বাগানের ভূত, ভূতের বাগান
মা বলেন, সোনা তোর সঙ্গে বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করে।
আমারও ইচ্ছে করে মায়ের সঙ্গে বেড়াতে যেতে। মা যাওয়ার জায়গা ঠিক করবেন, ট্রেনবাস থাকার জায়গা বুক করবেন, বিন্দুমাত্র না ঘাবড়ে অসামান্য হিন্দিতে ড্রাইভারজিকে রাস্তা বোঝাবেন, রাস্তাঘাটে আলাপ জমাবেন, কেউ ত্যাঁদড়ামো করলে তাকে সিধে করবেন। আমি হাতপা এলিয়ে বসে থাকব। মায়ের সঙ্গে আমার বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছেতে কোনও রহস্য নেই। কিন্তু মায়ের আমার সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছেটা বেদম রহস্যজনক। মা একবার আমাকে পাহাড়ে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন। হোটেল বুক করে, গাড়ির ব্যবস্থা করে আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে তুলে রওনা দিয়েছিলেন। এগারোটা নাগাদ হোটেলে পৌঁছে ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে স্নানে ঢোকার আগে একটাই দায়িত্ব মা দিয়েছিলেন আমায়, রান্নাঘরে ফোন করে দুপুরের খাওয়ার অর্ডার দেওয়া। আমি কী করেছিলাম ভগবানই জানেন, মোটকথা রান্নাঘরের লোকদের বোঝাতে পারিনি যে আমরা খেতে আসছি। ঘণ্টাখানেক বাদে আমাকে সঙ্গে নিয়ে মা যখন খাবার ঘরে গেলেন আমাদের দেখে ওঁরা অবাক হলেন তারপর সামলে নিয়ে রুটি ডাল মিক্সড ভেজ এনে দিলেন। বললেন, পরের বার যদি একটু খবর দিয়ে খেতে আসেন ম্যাডামজি, তা হলে আরেকটু ভালো খেতে দিতে পারি।
আমার বয়স তখন সাতাশ।
আমি ডুয়ার্স যাইনি, ডুয়ার্স যাওয়া যায়। মূর্তি নদীর পাশের গেস্ট হাউসের বারান্দায় বসে দিগন্তের জঙ্গলরেখার দিকে তাকিয়ে পা দোলানো যায়। মা ল্যান্ডোর দেখেননি, ল্যান্ডোরের ছায়াছায়া পথ ধরে মামেয়ে হাঁটা যায়। সিকিম আমরা কেউই যাইনি, যাওয়া যায়। রাবাংলা, গুরুডংমার ইত্যাদি সুন্দর সুন্দর অনুস্বরযুক্ত নামওয়ালা জায়গায় ঘোরা যায়। আবার দুজনেরই চেনা জায়গায় ফিরে যাওয়া যায়, ধুবড়ির ব্রহ্মপুত্রের পারে বসে পুরোনো দিনের মতো বাদামভাজা খাওয়া যায়।
এই সব সম্ভাবনা নাড়াচাড়া হচ্ছে, মা বললেন খবরের কাগজে না ম্যাগাজিনে কলকাতার ভূতের বাড়ির একটা লিস্ট দেখেছেন সম্প্রতি। কোন বাড়ির বারান্দায় এখনও বর্ষার রাতে সাহেব ভূত বুট পরে হাঁটে, রেডিওর পুরোনো অফিসে মাঝরাতে প্যাঁ প্যাঁ হারমোনিয়াম বাজে। লিস্টটা মা কেটে রেখেছেন। মায়ের ইচ্ছে বুঝে বললাম, লিস্ট ধরে ধরে সব বাড়িগুলো দেখতে গেলে মজা হবে, তাই না মা? মা বললেন, আমি তো সেই ভেবেই জমিয়ে রাখলাম। যদি কোনওদিন সুযোগ হয়…
আপাতত স্থির হয়েছে যদি কোনওদিন সুযোগ হয়, মায়ের হাতের কাছে আমি থাকি, আমার হাতের কাছে মা থাকেন, দুজনেরই হাতে সময় থাকে, শরীরমন চাঙ্গা থাকে, শীতগ্রীষ্ম মাপমতো থাকে তা হলে আমরা লিস্টটা নিয়ে গুটি গুটি শহর পরিভ্রমণে বেরোব। দিনাদিনিই যাওয়া ভালো, বাড়ির মালিকদের সঙ্গে দেখা হওয়ার চান্স কম থাকবে।
