মায়ের স্বপ্ন
সারাজীবনে কতগুলো স্বপ্ন দেখা হল আর সে সব স্বপ্নের কতগুলোকে বাস্তবে রূপান্তরিত করা সম্ভব হল সেটা আমার মতে জীবনের সফলতা-বিফলতা মাপার অন্যতম মাপকাঠি হতে পারে। স্বপ্ন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার মতো চেনা হতে পারে বা চাঁদে যাওয়ার মতো অচেনা। নেশাকে পেশা করে বাঁচার মতো সাহসী কিংবা কোনও বিশেষ মানুষকে বিয়ে করার মতো আনইন্টারেস্টিং। যা খুশি, যেমন খুশি স্বপ্ন হতে পারে। স্বপ্নের ভালোমন্দ এখানে বিচার্য নয়। বিচার্য হচ্ছে স্বপ্নের স্ট্রাইক রেট।
সে রেট দিয়ে বিচার করলে আমার মায়ের জীবন আগাগোড়া ফেলিওর।
ব্যর্থতার প্রথম কারণ মায়ের স্বপ্নের চরিত্র। মা এমন সব স্বপ্নই দেখেন যেগুলো সত্যি হওয়া অসম্ভব। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাবলীল ইংরিজি কথোপকথন। লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে ডুয়েট। দেশবিদেশের স্টেজে রবিশঙ্করের সঙ্গে সেতার।
মায়ের স্বপ্ন ব্যর্থ হওয়ার দ্বিতীয় কারণ, বেশিরভাগ লোকের বেশিরভাগ স্বপ্ন ব্যর্থ হওয়ার কারণের থেকে আলাদা নয়। যথেষ্ট সিরিয়াসলি স্বপ্নটার পেছনে না পড়ে থাকা। এই গোত্রে পড়বে মায়ের নিজে গাড়ি চালিয়ে দূরে দূরে বেড়াতে যাওয়ার স্বপ্নটা। একেবারেই নাগালের ভেতরের স্বপ্ন। আরেকটু দম লাগালেই, দম লাগাতেও হত না, খালি স্বপ্নটার কথা মাথায় রেখে জীবনের শেপটা একটু টিপেটুপে এদিকওদিক করে নিলেই মা এই স্বপ্নটাতে পাস করে যেতেন।
অবশ্য স্বপ্নে পাসফেলের ব্যাপারে অত চট করে করে সিদ্ধান্তে পৌঁছনো শক্ত। কারণ স্বপ্ন সাদাকালো নয়। ইন ফ্যাক্ট, স্বপ্নের কোনও রং থাকে না নাকি। যে ইতিহাস পরীক্ষার দিন ভূগোল পড়ে হলে পৌঁছনোর স্বপ্ন দেখছে সে আসলে কীসের ভয় পাচ্ছে, ইতিহাসের? নাকি প্রস্তুতিহীনতার? অনাহূত সারপ্রাইজের? যে ঘামতে ঘামতে মাঝরাতে উঠে বসছে, পরীক্ষা ঘাড়ের কাছে, সবার অংকের সিলেবাস শেষ একা তার ছাড়া, তার প্যানিকটা কি অংকে? নাকি বাকিদের সঙ্গে রেসে হেরে যাওয়ার আতংকটাই আসল? মায়ের গাড়ি চালিয়ে বেড়াতে যাওয়ার স্বপ্নটা সম্ভবতঃ গাড়ির নয়, বেড়াতে যাওয়ারও না। স্বপ্নটার নির্যাস হয়তো নিজের জীবনের চালকের আসনে নিজে বসাটা। সেদিক থেকে দেখলে মা অনেকটাই সফল।
কিন্তু আমি এইসব স্বপ্নবিচারে বিশ্বাসী নই। কিছু কিছু ব্যাপার (বেশিরভাগ) ফেসভ্যালুতে নেওয়াই কার্যকরী বলে আমি মনে করি। কাজেই আমি ধরে নিচ্ছি গাড়ি চালিয়ে লং ড্রাইভে যাওয়ার স্বপ্নে মা ফেল।
