ছবির গল্প
আসল ছবিটায় আসা যাক। স্থানঃ খান মার্কেট। পাত্রপাত্রীঃ ইউজুয়াল সাসপেক্টস। খালি কালটা আনইউজুয়াল। ক্যালেন্ডারের হিসেবে নয়। ছবিটা তোলা আগের সপ্তাহে, যার মধ্যে আনইউজুয়াল কিছুই নেই। ঘড়ির হিসেবে আনইউজুয়াল। ছবিটা তোলা মাঝরাতের অনেকটা পরে।
অন্যান্য রাতে এতক্ষণে রিটায়ার করি। কপাল ভালো হলে ঘুমিয়ে পড়ি, পিকচার অফ মোডে টিভিতে সানডে সাসপেন্স চলে। কপাল খারাপ হলে ঘাপটি মেরে ঘুরে ঘুরে সোশ্যাল মিডিয়ার পাঁক ঘাঁটি। মোদ্দা কথা, রাস্তায় টহল দিয়ে বেড়াই না। বেড়াতে যেতে হলে রাতেবিরেতে বাড়ি থেকে বেরোনোটা আলাদা ব্যাপার, দিল্লিতে থেকে রাত জেগে টো টো লাস্ট কবে করেছি মনে নেই। অথচ রাত জেগে টো টো করতে শিখেছিলাম এই দিল্লিতেই। তার আগে আর্লি টু বেড, আর্লি টু রাইজ, মেক্স আ গার্ল শান্ত, বাধ্য অ্যান্ড ইজিয়ার টু সাইজ।
সেদিন একটা ইউনিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হল। বাড়ি থেকে প্লেন ধরার জন্য অর্চিষ্মানকে বেরোতে হত রাত তিনটেয়, মিটিংটিটিং সেরে ব্যাগট্যাগ গুছিয়েও দেখা গেল চারঘণ্টা হাতে। এই সময়টা ঘুমিয়ে পড়ে, ঘুম ভেঙে ওঠার পক্ষে যথেষ্ট নয়। যদি ঘুম না ভাঙে-র টেনশন তো আছেই। নরম্যালি বিছানায় চিৎপাত হয়ে হইচই দেখার অপশনই মাথায় আসত, সেদিন মনে হল অন্য কিছু করা যাক। আউটডোর কিছু।
এত রাতে কী খোলা থাকে? মুরথল মাথায় এসেছিল কিন্তু সে বড্ড দূর, গিয়ে ফিরে আসার সময় হবে না।
অবভিয়াস জায়গাগুলো অবভিয়াসলি বাদ। সে সব জায়গায় যাওয়ার উৎসাহ আমাদের বয়সোচিত বয়সেই ছিল না, এখন প্রশ্ন নেই। একদল বিলো পঁচিশের উদ্দাম, ঘর্মাক্ত নৃত্য, কণ্ঠার নিচে দশহাজার ওয়াট সাউন্ড সিস্টেমের ঢিকচিক ঢিকচিক, চালশে চশমায় সাইকেডেলিক ঝিকমিক ঝিকমিক, ইমপসিবল। তাই বলে আবার বাংলা সাহিবের পুণ্যপুকুরের ঢেউ গুনে রাত কাটানোর দিনও আসেনি (অন্তত সে রকমই আশা)। কাজেই আমাদের লাগবে একটা জগঝম্পহীন ক্যাফে/রেস্টোর্যান্ট, যা গভীর রাত পর্যন্ত খোলা থাকে।
দেখা গেল, দিল্লির জগঝম্পহীন, সারারাত খোলা থাকা রেস্টোর্যান্টের মধ্যে একটা কালকাজীতে। আলট্রাসোনোগ্রাফি করিয়ে, ছোলেভাটুরে খেয়ে ফেরার পথে যেটার সঙ্গে আমাদের দেখা হয় প্রতিবার।
