সেই সব মায়েদের
ঘুমচোখে ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে অর্চিষ্মান বলল, শুনছ? জোম্যাটো রিসার্চ হ্যাজ ফাউন্ড আউট হোয়াট মমস ওয়ান্ট। বললাম, কী সেটা? অর্চিষ্মান ততক্ষণে টুইটারে শিফট করে গেছে তাই আর উত্তর দিল না।
অসুবিধে নেই। আমারও একটা ফোন আছে। সেই ফোনে সুইগি, মিন্ত্রা, রেলিগেয়ার ইনশিওরেন্স, নার্সারি লাইভ, ফ্লিপকার্ট, অ্যামাজন, বন্ধন লাইফ ইনশিওরেন্স, আদিত্য বিড়লা সান লাইফ মিউচুয়াল ফান্ড, কল্যাণ জুয়েলার্স সবাই মেসেজ পাঠিয়ে আমাকে জানিয়েছে যে এই মাদার্স ডে-তে মায়েরা কী চান। কী ডিজার্ভ করেন। আমার ফেভারিট হইচই-ও মাদার্স ডে-তে মায়ের মন জয় করার টোটকা পাঠিয়েছে। মাকে সঙ্গ দিন। মায়ের সঙ্গে বসে হইচইতে উনিশে এপ্রিল, চিনি ১ ও চিনি ২ দেখুন।
কালও স্বপ্নে মায়ের সঙ্গে দেখা হল। কিন্তু এ বছরের মাদার্স ডে-তে কী করলে তোমার মন জয় করতে পারব বল জিজ্ঞাসা করার সুযোগ পাইনি। কী একটা সাহিত্যসভা গোছের গোলযোগ চলছিল। মা সভায় অংশগ্রহণ করছিলেন। চেনা আরও অনেকে করছিল। আমাকে সাহিত্যসভায় ডাকেনি তবে উদ্বোধনী সংগীত গাইতে বলেছিল। ভাবছিলাম কী করে কাটানো যায় তাই মাকে বললাম মা তুমি বস আমি চা নিয়ে আসছি। চায়ের দোকানে গিয়ে দেখি অর্চিষ্মান এগরোলের মতো করে ধরে কোরিয়ান স্যান্ডউইচ খাচ্ছে। আমাকে দেখে বলল, হয়ে গেল গান? উত্তর না দিয়ে জুটে গেলাম। মাকে ফোন করে বললাম মা আমার এখানে দেরি হবে গো, চায়ের দোকানে খুব ভিড়। ওঁদের বলে দাও না উদ্বোধনী সংগীত অন্য কাউকে দিয়ে গাওয়াতে।
যাকগে মরুকগে। আমাদের ভক্তিবাদী দেশে মাতৃভক্তির স্রোতটা বিশেষ ভাবে জোরালো। যে কোনও ভক্তির স্রোতের মতোই সে স্রোতও ইন্টারনেটে আরও বেশি বেগবান। গত কয়েক বছরে সোশ্যাল মিডিয়ায় সমীক্ষা চালিয়ে আমি এবং আমার বন্ধুরা একটা আঁচ পেয়েছি। সেটা হচ্ছে মায়েরা ভক্তির যোগ্য হলেও সব মায়েরা ভক্তির যোগ্য নন। মাদার্স ডে-র ভক্তির ম্যাচে কিছু ক্যাটেগরির মায়েরা বছর বছর গোল খেয়ে চলেছেন।