*****
আমি কোনওদিন ভূত দেখিনি। অনেকবার মনে হয়েছে ঘাড়ের ঠিক পেছনে কে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস ফেলছে, রাতে একা শুয়ে মনে হয়েছে ঘাড় ফেরালেই দেখব জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে কে হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে, কিন্তু ঘাড় যেহেতু ফেরাইনি ভূতের সঙ্গে দেখাও হয়নি। দূরসম্পর্কের এক দিদা ছিলেন, আমাকে খুব ভালোবাসতেন, বাড়িতে গেলেই পাটিসাপটা খাওয়াতেন। আচমকা একদিন, কোনও কারণ ছাড়াই, এমন নয় যে সারাদিন দিদার কথা ভেবেছি কিংবা আমার সামনে বসে আমাকে না দিয়ে কেউ পাটিসাপটা খেয়েছে, সম্পূর্ণ আলটপকা দিদাকে স্বপ্ন দেখলাম। পরদিন মা খবর দিলেন, দিদা মারা গেছেন। জানুয়ারি মাসের রাতে হোস্টেলের হিটারহীন রুমে ঘাম ছুটে গিয়েছিল। মারা যাওয়ার সময় জানতে চাইলাম। মা বললেন, এই তো আজ সকাল দশটার সময়। সকাল দশটার সময় আমি দিদার স্বপ্ন দেখে উঠে ক্লাসে গিয়ে সাইমালটেনিয়াস ইকুয়েশন পড়ছিলাম। অর্থাৎ দিদা আমাকে দেখা দিতে এসেছিলেন ভূত হওয়ার আগেই। টাটা বলতে সম্ভবত।
মাও কোনওদিন ভূত দেখেননি। আমার থেকে আঠাশ বছর বেশি পৃথিবীতে চলাফেরা করা সত্ত্বেও। ছোটবেলায় খেয়ে উঠে যে সব ভাইবোনদের আগে হাত ধোয়া হয়ে যেত, তারা বাকিদের উদ্দেশে ‘তিন কালা ভূত টিক্কি ধইরা টান দিল রে এ এ এ’ বলে হ্যারিকেনের আলোছায়ামাখা কুয়োতলা পেরিয়ে ধুপধাপ দৌড়ত, সে হুল্লোড়ে যোগ দেবার লোভেও কোনও কচিকাঁচা ভূত আসেনি কোনওদিন।
ধরে নেওয়া যায় বাবাও কোনওদিন ভূত দেখেননি, দেখলে গল্প শুনতাম নিশ্চয়।
বাড়িতে ভূত দেখেছিলেন একমাত্র ঠাকুমা। ভরদুপুরবেলা, মাখনদাদুর বাগানে। ঠাকুমা বলতেন মাখমবাবু। মাখনদাদুর বাড়িতে মাখনদাদু, মাখনদাদুর স্ত্রী আর মিঠু নামের সবুজ টিয়া থাকত। ওই রকম নার্সিসিস্ট টিয়া আমি আর দেখিনি। সারাদিন দাঁড়ে বসে সে নিজের নাম ধরে চেঁচাত। মিঠুউউউউ, মিঠুউউউউ, মিঠুউউউউ। নিজের দাদু মারা যাওয়ার পরপরই আমি অমর চিত্র কথায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনী পড়ি এবং মাখনদাদুর সঙ্গে ঠাকুমার বিয়ের ব্যাপারটা বাড়ির লোককে ভেবে দেখতে বলি। মানানসই বয়সটা একটা কারণ, তাছাড়া বিয়ের পর ঠাকুমা একেবারে পাশের বাড়িতেই থাকবেন সেটাও সুবিধেজনক।
মাখনদাদুদের ছিল পাঁচিলঘেরা বিরাট বাগান। কাঠাবিঘের মাপ বলতে পারব না কিন্তু দুখানা বোম্বাই সাইজের দোতলা বাড়ি মাখনদাদুর বাগানে হেসেখেলে এঁটে গেছে। সে বাগানে আমার চেনা প্রায় সবরকম ফলের গাছ ছিল। আম জাম কাঁঠাল পেয়ারা নারকেল সুপুরি, আরও কত নাম ভুলে যাচ্ছি। ওই বাগানেই প্যাঁচা দেখেছিলাম আমি প্রথম। প্রথম শকুন দেখেছিলাম। সুপুরিগাছের মাথায় কুঁজো পিঠ আর সরু ঠোঁট নিয়ে বসে এদিকওদিক তাকাচ্ছিল।
তিনজনের মধ্যে প্রথম মারা গিয়েছিলেন মাখনদাদুর স্ত্রী। পরের গরমের শুরুতে, আমগাছে সবে মুকুল ধরেছে, দুপুরবেলা পুজো করার আগে বাগানের কল থেকে জল ভরতে না কী করতে গিয়ে ঠাকুমা দেখেছিলেন বাগানে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। ঘাড় উঁচু করে আমগাছের মুকুলভরা ডালের দিকে তাকিয়ে।
