আমার বাঁচা তোমার বাঁচা
বাড়ি গিয়ে অনেক লোকের সঙ্গে দেখা হল। মানে লোকের সঙ্গে তো সবসময়েই দেখা হয়, কিন্তু এবার যেহেতু একটু বেশিদিন থাকা হল আর উপলক্ষটাও লৌকিকতার উপযুক্ত ছিল তাই যাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা নয় তাদের সঙ্গেও হল।
এদের মধ্যে আমার সমবয়সীরাও আছে। যাদের সঙ্গে আমার জীবনটা এক সঙ্গে শুরু হয়েছিল। প্রাসঙ্গিক কথাবার্তা হল। তারপর সেই প্রশ্নটা আবার উঠল।
যোগাযোগ রাখিস না কেন?
যুগটাই পড়েছে যোগাযোগের। অবশ্য সে দিক থেকে সব যুগই যোগাযোগের। প্রথম যখন পায়রার বদলে টরে টক্কায় খবরাখবর চালাচালি হতে শুরু করল তখন নিশ্চয় সবার মনে হয়েছিল, উফ, যোগাযোগে বিপ্লব এসে গেছে। তখনও নিশ্চয় নিয়মিত ব্যবধানে খবর না পেলে লোকে নালিশ করত। এখন তো কত সুবিধে। পায়রা পোষার দরকার নেই, মাঝপথে পায়রা অ্যালজাইমার হয়ে অন্য রুটে চলে যাওয়ার আতংক নেই, বজ্রপাতে পায়রার অকালমৃত্যুর ভয় নেই, জাস্ট টকা টক টক টকা টক। এতেও যোগাযোগ রেখে ওঠা যাচ্ছে না?
কিন্তু আমি পায়রার যুগের লোক নই, টরে টক্কায় ইমপ্রেসড হই না। আবার একশো বছর পরেরও লোক নই যখন ফোনের ভেতর দিয়ে হাত বাড়িয়ে একে অপরকে ছুঁয়ে দিতে পারবে আর দু’হাজার উনিশের যোগাযোগের বারফট্টাই মনে করে খ্যা খ্যা হাসবে।
আমি হাসছি না কারণ আমি এই যুগের লোক। আমি মনে করি দু’হাজার উনিশই সব কথার শেষ কথা। শিল্প, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি।
আর দু’হাজার উনিশে বসবাস করেও যোগাযোগ না রাখা, গ্রুপে না থাকার অজুহাতটা কী জানতে চাইলে আমি মাথা চুলকোই। আমার দুরবস্থা দেখে তারা হেল্পফুল হয়।
দেখ, আমরা সকলেই ব্যস্ত। সময় আমাদের কারোরই নেই। তবু তো আমরা দিনের শেষে গ্রুপে ঢুকে একটুখানি…
দেখ, আমরা সকলেই ব্যস্ত। সময় আমাদের কারোরই নেই। তবু তো আমরা দিনের শেষে গ্রুপে ঢুকে একটুখানি…
আমি জানি ওদের সময় না থাকার দাবিটা সত্যি। সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে উঠে রাত এগারোটায় বিছানায় গা রাখা পর্যন্ত ওদের সময় নেই। থাকা অসম্ভব। আমার মায়েরও থাকত না। মা অফিস করতেন, সন্তানপালন করতেন। সংসারও ছিল, কিন্তু আমি জানি ওটা কান টানলে মাথা আসার মতো। মায়ের সময়ের মূল রাহু ছিলাম আমি, এই শর্মা।
কিন্তু যদি দাবি করি যে আমি সময়ের অভাবে যোগাযোগ রাখছি না; আমার এমন দায়িত্বপূর্ণ চাকরি যা আমাকে ষোলো ঘণ্টা খাটিয়ে নেয় তাহলে জিভটিভ খসে পড়তে পারে। আমার এই খুদকুঁড়ো চাকরির সবথেকে বড় সুবিধে এটাই যে চাইলেও কেউ আমাকে বেশি খাটিয়ে নিতে পারবে না। নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে থাকবেই।
প্রবল প্রতিবাদ করলাম। না না, সময় আমার অঢেল।
অত জোরে মাথা না নাড়লেও চলত। কেউই ভাবেনি আমার সময় কম পড়ছে। ওটা ভদ্রতা করে বলার জন্য বলা।
সেই তো। আমাদের না হয় সংসারের হাজার ঝামেলা, অফিসের পর হোমওয়ার্ক, সায়েন্স প্রোজেক্ট, তাইকোন্ডুর ক্লাস। তোর তো ঝাড়া হাত পা। অফিসের পর কী করিস?