মায়ের তৃতীয় ব্লান্ডার, স্বপ্নের দায় অপাত্রে অর্পণ করা। মা নিজেকে নিয়ে যতদিন স্বপ্ন দেখছিলেন, ততদিন তবু একরকম ছিল। তাতে ওঁর সাধ মেটেনি, ছাগলের ক্ষুরে পেনসিল বেঁধে তাকে সিঁড়িভাঙা সরল কষাতে গেছেন। (বাক্যটা শেষ করামাত্র বিবেকে একটা অস্বস্তি টের পেলাম আর অমনি বারান্দার গ্রিলের বাইরে একটা ছাগলের মুখ ভেসে উঠল। আমার নাম শুনলাম যেন? আমি তাড়াতাড়ি বললাম, এখানে ছাগল বলতে আমি তোমাকে মিন করিনি, আমার চেনা একজনের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছি। ছাগল বলল, অত প্রতীক দিতে হবে না। সোজা কথা সোজাভাবে লেখ। তাতে যদি লেখা উতরোয়। গভীর বিরক্তিসূচক 'হুঃ' বলে আবক্ষ ছাগল মিলিয়ে গেল।)
কিন্তু মায়ের সবথেকে বড় ভুল, পোস্টের গোড়াতে যেটা লিখলাম, সফল স্বপ্ন আর টোটাল স্বপ্নের অনুপাতের সহজ হিসেবটা মাথায় না রাখা। অনুপাত ভদ্রস্থ রাখতে গেলে স্বপ্ন কম দেখুন, হরের হুড়হুড়িয়ে বাড়া প্রতিরোধ করুন, তাহলেই লবের পেছনে অত পরিশ্রম না করলেও চলবে। কেউ কেউ দ্বিমত রাখতে পারেন। বলতে পারেন বেশি স্বপ্ন দেখার সুবিধে হচ্ছে একটা না একটা তো সফল হবেই। এঁরাই বলেন, পরীক্ষায় তো বস, ফেল করলে ফেল করবি। অ্যাপ্লাই তো কর, কেউ না কেউ তো ডাকবেই। পত্রিকায় লেখা পাঠাতে থাক, ছাপলে ছাপবে, না ছাপলে ছাপবে না। প্রোপোজ তো করে দেখ, রাজি হলে ভালো না হলে হল না।
এঁরা বিশ্বাস করেন, হারাজেতায় ক্ষতি নেই, পার্টিসিপেশনটাই আসল।
হারলে আমার কনফিডেন্স যে গুঁতোটা খাবে, সে ব্যাপারে এঁদের কোনও মাথাব্যথা নেই। এঁরা জানেন না, প্রতিটি হার, প্রতিটি প্রত্যাখ্যান আমার ইগো কত গভীর ফালাফালা করে যাবে, সে হাঁ সারাজীবনেও বুজবে না। এঁরা বোঝেন না, আমার অলরেডি তলানি-ছোঁয়া কনফিডেন্স আমাকে সামলে চলতে হবে, যত্রতত্র খরচ করে ফেললে চলবে না। লাভ চাই না, ক্ষতি যথাসম্ভব কম রাখাই আমার জীবনের লক্ষ্য। বি এম ডবলু চেয়ে হিরো সাইকেল পেলাম, তাতে আমি নেই। তার থেকে হিরো সাইকেলই চাইব আমি সকালবিকেল।
মায়ের সঙ্গে এ ব্যাপারেও আমার উল্টো। অগুনতি ব্যর্থ স্বপ্নের বোঝা সারাজীবন ধরে বইতে কষ্ট হল কি না সেটা আমি মাকে জিজ্ঞাসা করেছি। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ইংরিজিতে কথা বলতে না পেরে কষ্ট হয়েছিল? তোমার সব স্বপ্নে কচাকচ কাঁচি চালিয়ে দিয়েছি বলে আমার ওপর রাগ হয়? মা হাসেন। বলেন, ভুলেই গেছিলাম, তুই বললি বলে মনে পড়ল। ওই রকম বিশ্রী স্বপ্ন, পূর্ণ হয়নি বেঁচে গেছি।
হতে পারে আমাকে বাড়াবাড়িরকম ভালোবাসেন বলে মা দুঃখ চেপে রাখেন। কিন্তু আমার সেটা মনে হয় না। রাগ দুঃখ মনে পুষে বসে থাকার ব্যাপারেও মায়ের সঙ্গে আমার মিল নেই। মা স্বপ্ন দেখেন, বেশিরভাগই ব্যর্থ হয়, মা আবার তেড়েফুঁড়ে নতুন স্বপ্ন দেখেন। আমার মা প্যাথোলজিক্যাল স্বপ্ন-দেখিয়ে। এই বয়সে এসে এ রোগ সারা মুশকিল। সারুক আমি চাইও না। মা জেগে আছেন অথবা ঘুমোচ্ছেন অথচ স্বপ্ন দেখছেন না, এটা হলেই মাকে চেনা কষ্টের হবে।
