টয় ট্রেন





কালকা-সিমলা টয় ট্রেনে আমি ছোটবেলায় একবার চড়েছিলাম বাবার সঙ্গে, এবং খালি বাবার সঙ্গেই, মা যেন কাদের সঙ্গে বাসে করে পুরো রাস্তাটা গেছিলেন। এরকম অদ্ভুত ব্যবস্থা কেন হয়েছিল, আমি মা বাবা তিনজনেই এখন ভেবে মনে করতে পারছি না এবং তিনজনেই যারপরনাই অবাক হচ্ছি। আবার ওই একই ট্রেনে অর্চিষ্মান চড়েনি, কিন্তু নাকতলার মা চড়েছেন। এই সব অদ্ভুত অসাম্য দূর করার জন্য ঠিক হল টয় ট্রেনে সিমলা যাওয়া হবে। এখন, শুধু সিমলা গিয়ে আবার ফিরে আসা পড়তায় পোষায় না, তাছাড়া লোককে বলারও অসুবিধে। কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে, 'কী করলে?’ আর আমরা যদি বলি ‘এই তো ট্রেনে করে সিমলা গিয়ে আবার বাসে করে ফিরে এলাম’ তাহলে সবাই এমন মুখ করবে, করবেই, যেন আমাদের জন্ম বৃথা। বলবে, আহা ওই জায়গাটা গেলে না? দারুণ মিস করলে। এমন নয় যে সব কিছু দেখে এলেও লোকের মুখ বন্ধ করা সম্ভব। আমি নিশ্চিত ওয়ার্ল্ড টুর করে এলেও কেউ না কেউ থাকবে যার আমাদের ভ্রমণসূচী নিয়ে মতামত থাকবে। ওই জায়গাটায় গেলে না, বা গেলেও মোটে একদিন থাকলে, ওই মোড়টার ওই সিগন্যালটায় দাঁড়ালে না, সূর্যোদয় দেখলে, কিন্তু ওখানের তো সানসেটটাই ফেমাস ইত্যাদি।

দ্বিতীয় বিপদটা প্রথমটার থেকেও ভয়ংকর। সেটা হচ্ছে সিমলা যাওয়া। যথেষ্ট অন্যরকম লোকেরা সিমলা যায় না। টু পপুলার। সাতাশ কিলোমিটার দূরে সোঘিতে নেমে পড়ে, তবু সিমলা যায় না। আমরাও সিমলায় যাওয়ার নামে আঁতকে উঠলাম। টয় ট্রেনে চড়ছি বলে সিমলা যেতেই হচ্ছে, কিন্তু যত দ্রুত সম্ভব প্রাণ হাতে করে পালাতে হবে। পালিয়ে কোথায় কোথায় যাওয়া যেতে পারে খুঁজতে খুঁজতে শেষ পর্যন্ত সাংলা ভ্যালি পছন্দ হল। কিন্তু অতদূরে যেতে গেলে শুধু তিনদিনের উইকএন্ড যথেষ্ট নয়। আমাদের পক্ষে যা নিতান্ত অচারিত্রিক তাই করলাম। দু’দিন ছুটি নিলাম। বুধবার রাতে বেরোব, সোমবার রাতে ফিরব। 

টয় ট্রেনের চক্করে আরও একটা জিনিস স্বভাবের বাইরে গিয়ে করতে হল। পাহাড়ের এত কাছে থাকি বলেই, পাহাড়ের জন্য আমরা দিনসাতেকের বেশি সাধারণত প্ল্যান করি না। কিন্তু টয় ট্রেনের টিকিটের ডিম্যান্ড দু’নম্বর মার্কেটের ম্যাগাজিনের স্টলে দেশ-এর ডিম্যান্ডের থেকেও বেশি। একমাস আগে বুকিং খোলার দু’ঘণ্টার মধ্যে সব সিট শেষ। কাজেই একমাস আগে টিকিট কাটতে হল। আর ট্রেনের টিকিটই যখন কাটলাম তখন হোটেলগুলোও বুক করে ফেলা হল মাসখানেক আগে থাকতেই।