এর থেকে সুবিধেজনক, আরামদায়ক, নিরাপদ অপশন আর হয় না। উবার ডাকতে হবে না। ফেরার সময় উবার না পাওয়ার (বা পেলেও আকাশচুম্বী সার্জ দেওয়ার) টেনশন হবে না। পাড়াময় হলদু ব্যারিকেড সেঁটে পুলিসকাকুরা টহল দিচ্ছেন, গলিতে ঢুকে হুলোটার মুখোমুখি পড়া ছাড়া বিপদের আশংকা শূন্য। গটগটিয়ে যাব, গটগটিয়ে আসব।
কিন্তু সুবিধেজনক, আরামদায়ক, নিরাপদ অপশন আমরা খুঁজছি না। আমাদের খোঁজা সীমিত নয় গভীর রাত পর্যন্ত খোলা থাকা, জগঝম্পহীন, অধার্মিক/অবুড়োটে বেড়াতে যাওয়ার জায়গায়। আসলে আমরা খুঁজছি গভীর রাত পর্যন্ত খোলা থাকা, জগঝম্পহীন, অধার্মিক/অবুড়োটে, হাঁটার নাগালের বাইরে, টাকা গচ্চা দিয়ে উবার ধরে যাওয়ার মতো দূর, ফেরার সময় সার্জওয়ালা চার্জ দিয়ে (যদি পাওয়া যায় আদৌ), সি আর পার্কের চতুর্দিকে ব্যারিকেড-তোলা রাস্তার হেনস্থা সয়ে অবশেষে ধুঁকতে ধুঁকতে বাড়ি পৌঁছনোর ছুতো।
প্রসেনজিৎকে দরজার ছিটকিনি না দিতে বলতে ভুলে গেলে ষোল কলা। মাঝরাতে বেল বাজিয়ে, চিল্লিয়ে, প্রতিবেশীদের শাপশাপান্ত কুড়িয়ে, অর্চিষ্মানের প্লেন মিস হয়ে যাওয়ার টেনশনে বাকি চুলগুলোও পাকিয়ে ফেলা যাবে। মচৎকার।
সুবিধেজনক, আরামদায়ক, নিরাপদ আমাদের কামনাবাসনার লিস্টে কোত্থাও নেই।
দুটো দোকান আমাদের লিস্টের সবক’টা ক্রাইটেরিয়া পূর্ণ করে। জৈন চাওলওয়ালে আর কাকে দা হোটেল। এই দুটো দোকান অবশ্য দিল্লির রেস্টোর্যান্ট-সংক্রান্ত সমস্ত ক্রাইটেরিয়া পূর্ণ করে। পিপল’স চয়েস, লিজেন্ডারি, আইকনিক, বাজেট, লেট নাইট, আউটডোর সিটিং/ স্ট্যান্ডিং। দুটোর একটাতেও খাইনি। দুটো দোকানই সিপিতে, দিনরাতের বিবিধ সময়ে যাতায়াতের পথে দেখেছি। সর্বদাই মাহেশের রথের মেলার ভিড়। কাকে দা হোটেলের ভিড়টা তবু বোধগম্য। রাত প'নে একটায় কিমা কলেজি-র রোখ চাপলে পকেটবন্ধু, ভরসাযোগ্য বিকল্প পাওয়া শক্ত। ভরসা আজকের নয়। সেই আটচল্লিশ সাল থেকে। (আসলে একত্রিশ সাল থেকেই, লাহোরের গলিতে, মাঝখানে রিলোকেশনের চক্করে এক বছর গ্যাপ ইয়ার হয়ে গেছে)। জৈন চাওলওয়ালের জনপ্রিয়তাটা কনফিউজিং। সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত একটা ঘুপচি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জনগণ রাজমাচাওল খাচ্ছে (যদিও জৈন চাওলওয়ালে-তে ছোলেভাটুরে জাতীয় অন্যান্য পদও পাওয়া যায়, ক্লায়েন্টেল মূলতঃ রাজমাচাওলের), ভাবা যায়? একবার খেয়ে দেখতে হবে কী মিস করছি।
অর্চিষ্মানকে অপশন দিলাম। কোনটায় যেতে চাও?
