চালচিত্র এখন


হ্যাবিটাট ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অর্চিষ্মান কয়েকটা সিনেমা দেখেছে; তাদের মধ্যে একটা তিন্নির সম্পাদনা করা অসমিয়া সিনেমা। সিনেমার উদ্দেশ্য: উত্তরপূর্ব ভারতে সমাজব্যবস্থার "মাতৃতান্ত্রিকতা" নিয়ে আমাদের মনে যে ওয়ার্ম ফাজি ফিলিংটা আছে সেটা ধ্বসিয়ে দেওয়া। সিনেমাটা ভালো লেগেছে অর্চিষ্মানের। সিনেমার থেকেও ইন্টারেস্টিং লেগেছে সিনেমার পর পরিচালকের সঙ্গে কথোপকথন। পরিচালক নাকি বলেছিলেন যে সিনেমা যে গ্রামে শুট হয়েছে সে গ্রামে পরিচালকের চেনা এক মহিলা মিলিটারি দ্বারা গণধর্ষিত হয়েছিলেন। ধর্ষণের পর তিনি গর্ভবতী হন এবং গর্ভপাত করানোর সিদ্ধান্ত নেন। ক্লিনিকের পথে মহিলার বোন ভগবানের দান ইত্যাদি বলে মহিলাকে সন্তানটি রাখতে রাজি করান। ছেলে হয়। ওই তল্লাটের মানুষদের সম্পূর্ণ বেমানান চেহারায়। ছেলেটি বুলি হতে শুরু করে। স্কুলে, পাড়ায়, সমাজে। সমাজ থেকে বাতিল হতে হতে অবশেষে সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়।

অর্চিষ্মানের নাকি পরিচালককে বলতে ইচ্ছে করছিল, এই গল্পটা কেন বললেন না আপনি? তাহলে কি ইমপ্যাক্টটা আরও বেশি হত না?

অফ কোর্স, পরিচালক কোন গল্প বলবেন না বলবেন সেটা সম্পূর্ণ তাঁর সিদ্ধান্ত। বৃহৎপরিসরে, নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা গল্প যে এফেক্টিভ হবে না সে রকমটাও নিশ্চয় নয়। কিন্তু অর্চিষ্মানের সঙ্গে আমি একমত; সাধারণতঃ যে কোনও শিল্পের বক্তব্য বা থিম, ক্যারেকটারের ঘাড়ে ভর দিয়ে অনেক সহজে দর্শক/পাঠক/শ্রোতার কাছে পৌঁছয়। মাধবীলতা না থাকলে বাঙালি যুবকদের কাছে নকশাল আন্দোলন এতদিন ধরে শিল্পের উৎস হতে পারত? মন্দার বোস না থাকলে বাঙালি মেয়েরা এতদিন ধরে সাড়ে পাঁচ ফুটের কম ছেলেদের সন্দেহের চোখে দেখত?

‘চালচিত্র এখন’ যে সব কারণে ইদানীংকালের আমার দেখা শ্রেষ্ঠ বাংলা “বায়োপিক” তো বটেই, একটা বাংলা সিনেমাও, তার মুখ্য কারণ গল্প বাছায় অঞ্জন দত্তের বিচক্ষণতা। 'চালচিত্র এখন'-কে তিনি বায়োপিক হিসেবে ট্রিট করেননি। মৃণাল সেনের সতেরশো ইন্টারভিউ ঘেঁটে, পনেরোশো প্রবন্ধ পড়ে, এর ওর মুখে ঝাল খাওয়া অ্যানেকডোট এনে সিনেমায় গোঁজেননি। ইদানীং কালে আমার দেখা অধিকাংশ বাংলা বায়োপিক যে ঝামেলাটা পাকিয়েছে এবং বসে দেখার অযোগ্য প্রতিভাত হয়েছে।

'চালচিত্র এখন' উনিশশো একাশি সালে মুক্তি পাওয়া মৃণাল সেন পরিচালিত 'চালচিত্র' সিনেমাটার শুটিং-এর সময়টুকু নিয়ে বানানো। একটা ছাব্বিশ বছরের অ্যাংলিসাইজড ছেলে, কলকাতাকে যার অসহ্য লাগে, সেই ছেলেটার সঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত পরিচালক কুণাল সেনের দেখা হওয়া এবং দেখা হওয়ার পরবর্তী সময়খণ্ড নিয়ে। সিনেমায় অঞ্জন দত্ত হয়েছেন রঞ্জন দত্ত (শাওন চক্রবর্তী), মৃণাল সেন হয়েছেন কুণাল সেন (অঞ্জন দত্ত), গীতা সেন হয়েছেন মিতা সেন (বিদীপ্তা চক্রবর্তী)।

