দুই বোন



আমি এই কালকেই ভাবছিলাম, দিল্লির হিন্দির সঙ্গে আমি কীভাবে সড়গড় হয়ে যাচ্ছি, এমনকি এই ভাষাটা কীভাবে আমার মুখের কথাতেও সময়েঅসময়ে ঢুকে পড়ছে সে নিয়ে একটা পোস্ট লিখব। এই যেমন আজকাল গল্প ‘করা’র জায়গায় মাঝেমাঝে গল্প ‘মারা’ বেরিয়ে যায়। কাল অর্চিষ্মান ফোন করে বলল, ‘শোন, একটা লিংক পাঠিয়েছি, একটু দেখো তো,” আমি বললাম, ‘দাঁড়াও, হাতের কাজটা নিপটে নিয়েই দেখছি।’ 

আবার কিছু কিছু জায়গায় এখনও হোঁচট খাই, যেমন ‘আগে’ শব্দটায়।  ওলা ভাইসাবকে রুকতে বললে তিনি বলেন, ‘পেড় কি আগে?’ আমি বলি, ‘নেহি, পেড় কি বাদ।’ উনি বলেন, ‘ওহি তো বোলা ম্যায়নে, পেড় কি আগে…’ এইরকম খানিকক্ষণ চলার পরে আমার মনে পড়ে যে ভাইসাবের ‘আগে’ যা, আমার ‘বাদ’ ও তাই।


কাল আমার হাতে চা ধরিয়ে দিয়ে ভাইসাব যখন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পেপার দেনে আয়ে হো?’ আমি একমুহূর্তের জন্য কনফিউজড হলাম। সঙ্গে সাইকেল নেই, সাইকেলের হ্যান্ডেলে থলি বোঝাই খবরের কাগজ নেই, থাকলেও আমার টিপ যা খারাপ, সে পেপার পাকিয়ে তিনতলা কেন, তিন হাত দূরের বারান্দায় ফেলতে পারব কি না সন্দেহ। তা সত্ত্বেও আমি ‘পেপার দিতে’ এসেছি, এ রকম মনে হওয়ার কারণ কী?

তারপর মাথা খুলল। কাছাকাছি নাকি কোথায় একটা চাকরির ‘পেপার’ চলছে, ভাইসাবের সন্দেহ হয়েছে আমরা সেই সূত্রে রোশনারা বাগের সামনের রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছি কি না।


করছি না। রোশনারা বাগের সামনে আমরা ঘোরাঘুরি করছি রোশনারা বাগে যাব বলেই। রোশনারা বাগ হচ্ছে শাহজাহানের মেয়ে রোশনারার (সম্ভাব্য) সমাধি এবং সমাধিঘেরা বাগান। সি আর পার্ক থেকে বেশ দূর। ওই সকালবেলার খাঁ খাঁ রাস্তাতেও পৌঁছোতে ঝাড়া পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগল। জায়গাটা দেখে মনে পড়ল, এ পাড়ায় আগেও একবার এসেছিলাম। আধার কার্ড বানাতে।

পরশু কাজ নিপটে অর্চিষ্মানের লিংক খুলে দেখি দিল্লিতে ‘ওয়াক ফেস্টিভ্যাল’ চলছে। ঐতিহাসিক মনুমেন্ট, ফুড ওয়াক ইত্যাদি আরও যা যা চেনা ওয়াক হয় সে সব তো হচ্ছেই, বেশ কয়েকটা ইন্টারেস্টিং ওয়াক-ও আছে দেখলাম। চাঁদনি রাতে জঙ্গলের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে ভূতের গল্প শুনতে শুনতে ওয়াক; কুতুব মিনার, খান মার্কেটে চোখ বেঁধে ওয়াক ইত্যাদি। আমি বললাম, ‘আচ্ছা, চোখ বেঁধে ঘুরতে চাও না বুঝলাম, জঙ্গলে মাঝরাতে ভূতের গল্প শুনি চল,’ অর্চিষ্মান বেঁকে বসল। কাজেই কম্প্রোমাইজ। রোশনারা বাগে থিয়েটার ওয়াক হবে, রোশনারা বাগ আমাদের দেখাও নেই, সেখানেই যাওয়া স্থির হল। 

থিয়েটার ওয়াক হচ্ছে থিয়েট্রিক্যাল পারফরম্যান্স সহযোগে ওয়াক। 'শাহজাহান’স ডটারস’ নামের এই ওয়াকটি পরিচালনা করবেন ‘দরবেশ’ দলের প্রশিক্ষিত অভিনেতারা।