তাই কাল সকালে মা যখন বললেন পরশু রাতে তিনি একটা স্বপ্ন দেখেছেন, আমি চায়ে চুমুক দিয়ে হেলান দিয়ে বসে বললাম, বল শুনি কী স্বপ্ন।
স্বপ্নে নাকি মা লাইব্রেরি থেকে মোটা মোটা তিনটে বই হাতে নিয়ে সবে বেরিয়েছেন। মায়ের স্বপ্নের এমন আটপৌরে শুরু দেখে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম, কিন্তু প্রকাশ করিনি। দেখা যাক কোথাকার স্বপ্ন কোথায় দাঁড়ায়। সবে তো শুরু।
মায়ের স্বপ্নে বৃষ্টি নামল। সে কী বৃষ্টি রে সোনা, চারদিক ধোঁয়া, কিছু দেখা যাচ্ছে না। মা বই হাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছেন বাড়ি ফিরবেন কী করে। এমন সময় একটা বাস এসে থামল।
লাইব্রেরি থেকে আমাদের বাড়ির পথে আধঘণ্টা বাদে বাদে একটা করে টোটো যায়। কিন্তু এটা বাস্তব নয়, এটা মায়ের স্বপ্ন। মা বাসে চড়লেন। বাসে আর কেউ নেই। কন্ডাকটরও নেই? মায়ের মনে নেই। যাত্রী যে মা একা সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই, ড্রাইভার কন্ডাকটর কেউ আছে কি না মা খেয়াল করেননি।
জল জমে রাস্তা পুকুর, হেলেদুলে বাস চলল। বাইরে বৃষ্টি আরও ঝেঁপে এল, ক্রমে চাকা জলে ডুবে গেল। চাকা পেরিয়ে জানালার নিচ ছোঁয় ছোঁয়। মায়ের স্বপ্নের বাস থামছে না, চলছে তো চলছেই।
কোন লাইব্রেরিতে গিয়েছিলে, মা? জয়কৃষ্ণ? নাকি আরও দূরের? চিড়িয়াখানার পাশেরটা?
আরে না, আমাদের পাঠাগার। কিন্তু রাস্তাটা ফুরোচ্ছিলই না। স্বপ্নের রাস্তা বলে বোধহয়।
তারপর একসময় জল জানালা ছাপিয়ে ঢুকে পড়ল বাসের ভেতর। মা বুঝলেন আর উপায় নেই। বইগুলো ফেলে দুই হাত ওপরে তুলে বাঁচার চেষ্টা করলেন।
আর অমনি যেন কে তাঁকে দু'হাত ধরে টেনে নিল। বাসের জানালা গলে রোগা মা বেরিয়ে এলেন, তারপর ভেসে ভেসে ওপরদিকে উঠতে লাগলেন।
সত্যি সত্যি উড়ছিলাম রে সোনা। একসময় মেঘটেঘ ছাড়িয়ে চলে গেলাম। তখন আর বৃষ্টি নেই। ঝকঝকে রোদ, নীল আকাশ, ঠাণ্ডা হাওয়া, নির্ভার আমি উড়ছি।
কখন দেখলে মা স্বপ্নটা?
ওই তো একবার ঘুম ভেঙে দেখেছিলাম তিনটে সাতচল্লিশ, তারপর পাঁচটার সময় উড়তে উড়তেই ঘুম ভাঙল।
ভোরের স্বপ্ন। সত্যি হওয়ার কোনও চান্স নেই, বলা বাহুল্য।
*****
তারপর টাইপ করতে করতে, ওলায় যেতে যেতে, রুটি ঢ্যাঁড়সভাজা খেতে খেতে দৃশ্যটা দেখছি। আমার ক্ষীণতনু মা, উড়ছেন। কাদামাখা পৃথিবীর নাড়ি কেটে, মেঘ ছাড়িয়ে, নীল আকাশে ভাসছেন। শিরদাঁড়ার ব্যথা, পেনশনে টি ডি এস, বারবার খারাপ হওয়া মোবাইলেরা, না বলে কামাই করা মাসিপিসিরা মাটিতে দাঁড়িয়ে দু'হাত তুলে বলছে, ওগো যেয়ো না, আমাদের সঙ্গে নাও, মা উড়ে উড়ে, সবার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছেন।
হলই বা স্বপ্নে। হল তো?