ঠিক গল্প বলার মতোই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত (অনেকের মতো আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ) হচ্ছে গল্পটা ঠিক লোকের মুখ দিয়ে বলানো। ভাবুন তো। নাইনটিন এইটিফোর যদি বিগ ব্রাদারের পি ও ভি থেকে বলা হত? হ্যারি পটার ডাম্বলডোরের বয়ানে? নষ্টনীড়ের কেন্দ্রে যদি অমল থাকত? ব্রেকিং ব্যাড-এর হিরো যদি একজন পুলিস হতেন যিনি ওয়াল্টার হোয়াইট কে ধরতে আকাশপাতাল এক করে ফেলছেন?

অঞ্জন দত্তের মাস্টারস্ট্রোক হচ্ছে 'চালচিত্র এখন' রঞ্জনের পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে বলা। সিনেমাটা যদিও মৃণাল সেনের প্রতি ট্রিবিউট, ‘চালচিত্র এখন’ মৃণাল সেনের নয়, রঞ্জন দত্তের গল্প। গল্পের হিরো'স জার্নি রঞ্জনের। চালচিত্র এখন-এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কুণাল সেনের চরিত্রের কোনও ওঠানামা, আগুপিছু হয় না। হয় রঞ্জন দত্তের।

নিজের হিরোহিরোইনের ছাঁদ নিজের ছাঁদে ঢালা নভিস শিল্পীদের একটা প্রধান লক্ষক বলেন অনেকে। অন্য মতও আছে। অঞ্জন দত্ত একজায়গায় বলছিলেন যে ওঁর গানে, সিনেমায় বার বার ব্যক্তিগত জীবনের কথা এসেছে। সেটা সবসময় সুবিধের হয়েছে তা নয়। কাছের মানুষরা, যারা সে সব সৃষ্টিতে নিজেদের আনন্দ শোক যন্ত্রণাকে চিনতে পেরেছেন, তাঁদের অস্বস্তি হয়েছে। সেটা অঞ্জন দত্তকেও স্বস্তি দেয়নি। অপর্ণা সেন নাকি 'যুগান্ত' সিনেমা শুটিং-এর সময় অঞ্জন দত্তকে বলেছিলেন ব্যক্তিগত জীবনকে বাদ দেওয়ার জন্য প্রাণপাত করিস না। ওটা অসম্ভব। নিজের ছোঁয়া বাঁচিয়ে কিছু করতে গেলে ফাঁক পড়বে। নিজে নিজের সৃষ্টির মধ্যে যত থাকবি তত কাজ রিয়েল হবে। অথেনটিক হবে।

রঞ্জনের পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে গল্পটা বলার সিদ্ধান্ত একটা গোষ্পদে ডুবতে পারত। তোপসেকে দিয়ে ফেলুদার গল্প বলা হয়ে যেতে পারত। অজিতকে দিয়ে ব্যোমকেশ। অর্থাৎ গল্প পুজোয় পর্যবসিত হতে পারত। সেটা 'চালচিত্র এখন'-এ একদম নেই। একদম না। অঞ্জন দত্ত বারবার বলেছেন মৃণাল সেন বলতে আমি একটা ছটফটে, কেওটিক, ইররেসপনসিবল লোককে চিনেছি এবং সেই লোকটাকে বাঙালি দর্শককে চেনাতেও চেয়েছি। মৃণাল সেনের সিনেমা দেখলে পরিচালক সম্পর্কে যে ধারণাটা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, ভদ্রলোক বাস্তবে যে এক্কেবারে সে রকম ছিলেন না ‘বন্ধু’ পড়ে টের পেয়েছিলাম। ‘চালচিত্র এখন’ কনফার্ম করল। বিশ্ববরেণ্য পরিচালক বলছেন স্ক্রিপ্ট লাগবে কীসে, ও হয়ে যাবে। সহকারী অন্য লোকেশনে ট্রামের দায়িত্ব নিয়ে বসে আছেন, মৃণাল সেনের এখানে শুটিং সেরে ওখানে পৌঁছনোর কথা, পৌঁছননি। তাঁর অভিনেতারা স্ক্রিপ্ট পেলেও পড়েন না কারণ দাদা এসে তো ডায়লগ বদলেই দেবেন, কী লাভ পড়ে। ‘বন্ধু’ পড়ে মৃণাল সেনের চরিত্রের মায়া এবং স্নেহ সম্পর্কে জেনেছিলাম। ব্যক্তিগত সম্পর্কস্থাপনের জন্য যে গুণগুলো মারাত্মক কাজে লাগে। 'চালচিত্র এখন'-এও দেখলাম। যে ভদ্রলোক একটু আগে মৃণাল সেনকে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্য চিৎকার করে বকছিলেন তিনি এসে ভাতভর্তি মুখে ওষুধ পুরে দেন।