দশটায় ওয়াক শুরু হওয়ার কথা, তখনও মোটে ন’টা কুড়ি। বাগের অনেকগুলো গেট। ফোন করে জানা গেল হাঁটা শুরু হবে তিন নম্বর গেট থেকে। হেঁটে হেঁটে গেলাম তিন নম্বরে। পাখিসব কলরব করছে। একদল মহিলা বসে হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে ভগবানের নাম করছেন। কয়েকজনের হাঁটা/ছোটা ততক্ষণে শেষ, তাঁরা বেঞ্চে বসে হাঁপাচ্ছেন আর এখনও যারা হাঁটছে তাদের চেঁচিয়ে উৎসাহ দিচ্ছেন। বাচ্চারা বাগের মধ্যে বসানো খেলার যন্ত্রপাতিতে চড়ছে। আমরা গেটের কাছে এসে চা খুঁজতে লাগলাম। চা নেই, চারদিকে স্বাস্থ্যকর ফলের জুসের ঠেলাগাড়ি। খানিকটা এগিয়ে চায়ের দোকান মিলল। 


দশটা পাঁচ নাগাদ, সঙ্গের হাঁটিয়েদের সঙ্গে টুকটাক আলাপ আর টিকিট পরীক্ষার পর হাঁটা শুরু হল। এই হচ্ছে রোশনারার অফিশিয়াল সমাধি, যদিও রোশনারা এখানে সমাধিস্থ রয়েছেন না লালকেল্লায় পরিবারের লোকদের সঙ্গে, সেটা নিশ্চিত নয়। এখন হতশ্রী অবস্থা, কিন্তু একসময় এ বাড়ির রূপের বাহার ছিল। ফোয়ারা থেকে বেরোনো সুগন্ধী জল পরিখা ভরে রাখত। ভেতরের দেওয়াল, ছাদ মণিমুক্তো এবং মেঝে কার্পেট দিয়ে সজ্জিত ছিল। রোশনারা বহু যত্নে এই বাগান আর বাগানে এই বাড়িটি বানিয়েছিলেন, তাঁর ইচ্ছে ছিল মৃত্যুর পর তাঁকে এখানে সমাধিস্থ করা হবে। 




শাহজাহান’স ডটারস-এর বিষয় শাহজাহানের পতন এবং ঔরঙ্গজেবের উত্থানের সময়কালের ঘটনাপ্রবাহ। গল্প বলা হবে শাহজাহানের দুই মেয়ে, জাহানারা এবং রোশনারার বয়ানে, পাঁচটি ছোট ছোট দৃশ্যে।

জাহানারা রোশনারাকে সাবধান করছেন, আদর্শবাদী ঔরঙ্গজেব শুধু একটাই আদর্শে বিশ্বাস করেন, 'ঔরঙ্গজেব' আদর্শে

প্রথম দৃশ্য শুরু হচ্ছে যখন, তখন চোদ্দটি সন্তানের জন্ম দিয়ে মুমতাজমহল মারা গেছেন, তাঁর স্মৃতিতে তাজমহল বানানো হয়েছে, শাহজাহানের মন সাম্রাজ্য পরিচালনা থেকে সম্পূর্ণ উঠে গেছে, তিনি সাহিত্যসংস্কৃতিতে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছেন আর ভাবছেন এইবেলা একটা কালো তাজমহল বানালে কেমন হয়। এই সময় শাহজাহানের বয়স চল্লিশ, তাঁর বড়মেয়ে জাহানারার বয়স সাতাশ, দারা শুকো ছাব্বিশ, ঔরঙ্গজেব এবং রোশনারা আরও ছোট। ভাইবোনের মধ্যে, বলা বাহুল্য, সদ্ভাব নেই। মারামারি কাটাকাটির পারিবারিক ঐতিহ্য তো আছেই, তাছাড়া শাহজাহান নিজেও খানিকটা দায়ী। ছেলেমেয়ের প্রতি তাঁর ভালোবাসার তারতম্য ছিল। শাহজাহানের ফেভারিট ছিলেন জাহানারা, কারণ তিনি ছিলেন অবিকল মায়ের মতো দেখতে। শাহেনশাহর প্রশ্রয়ে জাহানারার প্রতাপ প্রবল ছিল। তিনি ছিলেন বাদশাহি হারেমের হর্তাকর্তা। রোশনারা বাবার স্নেহের কাঙাল ছিলেন, না পেয়ে চটে গিয়ে দিদি এবং বাবার অ্যান্টি হয়ে গিয়েছিলেন। ওদিকে আবার দারা শুকোর মুখ ছিল শাহজাহানের মুখ কেটে বসানো, শাহজাহানের তাঁর প্রতিও পক্ষপাতিত্ব ছিল। ঔরঙ্গজেব ব্যাপারটা মোটেই ভালো চোখে দেখতেন না। তাছাড়া সাম্রাজ্য পরিচালনা বিষয়ে বাবা এবং দাদার সঙ্গে তাঁর মত ছিল নর্থ পোল সাউথ পোল। ঔরঙ্গজেব বিশ্বাস করতেন শাহজাহান সাম্রাজ্য অলরেডি দুর্বল করে দিয়েছেন, এই সব কবিমার্কা দারা শুকো সিংহাসনে বসলে, যে কি না আবার ফারসি ভাষায় গীতাউপনিষদ অনুবাদ করতে চায়, আর রক্ষা থাকবে না। কাজেই দারা শুকোকে মেরে তাঁর মুণ্ডু শাহজাহানকে ভেট পাঠানো হল।

