গত সাত বছরে
কাল চিরাগ দিল্লির সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আমি সেই কাজটা করলাম, যেটা দু’হাজার নয়ের সেপ্টেম্বর মাস থেকে এই দুহাজার ষোলোর মে মাস পর্যন্ত, গত সাত বছরে কখনও করিনি।
বললাম, “একটা পোস্টের আইডিয়া দাও না গো।”
ও-কারের শেষটুকু ঠোঁট ছাড়ার আগেই সম্বিত ফিরল। এটা আমি কী করলাম! অবান্তরের সবথেকে অপরিহার্য নিয়মটাই ভেঙে ফেললাম? গত সাত বছরের শীত গ্রীষ্ম বর্ষা বসন্ত পেরোতে পেরোতে একটিই সত্যকে আমি ধ্রুব রাখতে চেয়েছি। অবান্তরকে ‘টিমওয়ার্ক ফ্রি’ জোন রাখতে চেয়েছি। অফিসে, সংসারে, উবারপুলে, টিমওয়ার্ক যত বুকের ওপর চড়ে গলা টিপে ধরেছে তত আমি প্রাণ পণ করেছি অবান্তরকে রাহুমুক্ত রাখার। অবান্তর আমার ছাগল, তাকে আড়ে কাটব না বহরে কাটব শুধু আমার এক্তিয়ার। আমার একার ক্ষমতায় যতটুকু কুলোবে, যেমন কুলোবে, অবান্তর ততটুকুই, তেমনই চলবে।
কিন্তু সত্যি সত্যি কি টিমওয়ার্ক ছাড়া কিছু দাঁড়ায়? পোস্ট আর কমেন্টের যুগলবন্দী ছাড়া ব্লগ কী? তাহলে আর ইন্টারনেটে কেন, ডায়রি কিনে মনের কথা লিখলেও হয়। অ্যাকচুয়ালি তাও হয় না, আমার কোটি কোটি ডায়রির সবগুলোই কোনও না কোনও সময় কারও না কারও হাতে পড়েছে। বেস্ট হয় মনের কথা মনেই রেখে দিতে পারলে।
অবান্তরের পাঠকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমি অনেককে জানি যারা আমার পোস্ট না পড়ে বা পড়ার পরে দ্বিগুণ উৎসাহে কমেন্ট পড়েন। কিন্তু কমেন্ট আর পোস্টের মাঝখানে ‘পাবলিশ’ নামের একটি নিশ্ছিদ্র দেওয়াল থাকে, তার ওপারে পাঠক আমার গুণগান করুন, গালি দিন, সাপের বদলে ব্যাঙ বেরোতে দেখে হতাশ হন, সে তাঁদের অভিরুচি, অধিকার। তার ওপর আমার হাত নেই। ঠিক যেমন কারও হাত নেই পাবলিশ হওয়ার আগে অবান্তরে কী ঘটছে তার ওপর।
পাঠকের না, অর্চিষ্মানের না, মায়েরও না।
আর সেই আমি কি না আইডিয়া ধার চাইছি?
অনেক খুঁজে একটাই সান্ত্বনা বেরোলো, যে ধারটা অন্তত অর্চিষ্মানের কাছে চেয়েছি। আমি নিজেকে বুঝিয়ে রেখেছি, অর্চিষ্মানের সঙ্গে করা গসিপগুলো গসিপ নয়। আপাদমস্তক ইনকারেক্ট ভাবনা, যেগুলো নিজের মায়ের কাছে বলার সাহস আমার হবে না এবং আমার মা আমাকে বললেও আমি তাঁকে ঘোরতর জাজ করব, সেগুলো অর্চিষ্মানের কাছে উন্মুক্ত করা, সামহাউ, ক্ষমাযোগ্য। অর্চিষ্মানের উদ্দেশ্যে বলা কথা আসলে আমার মনে মনে ভাবারই সামান্য এক্সটেনশন।
কিন্তু এসব সান্ত্বনা, সান্ত্বনাই। সত্যিটা হল, আমি আমার সাতবছর আগলানো দুর্গের মুখ খুলে দিয়েছি, এবার তেড়ে বন্যার জল ঢুকলে আমি ছাড়া দোষারোপ করার কেউ নেই।
দ্রুত ড্যামেজ কন্ট্রোলে নামতে হল। আর এতে সাহায্য করল আমার আর অর্চিষ্মানের দুজনেরই চরিত্র, যা সম্পূর্ণ বিপরীত কিন্তু এই সব মুহূর্তে পারফেক্ট পরিপূরক।
অর্চিষ্মানের যে ব্যাপারটা সাহায্য করল, সেটা হল ওর উত্তর দেওয়ার আগে ভাবার স্বভাব। আমি যেমন প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই “ওহ, এটা তো আমি জানি” বলে লাফিয়ে উত্তর দিতে শুরু করি, ও ঠিক তার উল্টো। প্রশ্নটা শোনে, ভাবে, তারপর উত্তর দেয়। এতে উত্তরের কোয়ালিটি তো ভালো হয়ই, তাছাড়া আমার মতো প্রশ্নকর্তার পক্ষেও, যিনি সাতপাঁচ না ভেবে প্রশ্ন করেছেন, ভালো হয়, কারণ তিনি কথা ঘোরানোর সুযোগ পান।