শুটিং চলে। সিনেমা এগোয়। রঞ্জন বদলায়। মাথায় তেল মেখে শুটিং-এ আসতে আসতে, বকুনি খেতে খেতে, কমিউনিজমের কাছে ঘাড় না পাততে পাততে। রঞ্জনের দৃষ্টি বদলায়। রঞ্জন ওর আশপাশের মানুষদের দেখতে পায় যারা ওর মতো নয়। যারা জীবনে দার্জিলিং যায়নি, জার্মানি যাওয়ার কল্পনাও যাদের নেই, ছোটস্য ছোট রোলে অভিনয় করার জন্য মুর্শিদাবাদ থেকে ট্রেনে চেপে কলকাতা এসে যারা স্টুডিয়োতে স্টুডিয়োতে ঘোরাঘুরি করে। রঞ্জনের এ সমস্ত বদল ঘটে বিরাট গাছের মতো এক ব্যক্তিত্বের ছায়ায়।

মৃণাল সেনের কাছের মানুষরা, মৃণাল সেনের সঙ্গে কাজ করা মানুষরাও চালচিত্র এখন-এ এসেছেন। গীতা সেন, অনুপকুমার, উৎপল দত্ত। দীর্ঘদিনের সহকারী কে কে মহাজন। মহাজনের সঙ্গে রঞ্জনের একটা দৃশ্য মনে থাকবে। রঞ্জনকে চেপে ধরে মদ খেতে বসিয়ে মহাজন জিজ্ঞাসা করছেন, কুণালদা তো বারবার বলছেন অভিনেতা হিসেবে রঞ্জন ফ্যান্টাস্টিক তবুও রঞ্জনের অস্বস্তি যাচ্ছে না কেন?

রঞ্জন মাথা নিচু করে বলছে, আই অ্যাম নট গুড লুকিং।

হায় রে। অরিজিন্যাল 'চালচিত্র' ছবিতে কলকাতার রাস্তায় হাত তুলে "ট্যাক্সি ট্যাক্সি" বলে ছোটাছূটি করা, ধপধপে পাজামাপাঞ্জাবী পরা যে ছেলেটাকে দেখে হাঁ হয়ে গিয়েছিলাম, অঞ্জন দত্ত এ রকম ছিল? এ ছেলের সামনে পড়লে তো বাঁচতাম না। সেই তীরের মতো ছেলেরও মনে মনে দুঃখ যে সে ভালো দেখতে নয়? আমি তো ভেবেছিলাম সারা পৃথিবীতে এ দুঃখ কেবল একলা আমার। জীবনটা যে কেকওয়াক হতে হতে হল না তার জন্য দায়ী কেবল এই থোবড়া। রঞ্জনের দুঃখের সঙ্গে নিজের দুঃখের এমন মিল দেখে হাসি কান্না একই সঙ্গে পেয়ে যায়।

অঞ্জন দত্তের অন্যান্য সিনেমাতেও থাকে, চালচিত্র এখন-এও আছে, রসবোধের উপস্থিতি। কুণাল সেন যখন রঞ্জনকে অ্যাল পাচিনোর কথা তুলে তুলে ধমকাচ্ছেন - অ্যাল পাচিনো এ রকম ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদে? অ্যাল পাচিনো এ রকম ক্যাবলার মতো রাস্তা পেরোয়? গাড়ি কি তোমার ওপর দিয়ে চলে যেত? ডায়লগগুলো বলার সময় কুণাল সেন হাসছেন না, রঞ্জন তো হাসছেই না, ব্যাকগ্রাউন্ডে হাস্যকর মিউজিক বাজিয়ে দর্শককে হাসির কিউ দেওয়ার কথা তো ছেড়েই দিলাম। এটা সেই ধরনের রসবোধ যা লেখকের স্বাভাবিক রসবোধের প্রমাণ হিসেবে বেরিয়ে আসে। চাপা দেওয়া যায় না বলেই।

