বানকাহি, অসম ভবন
স্টেট ভবন ক্যান্টিনে খেতে যাওয়া এবং সেই নিয়ে অবান্তরে পোস্ট লেখার সমস্যাটা হচ্ছে, একসময় রাজ্যের স্টক ফুরিয়ে যেতে বাধ্য। ঊনত্রিশটি রাজ্য এবং সাতটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ক্যান্টিনেই আমরা খেয়েছি এমন দাবি করি না। কারণ এক, সব রাজ্যের ক্যান্টিনে আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকের প্রবেশাধিকার নেই, যেমন জম্মু কাশ্মীর। একসময় ছিল, বছর সাতেক আগে খেয়েছিলাম, ইয়াব্বড় বড় গুশতাবা আর সিল্কের মতো ইয়াখনি, কিন্তু তখন ব্লগে লেখার আইডিয়া মাথায় আসেনি, এখন আর যাওয়া যায় না, কাজেই বাদ। উত্তরপূর্ব ভারতের কয়েকটি রাজ্যের ক্যান্টিনে কখনও কখনও যাওয়া যায়, কখনও যাওয়া যায় না। দুই, কিছু রাজ্যের ক্যান্টিনে যাওয়ার উৎসাহ বোধ করিনি, কারণ সে সব রাজ্যের ক্যান্টিন হয় নেই নয় যা পাওয়া যায়, ইডলি দোসা, বাটার চিকেন, বাইরের দোকানেও পাওয়া যায়। হয়তো বেটার পাওয়া যায়।
কিছু ক্যান্টিন রিপিট করেছি। বিহার অগুনতিবার, মহারাষ্ট্র অর্চিষ্মান এবং অন্যান্য লোকের সঙ্গে ঘুরিয়েফিরিয়ে বারতিনেক, অন্ধ্রপ্রদেশ আমি রাজি থাকলে প্রতি দু'সপ্তাহেই রিপিট হত, কিন্তু আমি রাজি নই।
অসম রিপিট করার একটা ছুতো মিলে গেল সম্প্রতি। অসম ভবনের ক্যান্টিন জাকোই বন্ধ হওয়ার খবর পেয়েছিলাম কিছুদিন আগে। গত সপ্তাহের শুরুর দিকে পেলাম বানকাহি খোলার খবর। নতুন মালিক, নতুন রেস্টোর্যান্ট। রিভিউ পজিটিভ, কাজেই দেরি করার মানে হয় না। এই শনিবারই হয়ে যাক।
শনিবার সকালে রুটিন না থাকাটা যেমন আরামের, তেমনি ঝামেলারও। তাছাড়া নতুন বাড়িতে সেটল করার পর্ব এখনও থামেনি। অনেক কাজ জমানো ছিল। সে সব সেরে ট্যাক্সিতে উঠে টের পেলাম সকালের ব্রেকফাস্ট মিস হয়ে গেছে।
সর্দার প্যাটেল মার্গ আর কৌটিল্য মার্গের সংযোগস্থলে অবস্থিত অসম ভবনের বেসমেন্টে বানকাহি। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। চাইলে বাইরে বসা যায়। সুন্দর ঘের দেওয়া বসার জায়গা আছে। কিন্তু দিল্লির মধ্যজুনের এই বাজারে দুপুর দুটোর সময় বাইরে বসতে কেউই চাইবে না। ভেতরটাও ছবি, আলোটালো দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। আমরা পৌঁছলাম যখন দু'জন খাচ্ছিলেন, আমাদের অর্ডার আসতে না আসতে গোটা খাবার ঘর ভরে গিয়ে গমগম করতে লাগল।
রিভিউ পড়ে সন্দেহ হয়েছিল, আশেপাশের সব টেবিলের অর্ডার দেখে নিশ্চিত হলাম, বানকাহির জনপ্রিয়তম ডিশ এইটা। বড়া প্ল্যাটার। পুদিনা ধনেপাতার চাটনির বাটি ঘিরে বিবিধ বড়া ভাজার সমাহার। ডালের বড়া, পোস্তর বড়া, কালো তিল বাটার বড়া। যে বড়াটি অচেনা সেটি হল কারি পাতার বড়া। বেসনে ডুবিয়ে ভাজা কারি পাতা যে খেতে এমন সুস্বাদু হতে পারে, ভাবা যায় না। ডাঁটিশুদ্ধু ভাজার জন্য দেখতেও স্ট্রাইকিং।
বানকাহির মেনুতে স্টার্টার, মেন কোর্স থেকে শুরু করে ডেজার্ট সবই আছে, কিন্তু অপরিচিত বা অল্পপরিচিত কুইজিনের দোকানে খেতে গেলে সবথেকে সোজা এবং নিরাপদ যে অর্ডার, আমরা সেটাই করলাম। ভেজ এবং ননভেজ থালি।
