বাসাবদলের পরে
স্কুলে বাধ্যতামূলক কেমিস্ট্রি পড়তে হওয়া নিয়ে আমার একসময় ক্ষোভ ছিল। কী লাভ হয়েছে? জলের আরেক নাম এইচ টু ও আর নুনের আরেক নাম এন এ সি এল জানা ছাড়া? পরে অবশ্য ক্ষোভ মিটেও গেছে। আমার কাজে লাগেনি, অনেকের নিশ্চয় লেগেছে। সব বিষয় ক্লাস টেন পর্যন্ত আবশ্যিক করে রাখাটাও বাড়াবাড়ি মনে হত একসময়। সেটাও কেটে গেল যখন শুনলাম অনেক দেশে, রীতিমত সভ্য দেশে ক্লাস ফোরটোর নাগাদই অ্যাপটিচিউড চিহ্নিত করে স্ট্রিম আলাদা করে দেয়। ক্লাস ফোর ফাইভে আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতি না কী একটা ক্লাস হত যেখানে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ শঙ্করাচার্য নিতাইনিমাই জগাইমাধাই এইসব পড়ানো হত। আমি তাতে নিয়মিত পঁচানব্বই পেতাম। সেই দেখে আমার অ্যাপটিচিউড নির্ধারণ যে হয়নি ভালোই হয়েছে।
নিজের এবং পরের শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে অনেক বিশ্বাস আমার উলটেপালটে গেছে, কেমিস্ট্রি কিংবা ভারতীয় সংস্কৃতি পড়া উচিত না উচিত না, কতদিন পড়া উচিত এসব নিয়ে আমার আর কোনও মাথাব্যথা নেই। ইন ফ্যাক্ট, পড়েছি ভালোই হয়েছে, না পড়ে টিভি দেখলে খারাপ হত।
কিন্তু যে ব্যাপারটাতে আমার প্রত্যয় ক্রমশ বাড়ছে সেটা হচ্ছে বাকিগুলোর সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু বিষয় আমাদের পড়ানো উচিত ছিল। ঐচ্ছিকটৈচ্ছিক নয়, বাধ্যতামূলক।
এসি মেশিনের বেসিক অ্যানাটমি এবং কার্যপদ্ধতি। টিভির ডিশ অ্যান্টেনা একবাড়ির ছাদ থেকে খুলে অন্য আরেকবাড়ির ছাদে লাগানো। খারাপ কলিং বেল সারানো। রান্নাঘরের পাইপ আনক্লগ করার কৌশল।
এই সব কাজ যাঁরা করতে জানেন গত তিনদিন তাঁদের পিছু ধাওয়া করতে করতে আমি বুঝেছি ভারতীয় সংস্কৃতিতে পঁচানব্বই পেলে আর কেমিস্ট্রির ইকুয়েশন কোনওমতে উগরে দিয়ে উতরে গেলেও লাইফ স্কিল আমার শূন্য। দরজার বাইরে দেওয়ালের ইলেকট্রিকের বাক্সগুলোর ঢাকনা খুলে তার সামনে আমাকে দাঁড় করিয়ে দেওয়াও যা, একটা রকেট ইঞ্জিনের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়াও তাই। ভালো স্টুডেন্টরা সিলেবাসের বাইরের এ সব জরুরি বিদ্যা নিজ উদ্যোগে শিখে নিতে পারেন, কিন্তু আমার মতো লাস্ট বেঞ্চের ছাত্ররা, যারা নিজের উদ্যোগে ক্যান্ডি ক্রাশ ছাড়া আর কিছু শিখে উঠতে পারেনি কোনওদিনও, তাদের জন্য এগুলো পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হওয়া মাস্ট।
