যদি কেবল একটি বরই মেলে



মাঝে মাঝে আমার সহকর্মীদের জন্য মনখারাপ হয়। সেই সব অটোভাইসাবদের জন্য, পুল সহযাত্রীদের জন্য, সেই সব কুকুরগুলোর জন্য যারা আজকের মতো দিনে আমার মুখোমুখি হবে। 

চোখ খোলার মুহূর্তেই বুঝে গেছি আজ সেই সব দিনগুলোর একটা হতে চলেছে। আজ ‘আমার-সঙ্গেই-কেন-এ’রম-হয়-ঠাকুর ধাতের দিন। বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করবে না। চা হবে নিড়বিড়ে, শিরদাঁড়াহীন। উবারের ম্যাপে দেখব ভাইসাব আমার থেকে ক্রমাগত দূরে, আরও দূরে চলে যাচ্ছেন। এদিকে ঘড়িতে আটটা চার। ক্যান্সেল করব। উবার বিনীত গলায় জানাবে, ইউ উইল বি চার্জড আ স্মল ফি সিন্স হি হ্যাজ অলরেডি স্টার্টেড দ্য জার্নি। 

আমি দাঁতে দাঁত চেপে বলতে চাইব, নো হি হ্যাজ নট, কিন্তু কাকে? কেউ শোনার নেই।

আজ ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়বে যে আমার কিস্যু হস্যে না। বাকি সবারই সব হয়ে যাচ্ছে, যা চাচ্ছে, টপাটপ। 

আজ এক হাতে বরফঠাণ্ডা জলের গ্লাস, অন্য হাতে ফুটন্ত চায়ের কাপ নিয়ে প্যান্ট্রির দরজা পা দিয়ে খুলে বেরোতে যাব, দরজার ফ্রেমে কাঁধে ধাক্কা লেগে দুই তরলের একটা ছলকাবে।

কোনটা, গেস করার জন্য কোনও প্রাইজ নেই। 

অর্ধেক কাপ সদ্য ফুটন্ত জল আমার আঙুলে। দেখতে দেখতে চারটে আঙুল লাল। কোনওমতে সিংকের কল খুলে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছি, সাক্ষী না রেখে, খালি প্যান্ট্রি দেখতে দেখতে বন্যার নদীর মতো ভরে যাবে। হোয়াট হ্যাপেনড? ও মাই গড, বহোত দর্দ হো রহা হ্যায় কেয়া? সবকো বুলাউঁ?  

ডেস্কে এসে গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে বসে থাকব। গত ক’সপ্তাহে একটাও নতুন পাতা বেরোয়নি। ওরাও কি আমার মতো শোকগ্রস্ত? 

ইন্টার্ন মেয়েটা অলরেডি পা টিপে টিপে হাঁটে, এমনি দিনে আমি ওর জন্য টুকটাক স্মল টক রেডি রাখি, আজ চোখ স্ক্রিনে এমন সেঁটে রাখব যেন সরালেই নোবেল হাতছাড়া। 

ইনবক্স খুলে দেখব, যে সমস্যাটার সমাধান আমার হাতে নেই সেটার আশু সমাধানের দাবি করে কেউ আমাকেই মেল করেছে। যাঁদের হাতে সমাধান তারা সিসি তে আছেন, কিন্তু ঘাপটি মেরে। মজা দেখছেন।  কে প্রথম সাড়া দিয়ে ফেলে।

বিকেলের কনফারেন্স কল সন্ধে পেরিয়ে টানবে। যে কথাটা পনেরো মিনিটে শেষ করা যায় সেটা দেড় ঘণ্টা কচলানো। কারও নতুন কিচ্ছু বলার নেই। সেই ডিপ ডাইভ আর আউটরিচ আর লং টার্ম স্ট্র্যাটেজি আর পলিসি ফ্রেমওয়ার্ক। যে যার চাকরি বাঁচাচ্ছে। শরীরের প্রতিটি কোষ চাইবে মাইক কেড়ে নিয়ে, সবার মুখে সেলোটেপ মেরে, “যাও সবে নিজ নিজ কাজে” বলে ঘণ্টা বাজিয়ে দিতে, পারব না। আমাকেও চাকরি বাঁচাতে হবে।

আজ বাজার করে ফিরতে হবে। আবারও সেজে আসবে আকাশ। সবাই বলবে, থ্যাংক গড, মনসুন ইজ ফাইন্যালি হিয়ার। 

