সহযোগিতা প্রতিযোগিতা
বিশেষজ্ঞ জিজ্ঞাসা করলেন, এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে কোনও সম্পর্ক এবং সম্পর্কজনিত জটিলতার দুটো দিক থাকে। কী কী বলুন দেখি?
স্ক্রিনে আর সবাই হাসি হাসি মুখে মিউট হয়ে রইল খালি এক বুরবক আনমিউট হয়ে লাফ দিয়ে উত্তর দিয়ে বসল।
পৃথিবীতে দু'ধরনের মানুষ থাকে। যারা শেখে আর যারা শেখে না। দেখা, শোনা জাতীয় অকার্যকরী শিক্ষণপদ্ধতির কথা হচ্ছে না এখানে, কথা হচ্ছে ঠেকে শেখার। প্রচুর মানুষ ঠেকে শেখে। তারা জীবনে একটাই মাত্র ব্যর্থ প্রেম করে, মোটে একটিবার ফেল, দিনে বসের কাছে মোটে একবারই বকা খায়, বাজারের কোনও দোকানি তাদের একবারের বেশি দু'বার ঠকানোর সাহস বা সুযোগ পায় না। তার আগেই তারা হয় দোকানিকে সিধে করে দেয় নয়তো শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় দোকানি বদল করে।
প্রসেনজিৎ রোজ এসে চেঁচায়, আবার ওই ডাকাতটার কাছ থেকে এনেছ? দু'পা এগোলেই যে চক্ষুলজ্জাওয়ালা একটা লোক বাজার নিয়ে বসে কতবার বলব?
সত্যি, অনেকবারই বলেছে বেচারা। আমিও জানি যে গেলেই ঠকব, তবু গত আট বছর ধরে যার কাছে ঠকছি তাঁর কাছেই যাই। প্রধান কারণ, আট বছর ধরে ঠকতে ঠকতে ভদ্রলোকের সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ত্যাঁদড় খদ্দের (গোড়াতে যাঁদের কথা বললাম - যাঁদের ঠকানো অসম্ভব এবং যাঁরা চশমা খুলে ঝুঁকে পড়ে ওজন মেলান) সরে গেলে আমার সঙ্গে প্রাণ খুলে নিন্দেমন্দ করেন, রাস্তায় যেতে যেতে আমাকে দেখলে ফুলস্পিড বাইকের ব্রেক থেকে হাত সরিয়ে টাটা করেন। আট বছর পর ওঁরই নাকের ডগা দিয়ে ওঁরই পাশের চক্ষুলজ্জাওয়ালা দোকানে যেতে আমার চক্ষুলজ্জায় বাধবে।
জীবনের বাকি ক্ষেত্রেও আমার না-শেখার প্র্যাকটিস জোরদার। বসের কাছে সকালবিকেল গালি খাই, ব্যর্থ প্রেমের তালিকা খুলে না-ই বা বসলাম।
মোদ্দা কথা, আমাকে শিক্ষা দেওয়া শিবের বাবারও অসাধ্য। কিন্তু আমার সতীর্থরা তো তা নন। তাঁরা জানেন যে বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশ প্রশ্নই আসলে রেটোরিক্যাল। না হলে নিজের উদ্দেশ্যে করা। যাতে নিজের প্রশ্নের নিজেই ঠিক উত্তর দিয়ে বিশেষ জ্ঞানের ছটায় সবাইকে চমকে দিতে পারেন।
তবু যদি ঠিক উত্তর দিতাম। তবু যদি প্রথমবার হত।
লাফিয়ে পড়ে ভুল উত্তর দেওয়ার ঘটনা যদ্দূর মনে পড়ে প্রথমবার ঘটেছিল ক্লাস ফাইভের ভূগোল ক্লাসে। ছোড়দিভাই ক্লাসে ঢুকে কথা না বলে চক তুলে হাত ঘুরিয়ে একটা গোল এঁকে ফেললেন ব্ল্যাকবোর্ডে। আমাদের স্কুলের বোর্ডগুলো যদিও ব্ল্যাক ছিল না, ছিল শ্যাওলা সবুজ। তখনও টাকাকড়ি, বাড়িগাড়ি, পুরুষনারী জীবনের লক্ষ্য হয়ে ওঠেনি। তখন জীবনের একটিমাত্র লক্ষ্য ছিল দিদিভাইয়ের মতো নিখুঁত পৃথিবী আঁকতে পারা। দিদিভাই তিনটে দাগ টানলেন গোলের পেট চিরে। আড়াআড়ি, সমান দূরত্বে। একেবারে সোজা না, অল্প অবতল। যেমন পৃথিবীটাও পুরো গোল আঁকেননি; ওই স্পিডে বাঁই বাঁই ঘুরলে যে কোনও গোল জিনিসের যেমন কমলালেবুর মতো ওপর নিচে সামান্য চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়ার কথা, ঠিক তেমনি এঁকেছিলেন।
মাঝের লাইনটায় আঙুল রেখে দিদিভাই জিজ্ঞাসা করলেন, এই লাইনটার নাম বল্ দেখি?
