একজন গোয়েন্দা, পাঁচটি বই


বই পড়া যে একদম হচ্ছে না তা নয়, সে বইগুলো নিয়ে অবান্তরে পোস্ট লিখতেও ভালো লাগবে না তাও নয় কিন্তু পড়ার সময় কমিয়ে পড়া নিয়ে লেখার ব্যাপারটা আজকাল অদ্ভুত ঠেকে। পড়ার সময় কমিয়ে যখন সুমনের গানের গল্প করি, বা দুপুরে ঘুমের গল্প বা নিজেকে আইসক্রিম খেতে নিয়ে যাওয়ার, তখন কিন্তু অদ্ভুত লাগে না।

সেই অদ্ভুতলাগা কাটিয়ে উঠে কয়েকটা বইয়ের কথা বলব আজ। আগের বছর আর এ বছরের পড়া মিলিয়ে মিশিয়ে মনে রাখা কয়েকটা বই। আমার পড়া একজন নতুন গোয়েন্দার কথাও বলব। ইন ফ্যাক্ট, তাঁর কথা দিয়েই শুরু করব।

The Widows of Malabar Hill (2018); The Satapur Moonstone (2019)/ Sujata Massey



গবেষণা করে লেখা গল্পে গবেষণার ছাপ রয়ে গেলে আপনি ইম্প্রেসড হন, না, না রয়ে গেলে? লেখায় গবেষণার ছাপ পেলে ইম্প্রেসড হওয়া মানুষের সংখ্যাটা কম নয়। ঐতিহাসিক রচনাপ্রেমীরা অনেকেই সেই গোত্রে পড়বেন। অর্চিষ্মান যেমন। ও বলে, যে মুহূর্তে তুমি খুনখারাপিটা উনিশশো কুড়িতে শুরুর দিকে নিয়ে ফেলছ, সে সময়ের লোকজন, সাজপোশাক ইত্যাদি দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছ, সেই মুহূর্তে তুমি আমার মনোযোগ আকর্ষণ করে ফেলছ।

অর্চিষ্মান আগ্রহ প্রকাশ করেছে উনিশশো কুড়ির বম্বের প্রেক্ষাপটে সুজাতা ম্যাসির লেখা পরভিন মিস্ত্রি সিরিজ পড়তে। যে সিরিজের প্রথম দুটো বই আমি অলরেডি পড়ে ফেলেছি, উইডোজ অফ মালাবার হিল আর সাতাপুর মুনস্টোন। প্রথম গল্পটি ফাঁদা হয়েছে বম্বে শহরে, দ্বিতীয়টি খাণ্ডালায়।

পরভিন জে মিস্ত্রি হচ্ছেন আমাদের গোয়েন্দা। চরিত্রটি চমৎকার এবং যত্ন নিয়ে তৈরি। বড় বাড়িতে জন্মানোর সুবিধেটুকু পেয়েছে পরভিন; সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেন 'ঠাকুরদা' মিস্ত্রি হছেন আধুনিক বম্বের কারিগর। নগরের  বিখ্যাত বিল্ডিংসমূহের বেশিরভাগই মিস্ত্রি কন্সট্রাকশনের বানানো। পরভিনের বাবা জামশেদ (যার আদ্যক্ষর জে পরভিনের মিডল নেম) উকিল। পরভিনও বাবার লাইনেই গেছে, কিন্তু বম্বে কোর্টে তখনও মেয়েদের প্রকাশ্যে সওয়াল করার অনুমতি নেই, কাজেই পরভিন সলিসিটার হয়েছে (আমাকে লইয়ার, ব্যারিস্টার, সলিসিটার ইত্যাদির খুঁটিনাটি জিজ্ঞাসা করবেন না দয়া করে,  পরভিন যা বলেছে আমি আপনাদের তা-ই বলছি - যতটুকু মনে আছে)। সে নেপথ্যে থেকে বাবার সহায়তা করে।

সুজাতা ম্যাসি বুদ্ধি খাটিয়ে পরভিনের এই প্রতিকূলতাকে তার শক্তিতে পরিণত করেছেন। পরভিন মেয়ে বলে যেমন কোর্টে ঢুকে সওয়াল করতে পারে না, তেমনি সে মেয়ে বলেই অনায়াসে অন্তঃপুরে ঢুকে যেতে পারে যেখানে পুরুষদের অধিকার নেই। মালাবার হিল উপন্যাসে একটি খানদানি মুসলিম পরিবারে তিন সতিনের সম্পত্তির খোঁজখবর নিতে পরভিন যায় এবং গিয়ে একটি খুনের মধ্যে পড়ে।