বাড়িতে ঘট নেড়ে উঠে টুকাইদা আমের পল্লব ঝাড়লে ওর থেকে বেশি জল ছেটে। 

ফিরতি পথে ভাইসাব লোকেশনের দুশো মিটার দূরে দাঁড়িয়ে বার্তা পাঠাবেন, আই হ্যাভ অ্যারাইভড। 

নো ইউ হ্যাভ নট। আমার আর যুদ্ধের শক্তি নেই, ক্যান্সেল করার সময় নেই। আপনি যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন, আমিই যাচ্ছি। 

সিগন্যাল ভেঙে, ফুটপাথে চড়ে, রাস্তার অন্যান্য চালকদের মামাসি উদ্ধার করতে করতে তিনি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবেন। আমি মোটা গলায় "রোকনা" বলে নেমে আসব। থ্যাংক ইউ, প্লিজ, ভেরি গুড, অলরাইট সৌজন্যের আজ কোনও জায়গা নেই। আমি ওঁকে পাঁচে এক দেব। উনিও আমাকে তাই দেবেন, গ্যারান্টি।

ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ভাবব কী হবে এই ছাইপাঁশ লিখে। দশবছর ধরে হাবিজাবি পার্সোন্যাল কথা লিখে চলেছি। কত সময় নষ্ট করে ফেললাম। নষ্ট, নষ্ট, সব নষ্ট। তার থেকে চানাচুর খাওয়া ভালো।  

আধবয়াম চানাচুর উড়ে যাবে। বুক জ্বলবে। চোঁয়া ঢেঁকুর। ভাতরুটির কথা মনে পড়লে বমি আসবে।

না খেয়ে রাতে শুয়ে মনে পড়বে যতজনের সঙ্গে কথা বলেছি সারাদিন, তাদের সবার মা আছে। ওর মা আছে, ওর আছে, ওর তো আছেই। খালি আমারই মা নেই। 

*****

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙবে, তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠব, দাঁত মাজতে মাজতে আয়নায় ঝাপসা মুখের আউটলাইনের দিকে তাকিয়ে ভাবব হতে পারে আমার নাক বোঁচা, ঠোঁট ছ্যাতরা, চিবুক ঢোকা, কিন্তু সব মিলিয়ে একটা বুদ্ধিমান, রুচিবান ভঙ্গি। কেমন একটা শান্ত সৌম্য ছাপ। 

আফসোস করব, কালকের লোকগুলো আমার এই সংস্কৃতিবান দিকটার পরিচয় পেলেন না। তাঁরা শুধুই ভাবলেন আমি একটি দুর্বিনীত, এনটাইটেলড, রামগরুড়ের ছানা। এই মুহূর্তে যদি তাঁদের আমার বডি ল্যাংগোয়েজ দেখাতে পারতাম, মাথা কেমন উঁচু, শিরদাঁড়া কেমন টানটান অথচ স্ট্রেসহীন, শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়মিত এবং ধীর। আজ আমি আম্বানিদের থেকেও বড়লোক। গোটা আটচল্লিশ ঘণ্টা আমার ক্রেডিট। 

চায়ের কাপ আর খবরের কাগজ থেকে সরে ঘড়ির চোখে চোখ পড়বে, সাড়ে সাতটা। তাড়া নেই। গত পাঁচ সকালের সংগীত বাংলার বদলে আজ ইউটিউবে মায়ের প্রিয় গানগুলো খুঁজে খুঁজে চালাব। মাঝখানে একদিন, বুধবার সম্ভবত, যখন সাপ্তাহিক টানেলের গভীরতম অংশ দিয়ে চলেছিলাম, ঘুম থেকে উঠে প্যালপিটেশন হয়েছিল। মায়ের গলা তো কোথাও রেকর্ড করা নেই, যদি ভুলে যাই? 