দু'তিনটি গা-জ্বালানি মেয়ে পড়া করে গিয়েছিল; গর্বিত গলায় বলে উঠল, বিষুবরেখা।
বাঃ। দিদিভাই মুক্তোর অক্ষরে 'বিষুবরেখা' লিখলেন লাইনের পাশে।
এটা? ওপরের লাইনটায় পৌঁছল দিদিভাইয়ের চক ধরা আঙুল। যে আঙুল দিয়ে বর্ষা এলে তিনি ঘরের বাইরে আমাদের জুতোর সারি সরিয়ে সরিয়ে দেন, যাতে ছাঁট লেগে জুতো ভিজে না যায় আর সেই ভেজা জুতো পরে আমাদের সর্দি না লাগে।
আবার কলকাকলি, এবার সংখ্যায় কিছু বেশি। সবাই বুঝে নিয়েছে, 'তুই বল' বলে একজনকে দাঁড় করিয়ে বেইজ্জত করার বদমতলবে নেই দিদিভাই। কাজেই ভীতু এবং/অথবা ফাঁকিবাজরাও উৎসাহিত হয়ে গলা মিলিয়েছে। উত্তর ভুল হলেও গোলেমালে চাপা পড়ে যাবে আশায়।
কর্কটক্রান্তি!
চমৎকার।
চক নিচের লাইন পর্যন্ত পৌঁছতে না পৌঁছতে ক্লাসশুদ্ধু মেয়ে গর্জে উঠল, 'মর্কটক্রান্তি!'
আঁচল দিয়ে চোখ শুকিয়ে, হাসি থামিয়ে, জল খেয়ে পড়ানোয় ফেরত যেতে দিদিভাইয়ের লেগে গিয়েছিল ঝাড়া তিন মিনিট।
আমিও ছিলাম ওই মর্কটক্রান্তির দলে।
দ্বিতীয় উদাহরণটাও ঘটেছিল স্কুলেই। অন্য একটা ক্লাসে। বাকি সব ক্লাসের থেকে বিশেষ ছিল সে ক্লাস। আমাদের স্কুলে প্রতি বছর একটা নির্দিষ্ট সময় বি এড-এর কোর্সওয়ার্কের অংশ হিসেবে পড়াতে আসতেন দিদিভাইরা। তাঁদের সঙ্গে আমাদের রোজকার দিদিভাইদের আকৃতিপ্রকৃতিতে তফাৎ ছিল। বয়সে ছোট, ভারেধারেও কম। পড়ানোর রকমও আলাদা। আমাদের দিদিভাইরা ঘরে ঢুকে বই খুলে পড়াতে শুরু করতেন, বি এড-এর দিদিভাইরা ঘাড়ে করে নিয়ে আসতেন কত রকম রংচঙে চার্ট, যন্ত্রপাতি, পঠনপাঠনের কত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। যে পদ্ধতিগুলো পরীক্ষা পাস করে গেলেই তাঁরা পত্রপাঠ ভুলে যাবেন। কয়েক সপ্তাহের ট্রেনিং ক্লাস নেওয়া শেষ হলে তাঁদের পরীক্ষা হত। তাঁদের দিদিভাইরা ক্লাসের পেছনের সারিতে নম্বরের খাতা খুলে বসে থাকতেন, আর তাঁরা, আমাদের অস্থায়ী দিদিভাইরা কাঁপতে কাঁপতে আমাদের পড়াতেন।