*****
একগাদা বাক্স, বাক্সে না আঁটলে নতুন পুরোনো বেডকভারে জিনিস পুঁটলি বেঁধে এসে বাড়ির দখল নিলেই বাড়ি নিজেদের হয়ে যায় না। ঠিক যেমন বাক্সপুঁটলি নিয়ে বাড়ি ছেড়ে গেলেই যাওয়া হয় না। বাথরুমে রাখা উদ্বৃত্ত সার্ফ এক্সেলে, রান্নাঘরের পেরেকে চিহ্ন লেগে থাকে।
আগের ভাড়াটেদের চিহ্ন মুছে ফেলে নিজেদের ঝাণ্ডা গাড়ার প্রক্রিয়া চলছিল এতদিন। শেষ হয়েছে বলব না, খানিকটা এগিয়েছে। হোঁচট খেতে খেতে, জানা জিনিস ভুল করতে করতে এগোচ্ছি। জানা কথা, যে যার মশলার র্যাকের সাইজ বুঝে পেরেক পোঁতে। কারও পেরেক কারও র্যাকের সঙ্গে মেলে না। জেনেশুনেও আগের ভাড়াটের পুঁতে যাওয়া পেরেকে আমার মশলার তাক ঝোলাতে গেলাম। ঝুলিয়েটুলিয়ে ওরে-বাবা-কত-কাজ-করে-ফেলেছি ভঙ্গিতে শোওয়ার ঘরে এসে এক দান ক্যান্ডি ক্রাশ খেলেছি, অমনি কড়াৎ। সারি সারি কাঁচের শিশিসহ র্যাক ভূলুণ্ঠিত। সকালে আয়নার সামনে দাঁড়ানোর আগে নির্ঘাত অর্চিষ্মানের ঘুমন্ত মুখে চোখ পড়েছিল, প্রতিটি শিশি অটুট রয়েছে।
আগের বাসিন্দারা ভক্তমানুষ ছিলেন, চতুর্দিকে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ সারদামণি অনুকূল ঠাকুর সাঁইবাবা। দরজার ফ্রেমে, জানালার সিলে, রান্নাঘরের টাইলে। নমো করে ঠাকুরদেবতাদের নামিয়ে রাখলাম। ল্যাম্পশেড থেকে সাদা রঙের সি এফ এল খুলে হলুদ এল ই ডি লাগালাম। হাঁ জানালায় চেনা পর্দা টাঙিয়ে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি হলকার মুখে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করলাম।
বাড়িটা খানিকটা আমাদের মতো হল।
খাট পাতা হল, বুককেস ভরে উঠল। দেড়দিন হাতে পায়ে ধরে সাধার পর টিভি কর্তৃপক্ষ এলেন, সেট টপ বক্স খুঁজে দিতে দেড় মিনিট দেরি হওয়াতে, ‘আগে থেকে সব হাতের কাছে গুছিয়ে রাখতে পারেন না? আমাদের সময়ের দাম নেই নাকি?’ ধমক দিয়ে গেলেন। সতেরোখানা বড় মাঝারি পুঁচকে কার্টন চৌকো থেকে চ্যাপ্টা হয়ে ওয়ার্ডরোবের মাথায় চড়ে বসল। আমরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রান্নাঘরের বাক্সগুলোতে হাত দিলাম।
ইস, রান্নাঘরটাই তো সবার আগে সেট করতে হয়। মা ফোনে ছিক ছিক করলেন। এই জন্য এ সব কাজে একটা বুড়ো মানুষ লাগে।
প্রথমত, আমিও যথেষ্ট বুড়ো হয়েছি, দ্বিতীয়ত, বুড়ো হলেই বেশি সেয়ানা হয় না। এই যেমন মা বুড়ো হয়েছেন কিন্তু এই আপাত বুদ্ধিহীন সিদ্ধান্তের পেছনে আমাদের শয়তানিটা ধরতে পারেননি।
যতদিন না রান্নাঘর আনপ্যাক হচ্ছে ততদিন তো না খেয়ে থাকা যায় না। সমাধান?