পাঁচটা টয় ট্রেন যায় কালকা থেকে সিমলা। সবক’টারই ভালোমন্দ আছে, সে সব লিখে আমি ব্লগপোস্ট ভারাক্রান্ত করছি না, সে সব নিয়ে লাখ লাখ সাইটে কোটি কোটি তথ্য আছে। সবদিক ভেবেচিন্তে আমরা বাছলাম শিবালিক ডিলাক্স এক্সপ্রেস। ভোর পাঁচটা কুড়িতে কালকা থেকে ছাড়ে, সিমলা পৌঁছোয় বেলা দশটা নাগাদ। দিল্লি থেকে কালকা আমরা যাব হিমাচল প্রদেশ সরকারের অর্ডিনারি নন-এসি সিটার বাসে। ছ’ঘণ্টার জার্নি। ভলভোও নেওয়া যেত, কিন্তু ভলভোর ভাড়া মাথাপিছু প্রায় হাজার আর সরকারি অর্ডিনারি বাসের ভাড়া মাথাপিছু দু’শো একাশি। নিজেদের বোঝালাম, যদি খুব কষ্ট হয়, যদি ঝাঁকুনিতে ঘনঘন মাথা বাসের ছাদে ঠেকে, তাহলে টাকা বাঁচানোর কথা একে অপরকে মনে করিয়ে সান্ত্বনা পাব। 

কিন্তু বাসের আর একটা ফ্যাচাং আছে, যেটা আমাদের আগে খেয়াল হয়নি। বাস যায় দিল্লি থেকে সিমলা। পথে কালকা রেলস্টেশন পড়ে। রাস্তার ওপরেই পড়ে না স্টপ থেকে আরও খানিকক্ষণ যেতে হয়, সেসব আমরা কিছুই জানি না। রাত আড়াইটের সময় স্টপে নেমে রেলস্টেশন পর্যন্ত যাওয়ার কিছু পাওয়া যাবে কি না তাও না।  এ সব আমাদের মাথায় এল আই এস বি টি-তে বাসে উঠে সিট বেছে বসার পর।  কন্ডাকটরকে জিজ্ঞাসা করলেই সব রহস্যের সমাধান, কিন্তু আই এস বি টি-তে গাড়ি ছাড়ার আগে কন্ডাকটরকে চিহ্নিত করা, আর করতে পারলেও তাঁকে সুস্থমতো প্রশ্ন করতে পারা, ওয়েল, যাঁরা জানেন তাঁরা জানেন। বসে বসে দুজনে টেনশনে ঘামছি, এমন সময় জানালা দিয়ে আমি দেখলাম, খাকি ইউনিফর্ম পরা ড্রাইভারজি দরজা খুলে হেঁইও বলে নিজের সিটে ওঠার উপক্রম করছেন। কনডাক্টরের থেকেও অথেনটিক পথনির্দেশ যদি কেউ দিতে পারেন তবে ইনিই, এই ভেবে চেঁচিয়ে আমি আমাদের প্রশ্নাবলী পেশ করলাম। 

১। বাসটা কালকা স্টেশন দিয়ে যাবে কি না?
২। গেলে কত কাছ দিয়ে যাবে?
৩। যদি দূর দিয়ে যায় তাহলে স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছনোর কিছু পাওয়া যাবে কি?

আমি যতক্ষণে দ্রুত আমার প্রশ্ন সারছিলাম, ততক্ষণ ড্রাইভারজি একহাত স্টিয়ারিং-এ, একহাত দরজার ফ্রেমে, এক পা চৌকাঠে রেখে আর দু’চোখ আমার দিকে রেখে ঝুলছিলেন। আমার প্রশ্নমালা শেষ হতে মুখভর্তি গুটখার পিক সামলে “হাঁ হাঁ” বলে বাসে উঠে পড়লেন। 

বাসে ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম হল, মাঝে কনুইয়ের খোঁচা মেরে অর্চিষ্মান দেখাল, সত্যি চণ্ডীগড় শহরটা ভারি সুন্দর। তারপর রাত আড়াইটে নাগাদ 'কালকা স্টেশনওয়ালে উতরো' চিৎকারে তন্দ্রা ছুটল। খচমচ করে লটবহর নিয়ে নামলাম, বাস সাঁ করে সিমলার দিকে ছুটে চলে গেল। আর আমরা আবিষ্কার করলাম, ঘুটঘুটে অন্ধকার জনপ্রাণীহীন রাস্তায় আমরা দুজন দাঁড়িয়ে আছি। রেললাইন বা স্টেশনের চিহ্নমাত্র নেই। শুধু দশ হাত দূরে একটা লাল রঙের বিন্দু একবার নিভুনিভু হচ্ছে আর একবার জ্বলে উঠছে।