নীল দত্ত সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, রঞ্জন যে পরে বাংলার একজন সাংগীতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠবে, তার ভিত তৈরির জন্য গান রাখার সিদ্ধান্ত। না হলে এ সিনেমায় গান থাকে না। আমার মনে হয়েছে না থাকলেই ভালো হত। গানগুলো আমাকে সিনেমাটা থেকে ছিঁড়ে বার করে আনছিল। সিনেমা শেষের পর নাম দেখানোর সময় অঞ্জন দত্তের গলায় ইংরিজি গানটা আমার ভালো লেগেছে।

পিরিয়ড পিস নিয়েও কথা উঠেছে। রঞ্জন রাস্তা পেরোচ্ছে আর শোঁ করে ইনোভা চলে যাচ্ছে এটা কীভাবে হজম করবে দর্শক। অঞ্জন দত্ত বলেছেন ওঁরা ও সব নিয়ে চিন্তা করেননি। ঠিকই করেছেন। উনিশশো আশির কলকাতা আঁতিপাঁতি তুলে আনতে ভাড়া করা ভিনটেজ অ্যামবাসাডর ছোটালাম এদিকে এদিকে চরিত্ররা সবাই পাড়ার মাঠে ছাব্বিশে জানুয়ারির গো অ্যাজ ইউ লাইক, ও ধ্যাষ্টামো অনেক হয়েছে।

'চালচিত্র এখন' মৃণাল সেনকে দেওয়া ট্রিবিউট, 'চালচিত্র এখন'-এর হিরো রঞ্জন দত্ত। কিন্তু 'চালচিত্র এখন'-এর একমেবাদ্বিতীয়ম স্টার অঞ্জন দত্ত। উনি স্ক্রিনে থাকাকালীন অন্য কারও দিকে তাকানো অসম্ভব।

শেষ সিনে সিনেমার শুটিং শেষ হয়। ছাদে দাঁড়িয়ে এ কথা সে কথা, তাত্ত্বিক রাজনৈতিক তর্কাতর্কির পর কুণাল সেন, এতদিন খেয়ে যাও বলার পর রঞ্জনের অজুহাতের উত্তরে যেমন জিজ্ঞাসা করে উঠেছেন, সত্যি? সত্যি কেউ বাড়িতে অপেক্ষা করবে? সেই কুণাল সেন, আনমনা, অগোছালো, আবারও রঞ্জনের নাড়িতে নির্ভুল হাত রাখেন। আসল কথাটা বলছ না কেন বল দেখি?

রঞ্জনের শেষ বর্মটুকু খসে পড়ে। অ্যাল পাচিনোর মতো নয়, ছাব্বিশ বছরের একটা রোগা বাঙালি ছেলের মতো ভ্যাঁ করে কেঁদে রঞ্জন দৌড়ে ছাদ পেরিয়ে কুণাল সেনকে জড়িয়ে ধরে। আসল কথা গড়গড় করে বেরিয়ে আসে চোখের জলের সঙ্গে। ওইটুকু ছেলের বুকের মতো কত জমাট বাঁধা ভয়, কী করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না, দুটো মানুষ জীবনে জড়িয়ে গেছে, সবকিছুর থেকে বার্লিন বাঁচাবে এমন একটা আশা টিমটিম করছিল বুকের ভেতর এখন বুঝতে পারছে যে বার্লিনটাও আসলে ইচ্ছে করছে না। এতরকম বুকধুকপুক থেকে এই ক’টা দিন গাছের মতো যে মানুষটা তাকে আড়াল করে রেখেছিলেন তাঁর ছায়া সরে যাওয়ার ভয়ে রঞ্জন কাঁদে।

আমিও টিভির এ পাশে বসে কাঁদি। হাসিও। কারণ রঞ্জন এখনও জানে না, আমি জানি। ছাব্বিশ আসলে শৈশব। এখনও কত বাঁক নেবে জীবন, কত খাতে বইবে। কত অনুভূতির স্রোত বইবে, শুকোবে। কত বিশ্বাস গড়বে, ভাঙবে। ছাব্বিশ বছরের কুন্তলার কথা মনে পড়ে। ল্যাং খেয়ে চোখ মুছে যে বলছে ধুস এ বয়সে আর প্রেম হবে না। যাঁর ডাইনিং টেবিলে বসে বলছে সেই ছেচল্লিশ বছরের প্রফেসর পেট চেপে ধরে হাসছেন। হাসতে হাসতে তাঁর দম আটকে যাচ্ছে, চোখে জল এসে যাচ্ছে।

