেটা হয়েছে সেটা হয়েছে সময় নষ্ট। গোটা প্রথমার্ধ এবং দ্বিতীয়ার্ধেরও সামান্য অংশ তার বাঁধতে খরচ করেছেন পরিচালক। তারপর অসীমাভ উধাও হয়েছেন, পুলিস এসেছে।

পুলিসের আসা নিয়েও আমার বক্তব্য আছে, কিন্তু তার আগে একটা অন্য কথা বলে নিই। আজকাল বাংলা গোয়েন্দা সিনেমায় পুলিসদের একটা ছাঁচ চলছে খুব, যেখানে অধস্তন অনবরত ভুল ইংরিজি বলেন আর ঊর্ধ্বতন অফিসার একেবারে পি কে দে সরকার গুলে খেয়েছেন। মেঘনাদ বধ-এও সেই ব্যাপার। যাই হোক, প্রথমটা আমার তাঁদের দেখে বেশ ভরসা হয়েছিল, দিব্যি মধ্যবিত্ত বাবাকাকাদের মতো চেহারা, করলে এঁরাই করলে কিছু করে উঠতে পারবেন, ওই সব ফ্যান্সি বুদ্ধিজীবী দ্বারা আর যাই হোক রহস্যদ্ধার হবে না, এ আশ্বাস আমার ছিল। 

কিন্তু তাঁরা কিছুই করলেন না। কয়েকটা জেরা করলেন, একটা অ্যালিবাইয়ের গোলমাল বার করলেন, তারপর মিটিং ডেকে তাঁদের "নিষ্কর্মা" গালি দিয়ে হাত থেকে কেস কেড়ে নিয়ে সি বি আই-কে দিয়ে দেওয়া হল। সে মিটিং-এ রিপ্রেজেন্টেশনের খুঁত কেউ ধরতে পারবে না। তিন বিগ বস পুলিসের একজন বাঙালি, একজন পাঞ্জাবী, আরেকজন মেয়ে।

এত কম ফুটেজ দিয়ে পুলিসকে আদৌ আনা হল কেন সেটা একটা রহস্য, আবার রহস্য নয়ও। কারণ পুলিস না আসলে ব্যাপারটা একটুও রিয়্যালিস্টিক হত না। ইদানীং অনেক বিশেষজ্ঞই বলেন, আজকাল রহস্য গল্পে এত যে পুলিস প্রসিডিওর‍্যালের বাজার যে তেজী হয়েছে তার একটা কারণ, সেকেলে গোয়েন্দা গল্পে যে দেখায় প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর সবাইকে জেরা করে বেড়াচ্ছে আর সবাই সুড়সুড় করে সব স্বীকার করে ফেলছে, বাস্তবে সেটা হয় না। আর মেঘনাদ বধে তো প্রাইভেট গোয়েন্দাও নেই, আছে শুধু প্রাইভেট নাগরিক। কাজেই জেরা এবং অ্যালিবাই চেকের জন্য পুলিসকে আসতেই হত।

এতক্ষণ ধরে রহস্য ফাঁদার তিন নম্বর অসুবিধেটা উন্মোচিত হল এই জেরার সময়। বেশিরভাগ গল্পের গোড়াতেই কেন খুনখারাপি ঘটে এবং তার পর বাকিটা সেটার একটা হাতেনাতে প্রমাণ পেলাম। আগে খুনখারাপি হওয়ার সুবিধে হচ্ছে জেরাটেরার মাধ্যমে মোটিভ অপরচুনিটি প্রকাশ করা যায়। এখানে ঠিক উল্টো হয়েছে। মোটিভ অপরচুনিটি সবই দর্শক জানে, পুলিস জানে না, জেরা করে জানছে। দর্শকও জানছে দ্বিতীয়বার করে এবং বোরের হদ্দ হচ্ছে। ওই জেরায় এমন একটিও তথ্য আবিষ্কার হয়নি, যা আমরা আগের দেড়ঘণ্টা ধরে না দেখেছি।  