ঠাকুমার হাতের কাঁসার ঘটি স্টেডি ছিল। ঘরে ঢুকে পাপোশে পা ঘষতে ঘষতে ঠাকুমা খবরটা দিয়েছিলেন। ভয় যে ঠাকুমা পাবেন না সে জানতাম, কিন্তু ঠাকুমা একবিন্দু অবাকও হননি। মরে গেলেই যে মানুষের মায়া ফুরোয় না, সে যে আমের মুকুল পাহারা দিতে ফিরে আসতে পারে সেটা যেন পৃথিবীর সবথেকে সহজসরল যুক্তির কথা।
মাখনদাদু আর মিঠুর মধ্যে কে আগে গেল সেটা অনেক ভেবেও মনে করতে পারছি না। মিঠু কীভাবে গেল, উড়ে না মরে, সেটাও না। মাখনদাদুর যাওয়াটা তবু খানিকটা স্মৃতিতে আছে, কারণ শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন খেতে গেছিলাম। বাগানের ধারে প্যান্ডেল বেঁধে পংক্তিভোজন হয়েছিল।
শ্রাদ্ধের পরদিন সকালবেলা দাদুর ছেলে এবং মেয়ে, যারা নিজের নিজের সংসার ছেড়ে পিতৃদায় পালনে এসেছিল, ছাদ ফাটিয়ে পাড়া বাজিয়ে ঝগড়া করেছিল। মাসছয়েকের মধ্যে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল মাখনদাদুর বাড়ি, বাগান।
বাড়িটা এখনও আছে। নতুন মালিকেরা বেশি অদলবদল করেননি। বাগান নেই। সেখানে এখন দুখানা প্রকাণ্ড বাড়ি। নতুন স্টাইলের এফিশিয়েন্ট ডিজাইনের বাড়ি। জমির সবটুকু বর্গইঞ্চি নিংড়ে তৈরি, পাঁচিল আর বাড়ির দেওয়ালের মধ্যে দু’পা পাশাপাশি রাখা যায় কি যায় না। তাতেও জায়গা কম পড়ে, বছর ঘুরতে না ঘুরতে দোতলার ওপর তিনতলা তুলতে হয়। গাছটাছ ফুলটুল যা থাকার থাকে ছাদের টবে। ও সব বাড়িতে অনেক ধনসম্পদও থাকে তাই চোর তাড়াতে চারদিকে বড় বড় ফ্লুরোসেন্ট লাইট লাগাতে হয়। আমাদের ছাদের উত্তরদিকটা এখন সারারাত সাদা সি এফ এল আলোয় ফ্যাটফ্যাট করে। উত্তরের ওই অংশটুকুই ছিল আমাদের ফেভারিট, ওইখানে মাদুর পেতে শুলে এদিকওদিক থেকে গাছের ডাল বেরিয়ে আকাশ ফুটিফাটা করে দিত না। এদিকে কালপুরুষ ওদিকে সপ্তর্ষি স্পষ্ট দেখা যেত। এখন ওদিকে শুলে সারা শরীরে আলো, আকাশ অস্পষ্ট।
বাড়ি গেলে আর ছাদে উঠলে আজকাল দক্ষিণপূর্বের অন্ধকার ফালিটুকুতে নিজেকে কোনওরকমে ঢাকা দিয়ে আমি মাখনদাদুর বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকি। কল্পনা করি, আলো নিভে গেছে। অন্ধকারে মাথা তুলেছে বৃক্ষের দল। ডালপালা মেলেছে, পাতার ফাঁকে ফাঁকে জমেছে ঘন ঠাণ্ডা ছায়া। গাছের ডালে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে ধপধপে লক্ষ্মীপেঁচা। সুপুরিগাছের ওপর আবের মতো ফুলে রয়েছে অন্ধকার, অন্ধকার না, ডানা গুটিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে শকুনের দল। বাগানের দিক থেকে আসছে মুকুলের আঠালো সুবাস, সে গন্ধে ঝিম ধরে ধরে, অমনি হৃৎপিণ্ড বন্ধ করে দিয়ে সরু গলায় কে যেন চেঁচিয়ে ওঠে, মিঠুউউউউ মিঠুউউউউ মিঠুউউউউ।
এত করে চাই, তবু মাখনদাদুর বাগানের ভূতেরা আমাকে দেখা দেয় না।
Lekhata pare thakumar sahaser tarif na kare parchi na,onno keu hole okhanei nirghat murcha jeto.Ami bhoote bejay voi pai,fale tader mukhomukhi habar kono basonai amar nei,jadi na tara sirsendu mukhopadhay ba lila majumder er galper vuteder mato valo hoi.-Sunanda.