আর আমার না ভেবে কথা বলার ক্ষমতাটাও কাজে লেগে গেল। সিগন্যাল যতক্ষণে সবুজ হল ততক্ষণে আমি অবান্তর থেকে ওয়েদার হয়ে শনিরবি কী কী ‘ফান থিংস’ করা যেতে পারে, কথোপকথন সেখানে নিয়ে গেছি। দুজনে মোবাইল খুলে ‘ডেলহিইভেন্টস ডট কম’ পরীক্ষা করছি, আমার মাথার মধ্যে একটা গলা বলে চলেছে, "মাগো, কী বাঁচাই না বাঁচলাম।"
*****
বলা বাহুল্য, অর্চিষ্মানের সাজেস্ট করা বিষয় নিয়ে অবান্তর লিখলে কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হত না। কথাটা সেটা নয়। কথাটা হচ্ছে, সাত বছর ব্লগ লেখার পরও এমন মুহূর্ত আসে, যে পরের পোস্ট কী নিয়ে লিখব সেটা ভেবে পাওয়া যায় না। এমন নয় যে মুহূর্তগুলো ক্বচিৎকদাচিৎ আসে। ঘনঘন আসে। সপ্তাহের শুরুতে, মাঝে, শেষে আসে। প্রতিটি পোস্ট ছাপা হওয়ার পরেই আসে।
এসে দু’হাত বুকের সামনে আড়াআড়ি ভাঁজ করে, ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকায়। বলে, "এটা তো নেমে গেল, এরপর? আর ভাণ্ডারে কিছু আছে? নাকি দোকান বন্ধ করার সময় এসে গেছে?"
কখনও সামান্য চিন্তা হয়। সত্যি, কী নিয়ে লিখব? এই যে বুদ্ধিমান পায়রাটা আমার নাকের সামনে দিয়ে উড়ে চলে গেল, নিজের জীবন সহজসরল রেখেছে, ব্লগ খুলে ঝঞ্ঝাট বাড়ায়নি, একে নিয়ে লিখব? এই যে লিফট-এ চেপে উঠছি, লিফট নিয়ে লিখব? কখনও পুরোদস্তুর প্যানিক সেট ইন করে। পাগলের মতো স্মৃতি হাতড়াই, লিফটে বলার মতো কিছু ঘটেছিল কি? কখনও কি কোনও টল ডার্ক হ্যান্ডসামের সঙ্গে বন্দী হয়ে পড়েছিলাম, বা লিফটে চড়ে জীবনের কোনও সারসত্য উপলব্ধি হয়েছিল? নাথিং। লিফটে বলার মতো একটাই ঘটনা ঘটে আমার সকালবিকেল, সেটা হচ্ছে দূর থেকে অফিসের চেনা লোক লিফটে উঠছে দেখলে হয় স্পিড কমাতে হয়, নয় গতিপথ বদলাতে। আর সে সব কিছুই করার সুযোগ না থাকলে দাঁত বার করে বলতে হয়, ডাক্তারের আদেশ। তারপর লিফটের বদলে ভাঙো পাঁচতলা সিঁড়ি।
বোরিং লোকের ব্লগ লেখার এটাই সমস্যা। নিজেকে রসদ করে ব্লগ চালাতে গেলে আমি আজ সকালে ঘুম থেকে উঠলাম, খেলাম, অফিসে এলাম, এসে বসের ধাতানি খেয়ে মুখ হাঁড়ি করলাম, দিনের পর দিন এই চর্বিতচর্বণ করে যেতে হয়। তাতে অসুবিধে কিছু নেই, এরকম ব্লগ অনেকেই লেখেন এবং আমার পড়তেও দিব্যি লাগে। তবে আমার ধারণা ক্রমাগত এসব লিখতে লিখতে আমি নিজেই বোর হয়ে যাব। বেশিদিন এইসব লেখা যায় না, ঠিক যে কারণে বেশিদিন ডায়রি লেখা যায় না।
তখন হয় আইডিয়ার অপেক্ষা করতে হয়, নয় ইমপ্রোভাইজ করতে হয়। কুইজ, কোটেশন, সাপ্তাহিকী হ্যানাত্যানা। এসব হাজার শব্দের ট্র্যাডিশনাল পোস্টের বিকল্প নয়, পাঠককে এসব দিয়ে বোকা বানানো যায় না। তবু মনে হয় ফাঁকা জায়গা তো খানিকটা ভরল। এই ভরাতে ভরাতেই হয়তো পরের আইডিয়াটা মাথায় আসবে।
আসেও। গত সাত বছরে কখনও হতাশ করেনি। সেগুলো আইডিয়া হিসেবে কেমন তার বিচার আমি করছি না, আমার পক্ষে করা সম্ভবও নয়। হাজার শব্দ লিখে যাওয়ার মতো কিছু একটা হলেই আমার মতে যথেষ্ট। তবু গোটা মন মানে না। লেখার সময় অর্ধেক মন ছি ছি করে, বোরের হদ্দ হয়, হাই তোলে। বলে "তুলে নাও মা, এ যমযন্ত্রণা জন্মের মতো ঘোচাও।" অন্য অর্ধেক বলে "ঘাবড়াও মৎ, লিখতে থাকো।" আমি সদাসর্বদা এই দ্বিতীয় মনটার কথা শুনি। যেমন আজ শুনলাম।
Ha ha ha ha. Axel Munthe er The Story of San Michele porechhen? Pore dekhte paren. Shunechhi poroborti somoyer bohu uponyash, cinema, natok naki Story of San Michele theke ektu adhtu inspired. Apni o hoito plot peye jete paren.
