অযৌক্তিক
রবিবার আমার মনখারাপ হয়েছিল। হাতপা অবশ, ঘাড় টনটন, চোয়াল শক্ত, বুকের ভেতর ফাঁকা, হোঁচট খাওয়া নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস। ঘাড়ের ওপর একটার জায়গায় দশটা মুণ্ডু, দশরকম তীব্রতায় দপদপ করছিল। মাঝখানের মেন মুণ্ডুটার ফাঁকা হলঘরে গ্যাঁট হয়ে বসে ছিল একটা যন্ত্র, দোমড়ানো তোবড়ানো ধাতব শরীর, চোখ নাক কান হাত পা নেই, মুখের জায়গায় একটা প্রকাণ্ড গর্ত। গর্তের ভেতর কুটকুটে অন্ধকার। অন্ধকার থেকে বেরোনো খোনা গলা গুঙিয়ে গুঙিয়ে বলছিল, 'হল না। হবে না। পেলাম না। সবাই পেল। হেরে গেলাম। কী লাভ। এত লোক থাকতে আমিই কেন।'
চোখ বুজে শুয়েছিলাম আর প্রার্থনা করছিলাম হয় আমার চারপাশটা অদৃশ্য হয়ে যাক, নয় আমি অদৃশ্য হয়ে যাই। পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যাক, নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে ছিরকুটে পড়ে থাক, আমি নেচে নেচে তার রক্তপান করি। কেজি ক্লাস থেকে যত লোকের ওপর যত রাগ হয়েছে সব তিনগুণ হয়ে ফেরৎ আসছিল। কাকে হাতের কাছে পেলে কী উচিত জবাব দিতাম মাথার ভেতর ক্রমাগত প্র্যাকটিস করছিলাম। তাবৎ দুনিয়াটাকে হাড়ে হাড়ে শিক্ষা দেওয়ার মতলব ভাঁজছিলাম দমবন্ধ করে। আর নরকের আগুনে ভাজাভাজা হচ্ছিলাম।
নিয়মিত ইন্টারভ্যালে এ রকম দিনরাত যে আসবে সেটা আমি মেনে নিয়েছি। চলেও যাবে। ঘণ্টা বারো দাঁতে দাঁত চেপে কাটিয়ে দিতে পারলেই। এর থেকে কমেও নিরাময়ের সম্ভাবনা থাকে, তবে সে জন্য বাড়ি থেকে বেরোনো মাস্ট। এইজন্য সপ্তাহের মাঝখানে এই সব মনখারাপের অ্যাটাক হওয়া সেফ। কারণ অফিস যেতেই হবে। অফিস না গেলে চাকরি যাবে। চাকরি গেলে আর নরকটা টেম্পোরারি থাকবে না। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত গাড়বে মাথার ভেতর। সপ্তাহের মাঝখানে মনখারাপ হলে আমি তাই মনকে ত্যাগ দিয়ে শরীরের ওপর মনোযোগ দিই। সেটাকে স্নান করিয়ে, চুল আঁচড়িয়ে, জামা পরিয়ে, জুতো গলিয়ে, সিঁড়ি বেয়ে নামাই। আর নামামাত্র ঘরের ভেতর বসে বসে যে দুনিয়াটাকে অভিসম্পাত দিচ্ছিলাম, রোদ, ধুলো, গরম, হর্ন, কুড়া কুড়োনোর গাড়ির টোকো গন্ধ নিয়ে সেটা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
তাতেই প্রতিরোধ খানিকটা ঢিলে হয়। তারপর কপাল ভালো থাকলে হাস্যমুখ তরুণ কিংবা বৃদ্ধ সর্দারজী চালকের সিট থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলেন, ‘গুড মর্নিং, ম্যাডাম।’
তখন কীই বা করার থাকে? চেঁচিয়ে বলা, ‘চুলোয় যান আপনি আর আপনার মর্নিং। গুড না হাতি। বিশ্রী, অকথ্য, জঘন্য, যত্তসব…’?