অর্চিষ্মান বলল, কোনওটাতেই না (ভাগ্যিস)। ও নাকি যেতে চায় একটা এসিওয়ালা দোকানে, যেখানে নিভুনিভু আলো, টুংটাং বাজনা, ভিড় নেই আবার শ্মশানের স্তব্ধতাও না, এন্টারটেনমেন্টের জন্য ক্রমাগত নিজেদের মুখে ফেনা তুলে যেতে হবে না, আশেপাশের লোকদের নিয়ে চর্চা করেই টাইমপাস হবে।
অগত্যা উবার ডেকে খান মার্কেট যাওয়া হল। অর্চিষ্মানের চাহিদামতো দোকান জুড়ে টিমটিম মোমবাতি, টুংটাং জ্যাজ। জ্যাজটা অবশ্য অর্চিষ্মান স্পেসিফাই করেনি। ওর দাবি ছিল স্রেফ একটা বাজনার, ভলিউম এবং লয় দুই দিক থেকেই যা মৃদু, যার সঙ্গে মেরে ফেললেও নাচা যায় না এবং সর্বোপরি লাইভ সংগীত নয়। দিল্লির দোকানে দোকানে লাইভের অত্যাচার দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। গাইয়েদের কোয়ালিটি আমার মতো। সিরিয়াস ইস্যু না থাকলে ও জিনিসের যেচে মুখোমুখি হয় না কেউ।
টেবিল খালি ছিল, তবু দোকানের প্রান্তে সারি সারি পিঠহীন টুলের দুটো বাছলাম। কারণ সামনের টানা জানালা দিয়ে মার্কেটের পেছনের গলি দেখা যায়। আর আমাদের উদ্দেশ্য দেখা। টুলগুলো দেখে যতটা শিরদাঁড়াঘাতী মনে হচ্ছিল ততটা নয়। টুলের সারির একদম ওই প্রান্তে একটা মেয়ে, বয়স বাইশের এক দিন বেশি না, একা একা খাচ্ছিল আর ফোন দেখছিল। অর্চিষ্মান বলল, মেয়েটা যেটা করছে, আমার কাছে সেটা আরামের শীর্ষ।
এদিকওদিক তাকিয়ে বললাম, একা মনে হয়। অর্চিষ্মান বলল, সেটাই তো আরাম। বললাম, তা ঠিক। কফি এল। চুমুক দিলাম। এত রাতে একা বাড়ি যাবে কী করে? অর্চিষ্মান বলল, গাড়িফাড়ি আছে। মেয়েটার পাস্তা অর্ধেক শেষ হল, বাকি অর্ধেক মেয়েটা প্যাক করাতে দিল। দিয়ে ভিডিও কলে হেসে হেসে কথা বলল। আবার দেখি কফি না কী অর্ডার দিল। প্রাণপণ কন্ট্রোল করতে চেয়েও আড়াই মিনিটের বেশি ও দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে রাখতে পারছি না। ঘনঘন কফিতে চুমুক দিয়ে ফেলছি। পাকামো মেরে মাকিয়াতো নিয়েছি, আর আধচুমুক পড়ে আছে কাপের তলায়। হাঁটু নাচাচ্ছি। ওরে, এবার বাড়ি গিয়ে ঘুমো, আর্লি টু রাইজ, আর্লি টু বেড, কিপ্স্ আ গার্ল হেলদি, ওয়েলদি অ্যান্ড সেফ। এমন সময় অর্চিষ্মান বলে উঠল, ওরে বাবা কুন্তলা, ছাড়ান দাও। এই মেয়ে এখন উবার ডেকে একা একা বাড়ি যাবে না, বিশ্বাস কর। একে নিয়ে যাওয়ার গাড়ি ডেফিনিটলি আছে।