ReplyDeleteঅত ভালো ভূত গল্পেই হয়, সুনন্দা, বাস্তবের ভূতেরা সব রিং সিনেমার ভূতের মতো, আমি শিওর।
DeletePatishapta khawano lokera shobai eke eke mara jachhen. Er por khete chaile bhut-i bhorsha :(
ReplyDeleteযা বলেছ।
Deleteতোমার ঠাকুমার কথা যত শুনি তত মুগ্ধ হই। জলজ্যান্ত ভূত দেখেও একটু ঢোঁক গিললেন না!
ReplyDeleteসে যুগের লোকেরা ভেজালহীন জিনিস খেতেন তো, অন্য রকম ধাতুতে গড়া হতেন, বিম্ববতী।
DeleteKi bhalo
ReplyDeleteAmi rishrar bari jabo kuntala, jekhane lokkhipencha amar dike takiye thakbe
এখন আর তাকাবে না রে তিন্নি, পঁচিশ বছর আগে তাকাত।
DeleteEi lekhata boddo bhalo laglo. Sabash Kuntala :)
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ অরিজিত।
Deleteলেখাটায় এত মায়া ভরা আছে যে খুব সাবধানে পড়তে হয়। যদি এই মায়া ছিটকে এসে চোখে লাগে, তাহলে ছোটোবেলার পুকুর আর বটের ঝুরি নামানো অলস বিকেলের মুহূর্তরা এই তুচ্ছ বর্তমানকে উড়িয়ে দিয়ে আমার দখল নেবে।
ReplyDeleteঅন আ ডিফারেন্ট নোট, আমি ভূত না দেখলেও ভৌতিক অভিজ্ঞতা হয়েছে খান তিনেক। কখনও সুযোগ পেলে বলব।
থ্যাংক ইউ, ঋজু। আপনার গল্প শোনার অপেক্ষায় রইলাম।
Deleteআমাদেরও বাড়ি হারিয়ে গেছে কুন্তলা। আমার বাড়ি ছিল রহড়ায়। তোমার মাখমদাদুর বাড়ির মতোই বড় মনে হয়। হয় কেন, নিশ্চিতই তাই কারণ আমরা বাড়ি বেচার পরে ওখানে চারখানা বড় বড় ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে। আমার দুবছর বয়েসে পুরোনো বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি তৈরী হয়।
ReplyDeleteবর্গক্ষেত্রের উত্তরপূর্ব কোন ঘেঁষে আমাদের বাড়ি। প্রকান্ড গেট। তারপরে গাড়ি যাওয়ার মতন চওড়া মোরাম আর সুরকির রাস্তা। একটা ঢুকে ডানদিকে বেঁকে গেছে সদর দরজার দিকে। আর অন্যটা তীরের ফলার মতন সোজা এগিয়েছে খিড়কি দোরের দিকে। সদর দরজার রাস্তার দুপাশের জমিতে ছোট্ট বাগান। সেখানে একটা কাঁঠালচাঁপার গাছ। পাড়ার একজনের বাড়ি থেকে চেয়ে এনে গেটের দুপাশে লাগিয়েছিলাম দুই বোনে। ডানদিকেরটা বাঁচেনি। বাঁদিকের টা তরতর করে বেড়ে দোতালা সমান হয়ে গেছিল। তারপাশেই সব বাবার শখের ফুলের বাহার। প্যানসি, জারবেরা, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া। বাড়ির খিড়কি রাস্তার দুপাশে আবার দেবদারু গাছের সারি। সে আবার হুইস্পারিং দেবদারু। একটু হাওয়া দিলেই দুলে দুলে ফিসফিস করে কথা বলতো। খিড়কি দরজার দুপাশে আবার সন্ধ্যামালতী ভিড়। সন্ধ্যেবেলা সদ্য ফোটা ফুল তুলে পেছেনদিকে চুষলে মিষ্টি হয়ে থাকতো মুখটা।