রোজকার দিদিভাইদের কোনওদিন কাঁপতে দেখিনি। উল্টে কেউ কেউ রেগুলারলি আমাদের কাঁপাতেন। এই নতুন, ছোট দিদিভাইদের সঙ্গে রোজকার দিদিভাইদের মূল তফাৎ ছিল সেটাই। রোজকার দিদিভাইদের ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে কমবেশি ভয় এবং ভক্তি মেশাতে হত। নতুন দিদিভাইদের প্রতি ভয় বিন্দুমাত্র থাকত না, ভক্তিটুকুও ভালোবাসায় বদলে নিলে কাউকে আপত্তি করতে শুনিনি। পুরোটাই ভালোবাসা। আর ভালোবাসার জুলুম। পড়া না করে গিয়ে ভুলভাল উত্তর দিয়ে জিভ কেটে হাসব। মাঠের ওপর মেঘ করে বৃষ্টি এলে চেঁচাব, আজ পড়ব না, আজ ভূতের গল্প শুনব। তারপর একমাস (নাকি কয়েক সপ্তাহ? মনে নেই, সময়ের হিসেব তখন আর এখনে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেছে) কেটে গেলে রংচঙে চার্ট গুটিয়ে চলে যাওয়ার সময় হলে হাইবেঞ্চে মাথা গুঁজে ভেউ ভেউ কাঁদব।
সেই দিদিভাইদের স্রোতের মধ্যে থেকে দুয়েকজনকে এখনও মনে আছে। তখনই তাঁরা জাত চিনিয়েছিলেন। আমি নিশ্চিত তাঁরা সারাজীবনে বহু মেয়েকে উৎরোবেন। বহু মেয়েকে স্বর্গের মইতে চড়াবেন, যে মই বেয়ে তারা নক্ষত্রের উচ্চতা ছোঁবে। নিচে গর্বিত এবং উৎকণ্ঠিত মুখ উঁচু করে প্রাণপণে মই ধরে থাকবেন দিদিভাই। পড়ে হাতপা না ভাঙে।
সে রকম একজন এসেছিলেন ইতিহাস পড়াতে। তাঁদের সম্ভবতঃ আদেশ থাকত প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে "ইনটারঅ্যাকটিভ" পড়ানোর। ক্লাসে ঢুকে তিনি জানতে চেয়েছিলেন, এটা কী যুগ চলছে বলতে পারিস?
উৎসাহে প্রায় হাই বেঞ্চে উঠে পড়ে যারা 'কলিযুগ' বলেছিল, তাদের মধ্যে এই শর্মাও ছিল। সেই ক্লাস সেভেনেই আঁচ করেছিলাম যে চারদিকে যা চলছে তাতে এ ঘোর কলি ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।
ভুল। ওটা ছিল লৌহযুগ। মাত্র তিরিশ বছরে সে উত্তরও ভুল হয়ে গেছে। এখন ইন্টারনেটের যুগ একমাত্র ঠিক উত্তর।
তবু আমার কেন যে ধারণা হল যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে কোনও সম্পর্ক এবং সম্পর্কজনিত জটিলতার দিকবেদিক আমি জানব এবং সে জানা প্রমাণ করার আমার দায় আছে, তার দুটো ব্যাখ্যা। এক, অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার আগাপাশতলা অক্ষমতা, দুই, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস।
চল্লিশ পার করে ফেললাম, নয় নয় করে চল্লিশ রকম সম্পর্কে তো থেকেছি। পারিবারিক, আত্মিক, আর্থিক, সামাজিক, রোম্যান্টিক। সে সব সম্পর্কজনিত জটিলতাও ভোগ করেছি। কাজেই সম্পর্ক এবং সম্পর্কজনিত জটিলতা সম্পর্কে আমার অজানা কী থাকতে পারে?
