সবথেকে যেটা গর্বের
অনেক লোক এসেছিল। কেউ ঘর পর্যন্ত, কেউ বারান্দা, বেশিরভাগই রাস্তাতে ঘোঁট পাকাচ্ছিল। ঘরে ঢুকছিল যারা, পরিচিতির মাত্রা বুঝে আমার মাথায় হাত রাখছিল, জড়িয়ে ধরছিল। কেউ চেঁচিয়ে কাঁদছিল, কেউ ফুঁপিয়ে। বৌদি, কাকিমা, অর্চনা, দিদি সম্বোধনে মাকে ডাকছিল। মা এঁদের অর্ধেককে চিনতে পারতেন না আমি নিশ্চিত। এঁরা মায়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না বলে নয়, মানুষের নাম, মুখ ভুলে যাওয়ায় মায়ের প্রতিভা সীমাহীন ছিল বলে।
পাড়ার লোক হলে এই সব পরিস্থিতিতে আমি কাজে আসতাম। আমার আবার অবান্তর তথ্য মনে রাখার ক্ষমতা দেখার মতো। এবারই রিয়েলাইজ করলাম পাড়ার অন্তত পাঁচটা বাড়ির ল্যান্ডলাইন নাম্বার (যে ল্যান্ডলাইনগুলোর আর অস্তিত্ব নেই), দশটা বাড়ির বাচ্চার (যাদের নিজেদের বাচ্চা হয়ে গেছে) জন্মদিন আমার মুখস্থ। মুশকিল হত মায়ের অন্য ক্ষেত্রের পরিচিত (মায়ের কাছে অপরিচিত) লোকেদের ক্ষেত্রে। যাঁরা উল্টো প্ল্যাটফর্ম থেকে 'মিসেস ব্যানার্জি! কিংবা অর্চনাদি! বলে চেঁচাতেন। আমি চিনি না। মায়ের মুখভঙ্গিতে স্পষ্ট যে মায়ের বিশ্বাস মা কস্মিনকালেও লোকটাকে দেখেননি, কিন্তু উল্টোপক্ষের প্রত্যাশাপূর্ণ মুখ ভিন্ন সাক্ষ্য দিচ্ছে।
এই সব পরিস্থিতির জন্য মায়ের কতগুলো টোটকা ছিল। প্রথম টোটকা হল ‘আরে ভালো তো’ ইত্যাদি ননকমিটাল কথোপকথন সেরে ‘এই তো মেয়েকে নিয়ে গানের স্কুলে/ ডাক্তারখানা যাচ্ছি’ বলে হাঁটা লাগানো। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এত সহজে কাজ দিত না। ডাকিয়ে মাকে ধরে গল্প জুড়তেন। তখন মা হাসি নিটোল রেখে ঘাড় বাঁকিয়ে জানতে চাইতেন, ‘আপনি কি এখনও ওখানেই/ ওই এক্সচেঞ্জেই?’ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই লিডিং প্রশ্নের উত্তরে আলাপচারীর কর্মক্ষেত্রের ঠিকানা বেরিয়ে আসত এবং মা অবশেষে তাঁকে চিনতে পারতেন (কিংবা পারতেন না)।
রবিবার মা চেনাঅচেনার ঊর্ধ্বে ছিলেন, আর আমি মাথা না ঘামালেও অভ্যেসবশতঃ সকলকেই চিনতে পেরে যাচ্ছিলাম। মায়ের সম্পর্কে তাঁদের কথা শুনছিলাম। এই পরিস্থিতিতে খারাপ কথা, ব্যতিক্রমী না হলে কেউ বলে না। কেউ বলছিল মায়ের কত সাহস ছিল, কেউ বলছিল কী আত্মত্যাগ, কেউ বিস্ময় প্রকাশ করছি মায়ের পরিশ্রম এবং সহ্যশক্তির মাত্রা মনে করে। কেউ বলছিল মা কত বুদ্ধিমান ছিলেন, কত খাঁটি। সকলেই সব বলছিল না, যে পরিসরে মায়ের জীবন যাকে যেভাবে ছুঁয়েছে, সেই সব পরিসরে যে যে গুণের মুখোমুখি হওয়া সম্ভব, সেই সেই গুণের কথা বলছিল।
কিন্তু সকলেই যে কথাটা বলছিল সেটা হচ্ছে মা তাঁর মেয়েকে ভালোবাসতেন।
মাকে যারা আমার সঙ্গে দেখেছে, দেখেনি, এরওর মুখে গল্প শুনেছে, তাঁরাও নাকি মায়ের মেয়েকে ভালোবাসার কথা জানেন।
