দাদার দোকান
এক নম্বর মার্কেটের কোণাকুণি একটা বড় গাছের তলায় - কী গাছ খেয়াল করে দেখিনি কোনওদিন, বট অশ্বত্থ পরিবারের সম্ভবতঃ - ছিল দাদার চায়ের দোকান। গাছের গায়ে চক দিয়ে কেউ লিখে দিয়েছিল, 'দ্য সিংগিং ট্রি।' চায়ের দোকানের নাম থাকাটা আনকমন। দাদার চায়ের দোকানও কমন ছিল না।
সে দোকানে সকালে গ্রিন টি পাওয়া যেত, সন্ধেয় হট চকোলেট। সে দোকানের পেছনের পাঁচিলের গায়ের শেলফে মকাইবাড়ি চায়ের প্যাকেট সাজানো থাকত। শেলফের নিচে খবরের কাগজে ছাপা ছবি সাঁটা থাকত, বলিউডের বিখ্যাত চিত্রপরিচালক দাদার দোকানে বসে চা খাচ্ছেন। একটা ইন্ডাকশনের ওপর বড় ডেকচিতে ক্রমাগত চা ফুটত, দুধ চা, যে রকম চা রাস্তার অন্যান্য চায়ের দোকানে আপনি আশা করবেন। অন্য ইন্ডাকশনে কফির জল কিংবা দুধ বসানো থাকত। সারি দিয়ে রাখা থাকত কমার্শিয়াল বৃহদায়তন চকচকে স্টিলের ভ্যাকুয়াম ফ্লাস্ক। মসালা লেমন টি চাইলে, সারি সারি সস এবং মশলার বোতল থেকে জিরের নির্যাস, মশলা মাখানো আমলকির টুকরো, কুচোনো আদা দিয়ে দাদা মশলা লেমন টি বানিয়ে দিতেন। গরমকালে লাল টুকটুকে ফ্রিজ থেকে বরফ বার করে মিক্সিতে গুঁড়িয়ে মিশিয়ে দিলেই হয়ে যেত মসালা লেমন আইস টি। শেষদিকে অবশ্য দাদার হাতের চা খাওয়ার আমাদের কপাল হত না। বেশিরভাগ দিন সহকারী বানিয়ে দিতেন, কোনও কোনওদিন বৌদি। দাদাবৌদির মেয়ের হাতের চাও খেয়েছি আমরা।
দাদাকে আমরা ভাঙা টেবিলে চা বানাতে দেখেছি, সে চা কেটলিতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দোকানে দোকানে ডেলিভারি দিতে দেখেছি। সেই থেকে শুরু করে মসালা লেমন আইস টি। সি আর পার্কে এ ধরণের রূপকথার গল্প হাওয়ায় ওড়ে। কে কবে এসেছিলেন রান্নার ঠাকুর। কিছু ছিল না সঙ্গে। রাঁধতে পারি, আপনার কোনও অনুষ্ঠানে লোক খাওয়াতে হলে বলবেন, শুধু এই অনুরোধটুকু ছাড়া। এই করে ক্রমে কেটারিং ব্যবসা, মার্কেটে দোকান, মার্কেট লাগোয়া চার কোটির ফ্ল্যাট। আমরা শুনে শিহরিত হতাম, কিন্তু দাদার উত্থানটা আমাদের আরও ইমপ্রেসিভ লাগত। কানে শোনা আর চোখে দেখার তফাত আছে।
আমরা দাদার দোকানে যেতাম। রোজ না কারণ দাদার দোকান থেকে আমাদের বাড়ি একটু দূরে। তবু মাঝে মাঝে ছুটির দিন, চল দাদার দোকানে চা খেয়ে আসি, বলে ধড়াচুড়ো পরে বেরোতাম। আমাদের পক্ষে এত উদ্যোগের কারণ শুধু চা, সে যত ভালোই হোক, হতে পারে না। আমরা যেতাম দাদার খদ্দেরদের দেখতে। দাদার দোকানে বিবিধ লোকের আমদানি হত। অটো চালান, অফিস থেকে ফিরছেন, চা খেতে যতটুকু সময় লাগে, তারপর চলে যাবেন, এঁদের দেখতে আমাদের উৎসাহ ছিল না। দাদার দোকানে কিছু লোক 'ঠেক' বসাতেন, আমাদের টানতেন তাঁরা। পোশাকআশাক দেখলেই বোঝা যেত তাঁরা নাটক করেন, লেখেনটেখেন, গানটান, মিছিলে হাঁটেন, কবিতা তো লেখেনই। আমরা চা নিয়ে বসে তাঁদের ডিবেট শুনতাম, রাজনীতি, খেলাধুলো, এবং আরও নানা বিষয়ে বক্তৃতা শুনতাম। কোনও কোনওদিন আমাদের চলে আসার সময় হয়ে যেত। কোনওদিন ওঁরা আগে যেতেন, কেউ কেউ যাওয়ার আগে দাদা/ বৌদি/ ভাইঝিকে 'হাগ' করে যেতেন, সেও দেখার সুযোগ হয়েছে।
একদিন সন্ধেবেলা অর্চিষ্মান বাড়ি ফিরে, কান থেকে গান খুলতে খুলতে খুলতে, এ দিয়ে ও পায়ের গোড়ালি থেকে জুতো আলগা করতে করতে বলল, দাদার দোকান তুলে দিয়েছে, জান?