জুমশুদ্ধু মুখে বড়া দিয়ে বসে থাকা বুদ্ধিমান সতীর্থদের মধ্যে লাফিয়ে উঠে বলে বসলাম, জানি জানি, সব সম্পর্কের যাবতীয় জটিলতার দুটো দিক। একটা তোমার দিক, একটা আমার দিক।
স্ক্রিনশুদ্ধু সবাই হাসল। দিদিভাইয়ের হাসির মধ্যে কেমন প্রাণখোলা প্রশ্রয় থাকত, এদের কেমন বেঁকা আর মুচকি আর জাজমেন্টাল।
বিশেষজ্ঞ বললেন, ভুল ভুল ভুল। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে কোনও সম্পর্ক আর সম্পর্কজনিত জটিলতার দুটো দিকের একটা হচ্ছে সহযোগিতার, অন্যটা প্রতিযোগিতার। পৃথিবীর যে কোনও সম্পর্ক এবং তার জটিলতাকে এই দুটো রাস্তার যে কোনও একটায় চালনা করা যায়। কোনটায় চলবে সে সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ সম্পর্কের এপাশে ওপাশে থাকা দুই পক্ষের হাতে।
যে কোনও সম্পর্ক?
যে কোনও। ছোটবেলায় পার্কে খেলার বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক, প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্ক, অধরা প্রেমের সঙ্গে সম্পর্ক, শ্বশুরবাড়ি বাপের বাড়ি, দোকানি, ডিরেক্টর - সবার সঙ্গে সবরকম সম্পর্ককে চাইলে আপনি সহযোগিতা অথবা প্রতিযোগিতার রঙে রাঙাতে পারেন।
এমনকী পৃথিবীর আকাশে কে কত ধোঁয়া/ দূষণ ছাড়বে, বা সে দূষণ কমাতে কে ট্যাঁক থেকে কত টাকা দেবে সেই নিয়ে আন্তর্জাতিক দড়ি টানাটানি (এবং জুতো ছোঁড়াছুঁড়ির) টেবিলে বসেও আপনি পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতে পারেন বা সহযোগিতার রাস্তা ধরে 'সবে মিলি করি কাজ/ হারি জিতি নাহি লাজ' আবৃত্তি করতে করতে সমাধানের রাস্তা খুঁজতে পারেন। সহযোগিতার পথে হাঁটলে নিজেরটুকু বুঝে নিয়ে কেটে পড়ার (কেটে পড়বেনই বা কোথায়, সমুদ্রতল ফুঁসে উঠলে উল্টোদিকের লোকটার সঙ্গে সঙ্গে আপনিও ডুববেন, আগে আর পরে) বদলে সামগ্রিক উন্নতি বা প্যারেটো ইম্প্রুভমেন্ট ঘটানোর দিকে আপনার লক্ষ্য থাকবে। প্রতিযোগিতার দিকে হাঁটলে রক্তচাপ বাড়বে, ঝগড়ুটে বলে নাম পড়বে, সবথেকে খারাপ যেটা হবে ঝগড়া করতে করতে কখন অ্যান্টার্কটিকা গলে আপনাকে এবং বাকি সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে টের পাবেন না।
আপনার অভিরুচি।
এতক্ষণে দামি মাথা ঘামানোর মতো একটা যোগ্য বিষয় পাওয়া গেছে হাঁফ ছেড়ে সবাই আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধানে ব্যস্ত হল। এদিকে কুড়ি মিনিট কেটে গেছে, আমার অ্যাটেনশনের কোটা ফুরিয়েছে, আমি ভিডিওতে মুখ ভাসিয়ে রেখে অন্য একটা সম্পর্কের কথা ভাবতে লাগলাম।
আন্তর্জাতিক তো না-ই, আঞ্চলিক, প্রাদেশিক, পাড়াতুতোও না।
আমার জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। উঁহু, অর্চিষ্মানের সঙ্গে সম্পর্ক না।
আমার সঙ্গে আমার আয়নার সম্পর্ক। বা আয়নার উল্টোদিকের মানুষটার। যাকে আমি ফোন করি না, চিঠি লিখি না, এমনকি কোনও কোনও দিন যার দিকে চোখ মেলে তাকাতেও বিরক্ত লাগে বলে গোটা সময় চশমাটা খুলে রাখি, তবু যে রোজ আমার সামনে এসে দাঁড়ায়।
তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কোঅপারেশনের না কমপিটিশনের?