আমি শুনছিলাম। শুনতে শুনতে টের পাচ্ছিলাম, পরীক্ষার নম্বর, গানের প্রতিযোগিতার প্রাইজ, স্পোর্টসের সান্ত্বনা পুরস্কার, এনট্রানস ক্লিয়ার, প্রশংসাবাক্য আরও যা যা জীবনের অ্যাচিভমেন্ট মেনে এসেছি, অল্পস্বল্প গর্বও বোধ করেছি মনে মনে, তাদের সবাইকে যোজন যোজন পেছনে ফেলে বুকের ভেতর এই সত্যিটাই আমার জীবনের সব থেকে বড় অ্যাচিভমেন্ট, সবথেকে গর্বের হয়ে উঠছে।
যে তুমি আমাকে ভালোবাসতে, মা।
আরও একটা সত্যি আছে। সবাই জানে না। জানার দরকার নেই, কারণ তুমি জানো। কারণ মায়েরা সব জানে।
সে সত্যিটা হল আমিও তোমাকে ভালোবাসতাম। তোমার যত কথা শুনেছি, যত কথা শুনিনি, যত সঙ্গ দিয়েছি, যত সোনার সময় কেড়ে নিয়েছি, যত আনন্দ দিয়েছি, যত হতাশ করেছি, সবই ভালোবেসে। সীমাহীন ভালোবেসে।
এর পরও যত কথা মনে মনে তোমাকে বলব, যত মুহূর্ত তোমাকে ভুলে থাকব, তোমার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকব অথবা দৃকপাত না করে দৌড়ব গন্তব্যের দিকে, তোমার কথা মনে করে হাসব, কাঁদব, অভিমান করব, সবই তোমাকে ভালোবেসে করব মা। আকণ্ঠ ভালোবেসে।
সময়, অনেকটা সময়। আর কোনো ওষুধ নেই কুন্তলা। পাস্ট টেনসে মায়ের আর তোমার ভালোবাসার কথা বোলো না বোনটি আমার। মা ভালোবাসেন। তুমি ভালোবাসো। সব ঠিক হয়ে যাবে। সাবধানে থেকো। বড্ড অন্যমনস্কতা ঘিরে থাকে এই সময়।
ReplyDeleteআমি তো ভালোবাসিই, অদিতি। বাসবও। মা আছেন কি না জানি না। থাকলে নিশ্চয় ভালোবাসেন আমাকে।
Deleteভালো থেকো কুন্তলা।
ReplyDeleteথাকব, অদিতি।
DeleteKhub mon kharap hoyechilo aagerdin khobor pore.. aapnar lekhar moddhe diye aapnar maa ekebare chena manush hoye uthechilen.. aar aapnader bond sotti extraordinary..
ReplyDeletesabdhane thakben.. bhalo thakben..
Indrani
কাল একজনকে এই কথাটা বলছিলাম, ইন্দ্রাণী। মা যেখানে চলে গেলেন, হাজার শক্তিশালী বন্ড দিয়েও সেখান থেকে কাউকে ফিরিয়ে আনা যায় না, এইটাই দুঃখ।
DeleteBhalo theko Kuntaladi
ReplyDeleteরণদীপ, তুমি বললে, ভালো লাগল।
Deleteকী যে বলি! সুস্থ থাকুন, শক্ত থাকুন।
ReplyDeleteসে রকমই থাকার চেষ্টা করছি, অন্বেষা। এই কথাগুলো অনেক হেল্প করছে।
DeleteMa achen... O Ma chirokal thakben.... Ebong Tomai bhalobasha diye jaben....amader orthat tomar oshonkhyo gunmugdho pathok er bhalobashar protisruti roilo
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, রণিতা। ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নেই আমার।
DeleteAapnar maa ke samnasamni dekhar soubhagyo hoini. Kintu aapnar lekhar modhyo diye uni amader parichito ekjon hoye uthechhilen. Hothat ei khoborta pore stombhito hoye gechhilam. Aapnara shokto thakun.