জন্মে থেকে 'চোর পুলিস ডাকাত বাবু' আর 'কিলার' খেলছি, তবু কেন যে এখনও আমার মুখ দেখে মনের ভাব কেউ ধরতে না পারার আশায় আছি ভগবান জানে। ঝাড়াপাড়া দিয়ে মাইন্ড ওভার ম্যাটার করে অন্যান্য দৃশ্যাবলীতে মনোস্থাপন করলাম।
বাজার বন্ধ হচ্ছে। পার্কের রেলিংঘেঁষা পার্কিং থেকে তিনচারটে গাড়ি বেরিয়ে গেল। একটা ঢুকল। যারা নামল কিছুক্ষণ পর হাতে আইসক্রিম নিয়ে এসে আবার গাড়িতে উঠে চলে গেল। একটা একটা করে আলো নিভল। দোকানের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীরা ঝাঁপ ফেলে ডাণ্ডা দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শাটার ডাউন করতে লাগলেন। একজন গর্ভবতী মহিলা ফুটপাথ ধরে হেঁটে এসে আমাদের জানালার নিচে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
গর্ভবতী-র বিকল্প কী লেখা যায় নিয়ে তিরিশ সেকেন্ড ভাবলাম। অপছন্দ বা অস্বস্তিজনিত কারণে নয়। কারণ শব্দ ইজ শব্দ আর যে শব্দ অর্থ বা ধারণার সফল পরিবহন করতে পারে তাকে অপছন্দ করা বা তাতে অস্বস্তি রাখার মানে নেই। কিন্তু লাস্ট কবে গর্ভবতী শব্দটার মৌখিক ব্যবহার হতে শুনেছি মনে নেই। বাচ্চা যেমন হয়ে গেছে বেবি, ঝোল হয়ে গেছে গ্রেভি, তেমন গর্ভবতী প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছে। প্রেগন্যান্টেও আমার আপত্তি নেই, বাংলা লেখায় ইংরিজি শব্দ ব্যবহার নিয়ে তো নেইই। তবু অনেকক্ষণ ভাবলাম যে প্রেগন্যান্ট আর গর্ভবতী ছাড়া আর কোনও শব্দে একই অর্থ প্রকাশ করা যায় কি না। গেল না।
তারপর সমাপতন। আজ সকালেই মার্গারেট অ্যাটউডের একটা ছোটগল্প পড়ছিলাম, সেখানে দেখি প্রোট্যাগনিস্টের অবিকল এই সমস্যা। প্রোট্যাগনিস্ট হল একটি এগারো বছরের বালিকা, যে তার গর্ভবতী মায়ের দেখাশোনা করছে। এবং অনাগত সহোদরের জন্য একটি সোয়েটার বুনছে।
"I was knitting this layette because my mother was expecting. I avoided the word pregnant, as did others: pregnant was a blunt, bulgy, pendulous word, it weighed you down to think about it, whereas expecting suggested a dog with its ears pricked, listening briskly and with happy anticipation to an approaching footstep."