ভেজ থালিতে ভাত ঘিরে লেবু লংকা কাসুন্দি, ক্ষার, আলু পিটিকা (আলু সেদ্ধ), বেগুন পোড়া, আলু পেঁপের তরকারি, আলু পোস্ত, ডাল (কী ডাল আমি চিনি না, মুগ বা মুসুর তো মনে হল না), ডালের বড়ার টেংগা (টক), রাঙা আলুর পিটিকা।
ননভেজ থালিতে এ সবের সঙ্গে, আলু পোস্ত আর বড়ার টেংগার বদলে মাছ ও মুরগি।
অর্চিষ্মানের বেস্ট লেগেছে ক্ষার। যেটা বেসিক্যালি বেশি করে সর্ষের তেল দিয়ে বানানো পেঁপের শুক্তো। সত্যি সত্যি ওই দিয়েই অনেকটা ভাত খেয়ে নেওয়া যায়। রান্নায় এঁদের সর্ষের তেলের ব্যবহার মন ভালো করে দেওয়া। পেঁয়াজকুচি দিয়ে মাখা আলুভাতে মুখে দিলেও সেই চেনা ঝাঁজের ঝটকা। ঝটকা অবশ্য যদি চান তাহলে তরকারি ছেড়ে লেবু ও লংকার সঙ্গে আসা কাসুন্দির এই ছোট কিন্তু এফেক্টিভ গুলিটিই যথেষ্ট।
আলুপোস্ত তো খারাপ লাগার কথা নয়, লাগেওনি, পেঁপের তরকারিও অনেক সময় আমি নিজের বাড়িতে খেতে পারি না, বানকাহির বাটি সাফ করে খেয়েছি। কাগজি লেবু চিপে ডালের বাটিও প্রায় ফাঁকা করে দিয়েছি। ডালের বড়ার ঝোল রিষড়ার বাড়িতে হত খুব। কয়েকটা বড়া ভাজা অবস্থায় রেখে দেওয়া হত ডালের সঙ্গে খাওয়ার জন্য। বংশের বাতি হওয়ার সুবাদে আমি ভাজা হওয়ার সময়েও পেতাম, আবার বাকিরা যখন ডালের সঙ্গে খেত তখনও। এখানে অবশ্য সে সব খাতিরের সম্ভাবনা নেই, কিন্তু বাড়ির কথা মনে পড়াতে পারাও সোজা নয়, বানকাহি সেটা পেরেছে। এঁদের টেংগা আমি আগেও খেয়েছি, ভালো লেগেছে। রান্নায় ঝাল ছাড়া টক, মিষ্টি ইত্যাদি আমি বিশেষ পছন্দ করি না, সেই আমারও ভালো লেগেছে। ঠাকুমা টকের অতি বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, ঠাকুমার নিশ্চয় আরও ভালো লাগত।
কারি পাতার বড়া বাদ দিয়ে আমার সেকেন্ড বেস্ট যেটা লেগেছে সেটা অবশ্য থালিতে নেই। সেটা আমরা আলাদা করে অর্ডার করেছিলাম। জোলাকিয়া ভাত। ভুবনবিখ্যাত জোলাকিয়া মরিচ আর রসুন ফোড়ন দেওয়া। সোজাসাপটা, ফুরফুরে ফ্রায়েড রাইসের কথা ভাবুন, আর প্রতি গ্রাসের পর গলার কাছটায় একটা হালকা ঝাঁজের ছোঁয়া কল্পনা করুন। সঙ্গে বেগুন কিংবা আলু ভাজা বা কারি পাতা ভাজা থাকলেও আমার আর কিছু লাগবে না, প্রমিস। জোলাকিয়া জোগাড় করার উদ্যম নেই, কিন্তু গোলমরিচ রসুন দিয়ে ভাজা ভাত বাড়িতে করাই যায়। ট্রাই করে দেখব একদিন।
ননভেজ থালির মাছ মাংসও অতি উমদা কোয়ালিটির। মাছের অত বড় পিস আমাদের আশার বাইরে ছিল। বানকাহির বাকি পদের কথা বলতে পারি না, কিন্তু ভেজ আর নন ভেজ থালি অবাক করার মতো কম দাম।
রাঙা আলুর পিটিকা আমি খাইনি, কারণ খেলে ডাক্তার ডাকতে হত। ওই সব বাটি শেষ করার (প্লাস অর্চিষ্মানের থালির বেগুনপোড়ার বাটি) আমার ওই সুদৃশ্য সিটে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছিল। অর্চিষ্মানের অবস্থাও তথৈবচ। ভীষণ ইচ্ছে ছিল শেষ পাতে আসাম চায়ের সঙ্গে নারিকোলের লাড়ু খাব, কিন্তু তখন খাওয়ার চোটে নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কোনওমতে ঠোঁট নেড়ে একে অপরকে 'ভাগ্যিস ব্রেকফাস্ট করিনি' বলে হাই ফাইভ দিলাম। লাড়ুর প্রশ্নই নেই, কিন্তু চা না খেলে উঠে আসতে পারব না।