ReplyDeleteআমার খুব ইচ্ছে করে আমার পছন্দের লোকেদের সঙ্গে আমার মায়ের আলাপ করিয়ে দিতে। কারণ দুপক্ষেরই দুপক্ষকে ভালো লাগবে জানি। আর তো তার উপায় নেই, সুস্মিতা।
Deleteভাল থেকো কুন্তলা। নিজের যত্ন নিও। জানি তুমি ভাল নেই তাও শক্ত থেক।
ReplyDeleteসে রকম থাকারই চেষ্টা করছি, চুপকথা। বেশিদিন খারাপ থাকার শক্তি আমার নেই।
Delete"তোমার মহা বিশ্বে কিছু হারায় না তো কভু"- কুন্তলাদি এ কথাটা খুব মিথ্যে না মনে হয়। মানুষের শরীর একটা যন্ত্র মাত্র হলেও এই যে ভালোবাসা এ তো কোথাও না কোথাও রয়েই যায়। যা নিয়ে এগোই তা সবই কি আর অর্জন খানিক তো উত্তরাধিকা।। সে সবের মধ্যেও তো ওই মানুষটা রয়েই যায়। ওনার ভালোবাসাটা তোমায় এই সময়টা ভালো থাকার শক্তি দিক।
ReplyDeleteভালো থেকো কুন্তলাদি।
তুমি আমার মায়ের প্রিয় গানটার উল্লেখ করলে প্রদীপ্ত। তোমার বাকি কথাগুলোও অসম্ভব দামি। আমি তো অর্জন কিছু খুঁজেই পাই না। উত্তরাধিকার ভাঙিয়েই চলছে। চলবে।
Deleteশুধু অনুভব করলাম।
ReplyDeleteBaptu
থ্যাংক ইউ।
Deleteঅনেকটা ভালোবাসা দিয়ে গেলাম , ভালো থেকো কুন্তলা | (অবান্তরে অনেকদিন পর এসেছিলাম , লেখাটা পরে কি বলবো কি না বলবো বুঝতে না পেরে শুধু এইটুকুই ) - ইচ্ছাডানা
ReplyDeleteখুব জরুরি জিনিস দিয়েছেন, ইচ্ছাডানা। এই মুহূর্তে আরও বেশি জরুরি।
Deleteদেখো কুন্তলা দিদি তোমার জায়গায় দাঁড়িয়ে কথাগুলো অর্থহীন হাস্যকর মনে হলেও আমার সত্যি সত্যি একটা জিনিস খুব মনে হয় , যে মৃত্যু শুধু একটা জার্নি. যেমন তুমি যেদিন রিষড়া থেকে দিল্লি চলে গেছিলে, জায়গা পাল্টেছিলে, নিজেকে পাল্টাওনি, সম্পর্ক পাল্টাওনি, তোমার সব আজন্মপরিচিত স্মৃতি গন্ধ মনে পড়া কিছুই পাল্টাওনি, তেমন ই কাকিমা কে যেতে হয়েছে একটা নতুন জায়গা এ কারণ সবাই কে যেতে হয় , এই মাত্র. আর কিছু পাল্টায়নি কুন্তলা দিদি বিশ্বাস করো। কাকিমা কোথাও না কোথাও থেকে তেমনভাবেই ভাববেন তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে কিনা যেমন সব সময় ভেবে এসেছেন, শুধু ওখানকার নেটওয়ার্ক সমস্যার জন্য ফোন করা সহজলভ্য নয় তাই মনে মনে কথা বলে নিতে হয়, আর খুব খুব কাছের মানুষরা তো সেটা পারেই বল. আর কখনো না কখনো তো আমরা সবাই ই ওই জায়গা তাই যাবো , কে বলতে পারে হয়তো সবার সাথেই সবার দেখা হয়ে যায় তখন. সব কিছু আবার আগের মতো হয়ে যায়. একদম ছোটবেলার মতো.