জাহানারা বিপদ বুঝে আড়ালে চলে গেলেন। রোশনারার এতদিনের প্রতীক্ষার অবসান হল, ঔরঙ্গজেবের প্রতি তাঁর অন্ধ আনুগত্যের ফল ফলল, তিনি প্রবল প্রতাপশালী হয়ে উঠলেন। দাক্ষিণাত্য ঔরঙ্গজেবের অধিকাংশ সময় এবং মনোযোগ অধিকার করে রাখত, দিল্লিতে রোশনারাই ছড়ি ঘোরাতেন। অচিরেই শত্রু বাড়তে আরম্ভ করল। একবার জাহানারার কাপড়ে আগুন লাগল, দুই সহচরী প্রাণ দিয়ে রাজকুমারীর প্রাণ বাঁচালেন। কানাঘুষো হল, রোশনারার চক্রান্ত। দলের লোক না হলেও ঔরঙ্গজেব জাহানারাকে ভালোবাসতেন। দাক্ষিণাত্য থেকে দৌড়ে এলেন দিদির খবর নিতে। এর মধ্যে রোশনারা নাকি এমন কর বাড়িয়েছিলেন, সে আমলের নিরিখে যা বেশি রকমের বেশি। মোদ্দা কথা, রোশনারা ঔরঙ্গজেবের মাথাব্যথার কারণ হলেন। হ্যাঁ, সিংহাসনে চড়ার সময় রোশনারা তাঁর ভয়ানক কাজে লেগেছিলেন, কিন্তু তার প্রতিদান সারাজীবন ধরে দিতে হবে এমন কথা কোথাও লেখা নেই। বিবেকের শেষ বেড়াটুকু ভাঙার অজুহাতও মিলে গেল চটপট। রোশনারা তো ঠিক অসূর্যম্পশ্যা ছিলেন না, প্রচুর পুরুষপরিবৃত হয়ে তাঁর ছবিটবি আছে। তাঁকে দুশ্চরিত্র প্রমাণ করা শক্ত ছিল না। পরিষ্কার মনে ঔরঙ্গজেব দুশ্চরিত্র বোনকে বিষ খাওয়ালেন। রোশনারার জীবনপ্রদীপ নির্বাপিত হল। 


জাহানারা বুড়ো হয়ে মরেছিলেন, তাঁর সমাধি নিজামুদ্দিনে আছে। রোশনারার মার্ডার চুপচাপ চেপে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ করে এই রোশনারা বাগেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল কি না, নাকি লালকেল্লাতেই তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছিল, সে নিয়ে তাই সংশয় যায়নি।


Comments

  1. khub bhalo abhigyata hoyeche , mone hocche :)

    ReplyDelete
  2. ami jakhon jabo, amake erakam kothao nie jash

    ReplyDelete
  3. Ekdom onyorokomer ekta anubhuti holo ei lekhata pore. Erokom walk er aro publicity howa uchit.-Bratati

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে কতকিছু যে হয়, ব্রততী, হতেই থাকে, খবর রাখাই হয় না।

      Delete
  4. Ki shundor experience! Eyi jonne eto icche kore Delhi te thakte.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমি আগে কোনওদিন থিয়েটার ওয়াক দেখিনি, শর্মিলা, আমার তাই এক্সট্রা ভালো লেগেছে।

      Delete
  5. এই সময় শাহজাহানের বয়স চল্লিশ, তাঁর বড়মেয়ে জাহানারার বয়স সাতাশ...