ভাবুন ইউনিভার্সের কামাল। যেটা নিয়ে ভাবছি, সেটার একটা প্রতিচ্ছবি আমার সামনে হাজির করেছে। বাংলায় এক্সপেক্টিং গোছের কোনও একটা শব্দ থাকলেই গল্পের বালিকার মতো আমার সমস্যার সমাধান হয়ে যেত।
যাই হোক, কথাটা হচ্ছে, বসে বসে এইসব দেখতে চমৎকার লাগছিল। ঠিক যেন নির্বাক সিনেমা। কারখানা ছুটি হওয়ার পর দলে দলে শ্রমিকদের বেরোনো, কিংবা ট্রেন এসে থামার পর স্টেশনের জ্যান্ত হয়ে ওঠা। সবই হচ্ছে সম্পূর্ণ নীরবতায়। বাইরে ঘটনাবলীর সঙ্গে সম্পূর্ণ সংযোগহীন একটা বাজনা বেজে চলেছে। আমাদের দোকানটা দোতলায়। দৃষ্টিপথের কোণাকুণি পাশের বিল্ডিং-এর দোতলায় ইয়াম ইয়াম চা-তে কয়েকজন মহিলা বসে খাচ্ছিলেন। একতলায় বিগ চিল-এর পেছনের দরজা বার বার খুলছিল, বন্ধ হচ্ছিল। অধিকাংশ খদ্দেরই বেরোলেন, একটা কি দুটো গ্রুপ ঢুকল। যে সিকিউরিটি ভাইসাব দরজা অপারেট করছিলেন, একটা টুলের কানায় বারবার শরীরের ভর দিচ্ছিলেন।
আমার একটা অসুখ হয়েছে। এই বাক্যটার দুটো শব্দ সমস্যাজনক ঠেকতে পারে। এক, এটা 'অসুখ' না। গলাবুকজ্বালা, উদরী, কর্কট যে সেন্সে অসুখ, সে সেন্সে এটা অসুখ না। দুই, যদি অসুখ হয়ও, অসুখটা 'আমার' না। সবারই। সেটা হচ্ছে কোনও একটা দুশ্চিন্তা ছাড়া না থাকতে পারা। আমার ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুশ্চিন্তাটা হয়ে যায় প্যানিক। যেমন বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনে হয় পাসপোর্টটা অনেকদিন দেখিনি (দেখিনি কারণ দেখার কারণ ঘটেনি। এ তো ফ্রিজ নয় আধঘণ্টা বাদে বাদে খুলে দেখব ভালো কিছু আছে নাকি। কখনওই থাকে না, বাই দ্য ওয়ে)। যেহেতু দেখিনি, আমার মাথা কনক্লুশনে পৌঁছয়, নিশ্চয় হারিয়ে গেছে। ব্যস, দশ মিনিটের জন্য গলা খটখট, জিভ খসখস, মাথা দপদপ, বুক ধুকপুক। বিশুদ্ধ, ওয়ার্ল্ড ক্লাস প্যানিক। সেদিন পুপুর সামনেও হল। দিব্যি চায়োস-এ বসে সুলেমানি লেমন টি-তে চুমুক দিতে দিতে প্রাণায়ামের উপকারিতা আলোচনা হচ্ছিল এমন সময় বাড়ির চাবিটা মাথায় ভুস করে উঠেই মিলিয়ে গেল। সব থামিয়ে পাগলের মতো ব্যাগ হাঁটকাতে হল। রিপিট টেলিকাস্ট সোয়া ঘণ্টা বাদে বাড়ি ফেরার পথে। শর্টকাট করতে পার্কের মধ্যে ঢুকেছি অমনি মনে হল চেক করতে দোকানে ব্যাগ থেকে চাবি বার করলাম, তারপর ঢুকিয়েছিলাম? পার্কে ঢোকার রিভলভিং গেটের খাঁচার ভেতর দাঁড়িয়ে আবার পরীক্ষা করতে হল। পুপু আপাদমস্তক ভদ্রলোক। কিচ্ছুটি না বলে স্মিত হেসে অপেক্ষা করল, তারপর চাবি পেয়ে হাঁটা শুরু করতে গলা আলতো ঝেড়ে বলল, তুমি প্রাণায়ামটা শুরু কর, বুঝলে কুন্তলাদি।