শুধু প্রেমভালোবাসা নয়। ছাব্বিশ বছর বয়সে জীবনের যে ইস্যুগুলো গভীর ও গম্ভীর মনে হচ্ছিল সেগুলো এখন মনেও করতে পারি না ভালো করে। সেগুলোকে নিয়ে ভেবে ভেবে চুল পাকানো ত্বরান্বিত করেছিলাম সেটা মনে আছে। অঞ্জন দত্ত আরেকটা ইন্টারভিউতে বলছিলেন সেই অঞ্জন কিন্তু এই অঞ্জন নয়। বলে নিজের দিকে দেখিয়েছিলেন। সেই কুন্তলাও এই কুন্তলা নয়। এই রঞ্জনও উবে গিয়ে অন্য এক রঞ্জন আসবে। কিন্তু এই রঞ্জন সে কথা জানে না। এই রঞ্জন ওই গানটা শোনেনি। সময় দেখবি সব খাঁচা খুলে দেয়, তারগুলো কেটে দেয় অদৃশ্য ছুরি।

শুনলেও বা কী? আমি তো কোটিবার গানটা শুনেছি। কিছু লাভ হয়েছে কি?

কেউ বলতে পারে একটা সিনেমার প্রতিক্রিয়ায় এত ব্যক্তিগত কথা কেন? ইটস নট অ্যাবাউট ইউ। অঞ্জন দত্ত একজন স্রষ্টা হিসেবে সেখানেই বাজিমাত করেন যেখানে রঞ্জন আমি হয়ে যায়। আমি রঞ্জন। অস্তিত্বের সমস্ত তন্তু দিয়ে আমি রঞ্জনের দুশ্চিন্তা, ভয়, দিশাহীনতা অনুভব করতে পারি। ছাব্বিশের রঞ্জনের মতো সেই একই ভয় একই অনিশ্চয়তায় কি আমার এই তেতাল্লিশের পালছেঁড়া নৌকোও দুলছে না? ছাব্বিশ অতীত হয়ে গেছে। তেতাল্লিশও কি যায়? বড় দেরি কি হয়ে যায়নি?

শেষ দৃশ্যে কুণাল সেনরূপী অঞ্জন দত্ত লম্বা লম্বা পা ফেলে গলি পেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান। অঞ্জন দত্তরূপী শাওন তাঁর পেছনে দৌড়তে শুরু করে। চোখের কোণে আঙুল বুলিয়ে অর্চিষ্মান বলে ওঠে, আহ্‌ কী সুন্দর ট্রিবিউট। শাওনের মতো আমার বুকের ভেতরেও যে কত কিছু দৌড়ে যায়। সময়, যৌবন। অঞ্জন দত্তর সৃষ্টিতে যৌবনের চলে যাওয়া বারবার এসেছে। হেমন্ত সিনেমায় গায়ত্রী সেন কেঁদে উঠেছেন, আই লস্ট মাই ইউথ। ম্যাডলি বাঙালির অন্তে বেনজি ভয়েস ওভারে বলেছে, একটাই আফসোস, বয়সটা বেড়ে গেল। ফেসবুকে মৃণাল সেনের জন্মদিনে অঞ্জন দত্তের লেখা পোস্ট পড়াল তিন্নি। তার একটা বাক্য - আই অ্যাম সেভেন্টি ওয়ান নাউ। বিস্ময়চিহ্ন না থাকলেও বাক্যটার প্রতিটি বিন্দুতে কি বিস্ময়, অবিশ্বাস মাখামাখি হয়ে নেই? ছাব্বিশের যে ছেলের সঙ্গে মৃণাল সেনের প্রথম দেখা হয়েছিল সে এখন সেভেনটি ওয়ান? অঞ্জন দত্ত এই বিস্ময় বানিয়ে লেখেন না। তাঁর এই আফসোসের কোনও মুখোশ নেই।