অর্চিষ্মান কানাঘুষো খবর এনেছিল, ওই তল্লাটে থাকা দুই বন্ধু কনফার্ম করল। দাদার চায়ে নাকি ড্রাগ মেশানো হত। কেউ বলছে চায়ে মেশানো হত, কেউ বলছে আলাদা কেনাবেচা হত। মোদ্দা কথা কোনও একটা বেআইনি ব্যাপার চলছিল। খবর পেয়ে পুলিশ এসে তুলে দিয়েছে।
বলা বাহুল্য আমরা এ সব গুল বিশ্বাস করিনি। কারও পকেটে যত পৌঁছচ্ছে আর যত পৌঁছনো উচিত সে নিয়ে একটা দড়িটানাটানি উপস্থিত হয়েছে এবং দাদা সে টানাটানিতে হেরে গেছেন।
তারপর বেশ কিছুদিন ওই জায়গাটা দিয়ে আসতে খারাপ লাগত। গাছের তলা ফাঁকা। চেয়ার নেই, মানুষ নেই, গাছের গা থেকে কাগজের সাজগুলোও খুলে নিয়ে গেছে।
আরও কিছুদিন বাদে মনখারাপটাও রইল না।
*****
কাল সন্ধেয় অর্চিষ্মান বাড়ি ফিরে, কান থেকে গান খুলতে খুলতে, এ পা দিয়ে ও পায়ের গোড়ালি থেকে জুতো আলগা করতে করতে বলল, ওহ, দাদা এখানে নতুন দোকান দিয়েছেন, জানো!
আমাদের বাড়ি থেকে মারাত্মক কাছে, মেলা গ্রাউন্ডের পাঁচিল ঘেঁষেই নাকি দাদার দোকান। অর্চিষ্মান আশ্বাস দিল, ওটা দাদাই। কারণ দাদা অর্চিষ্মানকে দেখে হাত নেড়েছেন। বলেছেন, এসে গেছি, আপনাদের পাড়ায়।
আমি দেখিনি, কাল পরশুর মধ্যে দেখে ফেলব নিশ্চয়, তবে অর্চিষ্মান যা বলল, আপাতত জাস্ট একটা টেবিল আর স্টোভ আর সসপ্যান। মেনুতে জাস্ট নর্মাল চা, বড়জোর লাল চা। চেয়ার নেই, গ্রিন টি নেই, দেওয়ালই নেই যে সেলিব্রিটিদের ছবি সাঁটা হবে।
খালি দাদা আছেন আর দাদার ফাইট আছে। আগেরবারের শুরুতেও যা ছিল।
পাঁচটা লোকের কথা মাথায় না রেখে এভাবেই তো ফিরে আসা যায়! তাই না? আপনার চোখ দিয়ে সেটাই দেখলাম।ভালো লাগলো।
ReplyDeleteধন্যবাদ।
Deleteচায়ে নাকি ড্রাগ মেশানো হত
ReplyDeleteore baba cha e drug..de la grandi bepar to..lsd wala cha kheyecho balo tale..
bhalo laglo lekhata..
prosenjit
ধন্যবাদ।
Delete১৫ ই আগস্ট এর পক্ষে লেখাটি খুবই ইন্টারেস্টিং। ভালো থাকবেন ও আরো লিখবেন।
ReplyDeleteধন্যবাদ, নালক।
DeleteHero dada.. ebar aro boro dokan hok..
ReplyDeleteদাদা যে হিরো তাতে সন্দেহ নেই, ঊর্মি। কানে দুল, মাথায় ঝুঁটিও দেখেছিলাম একবার।
Deletebesh bhalo laaglo lekhata....interesting...
ReplyDeleteধন্যবাদ, সুস্মিতা।
DeletePolice er unnecessary harassment theke eyi khete khawa lokgulo konodin e paar paye na. Drugs er kotha ta rumour hote pare, society r pressure create korar jonne.
ReplyDeleteDada je abar dokan khule juddhe nemechen, eta commendable.
একমত, শর্মিলা।
DeleteDadar dokan Abar romromiye choluk. Ei pora deshe chakri nei, Abar freely babsa korar odhikar o nei
ReplyDeleteফ্রি-তে ব্যবসা করার অধিকার একেবারে নেই বলব না সুহানি, না হলে ভারতের বেশিরভাগ বাজারই উঠে যেত। বিশেষ করে এই ঘটনাটায় কিছু একটা গোলযোগ ঘটেছিল বলেই আমার ধারণা। দেখা যাক, দাদা এবার সে সব গোলযোগ এড়িয়ে যেতে পারেন কি না।
Delete