দ্বিতীয় গল্পে সতপুরের রাজবাড়িতেও একই সমস্যা, শাশুড়ি রানি আর বউমা রানির ঝগড়া লেগেছে। রাজামশাই মারা গেছেন, মারা গেছেন কিশোর রাজাও, ঝগড়া বেধেছে নাবালক রাজা আর তার নাবালিকা রাজকন্যার লালনপালনের রকমসকম নিয়ে। ততদিনে এই সব ছোট ছোট রাজ্যগুলোর ওপর ব্রিটিশের অধিকার কায়েম সম্পূর্ণ হয়েছে। একজন ব্রিটিশ প্রতিনিধি আছেন বটে এই সব মেটানোর জন্য, কিন্তু ভারতীয় পুরুষেরাই সেখানে অনুমোদিত নন, ইনি তো গোরা সাহেব। কাজেই পরভিন ভরসা।

মিস্ত্রি সিরিজের প্রধান ভালো ব্যাপার হচ্ছে যে সুজাতা পরভিনের কাজের দিকটাকে, অনেক সংগ্রাম করে যে কাজের অধিকার পরভিন জোগাড় করেছে, দুধভাত হিসেবে ট্রিট করেননি। পরভিনের সব কেসই কাজের সূত্রে পাওয়া। দ্বিতীয় ভালো ব্যাপারটা হচ্ছে গল্পে ইংরেজ চরিত্রদের আনাগোনা। পরভিন যে বাড়ির মেয়ে এবং অক্সফোর্ডে পড়াশোনাটোনা মিলিয়ে, পরভিনের ইংরেজদের সঙ্গে ওঠাবসা না হলেই অস্বাভাবিক হত। অক্সফোর্ডের বন্ধু অ্যালিসের বাবা ভারতে উচ্চপদস্থ ইংরেজ অধিকর্তা, সেই সূত্রে অ্যালিস ভারতে এসেছে এবং পরভিনকে সাহায্য করছে নানাভাবে। তিন নম্বর ভালো, পরভিনের ব্যক্তিগত জীবনটাকেও লেখক গল্পের অনেকটা জুড়ে রেখেছেন এবং খাপছাড়াভাবে রাখেননি। সেখানেও পরভিন তৎকালীন সমাজে ব্যতিক্রম। একটি হরেন্ডাস বিয়ে এবং বিয়েপরবর্তী ছাড়াছাড়ি হয়েছে পরভিনের।  পরভিন যে তাতে কাবু হয়ে পড়েনি সেটা দেখানোর জন্য যেমন আমি খুশি হয়েছি, পরভিনের পরিবার যে সর্বান্তঃকরণে এবং সোৎসাহে পরভিনকে পুরোনো জীবন ভুলে নতুন জীবনে নিজের ইচ্ছেমতো ভেসে যেতে সাহায্য করেছে সেটা দেখানোয় আরও বেশি খুশি হয়েছি। "বাস্তব" তুলে ধরার নামে কল্পনায় আমরা মেয়েদের কম অত্যাচার করি না।

এবার অভিযোগের এক দুই তিন। প্রথম অভিযোগের রেশ গোড়াতেই দিয়েছি। এই সিরিজ লিখতে লেখককে মারকাটারি রিসার্চ করতে হয়েছে এবং সে রিসার্চের প্রমাণ গল্পের ছত্রে ছত্রে।

প্রথম গল্পে মুসলিম সম্পত্তি আইনের ব্যাখ্যা পড়তে বিশেষ ক্লান্তি ঘটে। আমার মতো সাধারণ পাঠকেরা খুনটা পড়তে চায়, অত আইনের মারপ্যাঁচ তারা পড়তে চায় না। টাকার জন্য খুন হয়েছে, ব্যস। আমি কিন্তু বলছি না তার মানে কোনও রিসার্চ না করে দুমদাম লিখে দিতে। রিসার্চ থাকবে, কিন্তু সে রিসার্চ যে আছে সেটা বোঝা যাবে না, এইটা হচ্ছে আমার মতে আদর্শ পরিস্থিতি। আমি জানব যে লেখক জানেন। সে জেনেই আমি আশ্বস্ত বোধ করব, নিজে জানতে উৎসাহী হব না।

এই প্রসঙ্গে স্টিফেন কিং-এর এই নিচের কথাগুলো আমার কার্যকরী মনে হয়।

If you do need to do research because parts of your story deal with things about which you know little or nothing, remember that word back. That’s where research belongs: as far in the background and the back story as you can get it. You may be entranced with what you’re learning about the flesh-eating bacteria, the sewer system of New York, or the I.Q. potential of collie pups, but your readers are probably going to care a lot more about your characters and your story.”