উত্তরটা শক্ত নয়। আমার জীবনের যা যা হল না তার জন্য ওই লোকটাই যে দায়ী এ আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। আমার নাকটা যে থ্যাবড়া, আমার গালে যে ব্রণর ক্ষত, আমি যে কুঁড়ের বাদশা এবং আমি যে এ জীবনে আমার স্বপ্নের ধারেকাছে পৌঁছতে পারব না, কোনওটাই আমার দোষ নয়। সবের জন্য দায়ী, ওই লোকটা।
সফল সম্পর্কের টিপস যেখানে যত পড়েছি, বেলুড়মঠ থেকে কসমোপলিট্যান, 'শান্তি চাইলে পরের দোষ দেখবে না' থেকে 'ভালোলাগা মুখে প্রকাশ করে বলবে' সব আমি পড়েছি, শুনেছি, মেনেছি। দেখা হলে ''এ কী চেহারা হয়েছে?' আঁতকে না উঠে, 'বাঃ কেমন সুন্দর জামাটা, কোথা থেকে জোগাড় করলে?' বলার যে কার্ডিনাল নিয়মগুলো মানতে মানতে আমি স্বভাবের অংশ করে ফেলেছি, সে সব আমি এই লোকটির ক্ষেত্রে বলে বলে দু'বেলা, সোৎসাহে ভেঙেছি। ত্যাঁদড় টিমমেটকে 'বাবাবাছা' বলে কাজ করিয়ে নিয়েছি অফিসে, আর এই লোকটার প্রতি রেখেছি কেবল মুখঝামটা আর সখেদে মাথা নাড়া।
আবার ডেডলাইন মিস করলে? আবার প্রেমে পড়লে? আবার বোকা বনলে?
তবু যদি কিছু লাভ হত তাতে। এত গঞ্জনা দিয়ে যদি উল্টোদিকের লোকটাকে শুধরোনো যেত। আমি কি জানি না, সূর্য হঠাৎ একদিন উত্তরদিকে উঠতে পারে, কিন্তু রত্নাকর বাল্মীকি হয় কেবল গপ্পে? আমার বস্ কে কি আমি বদলানোর চেষ্টা করেছি? আমার মাকে? অর্চিষ্মানকে পর্যন্ত করিনি। অথচ আয়নার উল্টোদিকের লোকটাকে নিরন্তর করে চলেছি। অলস পাল্টে পরিশ্রমী করার চেষ্টা করে চলেছি, কুৎসিত বদলে সুন্দর, শর্টটেম্পার চাই না ধৈর্যের প্রতিমূর্তি কই? বলে ক্রমাগত হাত পা ছুঁড়ছি।
যত পাচ্ছি না, টেম্পার তত চড়ছে ওই লোকটার প্রতি।
ভাবতে ভাবতে উচ্ছ্বাস কানে এল। অবশেষে মিটিং শেষ হচ্ছে। এতক্ষণ যারা হাঁড়িমুখে বসে ছিল তারা সবাই উজ্জ্বল মুখে একে অপরকে হাত নাড়ছে। আমিও নাড়লাম। তারপর স্থির করলাম, এবার থেকে নিজের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্কে যাব। 'কেন হল না?'-র থেকে 'করলেই হয়ে যাবে' বলব। সে আমার স্বপ্নের দিকে দশ পা হাঁটলে আমি তাকে পাঁচহাজার পা বাড়তি হাঁটতে নিয়ে যাব বিকেলবেলা। আইসক্রিম খেতে খেতে পার্কের মধ্যে দিয়ে ফিরব।
আপনার সঙ্গে আপনার আয়নার মানুষটির সম্পর্ক কীরকম? সহযোগিতার না প্রতিযোগিতার? নাকি দুইয়ের মাপমতো মিশেল? আমি যেমন একসঙ্গে হাঁটতে যাই আর আইসক্রিম খাওয়াই, কোঅপারেশনের মেজাজে থাকলে আপনি কী করেন আপনার আয়নার ওপারের লোকটির সঙ্গে?