তেমনি, মেয়েটার বাড়ি ফেরার চিন্তা চলে গিয়ে আমার মাথায় ঢুকল বিগ চিল-এর সিকিউরিটি ভদ্রলোক কখন বাড়ি যাবেন। সহি লিবারেলের মতো আমি এসিতে বসে মাকিয়াতোতে চুমুক দিতে দিতে ওঁর এই রাতজাগা পরিশ্রম নিয়ে ফিল ব্যাড করতে লাগলাম। প্রিভিলেজঘটিত অপরাধবোধের অল্প আঁচে নিজেকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেঁকতে লাগলাম। অবশেষে দোকান বন্ধ হল। ভাইসাব উঠে টুল দোকানের ভেতরে ঢোকালেন। ওঁর সামনের পেডেস্টাল ফ্যানটা আনপ্লাগ করে, সেটাও। একটু আগেও ভদ্রলোকের সারা শরীরে কেমন একটা হালছাড়া শ্রান্তি, আর এখন এই টুল তোলা, ফ্যান গোছানোর সময় শ্রান্তির শ নেই, প্রতি মুভমেন্ট থেকে ফুর্তি উছলে পড়েছে। ছুটির কী মহিমা, আহা। গোটা জীবনটা ছুটি কেন হয় না।
ভদ্রলোক রাস্তা পার হয়ে এসে বি এম ডবলিউ আর অডি-র ফাঁকে পার্ক করা একটা সাইকেল বার করে সিটটিট থাবড়ে সেটাকে রাস্তার এ পাশে এনে স্ট্যান্ড করে রাখলেন। দোকানে ঢুকে গেলেন। বেরোনোর নামই করছেন না। মনে মনে ওঁর সাইকেলটা পাহারা দেওয়ার কাজ নিলাম। অর্চিষ্মানকে একবার বলেও ফেললাম, কাল কখন ওঁর শিফট শুরু হবে বলে তোমার ধারণা? এখনও বাড়ি না গেলে ঘুমোবেন কখন?
ভদ্রলোক বেরোলেন। সাইকেলের ক্যারিয়ারে একটা সাদা ব্যাগ গুঁজে আবার দৌড়ে ভেতরে চলে গেলেন। মনে হয় ভেতরে খাওয়াদাওয়া চলছে। মন দিয়ে ওঁর সাইকেল পাহারা দিতে লাগলাম। একটা চিমড়েমার্কা কুকুর এসে বিগ চিল-এর দরজার সামনের ফুটপাথটা ভালো করে শুঁকে, আড়াইখানা পাক খেয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুল। গর্ভবতী মহিলা দেখি আবার ফিরে আসছেন। দৈনিক পদক্ষেপের কোটা খান মার্কেট প্রদক্ষিণ করে সম্পূর্ণ করছেন মনে হয়।
তারপর কী সব যেন হল, পরিবেশক এসে বললেন, রান্নাঘর বন্ধ হচ্ছে, খাবার কিছু অর্ডার করতে চাইলে এই বেলা করে ফেলুন। আমরা তাকাতাকি করে আরেক কাপ করে কফি অর্ডার করলাম। মাকিয়াতো অনেকক্ষণ শেষ। এবার বুদ্ধি করে এক গামলা ক্যাপুচিনো অর্ডার করলাম। অর্চিষ্মানও যেন কী সব বলল। এই সব সেরে সবে ফোনটার দিকে দেখছি, গত তেত্রিশ ঘণ্টায় যে একটাও মেল করেনি কেউ, আধখানাও পিং করেনি, কোনও নোটিফিকেশন এসে অপেক্ষা করছে না সেটা তেত্রিশকোটিতম বার চেক করছি, অর্চিষ্মান বলল, এই গেল, গেল, গেল...
চোখ তুললাম। শুধু সাইকেলের ক্যারিয়ারে সাঁটা এক ঝলক সাদা দৃষ্টির বাইরে বেরিয়ে গেল। চিমড়ে কুকুরটা কান খাড়া করে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে। টা টা করছে বোধহয়। রিফ্লেক্সে ঘাড় ঘোরালাম। কোণার টুলটাও ফাঁকা। মেয়েটা বেরিয়ে গেছে কখন।
কফি শেষ করে আমরাও বেরিয়ে পড়লাম। বাহরিসন্স-এর বন্ধ দরজার সামনে একটা ছেলে গিটার নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান গাইছে। ঢোকার সময়েও গাইছিল। এই সব আগে চোখে পড়ত না, দিনকে দিন কমন হচ্ছে। সে হবি হ’, গান গাওয়ার মধ্যে দোষের কিছু নেই। এখন দেখি একজোড়া হাফ-হিপি সামনে মাদুরজাতীয় কী সব পেতে বসে গলা ছেড়ে ধুয়ো ধরেছে। অর্চিষ্মান বলল, তুমি করতে নাকি এ রকম? রাস্তায় কাউকে গান গাইতে দেখলে দাঁড়িয়ে গলা মেলাতে?
