মায়ের চাওয়া



অনলাইন বেচাকেনার এই বাজারে সোমবার সকালে অফিস পৌঁছে ডেস্কের ওপর পার্সেল পড়ে থাকতে দেখাটা কিছু সারপ্রাইজ নয়। কিন্তু সে বাক্সের ওপর প্রিন্ট আউটে খুদি খুদি অক্ষরের বদলে নীল কালিতে গোটা গোটা অক্ষরে আমার নামঠিকানা লেখা থাকাটা সারপ্রাইজ। কে পাঠিয়েছে তাতে অবশ্য কোনও সারপ্রাইজ নেই, অক্ষরের ছাঁদ আমার চেনা। 

মা অফিসে মেডিক্যাল বিল জমা দিতে গিয়েছিলেন। কলেজ স্ট্রিট হয়ে বই কিনে পাঠিয়েছেন। সাহিত্য অকাদেমি প্রকাশনের 'বাংলা গল্প সংকলন' প্রথম এবং দ্বিতীয় খণ্ড। ফ্লিপকার্ট থেকেও পাঠাতে পারতেন কিন্তু তাতে নিজে হাতে লিখে দিতে পারতেন না, তাই সশরীরে কিনে প্রথমপাতায় শুভেচ্ছাবার্তা লিখে পাঠিয়েছেন। 

খুব খুশি হলাম, তারপর মনে হল আমারও মাকে কিছু দেওয়া উচিত। তাছাড়া আমাদের বিবাহবার্ষিকী উদযাপনের এত কাছে মাদার’স ডে, মাকে কিছু দেওয়ার এর থেকে ভালো ছুতো আর কী হতে পারে। 

মাকেই জিজ্ঞাসা করলাম। তোমাকে কী দেব মা? শাড়ি? পাগল, কয়েকটা নিয়ে গিয়ে আমার আলমারিটা খালি কর সোনা। স্মার্ট ফোন? সুখে থাকতে ভূতের কিল খাওয়াবি সোনা? কাছে থাকলে খাওয়াতে নিয়ে যাওয়া যেত, যদিও সেটাও একটা স্ট্রাগল। মা বলবেন, কী হবে সোনা একগাদা টাকা নষ্ট করে বাইরে খেতে গিয়ে? তার থেকে আমি গরম গরম দুটো রুটি করে দিই, আলুভাজা ভেজে দিই। ধড়াচূড়া পরে দোকানে গিয়ে খাওয়ার থেকে বেশি আরাম হবে, দেখিস। সে আমিও জানি হবে। কিন্তু দ্যাট ইজ নট দ্য পয়েন্ট। এটা তোমার দিন, আমি তোমার আরামের খেয়াল রাখব, তুমি আরাম করবে, সেটাই মাতৃদিবস পালনের পয়েন্ট। মা হাঁ করে থাকেন। আমার আরাম, বিশেষ করে মায়ের পরিশ্রমের ফলে জাত আমার আরাম থেকে তাঁর নিজের আরাম যে আলাদা হতে পারে, এই শক্ত কথাটা তাঁর মাথায় ঢোকে না।

ব্লগেট্‌লগে মাদার’স ডের গিফট গাইড দেখেছি, মনে করার চেষ্টা করলাম। মুখে মাখার ক্রিমট্রিম পাঠালে মাখার দু’মিনিটের মধ্যে মা গলগল করে ঘামতে শুরু করবেন (আমি জানি, ঘামার প্রতিভা আমাদের দুজনের কমন) দৌড়ে গিয়ে ধুয়ে ফেলে প্রাণে বাঁচতে হবে। বই পাঠানো যায়, কিন্তু সে বই মা বিকেলবেলা গিয়ে লাইব্রেরি থেকে তুলে আনতে পারেন। ফুল চকোলেট টেডি বিয়ার পাঠানো মহা হাস্যকর হবে।

খবরদার পয়সা খরচ করবি না সোনা। 

ভাবনা ছিঁড়ে মায়ের সতর্কবাণী ঢুকে পড়ে।

ওহ, মা মেটেরিয়াল কিছু চান না তার মানে। ইমমেটেরিয়াল কিছু... কথাটা মাথায় আসামাত্র আমার হৃদপিণ্ড ডিগবাজি খায়। 

যদি চেয়ে বসেন, এবার থেকে আমার সব কথা শুনে চলবি? আমার কাছে যতদিন ছিলি ততদিনের মতো রোজ সকালবিকেল পড়তে বসবি, ইন্টারনেটের নেশা ছাড়বি, রোজ মন দিয়ে একঘণ্টা রেওয়াজ করবি?

তোকে নিয়ে যত স্বপ্ন দেখেছিলাম সব পূর্ণ করবি?

ওড়নার প্রান্ত তুলে মুখের সামনে নাড়তে শুরু করলাম। অফিসের এসিগুলো কি সব ছুটিতে গেছে? 