ReplyDeleteOh hnya, ekta disclaimer achhe - Mam'selle Agatha ke tarpor konodin bhulte parben na :)
রেকোমেন্ডেশনের জন্য ধন্যবাদ। আজই পড়া শুরু করছি।
Deleteei dekho kemon abar ekta blog post likhe felle. erokom i likhte thako, ei je roj dhun mari eta koto boro recreation tumi bhabteo parbena...plz lekha chalie jao...r tachhara notun table er maan rakhte habe to..- Bratati.
ReplyDeleteসে তো বটেই, ব্রততী। নতুন টেবিলে বসলেই আজকাল ফসফস করে লেখা বেরোয়। পয়া টেবিল মনে হচ্ছে।
DeleteThis is what I love about your writing. U can pick anything and turn them in sundar lekha.... Bhalo laglo kuntala Di.
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, প্রিয়াঙ্কা।
DeleteNotun table ta boro poya. ese theke tomar lekha regularly fosfos kore ese jachhey. roj ekta notun lekha.. :)
ReplyDeleteLandore cookbook theke kichhu ranna korle? Tahole sei rannar golpo diye ekta blog lekho na please.
এটা একটা মনের কথা বলেছ, চুপকথা। ওই গুড প্লেন কেকের রেসিপিটা দেখে থেকে ভাবছি বানালে হয়, কিন্তু যা উদ্যমী লোক, বুঝতেই পারছ। তুমি বললে, উৎসাহ পেলাম। বানিয়ে লিখব অবান্তরে। থ্যাংক ইউ।
Deleteআপনি তো রেগুলারলি লিখে যাচ্ছেন, তারপরেও এত চিন্তা? আমি তো বোর হয়ে প্রায় লেখা ছেড়েই দিলাম। আপনার লেখাটা পড়ে ভাল লাগল, মনে হল আমি একা নই, আপনার মতন লোকেরও যদি এরকম হয় তাহলে আমার তো হতেই পারে!
ReplyDeleteআরে লিখছি কি আর শখে, সুগত, না লিখলে যে ফাঁকটা হবে সেটা ভরাট করার মতো যদি কিছু হাতের কাছে থাকত তাহলে বিনাপয়সায় এই গাধার খাটনি খাটতাম না।
Deleteonek din por comment korlam,are office e ki keramoti koreche,tomar blog khole comment kora jay na..se jag..majhe baro sundor sundor galpo o bhraman kahini diecho..khub bhalo..
ReplyDeleteprosenjit
আরে প্রসেনজিৎ যে, কেমন আছ? সে আর কী করা যাবে, অফিসের কাজই কেরামতি করা। পড়তে যে দিচ্ছে এইটা ভালো। অনেকদিন বাদে কমেন্ট পেয়ে খুব ভালো লাগল। থ্যাংক ইউ।
Deleterannar golpo ekta hok, anekdin hoyni - arekjon o bolechen dekhlam. ar Quiz? kotodin quiz hoyni!
ReplyDeleteহ্যাঁ, রান্না, কুইজ, দুটোই অনেকদিন হয়নি, কাকলি। দেখি।
Delete
ReplyDeleteআরে, এতো চিন্তা করবেন না। showing up is the main thing. যদিও এই লেখাটাও দারুন হয়েছে। এই আইডিয়া না পাওয়ার ভয়ে আমি তো কিছু লিখেই উঠতে পারি না। অবশ্য লিখলেও অতি পচা হয়. যাই হোক,আপনি যে আপনার ভিতরের সমালোচনা , হতাশা অগ্রাহ্য করে এতো সুন্দর লেখেন,এটা খুব বড়ো ব্যাপার। সবাই পারে না। লিখতে থাকুন
ভালো থাকবেন
ইন্দ্রানী
থ্যাংক ইউ, ইন্দ্রাণী।
Delete