ReplyDeleteরাগ করো না কুন্তলা দিদি তোমার ব্যক্তিগত পরিসরে হস্তক্ষেপ করলাম বলে, কিন্তু তোমার লেখা পড়েই তোমাকে আসলে খুব চেনা ভেবে ফেলেছি তো।
সূচনা, এইরকমের হস্তক্ষেপ যে কী আদরের যদি বোঝাতে পারতাম। তুমি যে আমাকে আশ্বাস দিলে যে মা আছেন, শুধু ফোনের লাইনটা কেটে গেছে, আমার যে কী শান্তি হল। থ্যাংক ইউ, সূচনা। তোমরা ছিলে বলে কষ্ট অনেক কম হল। সত্যি বলছি।
Delete
ReplyDeleteকিছুই বলার নেই। আশা করি আপনার বাবা স্থির আছেন।
সময়ে সব যন্ত্রণারই উপশম হবে। আপনার মা, যেখানেই যান, আপনার মত মেয়ে পেয়েছেন বলে নিশ্চয়ই গর্ব করবেন। ভাল থাকবেন।
গর্ব সবটুকুই আমার তরফ থেকে, আত্মদীপ। আপনি আমার পাড়ার লোক, শুভেচ্ছা পেয়ে ভালো লাগল।
Deleteদিদি, এই শোকের কোন সান্ত্বনা হয় না। তাই মনভোলানো কথা বলবো না।শোকের ভাগ নেওয়া নয়, পাশে বসার চেষ্টা করলাম। আমিও ঠিক চার বছর আগে এই দিনটা দেখেছি আর তারপর থেকে জীবন আর একরকম নেই।যেমন সেড্রিকের মৃত্যুর আগের হ্যারি আর পরের হ্যারির মধ্যে বেশ অনেকটা তফাত, আমার জীবনেও তাই।মা আপনার সাথেই আছেন, থাকবেন ও চিরকাল।এই পোস্টটার অপেক্ষায় ছিলাম এক সপ্তাহ।
ReplyDeleteভালো থাকুন আপনারা , বাবাকেও ভালো রাখুন
এটা ঠিকই বললে, ঋতম। আমারও কেমন একটা বিফোর আফটার ফিলিং হচ্ছে। আসলে এই ঘটনা তো জীবনে একবারই ঘটে।
DeleteOnekd din pore eshe eyi rokom ekta post dekhbo bhabte e parini.
ReplyDeleteTomar shob koshto dukkho shomoyer saathe aaste aaste shohoniyo hoye uthuk eyi kamona kori Kuntala.
Ma achen ... tomake dekhchen, bhalobashchen o ashirbaad korchen … bisshash koro.
Bhalo theko.
থ্যাংক ইউ, শর্মিলা। ভালো লাগল তোমার শুভেচ্ছা পেয়ে।
DeleteKuntala apnar post pore apnar Ma er kotha jante pere ami shtombhito hoe gechilam kichukhoner jonyo...karone ami apnar sob lekha porar chesta kori ebong Abantor e apnar Ma er o kotota bhumika ache apnar lekha theke ta spostho bujhte pari... Baba Ma er onuposthiti keu kokhono puron korte pareni... Apnar Ma jekhane jatra korlen asha kori shekhane thekeo uni apnake shoman bhabe songo deben o shanti te thakben... Apnio bhalo thakun...
ReplyDeleteহ্যাঁ, মধুজা, আকস্মিক হল খুব ব্যাপারটা। আমিও তাই ভাবছি, মা হয়তো এখানে কষ্ট পাচ্ছিলেন, চলে গিয়ে হয়তো ভালো আছেন। এটুকু ধরে নেওয়া ছাড়া আমার তো আর কিছু করারও নেই। আপনার মন্তব্য পেয়ে ভালো লাগল, এই কথাগুলো অনেকটা শান্তি দেয়।
Delete