আমার বাড়িতে এখন প্রতিযোগিতার মরশুম চলছে সপ্তাদুয়েক। কাজেই এক ঘরে বসলে, মুখে বিরক্তি বা গোমড়ামো ছাড়া আর কোনো ইতিবাচক ভাব ফোটানো যাচ্ছে না। তারমধ্যে সবে দুটো চোখা চোখা মন্তব্য বিনিময় হয়েছিল। গরম মাথা নিয়ে অবান্তর খুলেই মর্কটক্রান্তি...!!
ReplyDeleteনিঃশব্দে হাসতে গিয়েও নাক টাক থেকে বিচ্ছিরি শব্দ বেরিয়ে পড়ল। না হাসি না শব্দ, কোনোটাই আটকাতে পারলাম না।
উল্টোদিকের নেতিবাচক মনোভাব মনে হয় বেড়ে গেছে।
তা যাকগে।
আমারও ভূগোল ক্লাসের একটা ছবি মনে পড়ে গেলো, শুরুর দিকটা এক। দিদি ক্লাসে এসেই কমলালেবু এঁকে তার মধ্যে তিনটে সামান্য অবতল দাগ একে ফেলেছেন।
তারপর প্রায় গোলাকার দিদি, নিজের পেটে হাত বোলাতে বোলাতে মাঝের দাগের কাছে আঙুল দিয়ে বলছেন - এই দেখ্, এই হচ্ছে পৃথিবীর ভুঁড়ি।
হাহা, আমাদের সবার ভূগোল ক্লাস রোমহর্ষক ছিল মনে হচ্ছে, বৈজয়ন্তী। ভূগোল দিদি/দিদিভাইরা ইন্টারেস্টিং লোক হন, এটা আমি আগেও নজর করেছি।
Deleteতা সর্বদা বি পজিটিভ না হয়ে নেগেটিভিটিতে বিচরণ করা ভালো। প্রতিযোগিতার মরশুম কেটে গিয়ে সহযোগিতার সিজন নেমে আসুক এই কামনা করি।
Khub ekta ghatai na ayenar ulto diker loktake....
ReplyDeleteTobe mone hoy na ghataleo shey amaake ek photao patta dito
এটা ভালো স্ট্র্যাটেজি, অর্পণ। আমার আবার ওই লোকটাকে অত্যধিক ঘাঁটানোর বদভ্যেস আছে।
DeleteDaarun likhechen.. Mongolbar sokal ta bhalo hoye gelo.. aami kichudin holo aaynar manushtir songe bhalo somporko goRar chesta korchi.. maane onek toh boyes holo.. ja sudhroyni, aar sudhrote chai o na.. aar eta aamaar core personality maane moha phnakibaaj, moha lyad aamir sathe bhalo jaay.. otoeb..
ReplyDeletekichudin aage Samaresh Basu r Ashok Thakur goyenda somogro porchilam.. aapni nishchoi onek aagei poRechen? aami ekdom e beshi Samaresh Basu poRini.. kintu ei series "duschoritra" mohilader otyodhik presence khub obaak korlo aamaake.. aapnar ki mone hoy?
khub bhalo thakben.. Sabdhane thakben..