ভুলিনি। আজ মায়ের হাসিটা স্পষ্ট কানে বাজবে। মায়ের সঙ্গে রসিকতাগুলো মনে পড়ে মুখ হাসিহাসি হয়ে থাকবে। 

অর্চিষ্মান উঠলে ঠিক হবে, আজ বাড়ির বদলে বাজারের কোণের চা খাওয়া যাক। রাধাবল্লভীও নিয়ে আসব একইসঙ্গে। মেলা গ্রাউন্ড দিয়ে শর্টকাট করব। সময় বাঁচানোর জন্য নয়। বললাম না, আটচল্লিশ ঘণ্টা আছে এখনও। ফুটবল খেলা হচ্ছে মাঠের তিন ভাগে। তিনটে খেলার ঠিক মাঝখানে কালো গুণ্ডা কুকুরটা আরাম করে শুয়ে আছে। বল লাগার ভয় নেই। বলগুলোই বরং ওকে ভয় পায়, গায়ে লাগতে লাগতেও বাঁক বদল করে।

কালকের কুকুরটার কথা মনে পড়বে। অফিসের সামনে বসে যে আমার দিকে অসম্ভব করুণ দুটো চোখ মেলে আই কন্ট্যাক্টের চেষ্টা করছিল। আমি জোর করে চোখ অন্যদিকে সরিয়ে রেখেছিলাম। নিজের ওপর রাগ হয়, তবে বেশিক্ষণের জন্য নয়। আজ শনিবার, আজ পজিটিভিটির দিন।

ভক্তমানুষদের ছেড়ে আমার কাছে ভগবান আসবেন না, কিন্তু যদি আসেনই, আর যদি বলেন পরজন্ম আছে, আর যদি জানান এ জন্মে ডেবিট ক্রেডিট না মেলার জন্য আমাকে ফিরে জন্ম নিতেই হবে, আর এও বলেন এ জন্মে অত্যাশ্চর্য ভাবে কিছু পুণ্য জোগাড়ের ফলে আমি একটা, শুধু একটাই মাত্র বর চাইতে পারি সামনের জন্মের জন্য, তাহলে অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে একটা বরই চাইব।

সামনের গোটা জন্মটা যেন শনিবারের সকালের মতো হয়, ঠাকুর। 


Comments

  1. আমার হাতে সুযোগ থাকলে এক্ষুনি দিয়ে দিতাম, বলতাম তথাস্তু।

    ReplyDelete
    Replies
    1. বেঁচে থাক, বাবা।

      Delete
  2. aha eto amar proti shonibarer ichhey

    ReplyDelete
  3. '..emon keno sotti hoina..AHA !' - Ichhadana.

    ReplyDelete
    Replies
    1. সিরিয়াসলি, ইচ্ছাডানা।

      Delete
  4. "সামনের গোটা জন্মটা যেন শনিবারের সকালের মতো হয়, ঠাকুর।" khaaNti kotha !

    ReplyDelete
  5. টুকাইদা আর আমের পল্লব .. পুরো অন্য অনেকের ডায়রি টুকে লিখেছ তো .. হাহা .. ভাবতেও ভাল লাগে সবার সাথেই এই ঘটনাগুলো ঘটে ☺️

    ReplyDelete
    Replies
    1. সে তো ঘটেই রে ঊর্মি। আমরা সবাই যে কী ভীষণ সবার মতো...

      Delete
  6. "আমার সঙ্গেই কেন এরকম হয়" - বুধবার নাগাদ এরকম বোধয় অনেকের ই মনে হয় :)
    শনিবার এলে একটা বেশ হালকা পসিটিভ ভাব.. এটাও বেশ relate করতে পারছি।
    শুধু এইটা মানা গেলো না :
    "দশবছর ধরে হাবিজাবি পার্সোন্যাল কথা লিখে চলেছি। কত সময় নষ্ট করে ফেললাম। "

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, তোমরা পক্ষপাতদুষ্ট, কাকলি।

      Delete
  7. আহা খাসা লেখা কুন্তলা।
    প্রতি শুক্রবার অফিস থেকে ফেরার সময় আমারও এই অনুভূতিটা হয়। :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. না হলেই চিন্তার কথা হত, অরিজিত।

      Delete
  8. Bhalo laglo pore... anek bishoy nijer sathe relate korte parchhi... aar oi 15 minute er meeting der ghantai niye jaoa....manusher dekhi meeting e elei nana eisei kotha bere jai...ek kotha ke 5 bar paanch rokom kore bolbe....

    Apnar ei lekhagulor jonyo apeksha kore thaki...mone hoi anek somoy nijer likhte na para kothagulo bhari sundar guchhiye Abantor amar jonyo pesh korechhe...bhalo thakun.

    ReplyDelete
    Replies
    1. লোকে কথা বলতে ভয়ানক ভালোবাসে, সুস্মিতা। বিশেষ করে যে কথাগুলো বললে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করা যায়, সেই সব কথা। ব্যাপারটা বেশ করুণ।

      Delete

Post a Comment