আগামী দু'সপ্তাহে


জ্ঞানপাপী শব্দের মানে কেউ জিজ্ঞাসা করলে তাঁকে আমার উদাহরণ দিতে পারেন, এই আমি ঢালাও অনুমতি দিয়ে রাখলাম।

জ্ঞানপাপী হওয়া ছাড়া আমার সেদিনের সেই সিদ্ধান্তের আর কোনও ব্যাখ্যা নেই। কাজ না পেয়ে ইউটিউবে পজিটিভিটি-টক শোনার সিদ্ধান্তের। বহুদিন বাদে এই ফাঁদে পা দিলাম, কেন কে জানে। ভিডিও তো দূর, পজিটিভিটি নিয়ে অডিও, লেখা, মিক্সড মিডিয়া - যে কোনও রকম প্রোডাকশন আমি এড়িয়ে চলি। কবে থেকে নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না, সম্ভবতঃ তবে থেকে যবে থেকে লক্ষ করেছি যে পজিটিভটির ঝাণ্ডা ওড়ানো লোকেরা অধিকাংশই আগাপাশতলা নেগেটিভ।

একজনকে জানি (চিনি না, চেনার ইচ্ছেও নেই) তিনি তাঁর সমস্ত বি-পজিটিভ বক্তৃতাই শুরু করেন এই দিয়ে যে, "কিছু কিছু লোক আছে যারা সর্বক্ষণ নেগেটিভিটিতে চুপচুপে হয়ে আছে, আমি তাদের মতো নই, আমি পজিটিভিটিতে বিশ্বাসী।" কর্মযোগ বিষয়ে তাঁর একটা বক্তৃতা শুনেছিলাম যার মূল প্রতিপাদ্য ছিল যে উনি আইটি অফিসে কাজ করা এবং করানোর ফাঁকে ফাঁকে ক্যান্টিনে, করিডরে, লিফটের জন্য দাঁড়িয়ে, পজিটিভিটির তাৎক্ষণিক সেমিনার দেন। তাতে গোটা অফিসের প্রোডাক্টিভিটি হইহই করে বাড়ে।

কিন্তু, বক্তা যোগ করেন, আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে ওঁর সেই সব সেমিনারে অনেকেই নাম লেখাতে উৎসাহ দেখায় না। পজিটিভিটির পালিশ প্রায় চটিয়ে, দাঁত নখ প্রায় বার করে, বক্তা বলেন, "সিটে বসে ক্যান্ডি ক্রাশ খেলবে, তবু দুটো ভালো কথা শুনবে না। কারা এরা? যারাই হোক, আমি এদের মতো নই। আপনারাও হবেন না খবরদার।"

এতসব জানা সত্ত্বেও ফাঁদে পা দিলাম। একজন মুখচেনা মান্যিগণ্যি টক দিচ্ছিলেন বলেই বোধহয়। আধশোয়া হয়ে দু'চোখ ক্যান্ডি ক্রাশে, আধখানা কান ভিডিওতে রেখে শুনছিলাম। তার বেশি মনোযোগ দরকারও ছিল না, বক্তৃতার গতিপথ সম্পর্কে একটা আন্দাজ ছিল। গোয়েন্দা প্লটের মতো এই বক্তৃতাগুলোরও বিট থাকে; ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড অ্যাক্ট, পিঞ্চ পয়েন্ট, ক্লাইম্যাক্স, ডেনুমঁ। পজিটিভ হিরো যাচ্ছিলেন যাচ্ছিলেন জীবনের রাস্তা বেয়ে, এমন সময় হঠাৎ গাড্ডা - প্রেমিকা বড়লোক প্রেমিকের জন্য দাগা দিল, বস্ অপমান করল, ফেসবুকে কেজি ক্লাসের বন্ধু আনফ্রেন্ড করল। আমাদের হিরো তখন অন্য এক বন্ধুর বাড়ির সোফায় শুয়ে; যে দিকে তাকান চাপচাপ অন্ধকার। হঠাৎ কী হল মাথার ভেতর পজিটিভিটির সুইচ খট করে অন হয়ে গেল, অমনি হিরো লাফ দিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে রোগা হয়ে গেলেন, বাঞ্জি জাম্পিং করে ফেললেন, স্বপ্নের কেরিয়ারে পাল তুলে ভেসে গেলেন।