সিনেমা শেষের পর পর্দায় ফুটে ওঠে - কুণাল সেন ইজ মৃণাল সেন। হি চেঞ্জড মেনি লাইভস। হি চেঞ্জড ইন্ডিয়ান সিনেমা। 'চালচিত্র এখন', মেনি লাইভস ও না, ওয়ান লাইফ, জাস্ট একটি জীবন বদলে দেওয়ার গল্প।

'চালচিত্র এখন' আমি আবার দেখব। আপনারাও দেখুন। কলকাতার কয়েকটা হলে চলছে বোধহয় এখনও। হলে গিয়ে দেখুন। না হয় হইচইতে দেখুন। সিনেমাটা দেখার পর যদি আপনাদের কারও নিজস্ব পুরুষটিকে সাদা পাঞ্জাবীপাজামাতে দেখতে ইচ্ছে করে, অগ্রিম হাই ফাইভ রইল।

Comments

  1. ঠিক করলাম, সিনেমাটা দেখব না। এই লেখার মধ্যে এতখানি কল্পনা আর অনুভবের পরিসর, ছবি দেখে তাকে আমি হারাতে চাই না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এইটা এক্কেবারে করবেন না। আমার অনুরোধ। লেখাটা আপনার এত ভালো লেগেছে জেনে আমি সত্যি সত্যি মুগ্ধ, অভিভূত, কৃতজ্ঞ, কিন্তু গ্যারান্টি দিচ্ছি, সিনেমাটা এই লেখার থেকে এক কোটিগুণ ভালো। তবেই বুঝুন। অবিলম্বে দেখে ফেলুন।

      Delete
  2. অরিজিন্যাল 'চালচিত্র' ছবিতে কলকাতার রাস্তায় হাত তুলে "ট্যাক্সি ট্যাক্সি" বলে ছোটাছূটি করা, ধপধপে পাজামাপাঞ্জাবী পরা যে ছেলেটাকে দেখে হাঁ হয়ে গিয়েছিলাম, অঞ্জন দত্ত এ রকম ছিল? Every young person have this insecurity, often more for those who are very good looking. দারুন লিখেছেন

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ।

      দুটো পয়েন্টেই আপনি নির্ভুল। আমার রূপসী বান্ধবীরা যারা বারো বছর বয়স থেকে লাল রঙের হিরো সাইকেলের পেছনে অনুরাগী সাইকেলের ঝাঁক, হ্যালি'জ কমেটের ল্যাজের মতো নিয়ে ঘুরত তারও নাকি নিজের নাকটা খুউউউব খারাপ লাগত।

      ইউথের সঙ্গেও এ অনুভূতির সম্পর্ক নিবিড়। আমার নাক তো বদলায়নি কিন্তু তখন নাক নিয়ে যে অদৃশ্য অ্যাপোলজিটা ঘাড়ে নিয়ে বেড়াতাম এখন আর বেড়াই না। কারও আমার নাক দৃশ্যদূষণ মনে হলে তাকে "আমারও এক্স্যাক্টলি এটাই মনে হয়!!!!" বলে হাই ফাইভ দিতে পারি, ব্যস।

      Delete
  3. "চালচিত্র এখন" দেখছি হৈচৈতে এসে গেছে। দেখবো। হৈচৈতে নতুন সিনেমা এতো দেরিতে দেরিতে আসে, যে চেক করতে গাফিলতি হয়ে যায় আজকাল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এটা শুরু থেকেই হইচইতেই রিলিজ করেছিল, রাজর্ষি। মৃণাল সেনের প্রতি ট্রিবিউট বলে দুয়েকটা সিংগল স্ক্রিনে (নন্দন, প্রিয়া) রিলিজ করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দত্তরা। কেমন লাগল জানাবেন।

      Delete
  4. Cinemata dekhechhi Kuntala. Apnar sange sahomot protikhetrei. Khub bhalo legechhe. Boro porday dekhte parini bole afsos aachhe, kintu abar dekhbo. Hoyto aro aro ekbar.

    ReplyDelete
    Replies
    1. যাক, সায়ন। আপনার ভালো না লাগলে আমাকে নিজের রুচি নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে বসতে হত।

      Delete
    2. Are nana, motei na :D Cinematir USP, khub sotbhabe banano, khaad nei kono...

      Delete
    3. সিনেমাটা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ঠিক এই শব্দটাই এসেছিল। সৎ। অথেনটিক। যে বৈশিষ্ট্যটি এখন হীরের মতো বিরল হয়ে উঠেছে।

      Delete

Post a Comment