বললাম, আমি কেন করব? তুমি করতে নির্ঘাত। না হলে এ জিনিস মাথায় আসা সম্ভব না।
উবার এসে গেল পাঁচমিনিটের মধ্যে। খাঁ খাঁ রাস্তায় এইটিন মিনিটস টু রিচ ডেসটিনেশন। ভাইসাব অলকনন্দার লোক, কোন গেট খোলা কোন গেট বন্ধ মুখস্থ। বাড়ির সামনে নামিয়ে দিলেন, নুয়ে পড়ে থ্যাংক ইউ বললাম। গেটের কোণা, পাঁচিলের ছায়া চেক করলাম। হুলোটা ঘুমিয়ে পড়েছে মনে হয়। প্রসেনজিৎকেও মেসেজ করে দিয়েছিল অর্চিষ্মান মনে করে। দরজা খোলা ছিল।
কি সুন্দর লিখেছ!
ReplyDeleteমাঝরাতে দিল্লিতে বেরোনোর কথা ভাবলেই আমার বুক ধুকপুক, পেট গুড়গুড়, মাথায় ভেসে ওঠা হাজার খারাপ হেডলাইনের ভিড়। তোমরা যে সাহস করে বেরিয়ে কত কি সুন্দর দেখে এলে, এতে আমি যারপরনাই ইমপ্রেসড।
থ্যাংক ইউ, বিম্ববতী। একা হলে আমিও হয়তো বেরোতাম না। দোকা থাকায় একটুও ভয় করেনি।
DeleteRestaurant ba je kono adda marar jaiga niye amio ekmot. music-er chot-e ulto dik-er lok jodi kotha shunte na pelo, tahole keno shekhane keu jete paare, ami aaj-o bujhlam na.
ReplyDeleteKhan market-er late night-er chhobi ta besh chokh-er shamne bheshe uthlo. raat hole praye shob jaigakei khub sundor laagey.
achha golite dhukle hulota ki bhortshona aar judgmenet meshano ekta drishti niye takaye?
Expecting-er bangla ki santan shombhaba?
সন্তানসম্ভবা শব্দটা মাথা থেকে বেরিয়ে গেল কেন নেক্সট পাঁচশোটা প্যানিক অ্যাটাক আমার সেই নিয়ে হবে। থ্যাংকস বাট নট থ্যাংকস।
Delete"raat hole praye shob jaigakei khub sundor laagey." রবীন্দ্রনাথ এই জন্যই বলে গেছেন, দিন হল নরলোকের, রাত সুরলোকের।
হুলোটা তাকায়ই না। আমরা অত গুরুত্বপূর্ণ না ওর কাছে। আমার অগুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকা অভ্যেস আছে কিন্তু অর্চিষ্মান ঘাড়ের ওপর গিয়ে হেই হুই করে অ্যাটেনশন চাইবে। তখন হুলোটা নিজের কাজ না থামিয়ে, অর্থাৎ পাঁচিলের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বা চিৎপাত হয়ে শুয়ে শুয়ে ম্যাও ম্যাও করে সাড়া দেবে। এইরকম ব্যাপারস্যাপার।
আরো একটা গ্রাম্য শব্দ আছে- পোয়াতি|
ReplyDeleteঅর্চিষ্মানের "ওরে বাবা কুন্তলা" পড়ে ভালো লাগলো| তোমার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আর বর্ণনা খুব খুব ভালো!