Indrani
থ্যাংক ইউ, ইন্দ্রাণী। হ্যাঁ, শুধরোনোর চেষ্টা বৃথা।
Deleteঅশোক ঠাকুর বহু আগে পড়েছিলাম। মনে রাখার মতো লাগেনি তাই ভুলে গেছি। তবে 'দুশ্চরিত্র' মহিলাদের বাড়াবাড়ি আন্দাজ/ব্যাখ্যা করার জন্য খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্লট মনে রাখার দরকার নেই। দুশ্চরিত্র কিংবা দেবী মহিলা হলে ভালো প্লটের মোচড় সৃষ্টি হয় যাতে কেন্দ্রীয় পুরুষটির কেরামতি দেখাতে সুবিধে। যে কোনও পুরুষকেন্দ্রিক গল্পে এ ঘটনা ঘটে, ঘটেছে ঘটবে। অশোক ঠাকুরকে বিশেষ করে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আর যদি কেন্দ্রে পুরুষকে রেখেও নারীকে মানুষের মতো লেখার দাবি জানান, আগে দৃষ্টিটা বদলানোর দাবি জানাতে হবে। বা মেয়েদের নিজেদের মতো মানুষ ভাবার দাবি জানাতে হবে। দেখছেন তো, আমি আপনি নিজেকে বদলাতে পারছি না, অন্যদের দৃষ্টি/বিশ্বাস বদলানোর আশা করি কী করে বলুন দেখি।
hyan.. khub e sotti kotha bolechen.
ReplyDeleteআমার আয়নার উল্টোদিকের লোকটা এক নম্বরের কুঁড়ে আর এক্কেবারে অপদার্থ। চল্লিশ বছর বয়স হতে চলল, একটা ভুঁড়ি কমাতে পারলনা কোনওদিন। কি আর বলব। একটুও ডিসিপ্লিন নেই, কোনও কাজ শুরু করে শেষ করেনা, আবার এদিকে লোকের সঙ্গে মিশতে অকওয়ার্ড ফীল করে। মানে আমি জীবনে যে কত উন্নতি করতে পারতাম এ লোকটাকে শোধরাতে পারলে, সেটা ভাবলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। ইদানিং আবার আমার মেয়েটাকে হাত করেছে - আমার যতই অপছন্দ লোকটাকে, আমার মেয়ের আবার তাকে ততই পছন্দ। বিরক্তিকর ব্যাপারগুলো যেন তার চোখেই পড়েনা, আদিখ্যেতা দেখে গা জ্বলে যায়! প্রতিযোগিতা করে করে হাল ছেড়ে দিয়েছি। এখন সহযোগিতা ফেজে আছি - ডেডলাইনের আগে কাজ শেষ করতে পারলে গিটার বাজাতে দিই, ছবি আঁকতে দিই, সাতদিন সুপ্ খেতে পারলে একদিন আইসক্রিম খাওয়াই, এইসব আর কি।
ReplyDeleteইশ, ইস্কুলের টিচারদের সার্কেল আঁকার ক্ষমতাকে কি হিংসেই না করতাম। এখন আমিও পড়াই, তবে খুব একটা সার্কেল আঁকতে হয়না (লিখতে গিয়েবোর্ডে কি কি করতে হয় সেটা খানিক ভাবতে হল, কারণ এক বছরের ওপর হয়ে গেল বোর্ডে পড়াইনি)। তবে আমার সন্দেহ হয়, আমি নিখুঁত সার্কেল আঁকলেও আজকালকার ছেলেমেয়েরা অতটা ইম্প্রেস্ড হবেনা। একবার আমি ক্লাসে বোর্ডে অঙ্ক কষে দেখাবার চেষ্টা করছিলাম এক লাইট ইয়ারে কত কিলোমিটার। একটা ছেলে বলল, "But what's the point? We can just Google for it, right?"
অলি আপনার থেকে সাইজে ছোট হলে কী হবে, আপনার আয়নার লোকটা সম্পর্কে আমি অলির মতামতকেই বেশি গুরুত্ব দেব। আপনি প্রতিযোগিতায় নামবেন না, অলির ক্যান্ডিডেট প্রতিবার বলে বলে জিতবে।
Deleteআজকালকার ছাত্রগুলো যাকে বলে রাম ডেঁপো। কল্পনায় কষে কান মুলে আর গাঁট্টা মেরে শোধ তুলবেন। একটাই সান্ত্বনা, আমাদের একশো বছর আগের শিক্ষকদের ছাত্ররাও ডেঁপো ছিল, আমাদের একশো বছর পরের শিক্ষকরাও বলবেন পৃথিবীর ইতিহাসে তাঁদের ছাত্রদের থেকে ডেঁপোতর ছাত্র আর আসেনি।