আমের মেলায়



নিজেকে যদি প্রশ্ন করি, গত সপ্তাহে কী এমন রাজকার্য করলাম, উত্তর হবে, চাকরি বাঁচালাম। কী রকম চালাক উত্তর হয়েছে ভেবে দুই হাতে হাই ফাইভ দিতে গিয়েও সামলে নিলাম। চাকরি করা ছাড়াও গত সাতদিন আমি অনেক কিছু করেছি। স্নান, ঘুম পর্যাপ্ত হয়েছে , আধবেলার খাওয়াও বাদ পড়েনি। হ্যাঁ গেম একটু কম খেলা হয়েছে, কিন্তু জুন মাসের 'গোলস' পাতায় কম গেম খেলার কথা লেখাই ছিল। কাজেই যত বেশি কাজ করেছি মনে হচ্ছে ততটাও করিনি। এ রকম কাজ, সম্ভবত এর থেকে ঢের বেশি পরিমাণে কাজ লোকে রোজ করে থাকে, আমার অভ্যেস নেই বলে বেশি চড়চড় করছে। 

স্নানখাওয়া সংগীত বাংলা দেখা তো চালিয়েই গেছি, তার ওপর আবার একখানা মেলাও ঘুরে এসেছি কাজের ফাঁকে। 


জনপথের গায়ে হ্যান্ডলুম হাট, হ্যান্ডলুম হাউসও বলে থাকেন কেউ কেউ, সেখানে বাংলা সরকারের উদ্যোগে আম্র মেলা চলছিল গত দু'সপ্তাহ ধরে। ছ'রকমের মান্যগণ্য আম মালদা, মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া থেকে এসেছিলেন। হিমসাগর, ফজলি, ল্যাংড়া খেয়েছি। আম্রপালী শুনেছি, খেয়েওছি সম্ভবত। লক্ষ্মণভোগ শুনেছি, সম্ভবত খাইনি। আমের নাম মল্লিকা জীবনে প্রথম শুনলাম। 


মেলায় আম ছাড়াও শাড়ি, ছবি, শান্তিনিকেতনের চর্মশিল্পের দোকান ছিল। আর ছিল জ্যামজেলির দোকান। বেশিরভাগই আমকেন্দ্রিক। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কৃষি বিপণন বিভাগের স্টল থেকে আমরা কাঁচা আমের আচার আর মিষ্টি চাটনি কিনলাম। সরকারি দোকানের সরকারি বোতলের লেবেলে 'ব' তিলক কাটা। দোকানে তুলাইপঞ্জী, কালোজিরা এই সব এক্সোটিক চালও পাওয়া যাচ্ছিল কিন্তু এগুলো দিয়ে কী করতে হয় জানি না বলে নিলাম না। 


চাটনিআচার কিনলাম বটে কিন্তু আমরা এদুটোর একটাও কিনতে যাইনি। আমরা গিয়েছিলাম আমকাসুন্দি কিনতে। ভদ্রলোক জানালেন, কাসুন্দি আগের দিনই শেষ হয়ে গেছে। আমাদের হতাশ মুখ দেখে উনি অন্যান্য জিনিস কিনতে উৎসাহ দিলেন। আমের চাটনির বোতলের মুখ খুলে নাকের নিচে ধরে বললেন, শুঁকে দেখুন, দারুণ জিনিস।

বললেন, আসলে ডিপার্টমেন্টের দোকান তো, আমাদের টেস্ট করানোর ব্যবস্থা নেই। আমি তাই এই রকম করেই বোঝাচ্ছি আরকি। প্রথম দু'দিন করেছি, যারা এক বোতল নিয়ে গিয়েছিল পরের দিন এসে চারপাঁচ বোতল করে নিয়ে গেছে। 

ওঁর মার্কেটিং কার্যকরী বলতে হবে, সাজেস্ট করা দুটো জিনিসই আমরা কিনে নিলাম। আজ দুপুরে ভাতের পাতে খেয়েছি, মচৎকার।

ডিপার্টমেন্টের দোকান নিয়ে ওঁর আক্ষেপের কারণটা বুঝলাম দ্বিতীয় জ্যামজেলির দোকানটার সামনে দিয়ে পাস করার সময়। দোকানের সামনে আনমনে হাঁটার স্পিড ঢিলে হলেই ওঁরা আচারের বোতল আর চামচ নিয়ে দৌড়ে আসছিলেন।

টেস্ট করুন দিদি, কিনতে হবে না। 

না না বলতে বলতেই দেখি আম কাসুন্দি আর আমের আচার ভরা দুই চামচ দুই হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। টেস্ট করে চামচ পাশে রাখা ঝুড়িতে ফেলে পাশ ফিরতে না ফিরতে হাতে আমপান্নার ভর্তি গ্লাস গুঁজে দিলেন ভদ্রলোক। এটা একটু টেস্ট করুন দিদি এবার, সবাই ভালো বলছে।