যে কোনও প্যাঁচালো পরিস্থিতির মতোই এই পরিস্থিতিতেও আমার একটাই প্রতিক্রিয়া মাথায় এল। এবং এই পার্টিকুলার পরিস্থিতিতে সে প্রতিক্রিয়াটির আয়রনি বুঝে হাসিও পেল। 

আমি আজীবন বিপদে পড়লে মাকে ডেকেছি। স্কুলে নোটখাতা না নিয়ে গেলে কানমলার অপমান থেকে বাঁচতে মাকে ডেকেছি। সিলেবাস শেষ না করে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার পথে মাকে ডেকেছি। বাড়ির চাবি হারিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে মাকে ডেকেছি। অ্যাপ্রাইজালের ইনটারভিউর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মাকে ডেকেছি। 

সবসময় যে ডাকা কাজে দিয়েছে তা নয়। যেমন কর্ম তেমন ফল বলেও একটা কথা আছে। মায়ের কথা অমান্য করে সিলেবাস শেষ না করে পরীক্ষায় বসলে হাজার মাকে ডাকলেও কাজ দেয় না। যা পরিণতি হওয়ার তাই হয়।

আবার কখনও কখনও দিয়েছেও। আমার আগের বেঞ্চ পর্যন্ত নোটখাতা চেক হওয়ার পরই টিফিনের ঘণ্টা বেজে গেছে। আমাকে কানমলা খেতে হয়নি। সিলেবাস শেষ না করেও মোটামুটি গয়ংগচ্ছ দিনাতিপাত হয়ে যাচ্ছে। এ সবের পেছনেও মায়ের হাত বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

কাজেই মায়ের হাত থেকে বাঁচতেও আমি মাকেই ডাকলাম। এবং মা সাড়া দিলেন। 

যদি দিতেই হয়…

মা মনস্থির করে ফেলেছেন। আমিও ফেললাম। মা চাইলে যে কোনও কথা দিতে হয় দেব। যদি একলব্য হতে হয় হব।

মা বললেন, যদি দিতেই হয়, সেদিন সকালে উঠে একবার মা বলে ডেকে দিস। তাহলেই হবে।

*****

ডাকব মা। তুমি বললেও ডাকব, না বললেও ডাকব। মাদার্স ডে-তেও ডাকব, বাকি তিনশো চৌষট্টি দিনও সকালবিকেল দুপুরসন্ধে ডাকব। আরামের দিনে যদি বা ভুলে যাই, বিপদের দিনে গলা ফাটিয়ে তোমাকেই ডাকব। আজীবন যেমন ডেকে এসেছি। বাকি জীবনটাও অন্যথা হবে না। 

হ্যাপি মাদার’স ডে, মা।


Comments

  1. Tomar erom lekhagulo etto beshi bhalo lage..je ki bolbo. Niejr bhetorer onubhuti hothat lekha hoe upohar pai. Aj amio Ma ke jigesh korlam je ki chai..Ma bollo 'Sokal bikel phone korish'...monta kemon jeno kore uthlo. Ami kintu dine 3-4 baar Ma r sathe kotha boli..na bole thakte amii pari na..tobuo kemon jeno mone holo Ma bodhhoy eka feel koren..r nijeke oshombhob oporadhi mone hochhe.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, অদ্বিতীয়া। অপরাধবোধ আমারও হয়, তবে আবার মনে হয়, কাছে থাকলে হয়তো সারাদিন মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করতাম। তার থেকে এইই ভালো হয়েছে।

      Delete
  2. Ami oti pashondo sontaan. ami nije theke ma ke phone korini. ma korechen. ato ket shekhar poreo akhono happy mother's day wish korar moto buker pata orjon korte parini. tai der ghonta bhatiye phone rekhechi. ami jani mother's day'r gift deyar kotha bolle amar ma o aki reaction deben. tai sei proshno o korini. khali Raj chokkotti ar shubhashree r biye niye gossip kore phone rekhechi. happy mother's day to all moms, from the worst daughter in the world.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমি শিওর তোমার মা তোমাকে ওয়ার্স্ট ডটার ভাবেন না, কুহেলি।

      Delete
  3. Aj tomar ei lekhata pore comment na likhe ar parlam na.... I tomar bohu nishobdo onuragi der ekjon.... Shudhu ektai shobdho ashche.. Dhonnyobad.... Eibhabe Ma ke mone koriye deoyar jonno dhyonnobad.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ আমারই দেওয়ার কথা, রণিতা।

      Delete
  4. "ডাকব মা। তুমি বললেও ডাকব, না বললেও ডাকব। মাদার্স ডে-তেও ডাকব, বাকি তিনশো চৌষট্টি দিনও সকালবিকেল দুপুরসন্ধে ডাকব। আরামের দিনে যদি বা ভুলে যাই, বিপদের দিনে গলা ফাটিয়ে তোমাকেই ডাকব। " <3 <3

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, অন্বেষা।

      Delete

Post a Comment