বিড়িওয়ালা ভদ্রলোক এগিয়ে এসে রাস্তার ধারে পাঁচিলের ফাঁকা অংশ দেখিয়ে বললেন, 'সিধা চলে যাইয়ে।' সে পথ যে কী অন্ধকার আর কী নির্জন, কী বলব। একটাই ভরসা, এত বেশি রাতে হয়তো দুষ্কৃতীরাও ঘুমিয়ে পড়েছেন। অবশ্য আমাদের সুটকেসের চাকা কংক্রিটের রাস্তায় যে পরিমাণ ঘর্ঘর তুলেছে, ঘুম ভেঙে যাওয়া বিচিত্র নয়। 

মিনিট দশেক হাঁটার পর কালকা স্টেশনের আলো চোখে এল। কালকা আমার অন্যতম প্রিয় স্টেশন। ছোট্ট, শান্ত, পরিচ্ছন্ন। ইতিউতি চাদর মুড়ি দিয়ে লোকজন ঘুমোচ্ছিলেন। আমরা একটা ফাঁকা বেঞ্চি বেছে বসলাম। চা আর ভেজ প্যাটিস খেয়ে আমি ক্যামেরার ব্যাগের ওপর মাথা রেখে গুটিসুটি হয়ে শুলাম, অর্চিষ্মান হাঁটাহুটি করে টাইমপাস করল, তারপর ভোর পাঁচটা নাগাদ আরেক কাপ গরম চা সহকারে খবর আনল যে প্ল্যাটফর্মে গাড়ি দিয়ে দিয়েছে। 

শিবালিক এক্সপ্রেসের ছাড়ার কথা পাঁচটা বেজে কুড়িতে। কিন্তু কখনওই টাইমে ছাড়ে না, কারণ কখনওই হাওড়া দিল্লি কালকা মেল টাইমে আসে না। শিবালিক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কালকার জন্য অপেক্ষা করে। ভালোই করে, কারণ প্রচুর লোক কালকা মেলে এসে টয় ট্রেন ধরেন।  আমাদের সৌভাগ্য সেদিন কালকা মেল মোটে ঘণ্টাখানেক লেট করেছিল। সোয়া ছ’টা নাগাদ কিলবিল করে লোকজন দৌড়ে দৌড়ে টয়ট্রেনের দিকে আসতে লাগল। “এদিকে”, “সুজিতদা", “পা চালিয়ে” ইত্যাদি শব্দ হাওয়ায় উড়তে লাগল। একজোড়া নারীপুরুষ, যাঁদের আমি অমাবস্যার রাতে চশমা ছাড়াও বাঙালি বলে চিনতে পারব, আমাদের জানালার বাইরের বেঞ্চে বাক্সপ্যাঁটরা বিছিয়ে বসলেন। বোধহয় অন্য কোনও ট্রেন ধরবেন। মহিলা বসেই একখানা বই খুললেন কোলের ওপর। ভয়ানক উঁকিঝুঁকি মেরে প্রচ্ছদে সমরেশ মজুমদারের নামটা দেখতে পেলাম। বইয়ের নাম দেখতে পাইনি।

গাড়ি ছেড়ে দিল। পথের বর্ণনা দেওয়া বাহুল্য। পাহাড়, কুয়াশা, পাইনের বন, সুড়ঙ্গ সব আছে। আর আছে ছবির মতো সব স্টেশন। টকসাল, গুম্মান, কোটি, মিষ্টি মিষ্টি নামের স্টেশনের চেহারাও ততোধিক মিষ্টি।  অদ্ভুত ভালো মেন্টেন্যান্স। ছবির মতো গুছোনো। 


কালকা-সিমলা রেলওয়ে চালু হয়েছিল লর্ড কার্জনের সময়, উনিশশো তিন সালে। কালকা থেকে সিমলা, মোটে ছিয়ানব্বই কিলোমিটার দূরত্বে এ ট্রেন পেরোয় একশো দু’খানা সুড়ঙ্গ, আটশোরও বেশি ব্রিজ আর চড়ে প্রায় চোদ্দশো মিটার। রাস্তা জায়গায় জায়গায় প্রায় আটচল্লিশ ডিগ্রি খাড়া। 

গোটা রাস্তায় বারোগ ষ্টেশনে একবার থামে ট্রেন। ভারি সুন্দর ষ্টেশন।

কালকা ষ্টেশনে দু’কাপ করে চা আর ভেজ প্যাটিস খেয়েছিলাম মনে আছে? ট্রেনে ব্রেকফাস্টে দিল পাউরুটি, ডিমভাজা/ ভেজ কাটলেট, জুস, চা। বারোগে ট্রেন থেকে নেমে ফোটো তোলাতুলি সেরে আমরা খেলাম আরও একটা করে ভেজ কাটলেট। তারপর কী একটা ষ্টেশনে হিসেবের বাইরে ট্রেন থামল, জানালা দিয়ে কিনলাম শশা, মশলা চানা, পপকর্ন। আর বাকি রাস্তায় সঙ্গের স্টক থেকে মোন্যাকো বিস্কুট আর নাট ক্র্যাকার। বেড়াতে গেলে পাকস্থলীর আয়তন বেড়ে যায়। এছাড়া এর আর কোনও ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। 