চন্দ্রিল ভট্টাচার্য রিসেন্টলি মধ্যবিত্ত নিয়ে একটা বক্তৃতা দিয়েছেন সেখানে মধ্যবিত্তের একটা লক্ষণ তিনি চিহ্নিত করেছেনঃ মধ্যবিত্ত সর্বদা হেরোদের সাপোর্ট করে। আমার মা টপ টু বটম মধ্যবিত্ত ছিলেন। প্লাতিনি এবং প্লাতিনির কারণে ফ্রান্সের কেসটা বাদ দিলে মা যে দল গোল খাচ্ছে আজীবন সেই দলকে সাপোর্ট করে এসেছেন। এই ব্যাপারে আমি আমার মায়ের সাচ্চা মেয়ে। জয়ীদের প্রতি আমি কৌতূহল বোধ করি না। মাধ্যমিকে ফার্স্ট হয়েছে? হয়েছে। অফিসে বেস্ট এমপ্লয়ী মেডেল পেয়েছে? পেয়েছে। আকাশছোঁয়া মাইনের চাকরি বাগিয়েছে? বাগিয়েছে। হাই তুলে পাশ ফিরে শুই। বিরাট গাড়ি চালিয়ে সেই বিরাট মাইনের চাকরিতে যাওয়ার আগে রোজ দু’ঘণ্টা চ্যান্টিং কেন করতে হচ্ছে আমার কৌতূহল সেখানটায়।
মাকে জিজ্ঞাসা করার উপায় নেই তিনি আজ কী পেলে খুশি হতেন। গোলখাওয়া মায়েদের পাশে মেয়ে দাঁড়াচ্ছে দেখলে খুশি হবেন ধরে নিয়ে এই পোস্ট লিখলাম।
*****
হ্যাপি মাদার্স ডে ২০২৪
যে সব মায়েরা নিজেরা না খেয়ে স্বামী আর সন্তানের পাতে খাবার তুলে দেন না। সমান ভাগ করেন। হ্যাপি মাদার’স ডে।
যে সব মায়েদের আঁচলে পার্মানেন্ট হলুদের দাগ নেই। হয় নিজে নিজের শাড়ি রেগুলার কাচেন নয় ধোপাবাড়ি পাঠান নয় ওয়াশিং মেশিনে দেন। হ্যাপি মাদার্স ডে।
যে সব মায়েরা ছেলেদের স্কুলের পিকনিকের চাঁদার জন্য বাবাদের মানিব্যাগ থেকে টাকা “চুরি” করেন না। নিজের বটুয়া খুলে (আঁচলের গিঁট খুললেও আমার আপত্তি নেই। আঁচলটা হলুদের দাগহীন হলে এক্সট্রা পয়েন্ট) নিজেই দেন। হ্যাপি মাদার্স ডে।
যে সব মায়েরা সন্তান নিজের প্লেটের লাস্ট মোমো শেষ করে তাঁর প্লেটে থাবা মারলে থালা সরিয়ে নেন। উঁহু। তুমি তোমারটা খেয়েছ। এটা আমার। আমি খাব। হ্যাপি মাদার্স ডে।
যে সব মায়েরা সন্তানের, "কতবার বলেছি আমার জিনিসে হাত দেবে না" খিঁচিয়ে ওঠার মুখে নীরবে চোখের জল না মুছে পারপিট্রেটরের চোখে চোখ রেখে বলেন, এ সব পেঁয়াজি অন্য কোথাও চালিয়ো, আমার সঙ্গে না। হ্যাপি মাদার্স ডে।
যে সব মায়েরা দশভুজা নন। স্বামী সন্তানের মতোই জাস্ট দুটো হাত নিয়ে ঘুরে বেড়ান। হ্যাপি মাদার্স ডে।
যে সব মায়েরা সন্তানের স্বাস্থ্যের অ্যাকচুয়াল কেয়ার করেন। দেখলেই ঠেসে খাওয়াতে বসেন না। খাওয়ানো ছাড়াও যে সব মায়েদের ভালোবাসার অন্য ভাষা জানা আছে। হ্যাপি মাদার্স ডে।
যে সব মায়েরা জীবনে এমন কোনও স্মরণীয় রান্না করে উঠতে পারেননি যা পৃথিবীর সেরা রেস্টোর্যান্টের খাবার খাওয়ার পরেও সন্তানকে ঢেঁকুর তুলে বলার সুযোগ দেবে - ভালো হয়েছে কিন্তু মায়ের মতো হয়নি। হ্যাপি মাদার্স ডে।