মহা বিপদে পড়লাম। কিছু না কিছু তো করিই। না হলে আর চব্বিশঘণ্টা ফুরোয় কী করে? স্নান করি, খাই, চুল আঁচড়াই এগুলো বলার মানে হয় না, কারণ এগুলো সবাই করে। আমার কাছে যেটা জানতে চাওয়া হচ্ছে তা হল আমার সঙ্গে একই মাটি, জল, হাওয়া মেখে বড় হওয়া সকলে যা করছে, অ্যাডাল্টিং-এর যা যা দায়িত্ব পালন করছে, সেগুলোর বদলে আমি কোন রাজকার্যটা করছি?
আমার রাজকার্য বলতে, সংগীত বাংলা দেখা আর গল্পের বই পড়া আর অনলাইন ডাইরি লেখা। নিজেরই লজ্জা হল। এ জিনিস নিজমুখে স্বীকার করা যায় না। কিন্তু একেবারে মিথ্যে কথাই বা বলি কী করে? তাই এইগুলো ছাড়া আর যে কাজটা আমি ভালোবেসে করি, সেটাই বললাম।
ক্যান্ডি ক্রাশ খেলি।
মুখ হাঁ হয়। বন্ধ হয়। আবার খোলে।
ক্যান্ডি ক্রাশ খেলবি তবু যোগাযোগ রাখবি না? এ কী ধরণের ঠ্যাঁটামো?
সে তুই তোর ইচ্ছেমতো জীবন চালাবি, আমাদের কার কী বলার আছে। অবশেষে এই প্যাসিভ অ্যাগ্রেসিভ মেনে নেওয়ায় এসে আলোচনা পথ হারায়।
সে তুই তোর ইচ্ছেমতো জীবন চালাবি, আমাদের কার কী বলার আছে। অবশেষে এই প্যাসিভ অ্যাগ্রেসিভ মেনে নেওয়ায় এসে আলোচনা পথ হারায়।
মিথ্যে বলব না, অস্বস্তি হয়েছিল। বিরক্তিও। পরীক্ষায় একের পর এক আনস্যাটিসফ্যাকটরি উত্তর দিয়ে যেতে কারই বা ভালো লাগে।
তারপর মনে পড়ল, আমার বিরক্তি দেখানোর কোনও অধিকার নেই। আমার জীবনের কার্বন কপি জীবন না দেখলে আমারও সে সব জীবনের সার্থকতা সম্পর্কে ঘোর সন্দেহের উদ্রেক ঘটে। আমিও প্রত্যাশা করি যে কিছু কিছু মাইলস্টোন (বিশেষ করে আমি যেগুলো পেরিয়েছি), সেগুলো লোকে পার করবে। ক্যান্ডি ক্রাশ না খেলে যোগাযোগ রেখে বেড়ালে হয়তো সে সন্দেহগুলো আমিও মুখে প্রকাশ করে ফেলতাম। (যোগাযোগ না রেখে ক্যান্ডি ক্রাশ খেলা চালিয়ে যাওয়ার এই আরেকটা মোক্ষম এবং জরুরি যুক্তি।) আমার থেকে বেশি সময় যাদের হাতে তারা সকলেই মানবজন্ম ফেলেছড়িয়ে একাকার করছে। আবার আমার থেকে বেশি কাজ করছে যারা, তারা জীবনের আনন্দ পুরোটাই হারাচ্ছে, পৃথিবীর রূপরসগন্ধবর্ণ কিছুই আস্বাদন করতে পারছে না। যে বাঁচায় ইচ্ছে হলে দু'দান ক্যান্ডি ক্রাশ খেলে নেওয়া যায় না, সে রকম বেঁচে লাভ কী?
আয়নার সামনে দাঁড়াতে মন ফুরফুরে হয়ে গেল। আরাম করে ক্যান্ডি ক্রাশ খুলে বসলাম।
"jogajog rakhish na keno" jatiyo proshno gulo amaakeo shunte hoy prochur. Honest uttor('ichhey korey na tai') ta bhagyish ditey parina.... Noiley whatasapp group theke shoja nirbashito hotaam, aar chomotkar shob forward aar chomokprodo shob khobor gulo pawa hoto na
ReplyDeleteকার যে যোগাযোগ রাখতে এত ভালো লাগে সেটাই আমার মাথায় ঢোকে না।
DeleteBeautiful post. My father is Bengali and mom is Assamese and I can read Bengali :) keep writing
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ।
Delete"Aami tow rakhte chai, kintu ki likhbo group e seta bhebe bhebe aar kichu lekha hoyna...kintu aami SHOOOOB pori, tai toder sabar khobor tow petei thaki" ;)
ReplyDeleteহাহা, এটা ভালো কর শম্পা। তোমার সঅ অঅব -এর ওপর এমফ্যাসিস পড়ে হাসছি।
Delete