অফ কোর্স, বলব না। বলব, ‘গুড মর্নিং।’ কাষ্ঠহাসি হাসতেও হবে। হাসতে গিয়ে ঠোঁট সামান্য ফাঁক হবে। অমনি সে ফাঁক দিয়ে হু হু করে রিয়েল লাইফ ঢুকে পড়বে। দৌড়োদৌড়ি করে দখল নেবে শরীরের। শিরাধমনীর রেলিং-এ স্লিপ খেয়ে হুস করে পৌঁছে যাবে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ। হুড়মুড়িয়ে দরজা ভেঙে ঢুকবে মুণ্ডুর হলে। চৌকো যন্ত্র তখন সবে দম নিয়ে আরেক সেট হাহাকার ওগরানোর জন্য রেডি হচ্ছে। দুপক্ষই দুপক্ষকে দেখে চমকে যাবে। থমকে যাবে।
প্রথমে সামলে নেবে রিয়েল লাইফ। চোখ কপালে তুলে, কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে জানতে চাইবে, ‘এটা কী রে?’
খুব ভয়ংকর জিনিসরা আসলে খুব হাস্যকরও হয়। কু ক্লাক্স ক্ল্যানের ইউনিফর্মটার কথা ভাবুন। আমার মুণ্ডুর ভেতরের যন্ত্রটা ওইরকম রক্তজমানো আর্তনাদ ছাড়তে পারে বটে, কিন্তু চেহারা খোলতাই। ভুষিরঙের খসখসে তোবড়ানো গা, দন্তহীন মুখগহ্বর।
রিয়েল লাইফের হাসি দেখে যন্ত্রের কনফিডেন্সে টান পড়বে। আস্তে করে মিলিয়ে যাবে হাওয়ায়।
সেদিন এসব হওয়ার চান্স ছিল না। একে রবিবার তার ওপর নববর্ষ। চ্যানেলে চ্যানেলে সুন্দর দেখতে লোকজন সুন্দর জামা পরে বসে নিজেদের সাফল্য উদযাপন করছেন। তাঁদের হাসি আমার কানে হাতুড়ি পিটতে লাগল। টিভি বন্ধ করলাম। মুক্তি নেই। পাড়ায় কে তারস্বরে তা তা থৈ থৈ চালিয়ে রেখেছে। বাঙালি পাড়ায় যেনতেনপ্রকারেণ লেপটে থাকার মজা বুঝলাম হাড়ে হাড়ে।
বিকেল নাগাদ যন্ত্রের চার্জ কমে এল, হাহাকার নিভে এল। দেহটা টেনে তুললাম বিছানা থেকে। চা করলাম। খেলাম। হাতপায়ে তখনও জোর নেই, বুক তখনও অল্পঅল্প ধড়ফড় করছে। কিন্তু নিজেকে আবার সোজা করে তোলা দরকার। আজকের দিনটা কৃষ্ণগহ্বরে বিলীন হয়েছে, কালটাও যাতে না মাটি হয় সেটার একটা চেষ্টা করা দরকার। নীল ডাইরি খুলে নতুন পাতায় নতুন সপ্তাহের টু ডু লিস্ট লিখতে যাব…
একটা উপলব্ধি হল।
সকাল থেকে ফুরিয়ে গেল, ফসকে গেল-র চক্রব্যূহে ঘুরছিলাম বলেই বোধহয় আমার কোনও সন্দেহ ছিল না যে এপ্রিল মাসটাও শিগগিরই ফুরোতে বসেছে। এ সপ্তাহে না হলেও, সামনের সপ্তাহে তো ফুরোচ্ছেই।
ভুল জানতাম। এপ্রিল মাস ফুরোচ্ছে আরও গোটা একটা সপ্তাহ বাদে।
ডায়রির ভাঁজ থেকে একটা এক্সট্রা সপ্তাহ কোলের ওপর খসে পড়ল। যেন প্যান্টের পকেট থেকে বেরোলো ভুলে যাওয়া পাঁচশো টাকার নোট।
ধড়ফড়ানি থেমে গেল, হাতপা স্টেডি হয়ে গেল। ন’টা খসে গিয়ে একটাই মুণ্ডু পড়ে রইল, ধড়ের সঙ্গে টাইট করে আটকানো। ভেতরে উৎসাহ, উদ্দীপনা, পড়ে পাওয়া সপ্তাহটার সদ্ব্যবহারের অযুত সম্ভাবনা গজগজ করছে।
একটু টিভি দেখা যাক। প্রস্তাব দিলাম অর্চিষ্মানকে। দেখবি তো দেখ তক্ষুনি জি বাংলায় নববর্ষের আড্ডা বসেছে, অঞ্জন দত্ত, নীল দত্ত, আবীর, সৃজিত, অনুপম… ভলিউমটলিউম বাড়িয়ে গুছিয়ে বসলাম। মাঝখানে একবার সম্প্রচারের গোলযোগে পর্দা ঝিরিঝিরি হচ্ছিল, বাংলা সংস্কৃতির এই রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ জমায়েতে এইরকম বিঘ্ন কেবল বাংলাদেশেই ঘটতে পারে, রেগে গিয়ে আলোচনা করলাম আমরা।