ঠিক যা যা মনে হল, আপনার সাজেস্টেড শব্দটা পড়ে, বলি, অমিতা। প্রথমে ভাবলাম, হ্যাঁ, গ্রাম্য বটে। এ রকম আরও কয়েকটা গ্রাম্য এক্সপ্রেশন আমার মাথাতেও এসেছিল, ছোটবেলায় এক্সটেন্ডেড পরিবারে শুনেছি। সেগুলো লিখে দেওয়ার মতো স্মার্ট লেখক হতে পারিনি এখনও, পারলে লিখে দিতাম। এবং পারা উচিত।
Deleteপোয়াতি শব্দটা, অন দা আদার হ্যান্ড, একটু ভাবলে, চমৎকার। ছোট। যুক্তাক্ষরবর্জিত। কনফিউশনের বাষ্পমাত্র নেই। দেখা, শোনা, পড়ামাত্র সবাই বুঝতে পারবে কী বোঝানো হচ্ছে। তারপর মনে হল, পোয়াতি মহিলা খানমার্কেট পাক দিচ্ছেন এটা একটু বেখাপ্পা লাগবে কিনা, পরক্ষণেই রিয়েলাইজ করলাম, পাক দেওয়া বা প্রদক্ষিণ দুটো শব্দের সঙ্গেই পোয়াতি, আদ্যক্ষরজনিত আত্মীয়তার কারণে চমৎকার খাপ খাবে। একজন পোয়াতি মহিলা খানমার্কেট প্রদক্ষিণ করছেন, এই বাক্যটি একজন গর্ভবতী বা (অপর্ণের কাছে মাপ চেয়েই) সন্তানসম্ভবা মহিলা খানমার্কেট প্রদক্ষিণ করছেন বাক্যের থেকে এককোটিগুণ ডিরেক্ট, ভ্যানতাড়াহীন এবং আমার মতে, প্রসাদগুণসম্পন্ন।
শব্দটার মহিমা উপলব্ধি করানোর জন্য থ্যাংক ইউ। পরবর্তী সুযোগ পাওয়ামাত্র ব্যবহার করব।
আপনার একলাইন সাজেশনের জবাবে আমার উত্তরের বহর দেখেও অর্চিষ্মান শিওর "ওরে বাবা" বলবে। কিছু করার নেই।
টুলে বসা মেয়েটার কথা যখন বলতে শুরু করেছিলেন মনে হচ্ছিল যেন কোনো দারুন গল্পের শুরু।
ReplyDeleteআগের বাক্যটা লেখার পর অনেক্ষন ভাবলাম, ওই সিকিউরিটি ভদ্রলোককে নিয়েও তো আপনি একই ভাবে বর্ণনা করেছেন - সেটার ক্ষেত্রে instinctively এই ভাবনা মাথায় আসেনি কেন? তারপর বুঝলাম যে ওনার বেপারটা একটু বেশি চেনা, একটু বেশি সাধারণ, বোঝা যায়, তাই। (আর এখন ওনার পরিস্থিতিটা এইভাবে একটু 'ছোট' করে দেবার পর একটু গিল্টি ফীল হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু হোকগে!)
কখনো কখনো সুযোগ হলে, এরম কোনো কোনো মানুষকে দেখে দারুন সময় কাটানো যায়।
রাজর্ষি, উত্তর দিতে দেরি হল। আপনি ঠিক বলেছেন, লোক দেখে সময় কাটাতে যে কী ভালো লাগে। বিশেষ করে সে লোক যখন এই গোটা ব্যাপারটা সম্পর্কে অবলিভিয়াস থাকেন। যেন সিনেমা দেখছি। বানানো সিনেমা না, সত্যি সিনেমা।
Deleteগিল্টি ফিল করবেন না। সব গল্প সবার পছন্দ হয় না। ভালোলাগার ভালোমন্দ বেছে চলতে হয় জীবনে ঠিকই, কিন্তু গল্পের ভালোলাগাটা তার মধ্যে পড়বে না। আর হয়তো মেয়েটার গল্পটা বেশি ইন্টারেস্টিং, কে বলতে পারে। আমি জানি আপনি এ সব কথাই জানেন, তবু বলছি।
সেই রাতটা সত্যি খুব ভালো কেটেছিল।