মা তারা-য় ভাত ডাল আলু পোস্ত অমলেটের ঝোল, নৈবেদ্যম-এ বাটারমিল্ক দিয়ে উদুপি দোসা, ফ্লেমিং ওয়ক-এ সেজুয়ান চিলি নুডলস উইথ ব্রকোলি মাশরুম ইন ব্ল্যাক বিন সস।
অবশেষে সে চৈত পরবের অবসান হয়েছে। রান্নাঘরের তিনখানা কার্টনই আনপ্যাক হয়ে গেছে। প্রথম বাক্স থেকে চায়ের কাপ, দ্বিতীয় বাক্স থেকে চা পাতা আর তৃতীয় বাক্সের একেবারে নিচ থেকে ইলেকট্রিক কেটলিখানাও আত্মপ্রকাশ করেছে।
অবশেষে সে চৈত পরবের অবসান হয়েছে। রান্নাঘরের তিনখানা কার্টনই আনপ্যাক হয়ে গেছে। প্রথম বাক্স থেকে চায়ের কাপ, দ্বিতীয় বাক্স থেকে চা পাতা আর তৃতীয় বাক্সের একেবারে নিচ থেকে ইলেকট্রিক কেটলিখানাও আত্মপ্রকাশ করেছে।
এখন খাটের ওপর ফ্যানের নিচে বসে যে যার কাপে চা খেতে খেতে সংগীত বাংলা দেখছি। বাড়িটা যে আমাদেরই সে নিয়ে আর কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই।
Ki moja ki moja. Ami goto chhoy mashe 2bar bari bodol kore bujhechi ki chaper bepar sobkichu. Mughal samrajyer potoner karon na jene urey jawa fuse ki kore thik korte hoy seta shekha je koto joruri chilo setao harey harey bujhechi. electrician der moto vip ar duniyate keu nei seta light chole gele malum hoy. in fact plumbing shekhao khub joruri. ami khali haturi niye deyale perek marte jani. ar proletariat der cheye better bathroom porishkar ar bason majte.
ReplyDeletetomader aktao kacher shishi bhangeni shune ki je khushi holam.
আমি ভাবছি নাপতোল থেকে একটা ড্রিল মেশিন কিনে নিজেই নিজের শিক্ষা শুরু করব।
DeleteBah. Ei barite jano sobkichu khaate boshe sangeet bangla dyakhar moto aramer hoy. Dugga dugga.
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, বিম্ববতী।
DeleteSangeet bangla...... Bhaba jai tomar ar amar modhye bodhoy shudhu ei ekta mil khuje pete amar baki chilo..... Jio
ReplyDeleteহাই ফাইভ, রণিতা।
Deleteভাগ্যিস শিশিগুলো ভাঙেনি !
ReplyDeleteভাগ্যিস বলে ভাগ্যিস। কাঁচ আর গুঁড়ো মশলার মিশ্রণ পরিষ্কার করতে হলেই হয়েছিল।
DeleteToder natun barite sangshar ente sente jome uthuk !!! .. :D :D
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, বৈশালী।
Deleteonek shubheccha.. notun barite khub bhalo katuk apnader..
ReplyDeleteiye, sangeet bangla-r gaan e click kore bhora office e ekkebare ja ta kando hoye gelo
ইস, এটা সাবধান করা উচিত ছিল, ঋতম। ভেরি সরি। যাই হোক, গানটা ভালো কি না?
Deleteশুভেচ্ছার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
নতুন বাড়িতে দিন ভালো কাটুক । শুভেচ্ছা রইলো অনেক । -প্রদীপ্ত
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, প্রদীপ্ত।
Deleteএকি? আপনাদের স্কুলে ওয়ার্ক এক্সপিরিয়েন্স ছিল না? আমাদের স্কুলে ছিল এস ইউ পি ডব্লু (সোশ্যালি ইউসফুল প্রোডাক্টিভ ওয়ার্ক)। সেই ক্লাস মন দিয়ে করিনি, তাই শিক্ষা হয়নি। কিন্ত আমার কিছু সহপাঠীকে দেখেছি টুকটাক টিউবলাইটের চোক বদলে ফেলে, সোলডারিং আয়রন দিয়ে ঝালাই করে ফেলে, ফিউজ সারিয়ে নিতে পারে। আমার এখনের বস জার্মান, তিনি বলেন জার্মানিতে এসব কাজ নাকি সবাই পারে।
ReplyDeleteরান্নাঘর গোছানোর কাজে গাফিলতিটা দারুণ লাগলো। হীরক রাজা হলে বলতেন - বটে? এত বুদ্ধি তোমার ঘটে?
নতুন বাড়িতে আপনাদের জীবন আরও সুন্দর হয়ে উঠুক।
আমাদের সেলাই শেখানো হয়েছিল, দেবাশিস। আর পাপোশ বানানো। শুভেচ্ছার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
DeleteNotun rannaghor cha diye inauguration ... er theke bhalo ar kichu hote pare na. :-)
ReplyDeleteআমিও একমত, শর্মিলা।
Deleteলেখায় ধৈর্য্য আছে।
ReplyDelete