আমার মতে মেঘনাদ বধ রহস্যের সবথেকে দুর্বল জায়গা অবশ্য এগুলোর একটাও নয়। সেটা হল ডিটেকটিভ গল্পে ডিটেকশনের অনুপস্থিতি। আমার একজন চেনা, গোয়েন্দাগল্পের সঙ্গে যাঁর দূরদূরান্তের গা ঘেঁষাঘেঁষি নেই, সিনেমাটা দেখে এসে একটা কথা বলেছেন যেটার দেশকালভেদে গোয়েন্দাগল্প রচয়িতাদের টেক্সটবুকে জায়গা পাওয়া দরকার। সেটা হচ্ছে, “ছাড়ানোর যদি দায় না থাকে তাহলে জট পাকাতে আর কষ্ট কী?”

এই সমস্যাটা মেঘনাদ বধ রহস্যের ভীষণ বেশি। প্যাসেঞ্জার লিস্ট দেখে একটা অ্যালিবাই বার করা ছাড়া আর কোনও রহস্যজনক ব্যবহারেরই কোনওরকম যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা কেউ “ডিটেক্ট” করে বার করার চেষ্টা করেনি। (এবং সেই অ্যালিবাই ভাঙার পরেও উক্ত সন্দেহভাজনের সঙ্গে পুলিসের কোনও মোলাকাত হল না।) দুয়েকজন সন্দেহভাজন সেকেন্ড হাফে গড়গড় করে নিজেদের সন্দেহজনক আচরণের কারণ বলে দিল, এক লাইনে, তাও আবার পুলিসের কাছে নয়, নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায়। তাতে ব্যাপারটা যা দাঁড়াল, সেটা হল যে ফার্স্ট হাফে কিছু তথ্য আমরা জানতাম না, সেকেন্ড হাফের শেষদিকে সেই সব তথ্যগুলো জানলাম। মাঝখানে কোনও ক্লু নেই, ক্লু ধরে ধরে সমাধানে পৌঁছনো নেই। এ রকম দুষ্কৃতী ধরে মজা কীসের?

লাস্টে আরেকটা কথা বলব। সব গল্পেই, বিশেষ করে গোয়েন্দাগল্পে ফোরশ্যাডোয়িং বলে একটা মারাত্মক জরুরি ব্যাপার থাকে। এই যে আমি এখন টাইপ করছি, ব্যাকগ্রাউন্ডে 'দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস'-এর বিবিসি অ্যাডাপটেশন চলছে, সেখানে আর্থার হেস্টিংস খুব গলা কাঁপিয়ে বলছেন, “But as the summerstorm drew nearer, I felt a strange premonition of evil. Of some fate that is to break in on us and change Styles Court for ever.

ফোরশ্যাডোয়িং এই সিনেমায় ভরপুর আছে। কিন্তু ফোরশ্যাডোইয়িং-এর একটা আবশ্যিক শর্ত হল ডেলিভারি। আপনি পাঁচবার বাঘ বাঘ বলে চেঁচালে একবার না একবার পালে বাঘ পড়তেই হবে। মেঘনাদ বধ রহস্যে অন্তত তিন থেকে চার বার এই রকম বাঘ বাঘ চেঁচানো হয়েছে। পাতাভর্তি ঘুমের ওষুধের পাতা ধরে লোকজন গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে, হাত থেকে মদের গ্লাস, জলের কাপ পড়ে চুরমার হয়ে যাচ্ছে, ক্লোজ আপে অবশ হাত, প্রিয়জন ঘরে ঢুকে নাম ধরে ডাকছেন, গলায় আতংক, দর্শকেরা টান টান, এমন সময় হাত নড়ে উঠল, হাতের মালিক চোখ খুলে বললেন, এই একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এটা একদু’বার ভালো লাগে, তিনবারের বার ধুত্তেরি বলে উঠে পড়তে ইচ্ছে হয়। মনে হয়, যা হয় হোক, আমার কিছু যায় আসে না।

আপনারা কেউ মেঘনাদ বধ রহস্য দেখলেন নাকি? কেমন লাগল?