যে সব মায়েরা জ্বরজারি, কোমরব্যথা, পিঠব্যথা অগ্রাহ্য করে সংসার ঠেলতে ঠেলতে মরে যাওয়ার আগেই দৌড়ে ডাক্তার দেখাতে যান। কোমর, পিঠ, মাথা এমনকি ঋতুস্রাবের ব্যথাতেও দরজা বন্ধ করে অন্ধকার ঘরে শুয়ে বাবাগো মাগো মরে গেলাম গো কোঁকান। হ্যাপি মাদার্স ডে।
যে সব মায়েরা একা একাই উবার ডাকতে পারেন। বিগ বাস্কেট থেকে অর্ডার করতে পারেন। যাঁদের সঠিক যতি দেওয়া হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ বা এস এম এস ভাঙিয়ে সন্তান ফেসবুকে হাস্যরসের দোকান খুলে বসার সুযোগ পায় না। হ্যাপি মাদার্স ডে।
যে সব মায়েরা অন্য মায়েদের মতো হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ ঝুলিয়ে দামি শাড়ি পরে শপিং মলে বাজার করতে গিয়ে স্মার্টফোনে সেলফি তোলেন। হ্যাপি মাদার্স ডে।
যে সব মায়েরা স্বামী সন্তানের জন্য সবকিছু ত্যাগ করেন না। বিপদ বুঝলে তাদেরই ত্যাগ করেন। হ্যাপি মাদার্স ডে।
Last point ta mokkhom, jodio sobkota wish er songei ekatto bodh korchi besh. Darun laglo!
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, বিম্ববতী।
Deleteaah...ei lekhatar jonno besh onekdin wait korechhilam. tai peye bishesh rokom khusi holaam.
ReplyDelete"adorsho" maa-er framework-e nijeder je maa ra bedhe raakhen ni chaar paasher hajaar khocha shotteo, ebong shei karone tader shontan der kachhe dher bhalo ekta example set korte shokkhom hoechhen, tader happy mothers day.
থ্যাংক ইউ, অর্পণ। তোমার উইশটাও ভারী সুন্দর।
Delete"আদর্শ মা"-এর মডেলের সঙ্গে অ্যাকচুয়াল মায়েদের সম্পর্ক ক্ষীণ।
Darun, Darun, ebong Darun. Aami erokom ma er sontan. Aami nijeo erokom ma. Bachha ke amar sobcheye beshi bola dialogue holo "cholo amra dujon shudhu araam kori ajke. Kaj kormo bondho". Adorsho ma der onek koshto korte hoi. Ki hobe eto khata-khatni kore? kar kache perfect hoar jonno? Bachha does not care.
ReplyDeleteআপনার প্রশংসা পেয়ে মন ভালো হল। টুকেও নিলাম। ভালো লাগলে এবার আমিও আপনার কায়দায় দারুণ বলব।
Deleteবাচ্চার জন্য বোধহয় কেউ করে না। বাচ্চার জন্য করতে গেলে গতের "আদর্শ মা"-এর থেকে আদতে অনেক বেশি পরিশ্রম আর ভাবনা খরচ করতে হয়।
কার কাছে যে পারফেক্ট হতে চাইছি, এটা একটা ভালো প্রশ্ন করলেন। ভাবব।
Brilliant!