হাফ গ্লাস আমপান্না আমি খেলাম, হাফ গ্লাস অর্চিষ্মান খেল। খেয়ে গ্লাস ঝুড়িতে ফেলে খুব নরম গলায় বলল, থ্যাংক ইউ দাদা, কিন্তু আমরা আম পান্না নেব না, বরং স্কোয়াশের বোতল দেখছি যেন একটা . . . শুনেই ভদ্রলোক মুহ্যমান। আমরা ভাবছি হয়তো ওই বোতল বিক্রির জন্য নয়, তারপর আসল কারণ জানা গেল। ওঁর কাছে টেস্ট করানোর জন্য স্কোয়াশের বোতল খোলা নেই। টেস্ট না করেই কিনব আশ্বাস দিয়ে দোকান থেকে মালপত্র নিয়ে বেরিয়ে এলাম। 

আম্রমেলার আসল ভিড় হয়েছিল রাজ্য সরকারের মৎস্য উন্নয়ন বিভাগের দোকানে। মাছ এবং আমের অতি কঠিন যুগলবন্দী ঘটিয়েছিলেন ওঁরা এবং সার্থকভাবেই ঘটিয়েছিলেন বলে দাবি অর্চিষ্মানের।



এই হচ্ছে আম ফিশ চপ। আম ভেটকি পাতুরিও ছিল, ছবি তোলার আগে ফুরিয়ে গেছে। ফিশ পোলাও, প্রন বিরিয়ানিও ছিল মেনুতে। এই দোকানের খাবারের থেকেও আমার ইন্টারেস্টিং লেগেছে খাইয়েদের। অফিসফেরত কাকিমা ছিলেন, একাই এসেছেন এবং কড়াইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে বলছেন, আরেকটু কড়া করে ভাজো না ভাই। দোকানের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কুড়কুড়ে ফিশ ফ্রাই মন দিয়ে খাচ্ছেন, খাওয়া হয়ে গেলে আবার কুপন কিনে এনে আরেকটা চপ, কুড়কুড়ে করে ভাজিয়ে খাচ্ছেন। দেখলেও মন ভালো হয়। হাফপ্যান্ট পরা জেঠু বলছেন, রিয়েল ফিশফ্রাই তিনি খেয়েছেন কলেজে থাকতে, সে জিনিস আর পাওয়া যায় না। আশেপাশের ভিড়ের মাথা ছাড়িয়ে প্রায় এক হাত উঁচু পাগড়িসজ্জিত মাথা, প্রতিটি ট্রে-র সামনে গিয়ে পদের নাম, রন্ধনপ্রণালী জিজ্ঞাসা করছেন। শেষে চরটে পাতুরি, চারটে ফিশ রোল, চারটে ফ্রাই, আরও কী সব নিয়ে বাড়ি গেলেন। 


কিন্তু এঁদের সবার থেকে ইন্টারেস্টিং ছিলেন, একজন নয়, একটা গোটা পরিবার। বাবা মা ছেলে মেয়ে। আমি শিওর গুজরাতি, অর্চিষ্মান বলছে আমার নাকি শিওর হওয়ার কোনও কারণই নেই। আমি বলছি, আরে ওঁরা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন স্পষ্ট শুনলাম গুজরাতি, অর্চিষ্মান বলছে আমি যেহেতু গুজরাতি ভাষা জানি না তাই আমার নাকি শিওর হওয়া অসম্ভব। যাই হোক, ওঁদের মাতৃভাষা যে বাংলা নয় সে বিষয়ে আমরা দুজনেই শিওর।  

এ বলে আমায় দেখ ও বলে আমায় দেখ করে চারজন মাছভাজা, মাছের পাতুরি, মাছের রোল খেলেন। প্লেট খালি হতে না হতে ছেলেটা দৌড়ে বাড়ির সবার পরের অর্ডার নিয়ে আসতে লাগল। আমরা মেলায় ঢোকার সময়ও ওঁরা খাচ্ছিলেন, মেলা ঘোরার সময়ও খাচ্ছিলেন, শেষ পাতে হিমসাগরের ম্যাংগো শেক খেয়ে বেরোনোর সময়ও দেখি চালিয়ে যাচ্ছেন। চট করে থামবেন বলে মনে হল না।



Comments

  1. লক্ষ্মণভোগ না?