বলতে যত সোজা, করতে তত কঠিন। ইনফরমেশন দেওয়ার মুনশিয়ানা সবার সমান থাকে না। একজন লম্বা লেখক ছিলেন বাংলা ভাষায়, পারিবারিক পত্রিকা বাঁচিয়ে রাখার খাতিরে চল্লিশ বছর বয়সে মারাত্মক ব্যস্ত জীবনে লেখা শুরু করেছিলেন এবং পরবর্তী কালে খানিকটা সত্যি এবং খানিকটা রসিকতা মিলিয়েই হয়তো বলেছিলেন, তাঁর সংসার চলে বই লিখে।

তিনি দিতে পারতেন, ইনফরমেশন। কোটি কোটি উদাহরণ দিতে পারতাম, এই মুহূর্তে সানডে সাসপেন্সে গ্যাংটকে গণ্ডগোল চলছে। সেখান থেকেই দুটো নমুনা রইল।

সন্ধের দিকে ভদ্রলোক একটা অদ্ভুত জিনিস এনে আমাদের দেখালেন। হাতখানেক লম্বা একটা লাঠি, তার ডগায় বাঁধা ছোট্ট একটা কাপড়ের থলি।

‘কী জিনিস বলুন তো এটা’, একগাল হেসে জিজ্ঞেস করলেন নিশিকান্তবাবু। ‘জানেন না তো? এই থলের ভিতর আছে নুন আর তামাকপাতা। পায়ে যদি জোঁক ধরে, এই থলির একটা ঘষাতেই বাবাজি খসে পড়বেন।’

ফেলুদা জিজ্ঞেস করল, ‘নাইলনের মোজা ভেদ করেও জোঁক ঢোকে নাকি?’

‘কিছুই বিশ্বাস নেই মশাই। গেঞ্জি, শার্ট আর ডবল পুলওভার ভেদ করেও বুকের রক্ত খেতে দেখেছি জোঁককে। আর মজা কী জানেন তো? ধরুন, লাইন করে একদল লোক চলেছে জোঁকের জায়গা দিয়ে। এখন, জোঁকের তো চোখ নেই–জোঁক দেখতে পায় না–মাটির ভাইব্রেশনে বুঝতে পারে কোনও প্রাণী আসছে! লাইনের মাথায় যে লোক থাকবে, তাকে জোঁক অ্যাটাক করবে না–কিন্তু তার ভাইব্রেশনে তারা সজাগ হবে। দ্বিতীয় লোকের বেলা তারা মাথা উঁচিয়ে উঠবে, আর থার্ড যিনি রয়েছেন, তাঁর আর নিস্তার নেই–তাঁকে ধরবেই।’

*

হেলমুট দেখলাম একটার বেশি ক্যামেরা সঙ্গে নেয়নি, আর নিশিকান্তবাবু দেখি কোত্থেকে একজোড়া চামড়ার গোলোস জুতো সঙ্গে নিয়ে নিয়েছেন। বললেন, ‘ভেবে দেখলাম, জোঁক যদি পায়ের পিছন দিকে ধরে, তা হলে তো আর দেখতে পাব না! নুনের থলি কোন কাজটা দেবে মশাই? তার চেয়ে এই গামবুটই ভাল–সেন্ট পারসেন্ট সেফসাইড৷’

‘যদি গাছ থেকে মাথায় পড়ে জোঁক?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

নিশিকান্তবাবু মাথা নাড়লেন। ‘ম্যাক–মানে ম্যাক্সিমাম জোঁকের টাইম এটা নয়। সেটা আরও পরে—জুলাই অগাস্টে। এখন বাবাজিরা সব মাটিতেই থাকেন।’

জোঁক সম্পর্কে এত যে ইনফরমেশন আপনাকে গেলানো হল, বিরক্ত লাগল কি?