    রাজাবাদশাদের ব্যাপার হলেও সংখ্যাগুলো একটু চোখে লাগলো। সিধুজ্যাঠা বললেন বাবা আর মেয়ের বয়সের তারতম্য বাইশ (মতান্তরে তেইশ) বছরের। ভারত-ঈশ্বর বোধহয় তখন পঞ্চাশ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, আমারও কানে লেগেছিল, দেবাশিস। আমিও রাজাবাদশার ব্যাপার বলে বিশ্বাস করে নিয়েছি।

      Delete
  6. এটা আমারও চোখে লেগেছিল বটে| ১৩ বছরের তফাতটা একটু বেশিই বাড়াবাড়ি|
    আর ঔরংজেবের সময়ে মুঘল রাজপরিবারের মেয়েদের বিয়ে না হওয়ার একটা ব্যাপার চালু হয়েছিল না ? অনেকদিন আগে পড়েছিলাম, ভুলে গেছি|

    ReplyDelete
    Replies
    1. মোগলাই রাজকন্যাদের বিয়ে না হওয়ার একটা ট্রেন্ড আছে সেটা ঠিক, অন্বেষা, কারণটা সহজেই অনুমেয়, নিজেদের মধ্যেই খেয়োখেয়ি, এর মধ্যে আবার চারটি জামাই এসে সিংহাসনের ভাগ চাইলেই হয়েছে। তবে নিয়মটা ঔরঙ্গজেবের আমলের কি না বলতে পারব না, কারণ জাহানারা রোশনারার-ও তো বিয়ে হয়নি এবং ধরে নেওয়া যায় তাঁদের বিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব শাহজাহানের ছিল। হতে পারে, যেটা সবার মনে মনে ছিল, ঔরঙ্গজেব সেটা অফিশিয়াল করেছিলেন। তবে আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না।

      Delete
  7. আমি কাল চাট্টি লিংক খুঁজে দেখলাম, এই নিয়মটা নাকি আকবরের সময়কার| জামাই নয়, মেয়ের ঘরের নাতিপুতিরা যাতে সিংহাসনের ভাগ না চায়, তার জন্যেই এই ব্যবস্থা| তার বিষময় ফল রাজকুমারীদের ঘরে প্রেমিকদের আসাযাওয়া ইত্যাদি| কারণ বিয়ে বন্ধ করলেই প্রবৃত্তি বন্ধ হবে এরকম তো কোনো কথা নেই |

    ReplyDelete
    Replies
    1. জামাই বলতে আমি জামাইয়ের উত্তরাধিকারীদের কথাও মিন করেছি। প্রেমিকদের আসা যাওয়া বিষময় অবশ্য আমি মনে করি না।

      Delete
  8. লেখাটা দারুণ মজার লাগল। কলকাতাতেও এই রকম হাঁটাহাঁটি তাও ভূতুড়ে বাড়ি ঘর দেখা নিয়ে শুরু হয়েছে। যাওয়ার ইচ্ছা আছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, বেশ ভালো লাগে, প্রিয়াঙ্কা।

      Delete
  9. bah.. sundor onnorokom experience... school e itihas joto baje lagto.. ekhon amar mughal bongsher golpo porte khub bhalo lage.. Kakimar golpo ta mone pore gelo.. sei jatra dekhe roshanara ba jahanara naam pochondo chilo tai na? :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. ঠিক, ঠিক, ঊর্মি। মুঘলদের ইতিহাস খুবই রোমহর্ষক।

      Delete
  10. বাঃ! দারুন কনসেপ্ট। এরম একটা walk এ অভিনয় করতে পারলে বর্তে যেতাম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে বাঃ, চন্দ্রচূড়, অভিনয়ের উৎসাহ আছে বুঝি?

      Delete
  11. K, roshanara aar jahanara r arek bon chilo. tar naam gauharhara. mumtaz mahal died while giving birth to her. gauharhara maintained a low profile. kintu mughal itihaas enar ulekh achey but primarily as a custodian for dara's daughters.

    aar mughal rajkonna der biye hoto tobe poribaar er cheleder sanghei hoto. kintu "singhashon juddhe" jehetu shob bibaho joggo cheleder kochukata kora hoto tai patrer abhabe rajkonna der majhe majhe biye hoto na.

    shahjahan badshah hoyechilen samasto mughal rajputra der ke mere tai R and J (and G) er janne patro chilo na. aurangzeb er khetreo tai hoyechilo. kintu later mughal princess were able to marry. eto boro comment hoye gyalo...kintu aajkal waldemar hansen er "the peacock throne" porchi..mughal der adab kayda anek kichu janlam :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে থ্যাংক ইউ, শম্পা। আমার এ সব কিছুই জানা ছিল না।

      Delete

Post a Comment