এ বছরটা কি অন্যান্য বছরের তুলনায় তাড়াতাড়ি গেল?
হাওয়াই চটি সুটকেসে পুরতে পুরতে প্রশ্নটা করেছিল অর্চিষ্মান।
একই প্রশ্ন চালাচালি হচ্ছে অফিসের প্যান্ট্রিতেও। আসলে সিজনটাই এই প্রশ্নটার। প্রত্যেক বছরই একটা বড় ঘটনার মুখে, যেমন পুজো, আগের বছরের পুজোটার স্মৃতি যখন জ্বলজ্বলে, মনে এই প্রশ্নটা জাগে। কিংবা আশপাশটা যখন বদলাতে শুরু করে। অবশেষে এসি নিভিয়ে দেওয়া যায়। হঠাৎ একদিন ভোরবেলা দরজা খুলতে বেরিয়ে গা শিরশিরোয়।
আর অমনি মনে হয়, অলরেডি?
বললাম, অন্যান্য বছরের মতোই নিশ্চয় গেছে। তাড়াতাড়ি আর কী করে যাবে, এ বছরেও তো মাসে তিরিশ কিংবা একত্রিশ দিন ছিল, সপ্তাহে সাত, দিনে চব্বিশ ঘণ্টা, ঘণ্টায় তিরিশ মিনিট…
অর্চিষ্মান অস্থির মাথা নাড়ল। সে তো গেছেই। ঘড়ি তো আর তাড়াতাড়ি ঘোরেনি। আমি বলছি মনে হওয়ার কথা। তোমার কি মনে হচ্ছে না এ বছরটা আগের বছরগুলোর থেকে তাড়াতাড়ি গেছে?
যদি মনে হয়েও থাকে, তারও সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যা আছে। আমরা যত বুড়ো হই আমাদের কাছে সময়ের স্পিড তত বাড়ে। ক্লাস ওয়ানে রুলটানা পাতা জুড়ে কবিদের গুরু রবীন্দ্রনাথ হাতের লেখা প্র্যাকটিস করতে ঘড়িতে মোটে সাড়ে সাত মিনিট কাটলেও মনে হত নরকের কটাহে অনন্তকাল ভাজাভাজা হচ্ছি, এখন চোখের পাতা ফেলতে না ফেলতে সাড়ে সাত বছর হাওয়া হয়ে যায়।
অর্চিষ্মানের মনঃপূত হল না কথাটা।
না না সে জন্য নয়। লাঞ্চ খেতে বসে কে যেন জিজ্ঞাসা করেছে সবাইকে যে এ বছরটা অন্যান্য বছরের থেকে তাড়াতাড়ি গেছে কি না, সকলেই মাথা নেড়ে বলেছে ঠিক ঠিক। সব বছরই তাড়াতাড়ি যায়, কিন্তু দু’হাজার উনিশ একেবারে উসেইন বোল্ট। তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম তোমাকে, তোমারও মনে হয়েছে কি না।
ওকে নিরুৎসাহ করতে মন চাইল না বলে মুখে কিছু বললাম না, কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে, মনে হয়নি।
কয়েক বছর আগে পর্যন্তও মনে হত। দুহাজার চোদ্দ কি তেরোর থেকে দ্রুত গেল? পনেরো কি চোদ্দর থেকেও তাড়াতাড়ি? ষোলটা তো দেখতেই পেলাম না।
এখন আর মনে হয় না। অবাক হওয়ারও তো একটা সীমা থাকে মানুষের।
অর্চিষ্মান এখনও সে সীমা পেরোয়নি। ও এখনও অবাক হচ্ছে। আরও সময় আছে ওর অবাক হওয়ার। হোক। অবাক হওয়া ভালো জিনিস। অবাক হওয়া ফুরিয়ে যাওয়া মানে সত্যি সত্যি বুড়ো হয়ে যাওয়া। বয়সে বুড়ো নয়, মনে বুড়ো। কোনও অ্যান্টি এজিং ক্রিমের সাধ্য নেই সে বার্ধক্যের ভাঁজ মসৃণ করে।।
আমি ভেবেছিলাম আমার সেই স্টেজ এসে গেছে। বাজারের আগুনদামে আর অবাক হই না। দুয়ে দুয়ে চার না হতে দেখে অবাক হই না। পরিশ্রমের সঙ্গে ফসলের অসামঞ্জস্য দেখেও নির্লিপ্ত থাকি।
হাল যখন ছেড়েই দিয়েছি, প্যান্ট্রিতে নেসক্যাফের পাইকারি কফি ফেটাতে ফেটাতে আর্টিসান কফির কাছাকাছি নিয়ে ফেলতে ফেলতে একজন আরেকজনকে বলল, ইট ওয়াজ এনশে-এ-এ-এন্ট। টু থাউজ্যান্ড ফোর অফ সামথিং।
চায়ের কাপ আর জলের গ্লাস ব্যালেন্স করে বেরিয়ে আসতে আসতে ভাবি, টু থাউজ্যান্ড ফোর এনশেন্ট হওয়ার কী আছে। এই তো সেদিনের কথা। ইবোলা দাউদাউ করে ছড়িয়ে পড়েছে,মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, প্রথমটা কেটে আমার দ্বিতীয় প্রেমটা সবে শুরু হয়েছে।
সব ঝকঝক করছে। এনশেন্ট হলে করত?