আমার দ্বিতীয় মনখুঁতখুঁত লেখাসংক্রান্ত। গল্প বলা ভালো, কিন্তু বড় বেশি সংলাপ। অত কথা বললে ডুব দিতে অসুবিধে হয়। আমি মানছি ডুব দিতে হলে গোয়েন্দাগল্প নিয়ে বসা উচিত নয়, কিন্তু তবু আরেকটু বর্ণনা বা চরিত্রদের নীরবতায়/ আত্মগত ভাবনায় ডুব দেওয়ার সুযোগ দিলে পাঠকের ভালো লাগে। সাহিত্যগুণ বৃদ্ধি পায়।

এইবার সবাই লাফিয়ে পড়ে বলবে, সাহিত্যগুণ চাইছ তো গোয়েন্দাগল্প পড়ছ কেন? হক কথা। আমি দাবি করছি না যে গোয়েন্দাগল্পের লেখা কালজয়ী সাহিত্য হতে হবে। কিন্তু সামান্য সাহিত্যগুণসম্পন্ন হলে গোয়েন্দাগল্পের রস ক্ষুণ্ণ হয় না বলেই আমার ধারণা। সবথেকে বড় কথা, লেখা 'সাহিত্যসমৃদ্ধ' করা খুব একটা শক্ত নয়। ইংরিজির একটা সুবিধে আছে - পাস্ট বদলে প্রেজেন্ট টেন্সে লিখলেই লেখা ঝপ করে সাহিত্য হয়ে ওঠে। বাংলায় সে সুবিধেটা অত স্পষ্ট নয়। বাংলা লেখার ক্ষেত্রে যে জিনিসটা কাজে দিতে দেখেছি সেটা হচ্ছে সংলাপ কমিয়ে চরিত্রের মনের মধ্যে ডুব দেওয়া এবং বিবরণ। বলা বাহুল্য, সেটাও মুনশিয়ানার সঙ্গে করা চাই। কুন্তলা দুপুরবেলা কুমড়োর ছেঁচকি দিয়ে ভাত খেয়ে তারকেশ্বর লোকাল ধরে হাওড়া গেল, এতে না আছে সংলাপ, না আছে সাহিত্য। ব্যোমকেশ নিয়ে আমার আর যা-ই বলার থাকুক না কেন, প্রসাদগুণে গল্পগুলো যে অত্যন্ত উতরেছে সে নিয়ে কোনও ব্যোমকেশ-ভক্তর সঙ্গে আমার কোনও যুদ্ধ নেই। ইন ফ্যাক্ট, তাঁরা মারতে আসতে পারেন জেনেও বলছি, ওই প্রসাদগুণের জন্যই ব্যোমকেশ উতরেছে, আর কোনও কারণে নয়।

আবীর মুখোপাধ্যায়ের স্যাম উইন্ডহ্যাম গোয়েন্দা সিরিজের কথা এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে। ম্যাসির মিস্ত্রি সিরিজ আর মুখার্জির উইন্ডহ্যাম সিরিজ অবিকল এক সময়ে ফাঁদা। পরভিন মালাবার হিলের খুন সমাধান করতে নেমেছে উনিশশো একুশে, আর উইন্ডহ্যাম কলকাতায় এসে রহস্য সমাধান করছেন উনিশশো উনিশে। আরও অনেক মিল আছে দুটোর। দুজনেই তুরুপের তাস "ঐতিহাসিক"। দুজনেই মারকাটারি রিসার্চ করেছেন। দুজনেরই প্লটের গোঁজামিল কমবেশি ধরা যায়। কিন্তু দুজনের লেখার ঘরানা সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায় স্রেফ ভাষা ব্যবহার, গল্প বলার গতি নিয়ন্ত্রণ এবং পারিপার্শ্বিকের বর্ণনার ঘাড়ে ভর দিয়ে।