(সে কেরিয়ারের খুঁটিনাটি নিচে দেওয়া আছে। পাঁচ দিনের  পজিটিভিটির কোর্সের ভাড়া ফাইভ থাউজ্যান্ড, দৈনিক পাঁচ মিনিটের ওয়ান অন ওয়ান জুম সেশন, পাঁচটা পি পি টি সেট। নেক্সট আধঘণ্টার মধ্যে সাইন আপ করলে পাঁচের জায়গায় সাতটা পি পি টি ফ্রিইইই ফ্রিইইই ফ্রিইইই।)

ভাবছি কারা সাইন আপ করবে, এমন সময় বক্তা বোমা ফাটালেন। বললেন, কোথায় যেন কোন বিজ্ঞানীর দল রিসার্চ করে বার করেছে যে মানুষের হক্কের আয়ু হচ্ছে চল্লিশ। ফর্টি। বাকি যারা যা বাঁচছে, সঅঅঅব নিয়তির দাক্ষিণ্য। বোনাস। চেনকাটা ব্যাগ ফেলে দিতে গিয়ে কী মনে হয়ে হাত ঢুকিয়ে দশ টাকার নোট।

একটা নির্দিষ্ট সময়ের বেশি সময় ধরে পজিটিভিটিতে ভুগলে পজিটিভ নেগেটিভ ধারণাটা গুলিয়ে যায় এটা আগেও দেখেছি। জানি না এই তথ্য দিয়ে বক্তা কোন পজিটিভিটির উদাহরণ দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু রাত পোহালে চল্লিশের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা লোকের কানে কথাটা কেমন ঠেকতে পারে ভেবে দেখেননি। অবশ্য অত কথা বললে ভেবে বলার যে সময় থাকে না সেটাও বিজ্ঞানীরা অনেকদিন আগে বার করে ফেলেছেন, কাজেই।

শিউরে উঠে ভিডিও বন্ধ করলাম। ততক্ষণে যা ঘটার ঘটে গেছে, ওই চল্লিশেই শেষের ব্যাপারটা কানের ভেতর দিয়ে শাঁ করে ব্রেনের ভেতর ঢুকে গ্যাঁট হয়ে বসে পা দোলাচ্ছে আর ভুরু নাচাচ্ছে।

ক্যান্ডি ক্রাশ মাথায় উঠল। আধশোয়া হওয়ার শক্তিটুকুও রইল না। চিৎপাত হয়ে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে আমি আমার জীবন নিয়ে ভাবতে লাগলাম।

এমন নয় আগে ভাবছিলাম না। ভাবনায় ফেলার জন্য দু'হাজার কুড়ির থেকে উৎকৃষ্ট বছর গত চল্লিশ বছরে (দুধভাত বছরগুলো যদি বাদও দিই, গত তিরিশ বছরে) দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। আমার জীবনে অবশ্য দু'হাজার উনিশেও অদ্ভুত ব্যাপারস্যাপার ঘটেছিল, কিন্তু দু'হাজার কুড়ির মাহাত্ম্য হচ্ছে যে এ বছর আমিতুমির ভেদাভেদ নেই, সকলের জীবনই এ বছরে অদ্ভুত, অভূতপূর্ব। ফোমোতে ভোগার কোনও প্রয়োজন নেই। সকলেই সঙ্গে আছে। সেই ফার্স্ট ইয়ারে ঢুকে ইস্তক শুনে আসছি স্ট্রাকচারাল ট্রান্সফরমেশন স্ট্রাকচারাল ট্রান্সফরমেশন, অবশেষে জীবনে দেখছি।