মাথার ভেতর একটা সিম্পল বিয়োগ করি। দু হাজার উনিশ মাইনাস দু'হাজার চার…
নির্ঘাত ভুল করেছি।
পাটিগণিতে নিজের পটুত্ব নিয়ে আমার গর্ব ছিল এককালে, বাকি সব রেসে লাস্টে গেলেও অংক রেসে আমি রেগুলার ফার্স্টে যেতাম। সেই আমার এমন অবস্থা যে একটা সিম্পল বিয়োগ করতে পারছি না? অবাক হই না, দুঃখিত হই। কেয়ারলেস মিস্টেক আমার চিরকেলে রোগ। মা বলে, বকে, বুঝিয়েও সারাতে পারেননি।
রিভাইস করতে বসি।
সেম উত্তর। উনিশ মাইনাস চার, পনেরো। পনেরো বছর আগের কথা হচ্ছে।
ওই সময়টা পনেরো বছর দূরে?
আরও পেছনে যাই। অন্য শতাব্দী। নেসক্যাফে গুলতে গুলতে যে অবাক হচ্ছিল, সে শুনলে অজ্ঞান হয়ে যাবে। ওই সময়ের সমস্ত দৃশ্যপট, চেনা মুখেদের, হাসি, গলার আওয়াজ, গানের সুর, হাওয়ার গন্ধ সব একেবারে ঝকঝকে। স্কুলের মাঠে, সবুজ ঘাসে হলুদ রাধাচূড়া, আজকালকার হাই রেজলিউশন ফোনদের বলে বলে হার মানাবে। আমার আনন্দ, সুখ, ভয়, শোক সব তাজা। একটুও ঝাপসা হয়নি।
অথচ সবই এনশেন্ট।
অনেক দিন পর আমি আবার এতখানি অবাক হই।
পুজোটা তবে কি কলকাতাতেই ?
ReplyDeleteনা, বাড়ি যাওয়া হচ্ছে না এবার।
Deleteei lekhata pore apnar i besh purono ekta mochotkar lekhar katha mone elo -- samay boyosher shathe shathe druto chale -- lekhata ami bohu lokke porieochi, ekhon kichutei khuje pachhi na...
ReplyDeleteওই লেখাটার কথা আমারও মনে পড়ছিল, দ্যোতনা, আমি অবশ্য খোঁজার চেষ্টা করিনি। এই খড়ের গাদায় কে নামবে হ্যারিকেন হাতে।
Deleteনিজেকে ভয়ঙ্কর বুড়ো মনে হয়েছিল যখন ২০১৩ সালে জুরাসিক পার্ক-এর ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে রি-রিলিজ করল আর আমি নিউ ইয়র্কে সেটা দেখতে গেলাম। জুরাসিক পার্ক? সে তো এই সেদিনের কথা! স্পষ্ট মনে আছে। তার ২০ বছর হতে যাবে কোন দুঃখে?
ReplyDeleteএটা আরেকটা স্মৃতির ফ্লাডগেট খুলে দিল। আমি যে হলে জুরাসিক পার্ক দেখেছিলাম সে হলটাই আর নেই, যদিও কোন জামা পরে দেখেছিলাম সেটা স্পষ্ট মনে আছে।
DeleteBesh onyorokom lekhata laglo.
ReplyDeleteBoyosh je barche, seta khub bhalobhabe bujhechhilam bochhor dui age, jokhon khurtuto vai madhyomik dilo, aar amake jigyes korechilo ami kon saal e diyechhi. khub casually bolechilam, 97. sei shune vai khanikkhon gol gol chokh kore takiye theke bolechilo, "Beeeeeeeeeeesh bochhor age????!!!!!"
Jurassic Park er comment tao dola diye gyalo. Jamuna hall e dekhte gechhilam, oi hall tao to mone hoy nei aar Kolkatay.
যমুনা নাম যখন ধরেই নেওয়া যায় ও হল আর নেই, অরিজিত। মাধ্যমিকটা এখন অন্য জন্মের কথা মনে হয়।
Delete