The Pull of the Stars/ Emma Donoghue





অধিকাংশ লেখকের লেখায় থিম, প্লট বা প্রেক্ষাপট কেমন ফিরে ফিরে আসে সেটা এই বইটা পড়তে গিয়ে আবার টের পেলাম। ডনহিউর প্রথম এবং আপাতত বিখ্যাততম উপন্যাস 'রুম'-এর একটা বিরাট অংশ ঘটেছিল একটা বদ্ধ ঘরের ভেতর। দ্বিতীয় উপন্যাস 'দ্য ওয়ান্ডার' এর ঘটনাক্রম ঘটেছিল, আবারও একটি বন্ধ ঘরের ভেতর এবং একটি অসুস্থ মেয়েকে কেন্দ্র করে। তৃতীয় উপন্যাসের প্রেক্ষাপট প্যান্ডেমিক, ঘটনাস্থল হাসপাতালের একটি বদ্ধ ওয়ার্ড। অসুস্থতা এবং স্থানসংকুলান, বোঝাই যাচ্ছে লেখকের প্রিয় বিষয়।

সমাজের আসল যে প্যান্ডেমিকগুলো - সময় ছাড়া যেগুলোর কোনও ভ্যাকসিন নেই, বিংশ শতাব্দীর গোড়ার স্প্যানিশ ফ্লু-এর প্যান্ডেমিকের আড়ালে আসলে সেই সব প্যান্ডেমিকের গল্প বলেছেন লেখক। সম্পদের অসমবণ্টন, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য আরও দাঁত নখ বার করে এসেছে এই ক্রাইসিসে। কার অসুখ হবে সেটা কারও জানা না থাকলেও, কাকে বাঁচানো অগ্রাধিকার পাবে সবাই জানে। এখনও জানে, তখনও জানত। একশো বছর পরের প্যান্ডেমিকেও জানবে। গরিব আর মেয়েরা আগে মরবে। গরিব মেয়েদের স্বয়ং যিশুখ্রিস্টও বাঁচাতে পারবেন না।

গোটা গল্পের মধ্যে সেভাবে দেখতে গেলে খোলা আকাশের নিচে হাওয়াখাওয়া দৃশ্য একটাই যেখানে নার্স পাওয়ার প্রোটাগনিস্ট কর্মস্থলের দিকে যাচ্ছেন। ভোরবেলা একটি লাল রঙের কোট পরে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন কাজের উদ্দেশ্যে। ধূসরতা, বিষাদ, মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে একটি মেয়ের সাইকেল চালিয়ে যাওয়া, সম্ভবতঃ চোখ দিয়ে দেখালে অত স্পষ্ট দেখতে পেতাম না, লেখক মন দিয়ে দেখতে বাধ্য করলেন বলে যত দেখলাম। বইটা শেষ করার কেন, তার পরের আরও দশটা বই পড়ার পরও সে দৃশ্য আপনার মনে থেকে যাবে।


Himself/Jess Kidd




ঘরানার মিশ্রণ অনেক রকম হয় শুনেছি, পড়েওছি কিছু কিছু। ঐতিহাসিক + রোম্যান্স, লিটারেরি + থ্রিলার, সাইফাই + রোম্যান্স, কমেডি + হরর। কিন্তু জাদুবাস্তবতার সঙ্গে গোয়েন্দাগল্প মেলানোর ব্যাপারটা আগে শুনিনি, আর সেটাই আমাকে জেস কিড-এর আত্মপ্রকাশকারী উপন্যাস হিমসেলফ পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল। 

আয়ারল্যান্ডের Mulderrig নামের একটি গ্রামে ফিরে আসে একটি শহুরে যুবক, Mahony, একটি মেয়ের ছবি হাতে নিয়ে। যে মেয়ে কি না তার মা। তার মায়ের সঙ্গে কী ঘটেছিল কেউ জানে না (অন্ততঃ না জানার ভান করছে), শুধু জানে যে একদিন কিশোরী Orla -কে, যে সদ্য জন্ম দিয়েছিল একটি পিতৃপরিচয়হীন পুত্রসন্তানের, আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। গোয়েন্দা অংশটুকু হচ্ছে Mahony-র সে সত্যিটা খুঁড়ে বার করায়।আর জাদুবাস্তবের অংশটা হচ্ছে এই জায়গায় যে Mahony মরা মানুষদের দেখতে পায়। দলে দলে মৃতেরা তাকে ঘিরে থাকে। কথা বলে। পথ দেখায়। মায়র সত্যি খুঁজতে এসে Mahony-র দেখা হয় নানা চরিত্রের সঙ্গে।