                                                                                                                             (চলবে)


Comments

  1. বেশ খিদে খিদে পেয়ে গেল, অ্যাপেটাইজারটা দারুণ! আমরা ওই হাওড়া দিল্লি কালকা মেলেই গিয়েছিলাম, তার দুটো প্রধান কারণ ছিল। প্রথম, পৃষাদেবী বাসে চড়তে পছন্দ করেন না। দ্বিতীয়, অনেক বাংলা বইয়ে, ইনক্লুডিং বাক্স রহস্যতে কালকা মেলের ডেসক্রিপশন পড়ে মনে হত একবার এই ট্রেনে চড়তেই হবে।
    মেন কোর্সের অপেক্ষায় রইলাম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, দেবাশিস। আমার আবার কালকা মেল শুনলেই ওই ঝড়তিপড়তি জোকটার কথা মনে পড়ে, "ইয়ে আজ কা নেহি,..." ইত্যাদি। তাই সাহস করে চড়া হয়নি কখনও। তবে বাবামায়ের সঙ্গে চড়ে থাকতে পারি, হয়তো ভুলে গেছি।

      Delete
  2. welcome back :) ..veg patties er eto prabolyo dekhe ramdeber sishyo hoyecho bhoy pachhi :D
    (ekta mail korechi ektu dekho somoy kore) -- Pradipta

    ReplyDelete
    Replies
    1. তোমার মেল দেখেছি, প্রদীপ্ত। একটু হাঁফ ছেড়ে উত্তর দিচ্ছি।

      Delete
  3. Issshshhhh.. ki lobh e na hocche ekkhuni toy train chapte jete.. Simla "onyorokom" lokra jay na.. eta ekdom mokkhom dhorechen :) :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, থ্যাংক ইউ, ইন্দ্রাণী। টয় ট্রেনটায় না চাপলে একবার সুযোগ করে প্ল্যান করুন। সত্যি ভালো লাগবে।

      Delete
  4. Amra puro gorom ta plan korte korte e katiye dilam oi toy train e chapbo bole. Ashole eto ta journey hoye jabe ekhan theke je shahosh kore uthte parchi na. Chobilgulo dekhe khub bhalo laglo.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, তোমাদের এত দূর আসাটাই একটা ঝামেলা, শর্মিলা। তবে অভিজ্ঞতাটা ভালো।

      Delete
  5. Replies
    1. থ্যাংক ইউ, কুহেলি।

      Delete
  6. sundar parer parber apekshyay thaklam

    ReplyDelete
  7. bhoyonkor lobh hochhey tomar beranor golpo pore. apiser fanke tuk kore pore felei monta hu hu kore uthlo.

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই ট্রেনটা চেপে আমাদেরও ভীষণ ভালো লেগেছে, চুপকথা।

      Delete
  8. Er ulto route ta (Shimla to kalka) niyechhilam Amra amaader honeymoon shere pherar shomoy. Boddo bhaalo ei train ta.

    ReplyDelete
    Replies
    1. সিরিয়াসলি, অর্পণ। এর হাইপটা সম্পূর্ণ ডিজার্ভড।

      Delete
  9. durdanto. :)
    porer porber opekkhay acchi

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, অরিজিত.

      Delete
  10. এই সেরেছে| এরকম উদ্ভট বাস/ট্রেনের সময় বাছাটা কি ছুটি বাঁচাতে ?

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, অন্বেষা।

      Delete
  11. ki darun likhechho Kuntala... ebar Shimla r toy train e uthtei hobe...

    ReplyDelete
    Replies
    1. এটা কিন্তু সত্যি চড়ার মতোই, ইচ্ছাডানা। একবার প্ল্যান করে ফেলুন।

      Delete
  12. Ki mojaa laglo eta pore. Ami oo Friday ei simla- kalka train e chorchi. R sotti bolte Simla Amar khub bhalo legeche,heritage walk ta khub sundar.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমারও সিমলা ভালো লেগেছে, প্রিয়াঙ্কা। যদিও ওয়াকে যাওয়ার সুযোগ হয়নি।

      Delete

Post a Comment