তারপর ধরা যাক, মৃত্যুর মিছিল। এক থেকে দশের দুধভাত দশকটা না হয় বাদ দিলাম, দশ থেকে কুড়ির দশকে কানাঘুষোয় জেনেছি মৃত্যু নামের একটা অসুখ হয় এবং আমার মতো অমর অজেয়দের কোনও চান্স না থাকলেও হেঁজিপেঁজি লোকেরা নাকি তাতে মারাটারা যায়। তিরিশের হাফ পার করে ঘাড়ের কাছে, ঘরের ভেতর তার ছায়া দেখলাম।

এখন যে রেটে চলছে বাই দ্য টাইম পঞ্চাশে পা দেব, বিজয়ায় প্রণাম করার মতো লোক পেলে হয়। মৃত্যু এখন আর অন্যের সমস্যা নয়, নিজের শরীরমনেও বেশ তাত (নাকি শিরশিরানি?) টের পাচ্ছি।

দু'হাজার কুড়ি শেষ হতে চলল। অদ্ভুত সময়টারও শেষ হতে চলল নাকি কে জানে। নাকি আরও খেলা বাকি আছে? এ বছর বেড়াতে যাওয়া হয়নি, ঠাকুর দেখা হয়নি, গুডরিডসের বইয়ের চ্যালেঞ্জ পূর্ণ করা হয়নি। এত কিছু না হওয়ার বছরে  রেজলিউশন নেওয়াটা কি ঠিক হবে? হকের জীবনটা তো কেটেই গেল, বোনাসটুকু নিয়ে প্ল্যান ছকতে বসে নিয়তির রসবোধে অনর্থক খোঁচা দিয়ে ফেলি যদি?

আরেকভাবে দেখা যায়। পড়ে পাওয়াই যখন, তখন সেটাকে তেমনি করে বাঁচার রেজলিউশন নেওয়া। এখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি। দেখি, নেক্সট সপ্তাহদুয়েকে করে উঠতে পারি কি না।


Comments

  1. বলেন কি? আমিও কি তাহলে যেটা বাঁচছি সেটা বোনাস? আশাপূর্ণা দেবীর এক গল্পে পড়েছিলাম যে একজন শক্ত সবল লোক কে এক জ‍্যোতীষ বলেছিলেন যে আপনি তো অলরেডী মারা গেছেন, তাতে উনি ঘাবড়ে গিয়ে পায়ের পাতা উলটো করে হাঁটার চেষ্টা শুরু করেন মানে ভূতেদের মতো। তাহলে কি আর দেরি না করে প্র‍্যাকটিস শুরু করাই ভালো?

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, নালক, প্রথমতঃ বোনাস লাইফ, যেটা আমি পরশু থেকে বাঁচব, সেটায় আপনাকে সঙ্গী পাওয়ার জন্য হাই ফাইভ। পায়ের পাতা উল্টো করার দরকার নেই, আরও ভালো আইডিয়া আছে। কেমন হবে যদি ফরটি অনওয়ার্ডস আমরা মাইকেল জ্যাকসনের মতো মুনওয়াক করে জীবনের মধ্য দিয়ে হাঁটি? বেশ কলার তুলে, ঘাড় ঝাঁকিয়ে। বোনাস সর্বদাই আসল মাইনের থেকে বেশি আনন্দ দেয়, কাজেই পরশু থেকে আমিও ভাবছি বেশি আনন্দ করব।

      Delete
  2. Aah... bhodro lok bhul ki bolechen? Boyesh bere tarpor buro hoye morbe naki? Shobai to jaane 40 er por boyesh ghuriye debaar kotha

    ReplyDelete
  3. Shottyi kemon jeno jhimocchillam...tomar ei anti positivity post pore changa holam.

    ReplyDelete
  4. "একটা নির্দিষ্ট সময়ের বেশি সময় ধরে পজিটিভিটিতে ভুগলে পজিটিভ নেগেটিভ ধারণাটা গুলিয়ে যায় এটা আগেও দেখেছি।"
    হাহা .. চরম ।
    তোমার লেখা গুলো পড়ে নিজেকে যে স্বাভাবিক মানুষ ভাবতে পারি এটাই একটা বড় পাওয়া ...

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমরা স্বাভাবিক তো বটেই, ঊর্মি। বাকিরা চরম অস্বাভাবিক।

      Delete

Post a Comment