আমি আয়ারল্যান্ডের গ্রাম দেখিনি, সাতের দশকের আয়ারল্যান্ডের গ্রাম দেখার চান্সও নেই, কিন্তু বিশ্বাস করতে পেরেছি যে দেখলে এইরকমই লাগত, গল্প পড়ে যেমন লাগছে। ভালো গল্প বলতে পারার তো সেটাই সব থেকে বড় কেরামতি, তাই না?  পাবের মালিককে দেখলে মনে হয় উনিশশো সত্তরের আইরিশ পাবের মালিক নির্ঘাত এইরকমই ছিল। কিংবা গ্রামের ক্যাবলা ছেলেটা, যে এতদিন গ্রামেই থেকেছে এবং বাকি জীবনটাও গ্রামেই থাকবে, লজঝড়ে গাড়ি চালিয়ে চৌখস লোকদের স্টেশনে/বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দিয়ে আসবে নিয়ে আসবে, তাকেও রক্তমাংসের কল্পনা করে নিতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয় না।

অসুবিধে হয় মূল চরিত্রতে এসে। Mahony-র সঙ্গে সঙ্গে এ গল্পে আরেকজন মূল চরিত্র আছেন - Mrs Cauley নামের এক একসেন্ট্রিক বয়স্ক মহিলা। পয়সাওয়ালা বলে গ্রামের লোক সহ্য করে। 

Himself হচ্ছে সেই ধরণর গল্প যা পড়তে বসলেই আপনি বুঝতে পেরে যাবেন গল্পের কোন কোন চরিত্রকে লেখক পছন্দ করেন আর কোন কোন চরিত্রকে দু'চক্ষে দেখতে পারেন না। Mahony, Mrs Cauley এঁরা সবাই হয় সুন্দর দেখতে, নয় বড়লোক, (দুজনেই ) ম্যাজিক্যাল ক্ষমতার অধিকারী। চার্চের প্রিস্ট, দুষ্টু নার্স, পুলিস - এরা সবাই বদের বাসা। ভালোরা খারাপদের ক্রমাগত অপমান আর হেনস্থার চূড়ান্ত করে এবং আপনি স্পষ্ট দেখতে পান যে সে হেনস্থার বিবরণ লিখতে লিখতে লেখক হেসে গড়িয়ে পড়ছেন। শেষে একটা দৃশ্যে তো কমিক রিলিফ দেওয়ার জন্য অপ্রগতিশীল প্রিস্টকে জামাকাপড় খুলিয়ে প্রকাশ্য রাস্তায় দৌড় পর্যন্ত করানো হয়।

কিছু কিছু আইরিশ পাঠকরা আপত্তি করেছেন যে জেস কিডের আইরিশ চরিত্রচিত্রণ আইরিশদের কার্টুন আঁকলে যেমন হবে, সেই গোত্রের।

ভেবে দেখলাম, এই জিনিসটাই আমাকে ভোগাচ্ছিল। এ বইয়ের ডোন্ট-কেয়াররা এত ডোন্ট-কেয়ার যে ভরা চার্চে সশব্দে বাতকর্ম সারেন, সুপুরুষরা এত সুপুরুষ যে দেখা হওয়ার (আলাপ হওয়ার প্রসঙ্গ তোলা হয়নি কোথাও) দিনকয়েকের মধ্যে সংসারধর্ম পালন করা মহিলারা ঘন জঙ্গলের কণ্টকাকীর্ণ মেঝেয় তার সঙ্গে শারীরিক সংসর্গে লিপ্ত হন। এ যেন কলকাতার কালচার্ড বাঙালি চরিত্র লিখতে বসে চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, গায়ে আদ্দির পাঞ্জাবী, কাঁধে ঝোলা আর প্রেক্ষাপটে অ্যাকাডেমি রেখেও "কী যেন একটা মিসিং" মাথা চুলকে অবশেষে তুড়ি বাজিয়ে লোকটার হাতের মুঠোয় লিটল ম্যাগাজিন গোল পাকিয়ে গুঁজে দেওয়া।



Piranesi/Susanna Clark




The Beauty of the House is immeasurable; its Kindness infinite.


