চৌকোড়ী ১/২



জায়গাটা দূর জানতাম। দিল্লি থেকে কাঠগোদাম, কাঠগোদাম থেকে দু'শো কিলোমিটার। কিন্তু দূরের মাপ গুগলে আর রাস্তায় নামলে আলাদা হয়ে যায়। 

শুরু থেকেই ভুল। ভেবেছি শতাব্দীর চেয়ার কারে বসে ভোরবেলা দৃশ্য দেখতে দেখতে ভেজ কাটলেট খেতে খেতে চলে যাব, ভুল হয়েছে। শতাব্দী কাঠগোদাম ঢোকে এগারোটা পঞ্চাশ। অর্ধেক দিন ওইখানেই হাওয়া। আপনারা যদি যান, রানিক্ষেত এক্সপ্রেস নেবেন। ওভারনাইট জার্নি। ভোরভোর কাঠগোদাম থেকে যাত্রা শুরু করে দুপুর দুপুর চৌকোড়ী পৌঁছনো।

পরের ভুল, ভেবেছি কাঠগোদাম কিংবা হলদোয়ানি থেকে সরকারি, বেসরকারি, মোদ্দা কথা লোকাল বাস পাওয়া যাবে। যায়নি। বাস যদি বা থেকে থাকে সেগুলো ছেড়ে যায় সকালের দিকে, বেলা বারোটা পর্যন্ত আমাদের মতো ভুলে ভরা প্যাসেঞ্জারের মুখ চেয়ে বসে থাকে না। মিনমিন করে জিজ্ঞাসা করলাম শেয়ার ট্যাক্সি পাওয়া যায় কি না, হাসি দেখেই বুঝলাম প্রশ্নটা কী মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। 

জায়গাটার নামটা পর্যন্ত ঠিকঠাক বলতে পারিনি। ইংরিজি বানান দেখে বলছি চৌকোরি, চৌকোরি, আর সবাই, ক্যা? ক্যা? করে যাচ্ছে। তারপর বলছে, ওওওও চকোওড়ি? পাঁচ হাজার দে দেনা। ওনলি ড্রপ।

(বাই দ্য ওয়ে, চৌকোরি একটু ভুল, পুরো ভুল নয়। তার থেকে চকৌড়ি অনেক বেশি ভুল। প্রমাণ? সবুজ দিকনির্দেশক বোর্ডে, কেতরে যাওয়া মাইলফলকে, দোকানের নামে, ভাঙা রাস্তার ধারে সরকারি প্রোজেক্টের বোর্ডে, সর্বত্র লেখা আছে চৌ - কো - ড়ী। সেভেন এইটে শেখা দেবনাগরীর এক দুই তিন চার আমার ফিকে হয়ে এসেছে কিন্তু অ আ ক খ এখনও দিব্য ঝকঝকে, কাজেই ভুল দেখিনি।

স্টেশনচত্বরের লাগোয়া আই আর সি টি সি-র ভোজনালয়ে গিয়ে ঢুকলাম। পুরিসবজি খেতে খেতে ভুলগুলো একেএকে ঠিক করা দরকার। ফোন করলাম চৌকোড়ীর কে এম ভি এন-এ। পাবলিক সারভেন্ট, পাবলিক ট্রান্সপোর্টের খবর দিতে পারবেন নিশ্চয়। ভয়ানক ভদ্র ব্যবহার। জিজ্ঞাসা করলাম, বাস আছে? বললেন, আলবাত আছে। আলমোড়া তক আ যানা, ফির ওহাঁ সে কুছ দেখ লে না। খুশি হয়ে ফোন কাটতে যাব ভাইসাব কী মনে করে জিজ্ঞাসা করলেন, আপ হো কাহাঁ? বললাম, কাঠগোদাম স্টেশন কে পাস।

ভাইসাবের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার উপক্রম। আপনারা তো আজ পৌঁছতে পারবেন না, ম্যাডাম। বহোৎ দূর হ্যায়, গাড়িওয়াড়ি কুছ দেখ লিজিয়ে। 