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ।
Deleteমোক্ষম
ReplyDelete❤️
Deleteদারুণ বলেছ, মানে লিখেছ। আদর্শ মা না হলে আদর্শ বাচ্ছার এক্সপেক্টেশনও থাকবে না। ফলে খুবই জরুরী "আদর্শ মা" না হওয়া।
ReplyDelete-প্রদীপ্ত
এটা একটা মারাত্মক পয়েন্ট, প্রদীপ্ত। ভাবিনি আগে।
Deleteলেখাটা পরে তো ভালো লাগলো। কিন্তু আদর্শ মা কেমন হাওয়া উচিত সে সম্মন্ধে আমার ধারণা নেই বললেই চলে। তাহলে কি লিখবো? একটু জেনেরালাইস করে, "সম্পর্ক" সম্মন্ধে নিজের লক্ষ্য করা দুটো কথা লিখি।
ReplyDeleteআজকাল মনে হয় যে কোনো নাম দেওয়া সম্পর্কই কমপ্লিকেটেড। যে কোনো নাম দেওয়া সম্পর্কের দুদিকে থাকে দুটো নাম দেওয়া চরিত্র। এবং থাকে আমার কল্পনার আদর্শ পৃথিবীতে সেই চরিত্র দুটো কেমন হতো, তার অপূর্ব ছবি। আর আমরা কখনো নিজেদের, কখনো বা অন্যদের, এই ছবিতে ফিট করার চেষ্টা করি (সাধারণভাবে এরকমটাই সহজে হয়, কিছু অন্যরকম তো থাকেই)। যেহেতু সবার কল্পনাতে এই আদর্শ পৃথিবী আর আদর্শ চরিত্রের ছবিটা আলাদা, তাই চলে নিরন্তর যুদ্ধ। তার ওপর আবার এই আদর্শ ছবিটাও সময়ের সাথে পাল্টে পাল্টে যায়।
আর যে সম্পর্কের মানুষরা আমাদের জীবনে থাকে একদম ছোটোবয়েস থেকে, কল্পনাশক্তি গড়ে ওঠার আগে থেকেই, সেরকম ক্ষেত্রে হয়তো কল্পনার ছবি গড়ে ওঠার শুরুর দিকে সেইসব মানুষদের প্রভাব বেশি থাকে।
"মিউচুয়াল ফান্ড" মাদার্স ডে-তে মায়েরা কী চান কেন বের করলো কিছুতেই বুঝতে পারলাম না... !!!
আসলে আমি বলতে চেয়েছিলাম, যে নাম দেওয়া সম্পর্ক তখন কমপ্লিকেটেড হয়ে যায়, যখন আমরা সেই সম্পর্কের নিজের কল্পনার আদর্শ ছবি আর বাস্তব ছবির মধ্যের ব্যবধানটা কমাতে চেষ্টা করি। যখন আমাদের খেয়াল থাকে না যে প্রত্যেক মানুষের জন্যে সেই আদর্শ ছবি, আদর্শ পৃথিবী, হচ্ছে আলাদা। এই ব্যবধান কমানোর চেষ্টা আমরা যত কমাতে পারবো, তত সরল হবে বেপারটা। সামাজিক পরিকাঠামো আমাদেরকে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করে যতই চেষ্টা করুক না কেন এক সর্বজনীন আদর্শের বা সৌন্দর্যের ছবি আমাদের মনে প্রলেপ করে দেবার, ভিন্নতা থেকেই যায়।
Deleteরাজর্ষি, মনে হল আপনার মন্তব্যের অপ্রাসঙ্গিক উত্তর দিচ্ছিলাম। তাই সেগুলো ডিলিট করলাম। আপনার ভাবনাগুলো মাথায় থাকল।
Deleteকুন্তলা আমি সুমনা .Google একাউন্ট থেকে কিছুতেই লিখতে পারছিনা .একদম মনের এবং কাজের কথা লিখেছো .আমি নিরানব্বই শতাংশ এরকম মা ,খালি এখন চাকরি করিনা বলে পার্স থেকে নিজের উপার্জনের টাকাটা দিতে পারিনা .
ReplyDeleteসুমনা, ভালোবাসা নিয়ো। পার্সের টাকা নিয়ে চিন্তা কোর না। তুমি তোমার সংসারে অর্থনৈতিক অবদান রাখো প্রতিদিন। পোস্টটা লঘু চালের। ওই পয়েন্টটা লিখেছি এই বিশেষ প্রসঙ্গটায় "চুরি" শব্দটার আশ্চর্যরকম বহুব্যবহার অ্যাড্রেস করার জন্য।
Deleteহ্যাঁ কুন্তলা আমি চিন্তাভাবনায় একদম স্বচ্ছ এই ব্যাপারে ,সরকারি চাকরি ছেড়েছি স্বইচ্ছায় .তবে নিজের কথা ভাবি বাকি দুজনের সাথে সমানভাবে .
Delete