কেউ প্রোলিফিক হয়ে নাম কেনেন, কেউ বা ঈদের চাঁদ হয়ে। দু'হাজার চারে বেরিয়েছিল সুজানা ক্লার্কের প্রথম এবং এযাবতের একমাত্র ফ্যান্টাসি উপন্যাস Jonathan Strange & Mr. Norrell। সকলের নজর কেড়েছিল। টিভি সিরিজটিরিজ। পরের ষোল বছরে একটা ছোটগল্প সংকলন, ব্যস। আর পাত্তা নেই। ষোল বছর পর সুস্যান ক্লার্ক আবার ফিরে এলেন তাঁর আড়াইশো পাতার উপন্যাস Piranesi নিয়ে।

উপন্যাসের নাম একজন সত্যিকারের লোকের পদবী। জিওভানি বাতিস্তা পিরানেসি ছিলেন একজন ইতালিয়ান প্রত্নতাত্ত্বিক, স্থপতি এবং শিল্পী। সতেরশো কুড়িতে জন্মেছিলেন, মারা গিয়েছিলেন সতেরোশো আটাত্তরে। ষাট বছরেরও কম জীবনে তিনি রোম শহরের দেওয়াল জুড়ে খোদাই করেছিলেন বিরাট বিরাট কাল্পনিক জেলখানা। আকাশ দেখতে না দেওয়া দেওয়ালের পর দেওয়াল, থামের পর থাম, সিঁড়ির পর সিঁড়ি। অনন্ত ওঠা নামা, ঘুরে মরার সে জেলখানা দেখলেই দমবন্ধ হয়ে আসে।

ক্লার্কের উপন্যাসের প্রথম ছেষট্টি পাতা জুড়ে আমরা সেই ঘুরে মরার বর্ণনা পাই। একটি মানুষ রোজ একটি প্রাসাদের একটি ঘর থেকে অন্য ঘরে হাঁটছে। কোথাও পৌঁছনোর জন্য নয়, কারণ পাঠক অচিরেই বোঝেন যে আসলে কোথাও পৌঁছনোর নেই। তবু সে রোজ একই বিন্দু থেকে শুরু করে একই বিন্দুতে ফেরে। দেখে একই জিনিস। ঢেউ, থাম, অট্টালিকা, মূর্তি, অ্যালবাট্রস। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লিখে রাখে তার খাতায়। রোজ। পরের দিন আবার সেই একই যাত্রার পুনরাবৃত্তি। আবার দেখা। আবার লেখা।

কী যে হচ্ছে, ক্লার্ক ভাঙেন না। পাঠকের হাত ধরার কোনও উদ্যোগই দেখান না। ছেষট্টি পাতা পর্যন্ত এইরকম চলতে চলতে শেষ পর্যন্ত যখন পাঠকের দম বন্ধ হয়ে আসে, আবর্তে পড়ে মাথা ঘোরার উপক্রম হয়, ধৈর্যের সুতো ছেঁড়ে ছেঁড়ে, তখন অল্প অল্প আলো দেখা যায়।

সে আলো কীসের, আমি বলব না। পিরানেসি পড়ার আগে পিরানেসির যে সব রিভিউ আমি পড়েছিলাম/শুনেছিলাম/দেখেছিলাম, প্রতি রিভিউয়ারই আমাকে সে আলো দেখাতে অস্বীকার করেছিলেন। এত রহস্য করা সত্ত্বেও আপনারা যদি কেউ বইটি পড়েন এবং মাঝপথে ধুত্তোর বলে উঠে না যান, তাহলে আপনাদের অন্ধকারে রাখার জন্য আমাকে ধন্যবাদ জানাবেন।

এবং একমত হবেন।

The Beauty of the House is immeasurable; its Kindness infinite.

এবং চোখে জল আসবে। আসবেই। কেউ রুখতে পারবে না।


Comments

  1. "ব্যোমকেশ নিয়ে আমার আর যা-ই বলার থাকুক না কেন, প্রসাদগুণে গল্পগুলো যে অত্যন্ত উতরেছে সে নিয়ে কোনও ব্যোমকেশ-ভক্তর সঙ্গে আমার কোনও যুদ্ধ নেই। ইন ফ্যাক্ট, তাঁরা মারতে আসতে পারেন জেনেও বলছি, ওই প্রসাদগুণের জন্যই ব্যোমকেশ উতরেছে, আর কোনও কারণে নয়।" eta sherlock holmes er jonyeo sotyi noy ki ?

    ReplyDelete
    Replies
    1. শার্লক হোমসের চরিত্রটাও ছিল। লেখা, লন্ডন আর গোয়েন্দা, তিনে মিলে প্লটের ফাঁকি চাপা দিয়েছে।

      Delete

Post a Comment