এই চেতাবনিটা চেনা। গন্তব্য চৌকোড়ী শুনে এক ট্যাক্সিওয়ালা চোখ কপালে তুলেছিলেন। অত দূরে তো পৌঁছতেই পারবেন না আজ, তার থেকে বরং নৈনিতাল ঘুরে বাড়ি যান। সে সব সুপরামর্শ অগ্রাহ্য করে যখন গটগটিয়ে হাঁটছিলাম, একটা না একটা সস্তা সমাধানের আশা যখন বুকে জাজ্জ্বল্যমান ছিল, এক ভদ্রলোক পথ আটকে বলেছিলেন, থ্রি থাউজ্যান্ড এইট হান্ড্রেড। স্বীকার করি না করি ততক্ষণে আমাদের সাহসে একটু টান পড়েছিল। একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে, থ্রি থাউজ্যান্ড ফাইভ হান্ড্রেড? প্রস্তাবের জবাবে উনি মাথা নেড়েছিলেন। সম্ভব নয়। হলে নিশ্চয় যেতেন।

আমরাও একই কথা বলে পুরি খেতে ঢুকে পড়েছি। এত দাম দিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যাওয়াটাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

ভয়ানক মিষ্টি চায়ে চুমুক দিতে দিতেই চোখের কোণে গাঢ় গোলাপি শার্ট।

সেই ভদ্রলোক। দরজা ঠেলে ঢুকে এলেন। বললেন, আমার নাম অ্যান্থনি। যদি আটত্রিশশোতে যেতে চান, আমি আর আমার গাড়ি এই এখানেই আছি। 

পুরি খেয়ে চড়ে পড়লাম গাড়িতে। অ্যান্থনিজি একবার টুক করে নিজের বাড়ি থেকে কম্বল আর সোয়েটার নিয়ে নিলেন। ওপরে নাকি ঠাণ্ডা হবে। একতলা পরিচ্ছন্ন ছিমছাম বাড়ি, পাশের একতলা পাকা কাঠামোর ওপর বোর্ডে 'দেবভূমি ট্র্যাভেলস অ্যান্ড নমকিন'। বাড়িটা অ্যান্থনিজির, ট্যুরস অ্যান্ড ট্র্যাভেলসের ব্যবসাটাও, নমকিনের দোকানটাও। 

কাঠগোদাম থেকে একটু এগোলেই কেইঞ্চি বাবার আশ্রম, সেখানে নাকি মার্ক জুকারবার্গ এসেছিলেন একবার। এমন লো পয়েন্টে ঠেকেছিল জীবন যে নিজেকে শেষ করে দেবেন ভেবেছিলেন। শেষে বাবার দর্শন করে মন শান্ত হয়। গলা বাড়িয়ে আশ্রমখানা দেখে নিলাম। বলা যায় না। 

দু’তিনটে ছোটবড় নদী পড়ে রাস্তায়। আমার খালি মনে আছে সরযু আর গড়গঙ্গা। পথের পাশে এই বড় বড় চ্যাপ্টা পাতার টিক গাছের ঠাসাঠাসি জঙ্গল তো এই সোজাসাপটা পাইনের সোজাসাপটা পাইনের বন। মনস্টেরা ডেলিশিওজা-র প্রকাণ্ড স্পেসিমেন। গাছের গা বেয়ে বেয়ে ফিলোডেনড্রনের ঝাড়। 

রাস্তায় থামতে অ্যান্থনিজি উৎসাহী নন। এইই কখন পৌছই ঠিক নেই। আমাদের থামার দরকারও নেই। ভাজা ময়দার সুবিধে এটাই, পাকস্থলীতে টেঁকে অনেকক্ষণ। খাই-খাই ভাব জাগলে সঙ্গে নাটক্র্যাকার আর হাইড অ্যান্ড সিক আছেই।