    ReplyDelete
    Replies
    1. দারুণ ধরেছেন, চন্দ্রচূড়। ঠিক করে দিচ্ছি। অসংখ্য ধন্যবাদ।

      Delete
  2. এসব মেলার খবর আমি পাই না, তাই যেতেও পারি নি। অবিশ্যি খবর পেলেও কদ্দুর যেতাম কে জানে! কিন্ত এসব খাবারদাবারের মেলা খুবই ভালো জিনিস।
    কালোজিরে চাল অধুনা প্রায় লুপ্ত, এই চালের পায়েস খুব ভালো হয়। সুগন্ধী চাল হবার সুবাদে কেউ কেউ এ দিয়ে পোলাও-ও রাঁধেন।
    গুজরাতি লোকে সপরিবারে মাছের চপ সাঁটাচ্ছে, এটা একটু রেয়ার ব্যাপার। পরিবারটি সিন্ধি হতে পারেন। অনেক সিন্ধিরা গুজরাতি টোনে কথা বলেন।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওহ, তাহলে সিন্ধিও হতে পারেন। কিন্তু বাঙালি কদাচ নন। খুব মর্যাদা করে মাছভাজা খাচ্ছিলেন।

      Delete
  3. Mela ki sesh kuntala di?? Prochondo lov dilam

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, প্রিয়াঙ্কা। ষোলো থেকে তিরিশে জুন ছিল। এই মেলা প্রতি বছর হয়, তুমি একটু চোখ খোলা রেখে পরের বছর যেয়ো।

      Delete
    2. Issh ektu age janle jetam! Porer bochhor thik jabo.

      Delete
    3. হ্যাঁ রুণা। আমিও এ বছরই প্রথম গেলাম। ভালো লাগল বেশ।

      Delete
  4. এই কালিজিরা চাল ওখানে খুব আসে, বাংলাদেশ থেকে। বেশ সুন্দর, গোবিন্দভোগ এর substitute :) আমি জানতাম ও না সে এতো মহার্ঘ ব্যাপার !

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওখানে না, এখানে..

      Delete
    2. সে হয়তো আমার মহার্ঘ লেগেছে, কাকলি। আমি বাসমতী গোবিন্দভোগ বাদে আর কিছুই জানি না।

      Delete
  5. achha ekta kotha jante chai ...'mochotkar' kothatar ki kono utsho achhe? naki sref apnar durdanto lekhonir r ekta udahoron? ...

    ReplyDelete
    Replies
    1. কথাটা আমার মায়ের থেকে টোকা, অনুরাধা। কোনও জিনিস/লোককে চমৎকার লাগলে (যা মায়ের অবিরতই লাগতে থাকে), তাকে খোলা গলায় মা "চমৎকার" বলেন। আবার কখনও কখনও এমন বস্তু বা ব্যক্তির সঙ্গে মায়ের দেখা হয়, "চমৎকার" বললে যার প্রতি অবিচার হয়। তারা চমৎকার-এর থেকে বেশি কিছু দাবি করে। তাদের বর্ণনা করার সময় মা "মচৎকার" ব্যবহার করেন। মায়ের দেখাদেখি আমিও করি। তবে মায়ের মতো ঘনঘন করি না।

      Delete
    2. Besh besh ... Amar ek dadar o erom obhyesh achhe, letter gulo ultopalta kore dewa .. kodin agey jante parlam amar Mesho r o erom kichu special kotha achhe .. Roler - Fosh jaemon ...

      Delete
    3. হাহা, এটা মজার।

      Delete
  6. পরের বার তুলাইপঞ্জি কিনো। খুব সুন্দর গন্ধ হয় ভাতটাতে। পোলাও করলে সারা বাড়ি গন্ধ ছড়ায়। কালিজিরাও ভালো তবে আমার গোবিন্দভোগ বেটার লাগে। আর বাংলাদেশের আরেকটা চাল হয় চিনিগুঁড়া বলে. ওটা পেলেও কিনে দেখতে পারো। খেতে খুব ভালো আর গন্ধটাও দারুন। এখানে আমি গোবিন্দভোগের সাবস্টিটিউট হিসেবে ব্যবহার করি.

    চুপকথা

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওহ, জানা রইল, থ্যাংক ইউ, চুপকথা।

      Delete
  7. Ki bhalo lekhata....lekhata pore aar chhobigulo dekhe monta ja durbol hoye porlo....office ferito maachher chop ekdhare dnariye khaoa...amrito...

    Aam kemon dekhlen?

    ReplyDelete
    Replies
    1. আম সত্যি বলছি খুব একটা দেখিনি, সুস্মিতা। মা বাবা মাঝে একদিনের জন্য এসেছিলেন, কোটি কোটি আম ফ্রিজে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তবে বাকিরা কিনছিলেন।

      Delete
  8. ei aam er chatni bodhoy ekhane biswa bangla outlet e pawa jaye. ami ajke dekhte jabo. agerdin okhan theke tulaipanji chaal ar dhonekhali saree kinechi.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ বিশ্ববাংলা আউটলেটে পাওয়ার হাই চান্স আছে, কুহেলি।

      Delete

Post a Comment