সারাদিন যে ব্যর্থ, বীভৎস, অনর্থক জীবনটাকে অভিশাপ দিচ্ছিলাম, সেটা সাতদিন দীর্ঘায়িত হওয়াতে শুধু যে মনখারাপ কেটেই গেল তা নয়, নব আনন্দে সর্বাঙ্গ চনমন করে উঠল। কী করে, ভগবানই জানেন।
Mankharap khub vayank jinis.Amar ajkal mankharap hole ami abantor er purono post pori.Man valo hoye jai.Jai hok,ses abdhi j apnar nababarser bikel ta sundor keteche setai bhalo khabar.Apnar man sabsamay valo thakuk,apni aro sundor lekha pathakder upohar din,etai kamana.-Sunanda.
ReplyDeleteআরে থ্যাংক ইউ, সুনন্দা।
DeleteTumi goto post e ekta comment er reply te mon kharap mention korechile ... bhabchilam ki holo.
ReplyDeleteJaak ... ekhon mon bhalo kore nao. Aaj ekhane kaalboishakhi r preparation cholche baaire ... kuchkuche kaalo megh guruguru korche ... du ekbaar bidyut o chomkalo ... dekhi ki hoye.
Tomader holo naki ek poshla?
আমাদের এখানে রোজ সকালেই কেমন অন্ধকার মতো হচ্ছে, কিন্তু আবার কেটেও যাচ্ছে, শর্মিলা। বলছে তো নাকি বর্ষা বেশি হবে এবার, আমিও অপেক্ষায় আছি কী হয় দেখতে।
DeleteAmar keno janina mon kharap holei "mon kharap kora bikel belay" gan ta sunte ichchey kore. ekhon motamuti menei niyechhi je mon kharap ta loop e ghurbe tobe oi tomar motoi, week day te hole ektu upokar hoy ar ki. :)
ReplyDeleteতা হয়, চুপকথা।
Deletehttps://www.youtube.com/watch?v=_6Cf2XDoekc
ReplyDeleteBhalo theko, Kuntala di. :)
থ্যাংক ইউ, বিম্ববতী।
DeleteAha monkharap er ato bhalo bornona khub kom porechi. Mon bhalo hoye gelo. :)
ReplyDeleteহাহা, থ্যাংক ইউ, কুহেলি।
Deleteতারানাথ তান্ত্রিক বে৺চে থাকলে তৃতীয় গল্প আপনাকে নিয়েই লিখত।
ReplyDeleteআপনার কমেন্ট পড়ে কাল রাতে তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প (সানডে সাসপেন্স) শুনতে শুনতে ঘুমোলাম।
Deleteফেসবুক হলে লাভ রিয়াকশন দিতাম । বড় ভালো লাগলো লেখাটা ...বন্ধুদের পড়ালাম , যাদের এ মন খারাপ রাক্ষস আছে :)
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, প্রদীপ্ত।
Deleteধন্য্যবাদ এই পোস্ট লেখার জন্যে।
ReplyDeleteআরে ধন্যবাদ আমারই দেওয়ার কথা, অস্মিতা।
Deletereal life er mon-kharaper ghotona erokom reel-life er moton futiye tolar jonyo onek dhonyobad :) Asha kori ei gorome mon ekhon furfurey acche.
ReplyDeleteগরমে আরও তিতিবিরক্ত করে তুলছে, অরিজিত। তবে শুক্রবারে গরমও মেজাজ মাটি করতে পারে না।
Delete