বানকাহিতে আসাম টি মানে টুইনিংস-এর টি ব্যাগ। বিশুদ্ধতাবাদীরা বিচলিত হবেন হয়তো। আমাদের পাশের টেবিলে একদল বসেছিলেন, দু'পক্ষই দু'পক্ষকে চোখে চোখে রাখছিলাম, যেই না আমাদের চা এল পাশ থেকে উত্তেজিত ফিসফিস শোনা গেল, 'টি ভি মিলতা হ্যায়? হোয়াট কাইন্ড অফ টি ইজ দ্যাট?' যেই না দেখলেন আমাদের টি ব্যাগের লেজ টি পটের গা বেয়ে ঝুলছে, বললেন, 'মাই ঘ্যাড, টি ব্যাগ?' বলে পরিবেশককে হুকুম করলেন, 'সাউথ ইন্ডিয়ান ফিল্টার কাপি লাও, জলদি।'
এই পাত্রটিকেই নাকি বলে বানকাহি। এটি মিনিয়েচার সংস্করণ।
বিল মেটানোর সময় মালিকের সঙ্গে আলাপ হল। ভদ্রলোক পরিষ্কার বাংলা বলেন, সি আর পার্কের বি ব্লকে থাকেন, ওঁর মেয়ে আই ব্লকে থাকে। ভারি ভদ্রলোক। ওঁর সঙ্গে কথা বলে বানকাহি রিপিট করার ইচ্ছেটা একেবারে ঝাণ্ডা গাড়লো। আপনারা যদি আশেপাশে থাকেন বানকাহি যাবেন অবশ্য করে। যেদিন যাবেন মনে করে ব্রেকফাস্টটা বাদ দেবেন।
আরে কি কান্ড, আমার বাড়িতে ওই পিতলের বানকাহি আছে! আমি জানতাম ই না ওতে করে মৌরি সার্ভ করতে হয়, আমি তো ওর ওপরে ছোট গণেশ বসিয়ে সাজিয়ে রেখেছি:) রিভিউ দারুন লাগলো।
ReplyDeleteবানকাহিতে করে সম্ভবত পুরোদস্তুর পঞ্চব্যঞ্জন মিলই সার্ভ করা হয়, কাকলি (ইন্টারনেটের জ্ঞান, ভুল হতে পারি)। এটা বানকাহির ক্ষুদ্র সংস্করণ বলে মৌরি দেওয়া হয়েছে। গণেশও মানিয়ে যাবে, আমি শিওর। আসামের এই সাজানোর জিনিসগুলো ভারি সুন্দর হয়। হড়াই বা হড়ুই বলে একরকমের জিনিস হয়, ভেতরে পানসুপুরি দিয়ে ওপর থেকে গামছা জড়িয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা হয়। পিতলের একটা বিশালকায় হড়াই আমার বিয়েতে বাবার তেজপুরের এক সহকর্মী ও তাঁর পরিবার উপহার দিয়েছিলেন, রিষড়ার বাড়ির সামনের ঘরে রাখা আছে।
Deleteবাহ্ এর পরের বার গিয়ে আমি হড়ুই আনছি তাহলে!
Deleteরেফারেন্সের জন্য এই ছবি রইল, কাকলি।
Deletehttp://mickysnortheastindia.blogspot.com/2014/02/xorai-traditional-symbol-of-assam.html
Darun khabar toh! Ar oi bankahi ta shotti khub shundor.
ReplyDeleteহ্যাঁ, শর্মিলা।
Deleteআচ্ছা কলকাতায় সর্বসাধারণের জন্য স্টেট ক্যান্টিন রয়েছে? মানে রাসেল স্ট্রীটের সিকিম হাউসটা জানি, আর কিছু আছে কি?
ReplyDeleteসেরেছে, আমার কোনও আইডিয়া নেই, ঋতম। অবান্তরের বাকিরা যদি কেউ জানেন আশা করি বলবেন। আমিও জানতে উৎসাহী।
DeletePare khide peye gelo.-Sunanda.
ReplyDeleteহাহা, আমারও লিখতে লিখতে কারিপাতা ভাজার কথা মনে পড়ে খিদে পাচ্ছিল, সুনন্দা .
DeleteBaah abar state canteen....purono abantor e fire gelam anekdin baade. Review niye bolar kichhu nei...seto umda botei...amar to ei bideshe bose thali aar bora bhajar thala dekhe ja khide peye gelo...
ReplyDeleteখিদের মুখে বড়া ভাজার থালাটা দেখে আমাদের যা ফুর্তি হয়েছিল, সুস্মিতা। ক্যামেরা নামিয়ে রাখার সাড়ে তিন মিনিটের মধ্যে থালা সাফ। গুঁড়োও পড়ে ছিল না।
Deletetomar blog pore dorshoneno ordhobhojonom korlam.
ReplyDeletechupkotha
থ্যাংক ইউ, চুপকথা।
Delete