পুরোনো বাড়ির সুরকি গুলো বাড়ির পাশের বাগানে একটা টিলা তৈরী হয়েছিল। কোনোদিন বিকেলে আমি আর বোন কয়লাখনির মজুর হয়ে কোদাল আর ঝুড়ি নিয়ে সুরকি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে "কয়লা" তুলতাম, মাঝে মাঝে নুড়ির ছদ্মবেশে "হিরে" ও পেতাম বৈকি। টিলার ঠিক পেছনে ছিল বাড়ির মিটার ঘর। মাঝে মাঝে প্রাণ হাতে করে সেখানে দুঃসাহসিক অভিযানে যেতাম আমরা। কিং সলমনের রত্নখনির খোঁজে। অবশ্য এটা বাড়ির বর্ডার চোখ এড়িয়ে যেতে হত। মাঝে মধ্যেই ওখানে সাপের খোলস পাওয়া যেত কিনা।
বাড়ির আরেক পাশের দেওয়াল ঘেঁষে শিউলি, জবা আর স্থলপদ্মের রাজত্ব। সারাটা শরৎ বাড়ির পাশটা ভরে থাকতো শিউলি ফুলের গন্ধে। বাড়ির গা ঘেঁষে ছিল নিতান্তই গদ্য ব্যাপার স্যাপার। লাউ আর কুমড়োর মাচা। ওখানেই একবার দাদুর সাথে ঢুকে লাউডগা স্যাপ দেখেছিলাম। ফিকে সবুজ রঙের সাপটা পুঁতির মতন চোখ মেলে চুপচাপ আমাদের দেখছিল। দাদু আমার হাতটা শক্ত করে ধরে আস্তে আস্তে পেছনে হেঁটে মাচার তোলা থেকে বেরিয়ে এসেছিলো। লাউ হলে তুলে খেতাম আমরা। পাতা দিয়ে বেটে দিদি লাউপাতা বাটা বানাতো। এখনো বানাই কিন্তু সে স্বাদ আর ফিরে আসেনা।
বাড়ির ঠিক পেছনে একটু খানি সভ্যভদ্র জায়গা। সেখানে বাবা, মা, বোন, আমি আর দিদি, পাঁচজনের আলাদা আলাদা সবজি ক্ষেত। তাতে লংকা, মটরশুঁটি, ভুট্টা, টমেটো সব হয়। যার যেমন ইচ্ছে। বাগানের সবজি বড় হলে তুলে এনে তাদের নিয়ে পিকনিকও হয়। বাগানের পেছনদিকটা ঘন জঙ্গল। তাতে খান পাঁচেক আম গাছ, গোটা দশ বারো সুপুরি গাছ, এছাড়া বিষটক বাতাবি লেবু, আমড়া, তাল, নারকেল সব গাছ। সেখানে যেতাম আমাজন এক্সপ্লোরেশনে। কয়েকবছর পর আমরা একটু বড় হলে কাকু একবার ছুটিতে এসে আমগাছের ডালে একটা দোলনা লাগিয়ে দিয়ে গেছিলো। গরমকালের দুপুরে আগের দিনের ঝড়ে পরে যাওয়া আম বা বাতাবি মাখা নিয়ে দোলনা চড়তে যেতাম। নারকোল গাছগুলোর মধ্যে একটা ছিল ভারী মজাদার। বাবা আন্দামানের থেকে নিয়ে এসেছিলো নারকোল গাছের চারাটা। বেঁটে খাটো গাছ একেবারে। মইয়ে চড়েই হাত পাওয়া যেত। আমরা রান্নাঘরের ঘড়াঞ্চি তুলে এনে নারকোল পাড়তে যেতাম।
বাগানের শেষে ছোট্ট গেট। গেটের পরে এজমালি পুকুর। ওখানে প্রিয় কাজ ছিল খোলামকুচি ছুঁড়ে ব্যাঙবাজি করা। বছরে দুবার জেলেরা এসে জাল ফেলতো। তিন চারটে ঝুড়ি করে মাছ দিয়ে যেত বাড়িতে।
তারপর আর কি। একের পর এক দিন চলে গেলো। আমরা বড় হলাম। বাইরে পড়তে এলাম আমি। আর বাবার কাছে একের পর এক প্রোমোটার আসতে থাকলো। যেখানে এত লোকের থাকার জায়গা নেই সেখানে একটা বাড়ি এতটা জায়গা নিয়ে থাকবে এতো ভারী অন্যায়। ভয় পেলাম, বুঝলে? বাড়ি বিক্রি করে রাজারহাটের নতুন ফ্ল্যাটে উঠে এলাম আমরা। আর আমাদের সব গাছ কেটে, বাড়ি ভেঙে সেখানে চারটে নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি হল। শুনেছি ভাল হয়েছে। আমি বা বোন দেখতে যাইনি কখনো।
মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত লাগলে আমি দুচোখ বুজে ফেলি। আর অমনি বাড়িটা রাজ্যের স্মৃতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরে মনের মাঝে। সেখানে আবার আমি নিজের মনে আচার খেতে গল্পের বই পড়ি বা মায়ের চোখ লুকিয়ে কালবৈশাখী ঝড়ের মধ্যে বেরোই আম কুড়োতে। নইলে তো সব পাড়ার বাচ্চারা নিয়ে যাবে, আমরা ভাগে পাবনা। বাস্তবের চুন বালি সুরকির মাঝে আমার নিজস্ব একটুকরো ওয়ান্ডারল্যান্ড।
ইস, কী অপচয়, কী অপচয়। যাই হোক, অপচয় জীবনের নিয়ম। যা হওয়ার তাই হয়েছে এ মেনে নেওয়া ছাড়া আর উপায় নেই। লেখাটা ভীষণ মনখারাপ করা হয়েছে, চুপকথা। থ্যাংক ইউ।
Deleteমাখমদাদুর গল্পের থেকেও আপনার গল্পটা পড়ে মন খারাপ হল বেশি। কাকু কাকিমা না জানি কি করে থাকেন ফ্ল্যাট বাড়িতে।
Deleteআমরা চারজনেই প্রসঙ্গটা প্রানপন অ্যাভয়েড করি। যদি তাও কখনো বাড়ির কথা ওঠে সবাই গলার স্বরে অতিরিক্ত উৎসাহ নিয়ে বাকিদের বোঝাই নতুন ফ্ল্যাটটা কি ভালো হয়েছে, সব আত্মীয়স্বজনের কাছে, সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়, ফ্ল্যাটের বাঁদিকটা কতখানি খোলা, সেখানে কি সুন্দর আলো হাওয়া আসে। এরকম বলতে বলতে একটা সময় গলা শুকিয়ে সবাই থেমে যায় আর ঘরে ঝুপ করে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে আসে।
Deleteতোমার গল্পটা হাত ধরে লিখিয়ে নিল আমায়। নিজে লিখিনি।
Deleteআপনার লেখাটা বড় মন খারাপ করে দিলো চুপকথা । আমরা একটা অসভ্য জনজাতি ...নিজেদের চাপেই নিজেরা মরে যাবো ঠিক ।
Deleteস্বপ্নেই থাক আলাদীন ...।
aha chokhe jol ese gelo lekha ta pore. Bidyasagar er jeeboni pore thakumar biye deyar idea ta amar khub pochondo holo. thakuma koto sahosee chhilen. ami to ghorer modhye ak ak somoy nijer chhaya dekhe emon chomke uthi je heartfail korar upokrom hoy.
ReplyDeleteBhooter barir list ta amakeo dio please. ami ar amar bondhu mile jabo.
অলরাইট, কুহেলি।
Deleteআপনার ভুতের লেখা পড়লেই সেই কলতলা থেকে দৌড়ে আসার গল্পটা মনে পড়ে। সেই যে 'তুমি কি ওনাদের থেকে জোরে দৌড়াতে পারবে'টা। কতজনকে যে ওটা শুনিয়েছি।
ReplyDeleteওই গল্পটা আমারও পছন্দের।
DeleteKi sundor lekha ta!!Kayek din dhore emni e mon ta barir janne baro kharap chilo..apnar lekha ta mon ke baro nara diye galo.
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, কথাকলি।
Deleteবড় মন কেমনের লেখা কুন্তলাদি ...
ReplyDeleteধন্যবাদ, প্রদীপ্ত।
Delete