ভাবছি, মায়ের থেকে স্বপ্ন দেখার বিদ্যেটা শিখে নিই। নাকি বড় বেশি দেরি হয়ে গেছে?
এইটা পড়ে বড় মন খারাপ হলো । মানে ঠিক বোঝাতে পারবো না , বুকের মধ্যে চাপ চাপ ব্যাপার , কষ্ট ভয় মেশানো ।
ReplyDeleteভালো থেকো ।
ধন্যবাদ, প্রদীপ্ত।
DeleteSakal sakal office e eseicoffee te chumuk dite dite abantor khulei lekhata pore besh bhalo laglo. Sesher diktabhari sundar aar ekta mishro anubhuti jagalo...
ReplyDeleteapnader moto eto sundar swapno aami dekhina...aage oi pariksha niye anek swapno dekhtam...ekhon nehat-i aatpoure swapno dekhi....aamar abar problem holo aami swapne kotha boli....chheleke porashona/khaoadaoa niye boka, borer sathe jhogra ei aar priyojoneder niye dushchinta----er baire beroi na....aage maane 10 bochhor aageo besh himalay e trekking....antarctica obhijan....sekhan theke rocket chepe mongol grohe jatra...swapner urane anekdur pouchhe jetam...bhese beratam
কী সাংঘাতিক! রকেট চেপে একেবারে মঙ্গলে! আপনি শিগগিরি এই স্বপ্নগুলো আবার দেখতে শুরু করুন, সুস্মিতা। না হলে ভারি লস।
DeleteEsab swapno dekhte hole aabar 10 bochhor pichhiye jete hobe.....
DeleteMontay j ki hochhe - bhalo lagchhe na kharap - bujhte parchhina - aapni kotha theke kibhabe j hridoy chhuye jaan seta oboshyo konodin e bujhte parina ... bhalo thakben
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, অনুরাধা, আপনিও ভালো থাকবেন।
Deleteamar 2 to swapno mone thake,barbar ase
ReplyDeleteekta dant pore jabar swapno,monta khub kharap hoe jay,ghum bhangle dekhi jakhan dant gulo ache,anondo hoy
ar ekta holo
পরীক্ষা ঘাড়ের কাছে, সবার সিলেবাস শেষ একা তার ছাড়া,khub atonko hoy,ghum bhagar por mone hoy oh...swapno..
baki gulo puro hijibiji swapno,oi indira gandhir sathe kotha bolar moto..
prosenjit
হিজিবিজিই ভালো।
Deleteহিজিবিজিই ভালো।..bhalo mane..hijibiji tai best..arek ta swapno o ase,script sei hijibiji,kintu jayga gulo barir/chotobelar moto,...pordin sokale monta ektu bisanno lage,bari jete eechche kore..
Deleteprosenjit
বিষন্ন লেখা - বড় ভালো একটা মনখারাপ হলো l
ReplyDeleteধন্যবাদ, কাকলি।
Deleteএক ভদ্রলোক ( এখন পাগল হয়ে গেছেন)এক সময় লিখেছিলেন - বন্ধু তোমার স্বপ্নটাকে হারিয়ে ফেল না_ _
ReplyDeleteসোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি আমার বিদ্বেষের অন্যতম কারণ এই ভদ্রলোকের কেসটা, নালক। আমার কত ইমপ্রেশন যে ধরে ধরে মাটি করেছে। আমি নিজেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি, যে শিল্পের সঙ্গে শিল্পীর সম্পর্ক নেই, খুব যে সফল হয়েছি বলব না। আজকাল কারও গান, গল্প, কবিতা, অভিনয়, রান্না, দৌড় ভালো লাগলে উদ্যোগ নিয়ে সে ব্যক্তির সোশ্যাল মিডিয়া উপস্থিতি এড়িয়ে চলি।
Deleteভয়ঙ্কর ভাবে একমত
Deleteহুম
ReplyDelete