ঝটকা ভেঙে উঠে বসি। কী অদ্ভুত সুন্দর একটা জায়গা দিয়ে যাচ্ছি। পায়ের কাছ দিয়ে বইছে একটা ছোট নদী, নদীর একেবারে গায়ের কাছ দিয়ে উঠেছে একটা পাহাড়। ডাইনে, বাঁয়ে, সামনে, পেছনে শেষবর্ষার সবুজ ঝেঁপে এসেছে।

মনে পড়ে, একটা ফোন করার কথা। এত সৌন্দর্য কারও সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার কথা। এসো কখনও তোমরা।

অন্যদিকে মন ঘোরাই। কী জায়গা এটা?

শেরাঘাট আসব আসব করছে। আমরা যখন নিদ্রা যাচ্ছিলাম, অ্যান্থনিজি টেনে চালিয়েছেন। আর বেশি বাকি নেই। সাড়ে ছ’টার মধ্যে চৌকোড়ী ঢুকে যেতে পারব।



















Comments

  1. Baah bhalo laglo lekhata pore. Chowkori shunechhi khub sundar jaiga. Second part er apekshai roilam..

    ReplyDelete
    Replies
    1. জায়গাটা সত্যিই সুন্দর, সুস্মিতা।

      Delete
  2. Chowkari ar Munsiyari er jonyo pick-drop na nie per day basis e gari nie sathe rakhle cost effective hoto....

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, উনি সঙ্গেই থেকে গিয়েছিলেন আমাদের। তবে আমরা মুন্সিয়ারি যাইনি।

      Delete
  3. Tumi ei beranor golpogulo 1st part ei eto jomiye dao.. ami kainchi temple gechi.. Ekta chotto nodir dhare.. setai ki ashram? Sada ar komla Rong er chilo.. Amra choukori jaini.. koushani gechi.. opurbo rasta.. brishti porchilo.. durdanto legechilo.. choukori er onek photo dekhechi..khub sundor ...

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ হ্যাঁ ওই সাদা কমলাটাই, ঊর্মি। দেখ কেমন একই রাস্তা দিয়ে তুই আর আমি ঘুরে এসেছি। রাস্তাটা সত্যি সুন্দর।

      Delete
  4. আরেকটা উপায় আছে রানিক্ষেত না পেলে| আনন্দ বিহার থেকে রাত এগারোটা নাগাদ উত্তরাখন্ড ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির ভলভো বাস| আমি রামনগর অব্দি গেছিলাম, নিশ্চই কাঠগোদামের দিকেও থাকবে| অতি আরামের আর চমত্কার টাইমে চলে| খাবার নিয়ে উঠতে হবে যদিও|

    আর কাঠগোদাম স্টেশন টা খাসা দেখতে, তাই না?

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ ভারি সুন্দর স্টেশন কাঠগোদাম।

      Delete
  5. চৌকড়ি কোথায় সেটা ভাবছিলাম আপনার লেখার টাইটেলটা পড়ে থেকে।  হঠাৎ কেইঞ্চি বাবার আশ্রম শুনে মনটা হুশ করে ২১ বছর পিছিয়ে গিয়ে একটা স্মৃতি ফিরে এল। আমরা নৈনিতাল থেকে দুদিনের একটা বাস ট্যুর বুক করেছিলাম, যেটা আলমোড়া হয়ে কৌশানীতে রাত কাটাবে, আর পরদিন রানীক্ষেত ঘুরে ফিরবে। এই ট্যুরের প্রথম স্টপ ছিল কেইঞ্চি বাবার মন্দির। লেখার শুরুটা বেশ সাস্পেন্সফুল হল, বাকিটা পড়ে দেখি কি হয়।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওহ, আপনিও কেইঞ্চি বাবার আশ্রম দেখেছেন, সুগত। মার্ক জুকারবার্গের সঙ্গে আমাদের এই খানটা মিলেছে।

      Delete

Post a Comment