Comments

  1. ami dekhechi ebong besh baje legeche , amar karon etai mone hoyeche rohosyo temon kichui na ar sekhane build up ei bekar somoy chole geche. after all eta movie 500 patar uponyas na - PB

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, প্রদীপ্ত, শুরুটা বড্ড বেশি খেলানো।

      Delete
  2. আমি দেখেছি, এবং খচে বোম হয়েছি। পুরো গালাগালি এখানে রইল:
    https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1426581390711832&id=100000799538490

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, আপনার গালাগালি পড়েছি, ঋজু। বেশিরভাগটার সঙ্গেই মত মিলেছে।

      Delete
  3. 1. Janaki choritrer obhinetrir nam Swati Sengupta..
    2. sabyasachi ebong Kalyan ray er sathe je shilpi chilen (mane jar exhibition udbodhon holo) tini ganesh halui..

    ar amar MBR besh bhaloi legeche..ajijul haq, saroj dutta, runu guha niyogi etc cross reference er jonye bhorpur moja peyechi

    ReplyDelete
    Replies
    1. গণেশ হালুইটা আমি সন্দেহ করেছিলাম, শিওর ছিলাম না। স্বাতী সেনগুপ্তর নামটা জানানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ, ঋতম। আমার আবার ক্রস রেফারেন্সগুলো একটু বেশির দিকে মনে হয়েছে, তবে এগুলো ব্যক্তিগত পছন্দঅপছন্দের ব্যাপার।

      Delete
  4. Besh detail e review likhechhen, tar jonyo dhonyobad Kuntala :) amar chhobita dekha hoyni, dekhar pore abar ei review ta porbo.

    chhotobelay phone na kore mama-mashi-jethu-kaku der bari jawar byapare high five. Sotyi, ki sundor gadget-bihin jibon chhilo tokhon! miss kori ekhon sei dingulo.

    ReplyDelete
    Replies
    1. সিরিয়াসলি, অরিজিত। আমি কাল ফোন না করে পাশের পাড়ায় চশমার দোকানে গিয়ে দেখি দোকান বন্ধ। জাস্ট ভাবুন একবার।

      ডিটেলে লিখেছি শুধু গোয়েন্দাগল্পের অংশটুকু। অভ্যেস খারাপ হয়ে গেছে আরকি।

      Delete
  5. Ami o dekhechi .Ami jehutu interval er age bhujte parchilam ki hochche tai temon bhalo lageni. Boddo opor chakchkyo kintu golpo ta sei bostopocha. Maitris Ghatak chilen book release e scene e. Kintu title card e nam khuje pai ni. Ami oo logix mall e dekhlam.tumi oo tai mone hochche!

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ হ্যাঁ, লজিক্স মলই, প্রিয়াঙ্কা। ওপর চাকচিক্য আমারও ভয়ানক বড় টার্ন অফ। অনেক সময় হয়তো খানিকটা অযৌক্তিকই, তবু। মৈত্রীশ ঘটকের নাম ছিল যেখানে সৌজন্যজ্ঞাপনট্যাপন হয় সেই লিস্টে।

      Delete
  6. chotobelar galpo niye notun ar ki bolbo....khub bhalo lage,ghatona guli mone pore,odbhut mosti lage..

    darun...

    কিশোরীটি “আবীর! আবীর!” বলে সিটের ওপর যে রকম লাফালাফি শুরু করল, দেখলেও মন ভালো হয়ে যায়।

    hese cholechi scene ta kalpona kore...tumi zata..

    prosenjit

    ReplyDelete
    Replies
    1. সত্যিই মেয়েটি খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল, প্রসেনজিৎ।

      Delete

Post a Comment